ব্লগ পড়তে দারুন ভালো লাগে..কিন্তু লিখতে পারিনা সিলেট নগরের অভিজাত আবাসিক এলাকা হাউজিং এস্টেটের ১৩২ নম্বর বাড়ি ‘সহিদ মঞ্জিল’। এর প্রধান ফটকে যুক্তরাজ্যের পতাকা আঁকা। দেয়ালজুড়ে বিক্ষিপ্তভাবে ইংরেজি ও আরবিতে লেখা কিছু সন-তারিখ আর যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন স্থানের নাম। দোতলা বাড়িটির নিচতলায় কলেজ ও স্কুলপড়ুয়া দুই মেয়েকে নিয়ে বাস করেন যুক্তরাজ্যফেরত বাবা আবদুন নূর (৭০)।
বাইরে থেকে এলাকাবাসী শুধু এটুকুই জানত।
বাড়ির ভেতরে যে বাবা, মেয়েসহ তিনজনই প্রায় দেড় বছর ধরে একধরনের স্বেচ্ছাবন্দী জীবন যাপন করছেন, তা জানা গেল গতকাল শনিবার সকালে পুলিশ উদ্ধারের পর। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মত, তাঁরা সবাই মানসিকভাবে অসুস্থ।
জানা গেছে, দীর্ঘদিন যুক্তরাজ্যপ্রবাসী আবদুন নূর স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকে মেয়েদের নিয়ে এ রকম অস্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন। গতকাল সকালে পুলিশ তাঁদের ‘বন্দিদশা’ থেকে উদ্ধার করে আত্মীয়দের মাধ্যমে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে।
প্রতিবেশী, আত্মীয় ও পুলিশ সূত্র জানায়, হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার কইয়ারখই গ্রামের বাসিন্দা আবদুন নূর ১৯৫৬ সালে যুক্তরাজ্যে যান।
সেখানে কর্মজীবন শেষ হলে তিনি ১৯৯৬ সালে দেশে ফেরেন এবং স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে হাউজিং এস্টেটের ওই বাড়িতে বসবাস করতে থাকেন। বাড়িটির অন্য তলায় তাঁর আরও দুই ভাই সপরিবারে থাকতেন।
আবদুন নূরের দুই মেয়ের মধ্যে শাফিয়া বেগম (৩২) নগরের আম্বরখানা বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। ছোট মেয়ে আফিয়া ওই বিদ্যালয়েই দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছেন। পড়াশোনা চলাকালীন হঠাৎ বাবা আবদুন নূর আম্বরখানায় একটি সেলাই কারখানা খুলে দুই মেয়েকেই সেখানে কাজে লাগিয়ে দেন।
আজ থেকে প্রায় দেড় বছর আগে আবদুন নূরের স্ত্রী রোকেয়া বেগম মারা গেলে তিনি দুই মেয়েকে নিয়ে ‘গৃহবন্দী’ জীবনযাপন শুরু করেন।
সিলেট কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ইখতিয়ার উদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবেশীদের কাছ থেকে খবর পেয়ে গতকাল শনিবার সকালে তাঁদের উদ্ধার করে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁরা মানসিকভাবে অসুস্থ বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইখতিয়ার উদ্দিন জানান, এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে, পুলিশ তা খতিয়ে দেখছে।
আবদুন নূরের ভাইপো আবদুল ওয়াদুদ বলেন, দেশে ফেরার পর থেকেই তাঁরা চাচার মধ্যে কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ করেন।
পরবর্তী সময়ে চাচি মারা যাওয়ার পর তাঁরা তিনজন ঘরে বন্দিজীবন শুরু করেন। আত্মীয়রা একাধিকবার হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাঁদের দা নিয়ে তাড়া করা হতো। আটকা থাকা অবস্থায়ও যাতে তাঁরা ভালো থাকেন, এ জন্য ফ্ল্যাটে গ্যাস ও বিদ্যুৎ-সংযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা নিজে থেকে গ্যাস ও বিদ্যুৎ বন্ধ করে রেখে অন্ধকারের মধ্যেই থাকতেন। সপ্তাহে এক-দুবার তাঁদের জানালায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যেত।
