আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

:::: বনের নাম রাজকান্দি ::::

::::: দেখবো এবার জগতটাকে ::::: হাম হাম (বা হাম্মাম) ঝর্না। রাজকান্দি বনের কথা যার কাছ থেকেই যতো বারই শুনেছি শুধু প্রশংসাই শুনলাম। প্রথমবার শুনলাম ব্লগার দুখীমানবের কাছ থেকে। শুনেই স্বপ্ন দেখতে থাকলাম যাবার কিন্তু ঠিক হয়ে উঠছিলো না। পরের বার কোমড় বেধে আসলো প্রথম আলো ব্লগের বিমান ধর।

ঘুরা ঘুরি নিয়ে অনেক দিন ধরেই আলাপ। সিলেটে থাকেন। ঢাকায় এসে নিজেই অফিসে এসে দেখা করে গেলেন কথা হলো পুরোটাই রাজকান্দি আর হামহাম বা হাম্মাম ঝর্না নিয়ে। ব্যাপারটা পুরোনো হবার জো রইলো না, সকাল হতে না হতেই ফোন আসলো ব্লগে পাশা ভাইএর। উনিও রাজকান্দি যাবার ধান্ধা করছেন।

তড়িঘড়ি করে ছুটি নিয়ে ফেললাম। সাপ্তাহিক ডে-অফের দিনের সাথে আরেকটা দিন জুড়ে দিতেই দুদিনের ছুটি। বাংলা’র পথে টিংকু ভাইও সদলবলে ঘোষনা দিলেন সঙ্গে যাবার। হরতাল অমুক তমুকের ঝামেলায় বের হওয়া হচ্ছিলো। হরতালের মাঝে রাত ১১টা পর্যন্ত ঘুরেও আমি আর আশিক ট্রেনের টিকেট করতে পারলাম না।

ঠিক হলো কয়েকভাগে ভাগ হয়ে যাওয়া হবে। ঢাকা থেকে আমরা ৬জন বাসে। টিঙ্কু ভাই’রা ৪ জন তাদের টিভি শো’র বিখ্যাত গাড়িটা নিয়ে আলাদা যাবে। সিলেট থেকে শ্রীমঙ্গলে এসে দলে যোগ দেবে কুয়াশা, এবং ফেসবুক ইভেন্ট দেখে আসা আরেকজন নাসিম ভাই। বিমান দা সদলবলে যোগ দেবেন পরদিন শ্রীমঙ্গলে নয় খোদ চাম্পারাই চা বাগান থেকে।

রওনা দেবার কদিন আগে থেকেই কেন যেন আকাশের মন খারাপ। বর্ষা কাল বৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ বৃষ্টিটা একটূ অন্যরকম। খবরে শুনলাম সাগরে কোথায় কি যেন নিম্নচাপ হয়েছে ৩/৪দিন প্রবল বর্ষন হবে সারা দেশে। এমনিতেই শ্রীমঙ্গল বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল এলাকা।

হামহাম পর্যন্ত যেতে পারবো কি না সন্দেহ হতে লাগলো। কিছুদিন আগে হামহাম ঘুরে এসেছেন এমন একজন জানালো শুকনো মৌসুমেই তারা ঝিরিতে যে পানি আর বীভৎস রকম জোঁক দেখেছেন এই ঘোর বর্ষায় আমাদের না পুরো রাস্তাই সাঁতার কেটে যেতে হয়। জোঁকের কামড় খেতেই হবে, সেটাতে আপত্তি নেই, রেইনকোটের পাশা পাশি দির্ঘদিন পরে থাকা লাইফ জ্যাকেট তিনটে নিবো কি নিবো না সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম না। কি মনে করে পাহাড়ের ওঠার কেবল আর সেফটি বেল্ট গুলো হ্যাভারস্যাকে ঢুকিয়ে নিলাম। চাম্পারাই চা বাগানে পথ হারানোর পড়ে চাঁদের ছবি তুলে সময় কাটানো।

ঢাকা থেকে বেরুনোর আগে আগে আকাশ ফুড়ে বৃষ্টি নামলো। সেটা থামার আর নামই নেই। সময় বেশী নেই। তাই কোনমতে ভিজতে ভিজতে একটা সিএনজি নিয়ে বসলাম। বাস সকাল ন’টায়।

