বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ এই গুমোট সন্ধ্যায় পুরানা পল্টনের একটি অফিস বিল্ডিং থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে পাশা, যে অফিসটায় চাকরি করতে ঘৃণ বোধ করে সে । যে অফিসের সহকর্মীদের সঙ্গে গত দুবছরেও আন্তরিক সর্ম্পক গড়ে ওঠেনি তার ... হয়তো কখনও উঠবেও না। এ নিয়ে গভীর অস্বস্তি বোধ করে পাশা।
অফিস থেকে বেরিয়েও স্বস্তি পায় না আজকাল। গভীর এক উদ্বেগ তাড়া করে ওকে । সে উদ্বেগ তাড়াতেই যেন ঘন ঘন সিগারেট টানে সে। যেন শরীরে বাসা বাধতে ক্ষয়কাশকে আহবান জানায়। অবচেতন ভাবে নিজের মৃত্যু কামনা করে ...
আজও ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে একটার পর একট সিগারেট টেনে যাচ্ছিল পাশা ।
দূরবর্তী সন্ধ্যার আকাশটা ক্ষয়রোগীর মত ধুকছে। হাওয়ারা যেন সব মরে গেছে। শহরটি হয়ে উঠেছে বাতাসশূন্য। বৃষ্টির লক্ষণ নেই। শহরজুড়ে পোড়া ডিজেলের গন্ধ।
পাশার বমি আসে । ফুটপাতে লক্ষ লক্ষ নিষ্প্রান মানুষ। যান্ত্রিক রোবোটের মতো লক্ষ্যহীন ভাবে হাঁটছে। মৃত মানুষের ভিড়ে মিশে পাশাও ফুটপাতের ওপর দিয়ে হাঁটতে থাকে। এখুনি ঠেলাঠেলি করে বাসে ওঠার যুদ্ধটা আরম্ভ করতে ইচ্ছে হল না তার ।
বরং হাঁটতে হাঁটতে সিগাটে টানতে থাকে । ... রুখসানা সিগারেট খেতে বারণ করত। ... কতকাল আগের কথা যেন ... রুখসানা কষ্ট পাচ্ছে বলে বহুকষ্টে দীর্ঘদিনের অভ্যেসটা ছেড়ে দিয়েছিল পাশা। সম্পর্কের সময় মেয়েরা এমন সিরিয়াস আবার সম্পর্ক ভাঙার সময় এমন নিষ্ঠুর আচরন করে ... পাশার জীবনের এই আশ্চর্য অভিজ্ঞতা রুখসানার সঙ্গে মিশে হয়েছিল ... রুখসানা তার জীবন থেকে ঝরে গেলে অভিমানবশত কিংবা নিজের মৃত্যু কামনা করে পাশা আবার সিগারেট ধরে ...। রুখসানা এখন সুইডেন ... বছর দুয়েক হল।
রুখসানা ওর জীবন থেকে ঝরে গেলে চাকরি পায় পাশা । ঘটনটা অনেকটা ‘নদীর একূল ভাঙে, ও কূল গড়ে’-র মত। ... তবে পাশার এখন দু- কূলই ভেঙে যাচ্ছে ...
