হাউকাউ পার্টি মামাবাড়ির মাঝি নাদের আলী বলেছিল, বড় হও দাদাঠাকুর
তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবো
সেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর খেলা করে !
সুনীলের এই লাইন গুলো এক সময়ে; এমনকি এখনও মাঝে মাঝে আমাকে খুব আলোড়িত করে। তার মতো আমারও দেখতে ইচ্ছে করে কেমন সেই তিন প্রহরের বিল! সত্যি কি সেখানে পদ্ম বন আছে?
পদ্মের বন........কি অদ্ভু্ত সুন্দর। পড়ন্ত নিস্তব্দ দুপুর, নীল আকাশে সাদা সাদা তুলোর মতো মেঘের সামিয়ানার নিচে কাকচক্ষু জলের সেই পদ্ম পুকুর...........পারে ঝিরঝিরে পাতার শিরিষ আর হিজলের বন...........মৃদু বাতাসে দু একটা শিরীষের পাতা বা হিজলের লালচে ফুলের পানিতে ঢলে পড়া.........গাঙ ফড়িং এর চঞ্চল উড়াউড়ি, তার ভেতরে পদ্মপাতায় সাপ আর ভ্রমরের খেলা............কি অপার্থিব সুন্দর।
সত্যি কি এমন আছে?
নিচের ছবিটা দেখুন তো, কি মনে হয়?
একদম পদ্মবন, শ্বেত পদ্ম!
সাদা বা লাল রং শাপলা ভরা দীঘি আর বিল চোখে পড়লেও আমাদের দেশে কিন্তু এমন পদ্ম দিঘী মোটমুটি বিরলই বলা যায়।
দারুন এই দিঘীটা বরিশাল শহরের বেলস পার্ক ও প্লানেট ওয়ার্ল্ড সংলগ্ন, হিমনীড়ে যা বর্তমানে বিআইডাব্লিউটিএর নির্বাহী প্রকৌশলী, বরিশাল ডিভিশনের কার্যালয় হিসেবে চালু আছে।
এতো দেখলেন শ্বেতপদ্মের বন, এখন দেখুন গোলাপী পদ্মবন......
এই পদ্মবনের দেখা পাবেন শ্রীমঙ্গলের বাইক্কার বিলে।
বাইক্কার বিল মূলত: অতিথী পাখির অভয়ারন্য হিসাবে বেশি পরিচিত। শীতের দিনে পাখিদের কলকাকলীতে মুখর হয়ে ওঠে বিলটা!
এই বিলটার পদ্ম ফুলের পাশাপাশি লাল শাপলাও ফোটে, যেমনটা দেখা যায় না বরিশালের শ্বেতপদ্মের বনে।
পদ্ম ফুল শুধু সৈন্দর্য্যের দিক থেকেই নয়, প্রাচীন সভ্যতার ধর্ম আর মিথেও এর গুরুত্ব পূর্ণ অবস্থান ছিল। বৌদ্ধ আর হিন্দু ধর্ম অনুযায়ি পদ্ম হলো সৌন্দর্য্য আর বিশুদ্ধতার প্রতীক।
পদ্মকে মাটি, পানি, আগুন আর বাতাসের চতুর্মুখি সন্মেলনের প্রাকৃতিক প্রতীক বলা হয়। কারণ পদ্মের শিকর থাকে পানির নীচে মটিতে, পানির উপরে সে লালিত আর বর্ধিত হয় বাতাসের আর সূর্যের আলোতে সে ফুল ফোটায়। প্রাচীন মিশরীয় বিশ্বাস অনুযায়ী পদ্ম হলো সূর্য আর পূনর্জন্মের প্রতিক। কারণ হিসাবে বলা হয়, রাতের বেলায় পদ্ম ফুলের পাপড়ি গুলো সব বন্ধ হয়ে যায়, পানির নিচে লুকিয়ে যায় কুড়ি। সূর্যের আলোতে সে আবার প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে।