কিন্তু ভয়ঙ্কর দেরী হয়ে গেছে। আমি যখন কোনমতে বিজয় স্মরনীর মীগগুলোর নিচে তখন আশিক ফোন দিয়ে জানালো ড্রাইভার তাড়া দিচ্ছে বাস ছেড়ে দেবার জন্যে। আশিক আর থার্ড ইয়ার হেলালকে বললাম বাস ওয়ালাকে পাঁচ মিনিট পাঁচ মিনিট করে রিকোয়েস্ট করতে। কোনমতে সিএনজি প্রায় উড়িয়ে নিয়ে সায়দাবাদে যখন দূর থেকে বাস দেখলাম দেখি সেটা আস্তে আস্তে করে চলতে শুরু করে দিয়েছে। লাফিয়ে কুদিয়ে বাসে উঠতেই সেটা ছেড়ে দিল।

পথে ঝুম বৃষ্টি থামার কোন লক্ষন নেই। ভৈরব ব্রীজ পার হবার সময় দেখি আকাশ অন্ধকার। উজান-ভাটি’তে পৌছেও মনে হলো আকাশের মনে হয় মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আজকে আর থামাথামি নেই। বারবার মনে পড়লো, অনেকে বলেছিল সাঁতরে হাম হাম যেতে হবে।

লাইফ জ্যাকেট গুলোর জন্যে দুঃখ লাগলো। তবে ভরসা এই পাহাড়ি ঝিরি’ পানি ধরে রাখতে পারেনা। বৃষ্টি বেশী হলেই ঢল হয়ে বেড়িয়ে চলে যায় ভাটিতে। আমরা শ্রীমঙ্গল শহরে নামলাম দুটোর সময়। ৩বছর পড়ে শ্রীমঙ্গল আসলাম।

প্রথমে রাস্তাঘাট চিনতে কেমন যেন সমস্যা হচ্ছিল। নতুন একটা রেস্টুরেন্ট দেখলাম কুটুম্ববাড়ি। ঝকঝকে তকতকে দারুন ভাবে ফার্নিশড। ঢুকে বসে অর্ডার দিলাম ঝাল ফ্রাই আর তন্দুরী রুটির। ইতিমধ্যে সিলেট থেকে কুয়াশাও হাজির।

আগের বর্ষায় নিঝুম দ্বীপে ক্যাম্পিং এ আলাপ হয়েছিল। এক মিনিটের জন্যেও মাথা থেকে বদখত টুপিটা খুলতে কেউ দেখেনি তাকে। খেয়ে দেয়ে দেখি আগে থেকে বুক করা জীপ চলে এসেছে। ড্রাইভারের নাম গিয়াস। মালপত্র বোঁচকা বুচকি তাতে ভড়ে দিয়ে আমি কুয়াশা আর অরনী বেরুলাম শপিং করতে।

কাঁচাবাজারে। দলের বাকিরা যাবে লাউয়াছড়া। ঘন্টাখানেক যেই সময়ই পাওয়া যায় তাতে লাউয়াছড়ার কিছুটা ট্রেক করতে পারে। ভাগ্য থাকলে উল্লুক দেখাও অস্বাভাবিক নয়। এর আগে লাউয়াছড়া ঢোকার আগেই মুল গেটেই প্রায় ১০টার মতো উল্লুকের পালকে একসাথে দেখেছিলাম।

কলিং টিংকু ভাই, ওভার?? ছবি-হেলাল হেজাজী। মুরগী কিনে কেটে কুটে নিলাম দোকান থেকেই, পর্যাপ্ত শুকনো খাবার, ওয়ানটাইম গ্লাস প্লেট, মশলা পাতি, চাল ডান কিনে আমরা একটা সিএনজি নিয়ে রওনা হলাম লাউয়াছড়ার দিকে। লাউয়াছড়ার গেটে যখন পৌছালাম ততক্ষনে সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে। গেটেই পুলিশ আটকে দিল। রাতের বেলা জঙ্গলে ঢোকা যাবে না।