মুখটা তিতা তিতা ঠেকছে। সিগারেট ছুড়ে ফেলে দিল পাশা। পাশে একটা গলি।
লোডশেডিং চলছিল। গলির ভিতরে ঢুকে পড়বে কি না ভাবছিল। ঠিক তখনই কারেন্ট এল। ঘড়ি দেখল। আটটার মতো বাজে।
গলির ভিতরে ঢুকে হাঁটতে থাকে পাশা। গুমোট। ঘেমে গেছে। সরু গলি। নর্দমার গন্ধ।
টুংটাং শব্দে একটা রিকশা যাচ্ছিল। রিকশায় মায়ের কোলে একটা শিশু। স্ট্রিট লাইটের আলোয় শিশুটাকে দেখে চমকে উঠল পাশা । শিশুর মুখটি যেন অবিকল তাহিয়ার মতো। পাশার ছোট বোন বীথির মেয়ে তাহিয়া ।
তিন বছর বয়স তাহিয়ার। ফরসা। টলটলে দুটি চোখ। পাশাকে খুব টানে। তাহিয়াকে দেখতে এই এক বছর আগেও রাতের বাসে চেপে খুলনা চলে যেত পাশা।
... বীথির শ্বশুরবাড়ি খুলনায় । আজকাল আর বীথির সঙ্গে যোগাযোগ নেই। বীথির স্বামী রশীদুল ব্যবসা করার জন্য পাশার কাছে বছরখানেক আগে লাখ দুয়েক টাকা ধার চেয়েছিল। টাকাটা পাশা দিতে পারেনি বলে বীথি অভিমান করেছে। ফোন করলে রিসিভ করে না বীথি ।
তাহিয়া কে আর ইচ্ছে হলেও দেখতে পায় না ...
পাশার এখন দু-কূলই ভেঙে যাচ্ছে ...
পুরনো বন্ধুদের সঙ্গেও আজকাল তেমন একটা দেখা হয় না। সবাই চাকরি আর ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। অনেকেই বিয়ে করেছে। ঘরসংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। রুখসানার ক্ষত বহুদিন পোড়াবে; তার জীবনে নতুন কেউ সহসা আসবে না।
আশ্চর্য! কী দ্রুত নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লাম। আমার জন্য দম বন্ধ করা একটা অফিস আর পোড়া ডিজেলের গন্ধে ভরা এই পোড়াটে শহর আর ভাইয়ের সংসারে অচ্ছুত হয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু নেই। ...
হাতের বাঁয়ে একটা দোতলা বাড়ি। ঠিকানা লেখা ২৩/২। দোতলায় গ্রিলে কালো সাইনবোর্ডে সাদা অক্ষরে ‘টু লেট’ লেখা।
দেখে থমকে দাঁড়াল পাশা। বড় ভাবী মেস-টেস দেখে উঠে যেতে বলছে। এক মাস সময় দিয়েছে। বড় ভাই চুপ করে থাকলেও বড় ভাবী তাড়া দিচ্ছে। বাবা মারা যাবার পর ভাই খাইয়েছে পড়িয়েছে।
আর কত? ভালো বেতনের চাকরি করছ যখন। তা ছাড়া তোমার বড় ভাই ফ্ল্যাট কিনেছেন। আমরা জুন মাসে নতুন ফ্ল্যাটে উঠব । তোমাকে বাড়তি রুম দেওয়া সম্ভব না। ঐশির নিস্পাপ মুখটি মনে পড়ে গেল পাশার ।
বড় ভাইয়ে মেয়ে ঐশি । ঐশি এবার ক্লাস টুয়ে উঠল। ছোট্ট কিউট মেয়েটির সঙ্গে ভারি ভাব জমে গেছে পাশার । বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে ঐশির জন্যেই কষ্ট হবে বেশি । ঐশির জন্যই পাশা বড় ভাবীকে বলতে পারে না - জমানো সব টাকা বাবা বড় ভাইয়ের হাতে তুলে দিয়েছেন।
বড় ভাবী হয়তো বলবে: বীথির বিয়েতে তোমার ভাই অনেক খরচ করেছে। তোমার পড়ার খরচও তো দিয়েছে।
...পাশা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ...