আবদুন নূরের ঘরে গিয়ে দেখা যায়, একটি পাত্রে কাঁঠালের বিচি আর শুকনো মরিচ ছাড়া আর কিছু নেই। প্রতিবেশীরা জানান, সপ্তাহে এক-দুবার আবদুন নূরকে সাধারণ পোশাকে বের হতে দেখতেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি হিসেবে পরিচিত হলেও গত দেড় বছরে তাঁকে মসজিদে দেখেননি কেউ।
কয়েকজন প্রতিবেশী জানান, তাঁরা শুনেছেন, আবদুন নূর যুক্তরাজ্য থেকে অনেক টাকা নিয়ে ফিরেছিলেন। তাঁরা মনে করেন, স্ত্রীর মৃত্যু ছাড়াও ওই টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে কোনো সমস্যার কারণেও বড় মানসিক আঘাত পেয়ে তাঁর এই অবস্থা হয়ে থাকতে পারে।
তবে হাসপাতালে পাশে থাকা আবদুন নূরের এক ভাই তাজউদ্দিন এ ধারণা সত্যি নয় বলে দাবি করেন। তাজউদ্দিন জানান, পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে আবদুন নূর মেজো। দেশে ফেরার পর থেকেই তাঁর অস্বাভাবিক আচরণ দেখে তাঁরা খোঁজখবর কমই নিতেন। পুলিশ উদ্ধার করেছে শুনে হাসপাতালে এসে তিনি ভাইয়ের দেখাশোনা করছেন। তাজউদ্দিন বলেন, তাঁদের জানামতে, ভাই আবদুন নূর অর্থবিত্তের প্রতি উদাসীন।
যুক্তরাজ্যে অবসর ভাতাও নাকি তিনি নিয়মিত উত্তোলন করতেন না। তবে ঠিক কী কারণে দুই মেয়েকে নিয়ে এমন অস্বাভাবিক জীবন কাটাচ্ছেন, এ বিষয়ে তাঁদের ধারণা নেই।
গতকাল দুপুরে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, পাশাপাশি শয্যায় থাকা আফিয়া ও শাফিয়া নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। কেউ কোনো প্রশ্ন করলে অসংলগ্ন উত্তর দিচ্ছেন এবং হাসছেন। দুজনেরই পরনে ছেলেদের পোশাক।
কথাবার্তায় বিদেশি টান। শাফিয়ার শরীর রোগা হয়ে গেছে। তাঁর ডান হাতে ও দুই পায়ের গোড়ালিতে ঘা।
অন্য ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে বাবা আবদুন নূরকে। দেখা গেল শয্যায় বসে নামাজ পড়ছেন।
এ প্রতিবেদককে ‘আর ইউ এ রিপোর্টার?’ প্রশ্ন করে বলেন, ‘হোয়াট ইজ লাইফ! আই অ্যাম ভেরি হ্যাপি!’ (জীবন যে কী! আমি খুব সুখী)। দুই মেয়ের কী হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাই ডটার্স আর ওয়েল অ্যান্ড গুড’ (আমার মেয়েরা ভালো আছে)। নিজ ঘরে বন্দিজীবন কেন, এ প্রশ্নের জবাবে শুধু বাংলায় ‘আল্লাহর হাওলায় রাখছি’ বলে নীরব হয়ে যান আবদুন নূর।
ওয়ার্ডে কর্তব্যরত চিকিৎসক মকসুদুল হাসান খান জানান, তিনজনকেই প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বড় বোন শাফিয়ার শারীরিক অবস্থা খারাপ।
তাঁর হাতে ও পায়ে চর্মরোগ হয়েছে, পাশাপাশি রয়েছে অপুষ্টিজনিত রোগ। আফিয়াকে সুস্থ দেখালেও তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ। তাঁদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অধীনে রাখা হয়েছে।
হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগের প্রধান গোপাল শংকর রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি তিনজনকেই দেখেছি। এঁরা মানসিকভাবে অসুস্থ।
নিজের সঙ্গেই কথা বলছেন। খাওয়াদাওয়ার কোনো নিয়ম না থাকায় শারীরিকভাবেও তাঁরা অসুস্থ। এর মধ্যে একজনের অবস্থা (আফিয়া) অপুষ্টিজনিত কারণে সংকটাপন্ন। ’
এক প্রশ্নের জবাবে চিকিৎসক বলেন, ‘কোনো মানসিক আঘাত কিংবা একাকী জীবন ও সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এঁরা একাকী থাকায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়ে অস্বাভাবিক আচরণ করছেন।
এ জন্য তাঁদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা প্রয়োজন। ’ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।