পৃথিবীর বুকে এমনও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে যাদের কাছে সভ্যতার আলো পৌঁছানও তো দুরের কথা যোগাযোগ ই করা শম্ভবপর হয়ে উঠেনি। এ ধরনের নৃগোষ্ঠী গুলোকে বলা হয়ে থাকে ‘ isolated people or lost tribes’। বিশেষজ্ঞ মত অনুযায়ী পৃথিবীতে বাস করছে এ ধরনের ‘lost tribes’ এর সংখ্যা আনুমানিক ১০০ এর উপরে। survival international এর এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এধরনের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’র অর্ধেকেরও বেশি বাস করে ব্রাজিলিয়ান এবং পেরুইযিয়ান অ্যামাজন রেইন ফরেস্ট অঞ্চলে। বাকিদের বসবাস বলিভিয়া, পারাগুয়ে, ইকুয়েডর এবং পশ্চিম নিউগিনি।
তবে এশিয়া তে এদের অবস্থান ইন্দোনেশিয়া এবং আন্দামান নিকবর দ্বীপপুঞ্জে। যেহেতু বেশিরভাগ নৃগোষ্ঠী’র বাস ঘন জঙ্গল এলাকাতে, এদের জীবন যাপন সম্বন্ধে খুব কম এ জানতে পাওয়া যায়। তবে ধারনা করা যায় প্রকৃতির সন্তান হিসাবেই এরা শত সহস্ত্র বছর ধরে বেছে রয়েছে।
আদিমতম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এরকম একটি উপ-নৃগোষ্ঠী হচ্ছে আন্দামান দ্বিপপুঞ্জের Sentinelese or North Sentinel Islanders. আন্দামান ভারত শাসিত একটি দ্বীপ (আন্দামান ও নিকবর দ্বীপপুঞ্জ)। ৩২৫ টি দ্বীপ সমষ্টি নিয়ে গঠিত আন্দামান এর আয়তন ৬৪০৮ বর্গ কি.মি. ।
পোর্ট ব্লেয়ার দ্বীপপুঞ্জদ্বয় এর রাজধানী। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আবাসভূমি। ১৭৭৭ সালে ব্রিটিশরা এই অঞ্চলে একটি নৃতাত্ত্বিক সমীক্ষা চালিয়েছিল। এই সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে, বহিরাগতদের আগমনের আগে কয়েক শতাব্দীকাল এই দুই দ্বীপপুঞ্জ নেগ্রিটো ও মঙ্গোলয়েড জাতিগোষ্ঠীর অধিকারে ছিল। বার্মা থেকে ২৮৫ কি.মি. দক্ষিণ এ অবস্থিত আন্দামান দ্বীপ north sentinel island যার নিজস্ব আয়তন ৭২ কি.মি. ।
এই ছোট দ্বীপ নর্থ সেন্তিনেলেই বাস করে পৃথিবীর সবচাইতে পুরানো uncontacted indigenous peoples । আনুমানিক ভাবে ধরা হয়ে থাকে বিগত ৬০০০০ বছর ধরে আন্দামানে ‘সেন্তিনেলিজ’ দের বসবাস এবং এরা পৃথিবীর অন্যতম নৃগোষ্ঠী যারা বাইরে থেকে যোগাযোগ স্থাপনের সমস্ত চেষ্টাগুলোকে খুব হিংস্র ভাবে বাতিল করেছে। এখনো পর্যন্ত তাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা শম্ভব হয়ে ওঠেনি। সর্বশেষ যোগাযোগ স্থাপন এর চেষ্টায় ভারত ব্যর্থ হয়ে শেষমেশ রণে ভঙ্গ দেয়। ধারনা করা হয়ে থাকে ২০০৪ সালের সুনামিতে সেন্তিনেলিজ দের তেমন উল্লেখযোগ্য কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