সৃষ্টির শুরুতে অসিম শূন্যতায় বিশ্বব্রক্ষান্ড পানিতে পূর্ণ ছিল। একদিন এই পানিতে জন্ম নেয় এক খন্ড মাটির বুকে বিশাল এক পদ্ম ফুল, সেই পদ্মের মাঝ থেকে জেগে উঠে সূর্য। এরপর আস্তে আস্তে পুরো সৃষ্টি জগত তৈরি করে। প্রায় একই ধরনের একই ধরনের মিথ কিন্তু হিন্দু ধর্মেও রয়েছে, সৃষ্টির দেবতা ব্রক্ষ্মা নিজেই জন্ম গ্রহণ করেছিলেন বিশাল এক পদ্ম ফুল থেকে।
একটা বিষয় লক্ষনীয় যে হিন্দু আর বৈদ্ধ ধর্মের বেশির ভাগ দেবদেবীর মূর্তিতে কোন না কোন ভাবে পদ্মকে উপস্থান করা হবেই।
স্বরস্বতী দেবীর প্রতীক শ্বেত পদ্ম, আপর দিকে লক্ষী, ব্রক্ষ্মা, গনেশ, গৌতম বুদ্ধ এদের প্রতীক গোলাপী পদ্ম!
এছাড়া প্রাচীন মিশরে অনেক চিত্রে নানা ভাবে পদ্ম ফুলকে উপস্থাপন করা হয়েছে।
মজার বিষয় হলো, ১৯২২ সালে টুটেনখামেনর মমি আবিস্কৃত হবার পরে দেখা যায়, তার সারা দেহের উপর নীল শাপলার পাপড়ি ছড়ানো। অনেক পদ্ম ফুলের নির্যাস আর পাপড়ি হ্যালুশিনেসন, স্টিমুলেশন ইত্যাদি চিকিৎসার কাজেও ব্যাবহার করা হতো!
লালা শাপলা আর পদ্ম নিয়ে অনেকেরই মধ্য কিছু কনফিউশন দেখা যায়। দুটোকে মাঝে মাঝেই গুলিয়ে ফেলা হয়। এই ফুল গুলো আলাদা ভাবে চেনার খুব সহজ একটা পদ্ধতি আছে........পদ্মের বীজ পত্রটা ফুলের ভেতরেই বাইরে থেকে দেখা যাবে, আর শাপলা ফুলের বীজপত্র বোঝা যায় না বাইরে থেকে, গর্ভকেশরে ঢাকা থাকে।
এই যে বীজপত্র ওয়ালা পদ্ম
আর এটা হলো শাপলা যার বীজপত্র লুকানো থাকে
পদ্ম ফুল হয় সাধারণত সাদা, গোলাপি অথবা হালকা গোলাপি রং এর। হুমায়ুন আহমেদ যতই লিখুন না কেন, "হিমুর হাত সাতটি নীল পদ্ম" আসলে নীল রং এর পদ্ম ফুল নেই। বরং বলা যায় হিমুর হাতে সাতটি নীল শাপলা
পদ্ম ফুল ফোটে মার্চ মাস থেকেই আর মার্চের শেষ থেকে মে মাস পর্যন্ত এ দৃশ্য দেখা যায়। কিন্তু বরিশালের পদ্মপুকুরের পদ্ম এখনো দেখতে পাওয়া যায়। বুঝাই যায় যে, আমার নানা বাড়ীর কারনে , বই এর লেখা এখানে অকার্যকর
পদ্ম পুকুরের কথা বলতে এসে ধান ভাংতে শিবের গীত গেয়ে ফেললমা।
যাই হোক,
এই সুন্দর পদ্মপুকুরটা দেখতে চাইলে আপনাকে দৌড়াতে হবে কীর্তনখোলা নদীর পাশের সুন্দর শহর বরিশাল পর্যন্ত।
আর পাখিদের অভয়ারন্য বাইক্কার বিল দেখতে হলে যেতে হবে শ্রীমঙ্গল।
ছবি সৌজন্য: জিশান শা ইকরাম ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।