কালো রঙের লোহার গেট ঠেলে ঢুকে পড়ে। সিঁড়িতে ম্লান আলো।
দোতলায় উঠে কলিং বেল বাজানোর পর আঠারো উনিশ বছর বয়েসি একটি মেয়ে দরজা খুলল। পাশা চমকে ওঠে। মেয়েটি দেখতে অবিকল রুখসানার মতো । তবে রুখসানা ফরসা আর চশমা পরত না। চশমা পরা শ্যামলা মেয়েটি সাদা রঙের সালোয়ার কামিজ পরে আছে ।
কালো ওড়না।
বিস্ময় চেপে পাশা বলল, আমি বাড়ি ভাড়ার ব্যাপারে এসেছি।
ওহ্ । বাবা তো বাড়ি নেই। মসজিদে গেছেন।
মিষ্টি রিনরিনে কন্ঠস্বর।
আচ্ছা আমি একটু পরে আসছি। বলে ঘুরে দাঁড়াতে যাবে মেয়েটি বলল, আপনি কিন্তু বসতে পারেন। বাবা এখুনি এসে পড়বে।
ভিতরে ঢোকা কি ঠিক হবে? যদিও ওর কৌতূহল হচ্ছিল।
পাশা ক্ষানিক ক্ষন ইতস্তত করে করে ভিতরে ঢুকল। ছিমছাম গোছানে ড্রইয়ংরুম। মেঝেতে কার্পেট। রট আয়রনের সোফা। এক কোণে সনি টিভি।
দেওয়ালে গোলাপি ডিসটেমপার। এক পাশের দেয়ালে কাঁচে বাধানো বড় কাবা শরীফের ছবি। অন্য পাশের দেয়ালে এক বৃদ্ধের ছবি টাঙানো। অবিকল পাশার বাবার মতো দেখতে। পাশা অবাক হয়ে যায়।
বাবার ছবি এখানে কেন?
আপনি বসুন। আমি আসছি। বলে মেয়েটি ভিতরে চলে যায়।
পাশা বসল।
ড্রইংরুমটা ঠান্ডা।
এসি নেই যদিও। পাখা ঘুরছে নিঃশব্দে। কার্পেটের ওপর একটা বেড়াল। কোত্থেকে এল? সাদা রঙের বেড়াল। চোখের মনি কালো।
চারপাশে ফিরোজা রং। মুখ তুলে পাশাকে দেখল। ‘রুবেন’,! ‘রুবেন’! ভিতর থেকে কে যেন ডাকল। যে মেয়েটি এসেছিল তার কন্ঠস্বর নয়, অন্য কারও। বেড়ালটি ভিতরে চলে যায়।
বেড়ালের নাম রুবেন। আশ্চর্য! কখন এল? টের পেলাম না।
সেই মেয়েটি ফিরে আসে। মেয়েটি পোশাক বদলে এসেছে । কালো রঙের সালোয়ার কামিজ পড়েছে।
অল্প সেজেছে বলে মনে হল। ড্রইংরুমে পারফিউমের হালকা গন্ধ ছড়াল। মেয়েটি পাশার মুখোমুখি বসল। বলল, আমি নীলা।
আমি পাশা।
কী গরম পড়েছে, তাই না ভাইয়া ?
হ্যাঁ।
উহঃ, অসহ্য। এখন একটু বৃষ্টি হলে বেশ হত।
পাশা চুপ করে থাকে। নীলার কথা বলার স্টাইল রুখসানা মত।
রুখসানা বছর তিনেক আগে মে মাসের দুর্দান্ত গরমের দিনে শাহবাগের বইয়ের দোকানে বলেছিল- উহঃ, অসহ্য। এখন একটু বৃষ্টি হলে বেশ হত।
নীলা বলল, একটু আগে লোডশেডিং হয়ে গেল। তখন আরও বেশি গরম লাগছিল।
পাশা কি বলতে যাবে-কলিংবেল বাজল।
উঠে দরজা খুলে দিল নীলা ।
একজন সৌম্যদর্শন বৃদ্ধ ঢুকলেন। অবিকল পাশার বাবার মতো। বৃদ্ধের পরনে লুঙ্গি পাঞ্জাবি। মাথায় টুপি।
চশমা । গায়ের রং ফরসা। শুভ্র দাড়ি। মাঝারি উচ্চতা। এই বয়েসেও বলিষ্ট গড়ন।
পাশা বৃদ্ধকে সালাম।
বৃদ্ধ কিছুটা যেন অবাক। নীলা বৃদ্ধকে ফিসফিস করে কী যেন বলল। বৃদ্ধ হাসলেন। বললেন বস বাবা, বস।
বৃদ্ধের হাতে পাউরুটি আর কলা। ওগুলো নীলার হাতে দিলেন বৃদ্ধ । ওগুলো নিয়ে ভিতরে চলে গেল নীলা ।
বৃদ্ধ সোফায় বসলেন।
পাশা বলল, আমি ভাড়ার ব্যাপারে এসেছি চাচা।
ওহ হ্যাঁ। তা কি নাম তোমার বাবা ?
