আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লজিং মাস্টার

নিজকে নিয়ে উদাস আমি, পরকে নিয়ে কখন ভাবি... ছেলেটাকে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে হায়দার সাহেবের। এমন মনে হওয়ার মানেটা তার জানা নেই। আটপৌরে সংসারে বড় হওয়া একটা বাচ্চা ছেলে। গায়ে গতরে চাকচিক্য নেই। তবে অলসতা আছে।

গরিব ছেলে-পেলেদের নাকি অলসতা কম থাকে। এরা সারাদিন দৌড়-ঝাপ করে কাজ করে। এই ছেলেটা ব্যতিক্রম। হায়দার সাহেব কিছু বলতে চাইলেন। কিন্তু বলতে পারলেন না।

মুখ দিয়ে কিছু বের হল না। অতি মাত্রায় সরল মানুষরা নাকি এমন হয়। জোর গলায় কিছু বলতে পারেন না। নরসুন্দা এলাকাটা এমনিতেই ভৌতিক। গ্রামের মধ্যমণি এক গোরস্তান।

আশপাশের দশগ্রামের মৃতের বসবাস ওইখানে। রাতে চলাফেরা মুশকিল। তবে এ গ্রামের মানুষের কাছে বড় সমস্যা সর্বহারা পার্টি। এরা কখন এসে কার জিনিস নিয়ে যায় কেউ বলতে পারে না। যা চায় দিতে হয়।

না দিলে লম্বা দায়ের পোঁচ। তার ওপর গ্রামে এখনো বিদ্যুৎ আসেনি। সন্ধ্যা নামতেই ঘুটঘুটে অন্ধকার। তবে ক’দিন আগে এখানে একটা মাদরাসা হয়েছে। দূরের ছাত্ররা লজিং থেকে পড়ে।

হায়দার সাহেবের সুবিধাই হয়েছে। তার কোনো ছেলে-মেয়ে নেই। তিনিও একটা ছেলেকে এনেছেন। নিজের ছেলের মতোই তাকে দেখেন। আদর করে খাওয়ান।

ওর নাম মতিন। মতিন রায়হান। বয়স দশ। বয়সের সাথে ওর পড়ার একটা মিল আছে। দশপাড়া হিফজ করেছে সে।

মতিনের মুখস্ত শক্তি অসম্ভব। মাত্র দুইমাসে দশপাড়া হিফজ করেছে। শিকরা বলছেন পড়ায় নিয়মিত হলে ও বছরখানেকের মধ্যেই হিফজ শেষ করবে। কাসে এই নিয়ে তর্ক হয়। এতো দ্রুত মুখস্ত করিস কিভাবে! ফাঁকি-টাকি দিস নাতো? বন্ধুরা থ্যাট দেয়।

এসবে গা করে না মতিন। রক্তে-মাংসের মানুষ। ডাল-চাল খেয়ে থাকিস। তোদের মাথায় আর কি থাকবে! ২ হায়দার সাহেবের শুতে একটু দেরিই হল। এরই মধ্যে তার স্ত্রী ঘুমিয়ে পড়েছেন।

তিনি একটা বই পড়ছিলেন। ভালো লাগছিল বলে রাখতে পারছিলেন না। বারটার দিকে হারিকেনের সলতে কমিয়ে যেই শুবেন তখনই ঘটল ঘটনাটা। বাইরের বারান্দায় খট করে একটা শব্দ হল। শব্দটা কিসের তিনি আবিস্কার করতে পারলেন না।

বিছানায় গা এলিয়ে দেয়ার আগে মতিনের রুমের দিকে একবার চুপি দিয়ে দেখলেন। বেঘোরে ঘুমোচ্ছে ছেলেটা। দ্বিতীয় বারের মতো শুতে যাওয়ার সময় অস্পষ্ট কিছু কথা কানে এল হায়দার সাহেবের। তিনি জানালা টেনে দেখার চেষ্টা করলেন। বাইরে চাঁদ নেই।

কৃঞ্চপ চলছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে প্রথমে কিছু আবিস্কার করতে পারলেন না। একটু পর অন্ধকার সয়ে এলে স্পষ্টই দেখলেন দুটো ছেলে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। অস্ফুট আওয়াজটাও কানে এল। গা ঝিম মেরে ওঠল হায়দার সাহেবের।