কি আর করা বাইরে থেকেই কয়েকটা হনুমান দেখে ফেললাম। জঙ্গলের মধ্যে পুরোপুরি অন্ধকার হতে হতেই টিংকু ভাইরাও হাজির হয়ে গেল। আমাদের এক চোখা জীপটা স্টার্ট দিয়ে রওনা হলাম চাম্পারাইএর দিকে। অন্ধকার রাত, গতপরশুই পূর্ণিমা ছিল। ঘন কালো মেঘের ফাঁক দিয়ে সাদা কালো যুগের সিনেমার মতো অপার্থিব চাঁদ উঠেছে।

লাউয়া ছড়ার ঘন বনের ফাঁকে আমাদের প্রাগৈতিহাসিক ভাঙ্গা জীপের একটামাত্র হেডলাইট জ্বলছিল টিমটিম করে। রাতে ঘুমের আগে ভুতের গল্পের আসর। চারপাশে ঝিঝির ডাক, দরজা জানালা বিহীন মুন্ডা পাড়ার স্কুল ঘর, দারুন আবহ। ছবি- হেলাল হেজাজী। আমরা ভানুগঞ্জ বাজারে এসে একটা ব্রেক নিলাম।

গ্রামের টিপিক্যাল বাজার। চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে সান্ধ্যঅবসরে গ্রাম্য আড্ডা, টিমটিমে হলুদ মন খারাপ করিয়ে দেয়া ম্লান আলো, বিড়ির বিজ্ঞাপন আর হিন্দিগান শিলা কি জওয়ানি। কিছু কেনা কাটা বাকী ছিল। সবাই ভাগাভাগি করে কিনতে বেরুলাম। হাত পায়ের খিল ছুটিয়ে নিয়ে আবার শুরু হলো যাত্রা।

মোবাইলের নেটওয়ার্ক সামনে গিয়ে আর নেই। তাই যতোটা পারি গুগল আর্থ খুলে জিপিএস থেকে ট্রেক রেকর্ড আপলোড করে নিচ্ছিলাম। দুই গাড়িতে দুটো ওয়াকি টকি ছিল। বাকি পথটা রেডিও’তে ফাজলামি করেই কাটিয়ে দিলাম। একটু পড়েই কুরমা বিটের জঙ্গলে ঢুকে গেলাম।

পুরোটাই কাঁচা রাস্তা। জায়গায় জায়গায় ভাঙ্গা চুড়ো। এখানে আমাদের আগে থেকে ঠিক করে রাখা গাইড শুভ্র উঠে পড়লো। অন্ধকার ঘন বনে এক ঘেয়ে ঝিঝির ডাকা ডাকি, জায়গায় জায়গায় জোনাক পোকার উড়াউড়ি। আমাদের ছোট বেলায় জঙ্গল ঝলমল করতো জোনাক পোকায়, ইদানিং গ্রামে ট্রামেও গেলেও দেখা যায় খানকয়েক জোনাক পোকা মনমড়া হয়ে ঘুড়ছে।

আধুনিক কেমিক্যাল ফার্টিলাইজার আর শক্তিশালী পেস্ট্রিসাইডিসের কুফল। শুভ্র জানাচ্ছিল রাজকান্দিতে কোথায় কবে ভালুক দেখেছে, ২৫দিন আগে কোথায় চিতা বাঘ হানা দিয়েছে এইসব খালি। চাম্পারাই চা বাগানের ভেতরে এসে ভাঙ্গা রাস্তায় খুব ভালো লাগছিলো। মাথার উপর অবারিত আকাশে জাম্বো সাইজের চাঁদ। ওয়াকি টকি তে শুনলাম টিংকু ভাইদের দলটা পথ হারিয়েছে।

গরম সাদা ভাত, আর লাল লাল মুরগীর ঝোল। গপাগপ। -ছবি হেলাল হেজাজী। রাত নটা কিংবা দশটা কত বাজে জানিনা। জার্নিতে কখনো ঘড়ি রাখি না হাতে।

