তরুণ নামের জয়মুকুট শুধু তাহার, বিপুল যাহার আশা, অটল যাহার সাধনা ১১ জুন ২০১১। ২৯ আগষ্ট ২০১০ থেকে এ সাড়ে আট মাসে মোট বিমান যাত্রা হয়েছে ৫ বার। এবার আমার ৬ষ্ঠ যাত্রা। কোনবারই লাগেজের ওজন নিয়ে নিশ্চিন্ত মনে থাকতে পারিনি। প্রতিবার ওজন বেশী হয়েছে আর আমি পড়েছি মহা মুসীবতে।
কখনো অতিরিক্ত ফি, কখনো এয়ারপোর্টে লাগেজ খুলে জিনিসপত্র কমানো, সে এক ঘর্মাক্তকর বিরক্তি। পুরো আনন্দ মিশে যায় চিন্তা আর হতাশায়। এবার তাই আগের দিন পুরো লাগেজ মেপে এনেছি এক কার্গো অফিস থেকে। কাটায় কাটায় মিলিয়ে বাক্স পেটরা গুছিয়েছি।
শিডিউল মাফিক বেলা সাড়ে তিনটায় লাউঞ্জে গেলাম।
লাগেজ ওজনকর্তার হাতে সঁেপ দিয়ে ডিজিটাল বোর্ডের দিকে তাকিয়ে দেখি, সাড়ে তেতাল্লিশ কেজি। দেড় কেজি বেশী, কর্মকর্তাটি কি যেন বলতে চাইল, আমি দ্রুত প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললাম, হ্যালো স্যার, আমি কাতার এয়ারওয়েজের প্রিভিলাইজ ক্লাব সদস্য। আমার ভ্রমণ যেন একাউন্টে যোগ হয়, একটু খেয়াল করুন। ” চশমার উপর দিয়ে আমার দিকে তাকাল ভারতীয় তরুণ অফিসারটি এবং অফকোর্স বলে সে সায় জানাল। আমি তার মুখের ভাষা পড়ে বুঝলাম, দেড়কেজির ঝামেলা শেষ হলো।
এবার অন্যান্য ঘাট পেরিয়ে বিদায় জানালাম মাহমুদ ভাইকে। আমি চলে গেলাম সোজা ইমিগ্রেশনে। কাতার ইউনিভার্সিটি প্রদত্ত বর্হিগমন অনুমতিপত্র এবং অন্যান্য কাগজ দেখে এক মিনিটেই আমাকে পার করে দিলেন বোরকাবৃত নারী অফিসার। কাতারের সর্বত্র নারীদের প্রাধান্য। এখানকার জনসংখ্যায় নারীদের অনুপাতও বেশী।
কেউ মুখ খোলা, কেউ শুধু চোখ দুটো অনাবৃত। এখানে নারীদেরকে মানুষ শ্রদ্ধা ও সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে। আমি রাজপথেও দেখেছি, নিজের গাড়ীর গতি কমিয়ে নারী চালকের গাড়ীটি আগে যাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে মানুষ। পর্দা করেও যে বড় বড় পদে চাকরী করা যায় কত স্বাচ্ছন্দ্যে, কাতারে না দেখলে সহজে তা বিশ্বাস হবে না হয়ত।
প্লেন যাত্রায় আমি এখন প্রায় অভ্যস্ত।
কাজেই নিজের সীটে বসে এদিক ওদিক হা করে না তাকিয়ে স্ক্রীনে ডকুমেন্টারী দেখা শুরু করলাম। জিওগ্রাফী চ্যানেলে টপ ফাইভ এমাজিং দেখতে দেখতে প্লেন আকাশে ডানা মেলল। আশে পাশে বাঙালীদের হাউ কাউ ততক্ষণে তুঙ্গে উঠেছে। কেউ পানি চাচ্ছে, কেউ খাবারের সময় গুণছে। ওরা কি ক্ষুধার্ত নাকি প্লেনের মজাদার খাবারের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠছে, বুঝতে পারলামনা।