বের হবেন না করেও হারিকেনের সলতে বাড়িয়ে দরজা খুললেন। গলা খাঁকাড়ি দিয়ে বললেন কে ওখানে? ঘুটঘুটে অন্ধকার হলেও হায়দার সাহেব টের পেলেন ছেলেদুটো অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। তার কথার কোনো জবাব এল না। তবে একটা খটকা লেগে গেল তার মনে। একটা ছেলেকে দেখতে অবিকল মতিনের মত মনে হল।

তিনি দ্রুত ঘরে এসে মতিনের রুমে উঁকি দিলেন। না এইতো মতিন ঠিকই আছে। ঘুমুচ্ছে। তাহলে বাইরে যে মতিনের মতো একজনকে দেখলেন হায়দার সাহেব সেটা কে? কোনো মানুষ হলে কথা বলল না কেন? তাকে দেখে সরে পরার কি কারণ? পরদিন রাতেও ঘুমাতে দেরি হল। ঘুমাই ঘুমাই করেই যেন একটু দেরি করলেন তিনি।

অনেকটা দেখার ইচ্ছে করছিল আজো গতকালের ঘটনাটি পুনরাবৃত্তি হয় কিনা। হল না। তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম ভাঙল গভীর রাতে। বাইরে শোরগোল।

এবার বারান্দায় নয় ওঠোনে। হায়দার সাহেব স্ত্রীকে জাগালেন। মতিনকে জাগাতে চেয়েও শেষ পর্যন্ত তা করলেন না। শেষে না ভয় পেয়ে এ বাড়ি ছেড়ে যায়। ওঠোনের শোরগোল এবার চড়া হল।

ফিসফিস। কথায় বুঝা গেল একদুজন নয় অনেকজন। দরজা খোলার আগে জানালায় উঁকি দিয়ে যা দেখলেন তার জন্য তিনি পুরোপুরিই অপ্রস্তুত। দলটা অনেক বড়। অনেকের হাতে রাম দা।

হায়দার সাহেব দেখলেন গোয়াল ঘর থেকে তার গাভিটা নিয়ে যাচ্ছে ওরা। এরা সর্বহারা পার্টি। এদেরকে কিছু বলার নেই। তবে তার প্রিয় গাভিটার কথা স্মরণ হতেই তিনি প্রায় কেঁদে ফেললেন। হায়দার সাহেব চাকরিজীবি হলেও সংসারি।

দশ বছর যাবত এই গাভিটা তিনি যতেœ লালন করছেন। দুঃখে মাথা চাঁপরাচ্ছেন তিনি। আগেই বলা আছে এদের কাজে কেউ বাধা দিলে নির্ঘাত জান হারাবে। গাভিটা বের করা হয়েছে। কয়েকটা ডাকও দিল হাম্বা বলে।

হয়তো রাতের বেলায় বের হতে চাচ্ছে না। হায়দার সাহেবের চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে। পাশে দাঁড়ানো স্ত্রীরও। দেখতে দেখতে হঠাতই যেন দৃশ্যপট পাল্টে গেল। হায়দার সাহেব ঘর থেকে অস্পষ্ট দেখলেন কারো সাথে যেন ডাকাতদলের মারামারি বেঁধে গেল।

ডাকাতদল যে তাদের সাথে কুলিয়ে ওঠতে পারছে না এটাও স্পষ্ট বোঝা গেল। হায়দার সাহেব কিছু বুঝে ওঠতে পারলেন না। কি হচ্ছে এসব? কেনই বা হচ্ছে এসব। তার বাড়িতে এমন কেউ নেই, ডাকাতকে প্রতিহত করবে। তাদের সাথে কুলিয়ে ওঠতে পারবে।

আর কিছু ভাবতে পারছেন না হায়দার সাহেব। জানালা বন্ধ করে শুয়ে পড়লেন। তবে সে রাতে আর ঘুম হল না। সকাল হয়েছে। আজান শোনা যাচ্ছে।

হায়দার সাহেব বাইরে বের হলেন। প্রথমেই গোয়াল ঘরে গেলেন। গাভিটা অতই আছে। অন্য সবকিছুও ঠিকমত। যেন কিছুই হয়নি।