কিন্তু গ্রামের হিসাবে গভীর রাত। জমির আইলের মতো পাতলা রাস্তা ধরে আমরা কলাবনের মুন্ডা গ্রামে এসে থামলাম। এটা মুলত চাম্পারাই চা বাগানের শ্রমিকদের বস্তি। চা-বাগান থেকে একটূ দুরেই বনের পাশে সার বাধা ঘর। আমাদের থাকার জায়গা হলো একটা স্কুল ঘরে।

মাথার উপর চালা আছে তাই তাবু বের করার দরকার হলো না। লম্বা স্লিপিং ম্যাট বিছিয়ে শোয়ার আয়োজন করা হলো। আমি রাঁধতে জানি না, শুধু খেতে পারি। বাকিরা সদলবলে রান্নায় নেমে গেল। অরনী কোথা থেকে জানি একগাদা লিচু এনেছিল।

ঘরের ভেতরে অন্ধকার, আমি আর টিংকু ভাই গপাগপ সাবার করে দিলাম চোখের নিমিষে। মুন্ডা’রা উপজাতী নয়, আদিবাসী। সাঁওতাল, ভীল, কোল, মুন্ডা, রাজবংশী এরাই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের আদি বাসিন্দা। চাঁদের আলোয় হাটা হাটি করতে হেলাল আর কৃতি’কে নিয়ে বেরুলাম। খোলা মাঠে বসেই দেখি আগে থেকে ক-জন গ্রামবাসী বসে আছে, পাড় মাতাল।

বসতে পারলাম না। রাত্রে বার-বি-কিউ এর কথা ভাবা হয়েছিল। রান্নার সমস্যা চিন্তা করে সাদা ভাত আর মুরগীর মাংসই রান্না হলো। হাপুশ হুপুশ করে খেয়ে দেয়ে সবাই যখন শুয়ে পড়লাম তখন আন্দাজ দেড়টা বাজে। এর মাঝে টিংকু ভাই শুরু করলো ভুতের গল্প।

গ্রামের বাড়িতে পরিত্যাক্ত এক রাজপ্রাসাদে রাত কাটাতে গিয়ে ভুতের সাথে মোলাকাত। গল্পটা এমনি’তে শুনতে পানসে হতে পারে, নির্জন রাতে মুন্ডা গ্রামে দূরে জঙ্গলে নাম না জানা পাখির ডাক। সাসপেন্সটা ভালোই জমলো। হাম হাম ঝর্ণা। ঝিরির পথে... (ছবি হেলাল হেজাজী) বলার অপেক্ষা রাখে না পরদিন সবাই উঠলাম অনেক দেরী করে।

শুনলাম সিলেট থেকে আমার সাথে দেখা করতে দুজন এসেছিল, আমাকে জাগাতে না পেরে দুজনেই দুটো দলের সাথে রওনা হয়ে গেছে। বুঝলাম বিমানদা আর নাসিম ভাইএর দল। সেদ্ধ ডিম, গরম কফি আর বিস্কুট টিস্কুট দিয়ে নাস্তা সেরে আমাদের বেরুতেই অনেক সময় লাগলো। গ্রামের সোজা পথ দিয়ে এগিয়ে বনের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। প্রথম অংশটার নাম বেতবন।

একটা কর্দমাক্ত ঝিরি পেরিয়ে বেতবনে ঢুকতে হলো। শ্রাবন মাসে প্রচুর পানি আর কাদায় তথৈবচ। কাদার জন্যে খালি পায়ে হাটলেই ভালো, কিন্তু বেতবনের কাটার কারনে সম্ভব হলো না। জঙ্গলটা পেরিয়েই বেশ ছড়ানো জঙ্গলে ঢুকে পড়লাম। সামনে একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়লো।

কুরমা ফরেস্ট বীট। এটাও বন, কিন্তু বেশ ছড়ানো একটা ফুটবল মাঠের মতো জায়গা চোখে পড়লো। সামনে একটা ঝিরি তাতে ২/৩টা বাঁশ দিয়ে সাঁকো পেরুনোর ব্যাবস্থা। ওপাশে কলাবন। জঙ্গলে বেশ বড় বড় বুনো কলা।

এই কলা গুলো মানুষ খেতে পারেনা। শুধু বাদর আর বাদুরের খাদ্য। জঙ্গলটা আনটাচড। প্রচুর পাখি চোখে পড়ছিল। সেই সাথে বানর।