সাজ্জাদ কবির। পাশাদের পারিবারিক উপাধি মল্লিক। পাশা অবশ্য ব্যবহার করে না।
তা তুমি ছাড়া আর কে থাকবে?
আপাতত আমি একাই থাকব চাচা।
বৃদ্ধের মুখে ছায়া ঘনাল। গম্ভীর কন্ঠে বললেন, তা তুমি চাকরি কর? না ব্যবসা?
আমি চাকরি চাচা।
কোথায় ?
একটা বিদেশি এনজিওতে। পল্টনেই অফিস।
বেশ।
তা তোমাদের দেশের বাড়ি কোথায় বাবা?
সাতক্ষীরার শ্যামনগর।
বাবার নাম?
আবদুস সোবহান মল্লিক।
বৃদ্ধ এবার সচকিত হয়ে ওঠেন। সামান্য ঝুঁকে তীক্ষ্ম চোখে পাশার দিকে তাকান। গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাবা কোথায় চাকরি করতেন বল তো? এনবিআর -এ?
হ্যাঁ।
পাশা বলল।
আমি তোমার বাবাকে চিনতাম। টু থাউজেন্ড টুয়ে তোমরা কি মোহাম্মদপুরে থাকতে? নূরজাহান রোডে?
হ্যাঁ।
ঠিকই আছে। আমি তোমার আব্বাকে চিনতাম।
আমার নাম তসলিম আহমেদ। আমার বাড়ি যশোরের মনিরামপুর। খুবই ভালো মানুষ ছিলেন তোমার বাবা । সৎ। বোঝই তো ওই দপ্তরে সৎ থাকাই মুশকিল।
বলে বৃদ্ধ হাসলেন।
পাশা জানে ওর বাবা সৎ। এ জন্য তার গর্ব হয়। লোকে বাবাকে সৎ বলেই জানে, তবে বাবার অন্য মহৎ গুণের কথা কেউ জানে না। মা যখন মারা যায় পাশার বড় ভাই তখন এস এস সি পরীক্ষার্থী।
পাশা আর বীথি অনেক ছোট। বাবা মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি কখনও। পাশা বলল, বাবা পাঁচ বছর হল মারা গেছেন ।
ওহ্ । বৃদ্ধের মুখে ছায়া ঘনাল।
নরম স্বরে বললেন, বড় ভালো মানুষ ছিলেন তোমার বাবা। অনেকবার দেখা হয়েছিল তার সঙ্গে। আমাকে অনেক সাহায্য করেছিলেন। আমরা প্রায়ই বন্ধুর মত হয়ে উঠেছিলাম।
পাশা চুপ করে থাকে।
তসলিম আহমেদ বললেন,আজ তো ২৫ তারিখ। তুমি এক তারিখেই চলে এস বাবা। তার আগেও আসতে পার। তুমি মল্লিক ভাইয়ের ছেলে যখন, বাড়ি ভাড়া নিয়ে ভেবো না। ওসব আমরা বসে ঠিক করে নেব।
ছাদের ওপর কিচেন আর বাথরুমসহ দুই রুম। আমার মেজ ছেলে শখ করে করেছিল। এখন ভাবলাম ফেলে না রেখে ভাড়া দেই। জিনিসপত্রের দাম যেভাবে হু হু করে বাড়ছে।
পাশা মাথা নাড়ে।
নীলা ড্রইংরুমে এল। হাতে একটা ট্রে। ট্রেতে চায়ের কাপ আর একটা প্লেট। প্লেটে সন্দেশ।