আমি কাতার এয়ারওয়াজের প্রিভিলাইজ ক্লাবের সদস্য হওয়ায় একটু বিশেষ সমাদর প্রক্রিয়া শুরু হল আমার সাথে। তথ্যানুযায়ী আমার সীটের সামনে এসে এয়ার সেবিকা অভিবাদন জানিয়ে জানতে চাইল, কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা? খাবারের জন্য বিশেষ কিছু পছন্দ রয়েছে কিনা? সীট পরিবর্তনের কোন ইচ্ছা আছে কিনা সহ কৃত্রিম খাতিরদারির বহিঃপ্রকাশমূলক বাক্যমালা শুনে আমি দু বাক্যে খাসীর বিরিয়ানী হলে খুশী হব জানিয়ে ডবুমেন্টারীতে মনোযোগী হলাম।
একটু পর খাবার এল, খাবার খেলাম। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের দেয়া যাত্রীর তথ্য ও লাগেজ বিষয়ক শুল্ক ফরম পূরণ করার জন্য বিলি করা হলো সবার মাঝে। আমি দ্রুত সেসব পূরণ করে কাগজটি পকেটে রেখে হাতে রিমোট নেয়া মাত্রই কানে ছেদ পড়ল।
আশে পাশের বেশ কয়েকজন অনুরোধ করছে তাদের ফরম লিখে দেওয়ার জন্য। কারো কলম নেই, কারো অক্ষরজ্ঞানও নেই। মানুষের উপকারের এ সুযোগটুকু আমি কাজে লাগালাম পূণ্য সঞ্চয়ের বাসনায়। এক এক করে প্রায় পঁিচশ জনের কাজ সেরে দিলাম। প্রতিজনের ফরম তার পাসপোর্ট দেখে দেখে নাম, বাবার নাম, ঠিকানা, জন্ম তারিখ, ভ্রমণ তারিখ, লাগেজ তথ্য লিখে বুঝিয়ে দিলাম কোথায় কখন তা দেখাতে হবে।
বলতে কার্পণ্য নেই, এ মানুষগুলোর কাজটুকু করে দিয়ে আমি অপার্থিব প্রশান্তির ছোঁয়া পেলাম।
প্লেনের ভেতরের সব আলো নিভিয়ে দেয়া হয়েছে, ফ্লাইট তথ্যবোর্ডে তাকিয়ে দেখি, আমরা এখন অর্ধেক পথ পেরিয়ে এসেছি, আমাদের এই আকাশ বাহনটি এখন পৃথিবীর মাটি থেকে তেত্রিশ হাজার ফুট উপরে এবং এর গতিবেগ ঘন্টায় ৫৯৭ মাইল। ততক্ষণে আমি বাব আল হাররা নাটকটি দেখছি। আরব বিশ্বের জনপ্রিয় সিরিয়ালগুলোর একটি। ঘুম ঘুম ভাব আসছে, কিন্তু ঘুম আসছেনা।
লালবাতি জালিয়ে কফি চাইলাম এবং কড়া কফির পেয়ালা হাতে ডুবে গেলাম বাব আল হাররা নাটকের শৈলীতে।
অবশেষে রাত আড়াইটায় বাংলাদেশের রানওয়েতে কপাল ঠুকলো কাতার এয়ারওয়েজের তিনশ বিয়াল্লিশ নং ফ্লাইটটি। যত দ্রুত ইমিগ্রেশন পার হয়ে মাল সামানা নিয়ে ছুটলাম বাসার দিকে। এয়ারপোর্টে তখন যেন এ্যাম্বুলেন্সের জোয়ার লেগেছে। হরতালে নির্বিঘেœ বাড়ী যেতে প্রবাসীদের এটুকু ছলচাতুরী তো মেনে নিতেই হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।