দূর থেকে অনেকবার উল্লুকের হু হু হু ডাক কানে আসলো। কলাবন অংশটাই অনেক বড়। বড় দল, তাই আমরা হাটছিলামও খুব দ্রুত। ঘন্টা খানেক পড়ে মুল জঙ্গল রাজকান্দিতে ঢুকে গেলাম। অসাধারন তার রুপ।

বড় বড় বৃষ্টিবহুল অরন্যের গাছ, গাছের গায়ে জায়গায় জায়গায় শ্যাওলা। সেই সাথে অনেক ধরনের ফার্নের ঝোপ। বনের গভীর থেকে পাখি আর নানাধরনের পতঙ্গের একটানা ডাক। জঙ্গলে ইদানিং প্রচুর ট্যুরিস্ট আসছে। গ্রামবাসিরা খুব বেশী ঢোকেনা।

মুল কারন ভাল্লুক আর বন্যশুকরের আধিক্য। আমাদের গাইড শুভ্র জানালো সে নাকি চিতাবাঘও দেখেছে। এছাড়া ভারতীয় সীমান্ত ফাঁড়ি খুব কাছেই। নাগা আর কুকি আদিবাসীরাও নাকি প্রায়ই এদিকে ঘোরাঘুরি করে শামুক গুগলী খুঁজতে। নাগা-কুকি’দের সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানি না।

বই পত্রে পড়েছি নগ্ন থাকার কারনেই নাকি নাগা নাম। কুকী’দের মাঝে একটা ঐতিহ্য ছিল (সম্ভবত হাজার বছর আগে) শত্রু গোত্রদের লোকজন ধরে মাথা কেটে নিয়ে আসা, পড়ে সেটা বাড়ীর সদর দরজায় ঝুলিয়ে রাখা ডেকরেশান আইটেম হিসাবে। লোকজন নাগা-কুকীদের সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানেনা, কিন্তু দেখলাম তাদের সম্পর্কে একটা ভীতির ভাব। রাজকান্দির জঙ্গলে (ছবি ডাক্তার এইচ এন আশেকুর রহমান, সবাই কাকতাড়ুয়া অথবা wall-e নামেই চেনে ) অনেকক্ষন হাটার পড়ে একটা পাথুরে অংশে আসলাম। বড় একটা পাথরে কয়েকটা গাছের পাতা।

শুভ্র জানালো মুন্ডারা জঙ্গলে কাজে ঢুকলে এই পাথরের উপরে কয়েকটা পাতা ফেলে যায়। কি কারনে সে কিছু জানেনা। আমাদের দলের পক্ষ থেকে কুয়াশা কয়েকটা পাতা ফেলে দিল। এর পরেই একটা বড় পাথুরে বেসিন। বর্ষায় অনেক পানি।

বাংলার পথে অনুষ্ঠানের পর্দার আড়ালের কুশীলব ক্যামেরা ম্যান রাহাত নেমে যেতেই দেখলো পানি কোমড় পেড়িয়ে বুকের কাছা কাছি চলে আসে। কোনমতে দেয়াল ধরে ধরে পার হয়ে সোজা একটা পাথরের ঢালে নামলাম। উপর থেকে প্রবল প্রতাপে পানি নেমে আসছে। অনেকটা বান্দারবানের শৈলপ্রপাতের মতো। কিন্তু বর্ষায় নতুন যৌবন পেয়ে গেছে।

চারপাশে প্রচন্ড পিচ্ছিল। আছাড় খেল আশিক। আশিক খুব ভালো ফটোগ্রাফার। একসময় কাকতাড়ুয়া নামে ফটোগ্রাফি করতো, এখন নিক ওয়াল-ই। ব্যাথা কতোটা পেল জানি না।

কিন্তু একটা লেন্স ভাঙ্গলো হাতের ডিএসলআরের। সুন্দরী রাজকান্দি'তে। ছবি -আশিক (কাকতাড়ুয়া/ ওয়াল-ই) বৃষ্টিস্নাত রাজকান্দির জঙ্গল। ছবি -হেলাল হেজাজী। পিছের জায়গাটা’কে একটা বড় সড় পুকুর বলা যায়।