অথচ রাতে কি বিশাল কাণ্ডটাই না দেখেছেন তিনি। সকাল আটটার দিকে এলাকায় গিয়ে টের পেলেন কালকের ঘটনাটা রাষ্ট্র হয়ে গেছে। সবাই এই কথাটাই আলাপ করছেন। হায়দার সাহেব আরো শুনলেন। কয়েকজন ডাকাত নাকি শেষ রাতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।

৩ হায়দার সাহেবের স্ত্রীর হার্টের সমস্যা আছে। অসুখটা ইদানীং বেশ বেড়ে গেছে। ওষুদপথ্য খাওয়ানো হচ্ছে। অসুখটা তেমন সমস্যা নয়। সমস্যা টুকটাক কাজ।

বাড়িতে ছোট কেউ থাকলে সুবিধা হয়। মতিনের মাদরাসা একসপ্তাহ বন্ধ গেল। দুইদিন হয়েছে মাদরাসা খোলেছে। কিন্তু মতিন এখনো আসছে না। হায়াদার সাহেব তার খোঁজ নিতে এই প্রথম মতিনের মাদরাসায় এলেন।

ছেলেটার কিছু হল কিনা। প্রিন্সিপাল সাহেবের সঙ্গে কথা বলে জানলেন এখনো বাড়ি থেকে আসেনি মতিন। হায়দার সাহেবের মন খারাপ হয়ে গেল। নিশ্চয় কিছু হয়েছে। না হলে তো কাস মিস দেয়ার কথা না ওর।

বাড়ির ঠিকানাও ভালোভাবে জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখা যেত। হিফজখানার কয়েকজন ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন। কেউ ভালোভাবে বাড়ির কথা বলতে পারল না। হায়দার সাহেব আশ্চর্য বোধ করলেন।

একসাথের ছেলেরাও তার বাড়ির কথা বলতে পারছে না। মতিন এল আরো দুদিন পর। বাড়িতে নাকি কি একটা ঝামেলা হয়েছিল। এটা নিয়ে অবশ্য এরচেয়ে বেশি কিছু জিজ্ঞেস করেননি হায়দার সাহেব। মতিন তার ভাড়াখাটিয়ে নয় যে বলবেন সময়মতো কেন এলে না।

বরং ওযে এখানে থাকছে এটাইতো ওদের জন্য বড় পাওয়া। মতিন আসার দিন রাতেই হায়দার সাহেবের স্ত্রীর অসুখটা বেড়ে গেল। ঘরে ওষুদ যা ছিল তাতে কাজ হল না। ডাক্তার ডাকা প্রয়োজন। নরসুন্দা গ্রামে একটাই ডাক্তার।

আহমদ আলী এমবিবিএস। এর আগেও একবার তার স্ত্রীকে দেখে গেছেন। মতিনকে পাঠালেন তাকে ডাকতে। রাতের বেলা তাকে একা পাঠাবেন কিনা ভাবছিলেন। অবশ্য স্ত্রীর মাথায় পানি ঢালতে হচ্ছিল বলে তিনি নিজে যেতে পারলেন না।

অল্প কিছুণ পরই ডাক্তার এল। হায়দার সাহেব অবাক হলেন। তার বাড়ি থেকে ডাক্তারের বাড়ি বেশ দূরেই। এত তারাতাড়ি আসার কথা না। তবে পরিস্থিতি ভালো না বলে বিষয়টি এড়িয়ে গেলেন তিনি।

ডাক্তার চেকআপ করতে শুরু করলেন। এর মধ্যে ডাক্তারের হাতের সঙ্গে হায়দার সাহেবের হাতটা একবার লেগে গেল। হায়াদার সাহেব অবাক হলেন। অসম্ভব ঠান্ডা হাত। একখণ্ড বরফ যেন।

বাইরে তাহলে ঠান্ডা পড়েছে। ভাবলেন হায়াদার সাহেব। হতে পারে। শীতের মৌসুম তো আসি আসি করছে। সবকিছু দেখে ডাক্তার ওষুদ দিলেন।