তসলিম আহমেদ বললেন, এ হল আমার মেয়ে।
তাসনিম আক্তার নীলা। এবার এইচ এস সি পাশ করল। নীলা খুব ভালো ছাত্রী।
পাশা হাসল।
টেবিলের উপর ট্রে রাখল নীলা।
তসলিম আহমেদ বললেন, মা, এই হল সাজ্জাদ । আমার বন্ধুর ছেলে।
নীলা মিষ্টি করে হাসল। বলল, ভাইয়া কিন্তু আমাকে বলেছে ভাইয়ার নাম পাশা।
পাশা আমার ডাক নাম।
পাশা মুচকি হেসে বলল।
বুঝেছি । বলে পাশার দিকে সন্দেশের প্লেট বাড়িয়ে দিল নীলা।
পাশা মাথা নাড়ল। ইঙ্গিতে বলল, কেবল চা।
নীলা মিষ্টি করে হাসল। তারপর ট্রে থেকে চায়ের কাপ পাশার দিকে বাড়িয়ে দিল। তারপর সোফার ওপর বসল। নীলার বসার স্টাইল অনেকটা রুখসানার মতো।
দরজার কাছে বেড়ালের ডাক ভেসে এল।
রুবেন? রুবেন অবশ্য ভিতরে ঢুকল না। তখন ভিতরে একজনের কন্ঠস্বর শোনা গেল। রুবেনকে ডাকছিল। কে সে? এই বাড়িতে আর কে কে থাকে?
চায়ে চুমুক দিল পাশা। লেবু চা।
আশ্চর্য! ওর লেবুচা ভীষণ প্রিয়। নীলা কি ভাবে জানল? আজ থেকে সিগারেট ছেড়ে দেবে পাশা। রুখসানা তার জীবনে ফিরে এসেছে। বিষময় ধোঁয়া আর গিলবে না সে। ভালো লাগছে ওর।
যেন স্বপ্নের সোপানের ধারে পৌঁছে গেছে অনেক অসহ্য মুহূর্তের পর ...এখন কেবই সুখ ...এখন কেবলি শান্তি ... আজ সন্ধ্যায় ভাবছিল, রুখসানার ক্ষত বহুদিন পোড়াবে; তার জীবনে নতুন কেউ সহসা আসবে না। আশ্চর্য! জীবন কি দ্রুত বাঁক নেয়!
তসলিম আহমেদ বললেন, আমার দুই মেয়ে এক ছেলে। বড় মেয়ের নাম শিরিন আক্তার বিউটি। বিউটির বিয়ে দিয়েছি। তার শ্বশুরবাড়ি সিলেট।
আর মেজ ছেলের নাম মকবুল আহমেদ ছোটন। ছোটন কানাডা থাকে। ওখানেই সেটেল করেছে। মাঝেমধ্যে আসে। বলে মেয়ের দিকে তাকিয়ে তসলিম আহমেদ বললেন, তোরা বসে কথা বল মা।
আমার অষুধ খাওয়ার সময় হয়েছে। বলে উঠে চলে গেলেন বৃদ্ধ।
নীলা বলল, ভাইয়া আমি ল পড়তে চাই।
বেশ তো।
আব্বা রাজি না।
কেন?
আব্বা বলেন উকিল-ব্যারিষ্টারদের গরমের মধ্যেও কালো কোট পরে থাকতে হয় । তুই অত গরম সহ্য করবি কি করে? তুই তো গরম একেবারেই সহ্য করতে পারিস না। বলে ফিক করে হাসল নীলা।
ওহ্ । পাশা হাসল।
জিজ্ঞেস করল, আপনি কেন ’ল পড়তে চান?