উপর থেকে শৈলপ্রপাতের পানি এসে জমা হচ্ছে, ঝিরির চেহাড়া নিয়ে বেড়িয়ে যায়। শৈলপ্রপাতের উপরে আরেকটা বড় পুকুর। সেখানে অনেক পানি। অনেকেই নেমে গেল সাঁতার দিতে। এখান থেকে উপরে উঠতে হবে।

ততোক্ষনে বেলা বেড়ে একটার মতো। আমরা সাথে আনা বিস্কুটের সদব্যাবহার করলাম। কয়েকটা জোঁকও টেনে উঠাতে হলো শরীর থেকে। সামান্য জিড়িয়ে পাহাড়ে দড়ি টাঙ্গানো হলো। মাউন্টেনিয়ার বাবু ভাইএর কাছ থেকে ধার করে আনা ক্লাইম্বিং রোপ, একেকটা দেড়হাজার পাউন্ড পরযন্ত টানতে পারে।

দড়ি বেয়ে সবাই উঠে গেল উপরে। পাহাড়ের চুড়ায় বিশাল বাঁশ বন। বাঁশের জঙ্গলের ভেতরে জোঁকের আড্ডা। খাড়া অংশ পেড়িয়ে মোটামুটি সমতল ধরে হেটে হেটে নামার পালা। ফের ঝিরি’তে।

এদিককার ঝিরি বেশ পাথুরে। পানির স্রোতও বেশ। সোজা উজান ঠেলে হাটতে হয়। জায়গায় জায়গায় কোথাও প্রচুর কাদা। কয়েকটা জায়গায় পা দিতেই হাটু নয় উড়ু পরযন্ত দেবে গেল।

ঘুরতে ঘুরতে যখন ক্লান্তির শেষ সীমায় তখন হঠাত দূর থেকে কানে আসলো পানির গর্জন। বুঝতে পারলাম হামহাম ঝর্না নব যৌবনে এসেছে। কিন্তু ঝিরির পথ পেড়িয়ে যখন দৈত্যাকার ঝর্নাটা চোখে পড়লো, তখন মনের অজান্তেই বিষ্ময় ধ্বনি বের হয়ে আসলো। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসছে প্রবল পানির ধারা। নিচে পুকুরের মতো একটা জায়গা তৈরি হয়েছে পানির আঘাতে।

পারে হ্যাভারস্যাক রাখতেই যা সময় লাগলো। কাপড় খুলে তিন লাফেই পানিতে। জায়গায় জায়গায় পাথর, সাতার দিয়ে একদম ঝর্নার নিচে। প্রবল ঠান্ডায় জমে যাবার অবস্থা। প্রায় দুশো ফিট থেকে নেমে আসা প্রবল পানির পিটুনি’তে দাড়ানোই মুশকিল।

শুরু হলো সবার জলকেলী। প্রচন্ড পরিশ্রমের পরে রাজকান্দির জঙ্গল পেরিয়ে হামহামে আসাটা মনে হয় স্বার্থক হলো। ঝিরির পানির স্পিড দেখার মতো। (ছবি টিংকু চৌধুরী বা টিংকু ট্রাভেলার) গহীন অরণ্যের মাঝে লুকানো ঐশর্য হাম হাম ঝর্ণা। ছবি- হেলাল হেজাজী।

বিঃদ্রঃ ঝর্নার নামটা জানতাম হামহাম। এলাকা বাসী কেউ কেউ বলছিলো হামহাম, আবার কেউ হাম্মাম। আরেকটা নাম পেলাম, চিতা ঝর্না। আর ভিডিও ব্লগ বানানোর ধান্ধায় সারা রাস্তাটাই হ্যান্ডি ক্যাম নিয়ে ব্যাস্ত থাকায় ছবি বলতে গেলে তোলাই হয়নি। কিন্তু ছবি ছাড়া ট্রাভেলগ পানসে লাগে।

তাই আশিক, টিঙ্কু ভাই আর হেলাল হেজাজী (থার্ড ইয়ারের) তোলা কয়েকটা ছবি ব্যাবহার করতে হলো। ছবির প্রশংসা শতভাগ তাদের।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।