ওষুদগুলো খাওয়ার পর কিছুটা সুস্থবোধ করলেন হায়দার সাহেবের স্ত্রী। সকালে ঘুম থেকে ওঠে মাদরাসায় চলে গেছে মতিন। হায়দার সাহেব ফজর আদায় করছেন। এ অবস্থায় স্ত্রীর চিতকার শুনলেন। আসুখটা কি আবারো বেড়ে গেল।

দ্রুত নামাজ শেষ করে স্ত্রীর কাছে এলেন। পেটের ব্যথায় কোঁকাচ্ছে স্ত্রী। তিনি পাশেই কতণ বসে থাকলেন। ভাবলেন আস্তে আস্তে কমে যাবে। কিন্তু না ব্যথা কমল না।

ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল। ডাক্তার ডাকা দরকার। বাড়িতেও একজন থাকা দরকার। ভাবতে ভাবতে নিজেই বেড়িয়ে পড়লেন ডাক্তারের উদ্দেশ্যে। বাড়ি এসে দেখলেন ডাক্তার আহমদ আলী নেই।

তার স্ত্রী এসে জানাল তিনি একটা ট্রেনিংয়ে যশোর গেছেন। হায়াদার সাহেবের মাথায় ধরল না। এত সকালে গেল কিভাবে। তিনি আবারো জানতে চাইলেন কখন গেছে, আসবে কখন? ডাক্তারের স্ত্রী জানাল গত পরশু গেছেন, আসবেন আরো তিন দিন পর। একসপ্তার ট্রেনিং।

হায়দার সাহেবের মাথায় যেন এবার সত্যি সত্যি বাজ পড়ল। তিনি বিস্ময় নিয়ে বললেন পরশু গেলেন কিভাবে, কাল রাতেই তো আমার স্ত্রীকে দেখে এল। কথাটা শুনে ডাক্তারের স্ত্রী মুচকি হেসে বলল, সেটা আপনি মনে হয় স্বপ্ন দেখেছেন। উনি তো তিনদিন ধরেই বাড়িতে নেই। হায়দার সাহেব কি বলবেন ভেবে পেলেন না।

ডাক্তার সাহেব আর তার স্ত্রীকে তিনি ভালো করেই চেনেন। মিথ্যা বলার মানুষ এরা না। তবে হায়দার সাহেব আর বাড়তি কিছু বললেন না। পাছে তাকে পাগল ভাবে। ডাক্তারের বাড়ি থেকে বের হয়ে বাড়ি গেলেন না হায়দার সাহেব।

তার মাথা এখন ঠিক নেই। বেশ কিছু বিষয় ঘোরপাক খাচ্ছে। গত রাতে তাহলে তিনি ডাক্তারবেশী কাকে দেখেছেন। এত তারাতারি সে কিভাবে বাড়ি এসেছিল। তার হাতই বা এত ঠান্ডা ছিল কেন।

এসব প্রশ্নের উত্তর তাকে খুঁজতে হবে। রাতে মাঝে মাঝেই বাইরে কথা বলতে দেখতেন। যাকে অনেকটা মতিনের মত মনে হত, সে কে? ডাকাতদলকে কারা কোপোকাত করল? এসব প্রশ্নের উত্তর কি? হায়দার সাহেব সরাসরি মাদরাসায় এলেন। প্রিন্সিপাল সাহেব রুমেই ছিলেন। সবকিছু খুলে বললেন তাকে।

ঘটনা শুনে প্রিন্সিপাল মাথা ঝাকালেন। হায়দার সাহেব তার দিকে চেয়ে আছেন। প্রশ্নগুলোর উত্তর চাই তার। কতণ চুপ থেকে প্রিন্সিপাল বললেন আমাদের এখানে অনেক জীনও পড়ালেখা করে। মানুষের মতোই এদের চলাফেরা।

তাদেরকে আলাদা করার কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। আর কেউ তাদের সম্পর্কে জেনে গেলে এরা আর সেখানে থাকে না। মতিনও নিশ্চয়ই চলে গেছে। প্রিন্সিপাল সাহেবের রুম থেকে দ্রুত বেরিয়ে খোঁজ নিয়ে জানলেন মতিনকে নাকি সকাল থেকেই পাওয়া যাচ্ছে না। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।