নীলা আদুরে গলায় বলল, ভাইয়া আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন। আমি আপনার অনেক ছোট।
ঠিক আছে বলব। পাশা বলল। মৃদু হাসল।
চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে রেখে দিল। আশ্চর্য! তার আর সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে না।
ইস, এখন যদি বৃষ্টি হত। নীলা হঠাৎই উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল।
হবে।
কি?
বৃষ্টি।
সত্যি?
হ্যাঁ, সত্যি।
যদি না হয়।
হবে দেখ।
নীলা জানালার দিকে তাকায়।
ঠিক তখনই জানালার পর্দা উড়তে থাকে। ঘরে শীতল বাতাস ঢোকে। দূরে মেঘ ডাকার আওয়াজ শোনা যায়। নীলা বলল, আপনি যাদু জানেন?
জানি।
নীলা।
ভিতর থেকে নীলার বাবা ডাকলেন।
আসছি । নীলা উত্তর দেয়।
আমি এখন যাই। বলে উঠে দাঁড়াল পাশা।
এখনি যাবেন? নীলার মুখে অভিমানের গাঢ় মেঘ জমল যেন।
পাশা মনে মনে বলল, আমি তো আবার আসব। আজ ২৫ তারিখ। আর ক’দিন পর প্রত্যেকদিনই তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে।
নীলা দরজা অবধি এল।
বিদায় দিতে অনিচ্ছুক। মুখ গোমড়া করে আছে। মনে মনে হয়তো বলছে-বাবাটা যে কী!
পাশা বলল,আমি যাই নীলা, তুমি ভালো থেকো । বলে সিঁড়ি দিকে এগিয়ে যায়।
নীলা দরজা বন্ধ করে দেয়।
ঠিক তখনই সিঁড়িটা অন্ধকার হয়ে যায়। লোড শেডিং। সে অন্ধকারে নীলা বলল, আমি আপনার অপেক্ষায় থাকলাম।
থেকো।
আপনি আমার বন্ধু হবেন?
হব।
তাহলে কখনও কিন্তু আমার পাস্ট জানতে চাইবেন না ।
আমি তোমার পাস্ট জানি নীলা।
মানে!
তুমি পূর্বজন্মে যাকে হারিয়েছ আমি তো সেই।
ওহ্।
আমাকে চিনতে পারনি রুখসানা?
অন্ধকার হাতড়ে নীচে নামতেই ঝরঝর বৃষ্টির শব্দ শুনল পাশা।
অন্ধকারে বৃষ্টি পড়ছে। গলিতে নেমে পাশা ভিজে যায়। ক’টা বাজে? আজ আর বাড়ি ফিরব না। রাতভর শহরের রাস্তায় হাঁটব। সারারাত বৃষ্টির ভিতর হাঁটব।
শরীর ভীষণ হালকা লাগছিল তার। একটু আগে চা খেয়েছে। কিন্তু সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে না। বার বার নীলার মুখটি ভাসছিল। গলিতে একটা সি এন জি আসছিল ।
বৃষ্টির ভিতরে হেডলাইটের আলো। আশ্চর্য! পাশা কে দেখে সিএনজি থামল। তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। পাশা সিএনজির পাশ কাটিয়ে চলে যায়। হাঁটতে হাঁটতে গলির মাথায় চলে আসে।
নীলার সঙ্গে মুহূর্তগুলো স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। গলির ভিতরে ২৩/২ নং দোতলা বাড়ি, সেই বাড়ির রুবেন নামে একটি বেড়াল আর তসলিম আহমেদ নামে একজন সৌম্য দর্শন বৃদ্ধকেও স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। সত্যিই কি আমি গলির ভিতরে স্বপ্নের বাড়িতে গিয়েছিলাম ? সে বাড়িতে কি আমার সঙ্গে নীলার সত্যি সত্যিই দেখা হয়েছিল? নাকি সবই অলীক? মায়া? কল্পনা? যাচাই করে দেখব? সত্যি কিনা?
পাশা ঘুরে দাঁড়ালেও তার গলির ভিতরে পা বাড়াতে ভয় হয় ...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।