সর্বমোট জনসংখ্যা আনুমানিক ৬০ থেকে ৪৫০ জনের মত হয়ে থাকতে পারে। যতদূর জানা যায়, ২টি উল্লেখযোগ্য ঘটনায় প্রথমবার ২০-৪০ জন এবং পরেরবার ৫০-৬০ জনের মত সেন্তিনেলিজ দের একত্রে দেখা গিয়েছিল। এ থেকে ধরে নেওয়া হয় হয়ত এরকম ৬-৭ টি উপদল এই ক্ষুদ্র দ্বীপ এ বিভক্ত হয়ে অবস্থান করছে।
সেন্তিনেলিজদের জিবনযাপন এর ব্যাপার এ তেমন একটা জানা যায়নি। তবে তথ্য উপাত্ত ঘেটে যতটুকু জানা যায় এদের খাদ্য উৎসের মুল ভাণ্ডার সমুদ্র এবং শিকার করে এরা জীবন নিরবাহ করে।
আগুনের ব্যাবহার সম্পর্কে তেমন কোনও উপাত্ত নেয়। তবে এরা পাথর, জাহাজের ভগ্নাংশ থেকে পাওয়া লোহা, বন্য গাছপালার ডাল, বাকল ইত্যাদি বেবহার করে। এরা মুলত দু ধরনের ঘর বানায়। একটি ঘর থাকে যেটাতে কোনও সাইড ওয়াল থাকে না, মাটির ওপর গাছের পাতা বিছানো থাকে। দ্বিতীয় ধরন টি বেশ বড় করেই বানানো হয়ে থাকে, সচরাচর এক্তু বৃহৎ পরিবারের জন্য।
ঘরটি মুলত মাচাং এর ওপরে বানানো হয়, আলাদা রুম এর বেবস্থা থাকে।
এদের ব্যবহৃত অস্ত্রের মাঝে রয়েছে বর্শা এবং ধনুক। শিকার এবং মাছ ধরার জন্য রয়েছে আলদা ধরনের ৩ রকম অস্ত্র। এরা ধনুক দিয়ে ১০০ মিটার দূর থেকে মানুষের সমান উচ্চতার যে কোনও শিকার পরযদস্তু করতে সক্ষম। হারপুন যাতিও একধরনের অস্ত্র এরা ব্যাবহার করে থাকে বড় মাছ ধরতে উচ্চতায় যা প্রায় ৮ ফুট ! আসবাবপত্রের মাঝে যা আছে টার বেশিরভাগ এ বাশ, কাঠ এবং পাথরের তৈরি।
সেন্তিনেলিজ দের ভাষা সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। এদের ভাষা এতটাই আলদা যে হাজার বছর ধরে আন্দামানিজরাও কোনও যোগাযোগ করতে পারেনি। কথিত আছে এরা আদিমানব এর সরাসরি বংশগত এবং আফ্রিকা থেকে এখানে বসতি স্থাপন করেছে। ধর্মীও আচার প্রথা সম্পর্কেও খুব বেশি কিছু জানা যায় না। কোনও বাচ্চা মারা গেলে কবর দেওয়া হয়, সাথে শামুক জাতিও সামুদ্রিক প্রাণীর খোলস দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়।
আচার অনুষ্ঠান এ এদের মাঝে লাল রঙের ব্যাবহার লক্ষ করা যায়। সেন্তিনেলিজ পুরুষ সুস্বাস্থের অধিকারী, সচেতন এবং সমৃদ্ধশালী।
বর্তমানে ভারত সরকার যেকোনো ধরনের যোগাযোগ প্রচেষ্টা অবৈধ করেছে এবং তাদের কে কোনও ধরনের হস্তক্ষেপ না করার জন্য আদেশ জারি করেছে। সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে আন্দামান দ্বিপপুঞ্জের সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিবাসি গ্রেট আন্দামানিজ এবং জারাও্যা ও অউঙ্গে দের বর্তমান অস্তিত্ব সংকট এর কথা মাথায় রেখে সেন্তিনেলিজ দের কে নিজেদের মত করে বাছার অধিকার দেওয়া হয়েছে।
সেন্তিনেলিজ দের নিয়ে এত কথা বলার একমাত্র কারন, এরাই শম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র মানব সম্প্রদায় যাদের সম্পর্কে না পৃথিবীর মানুষ কিছু জানতে পেরেছে, আর না সেন্তিনেলিজ রা পৃথিবী কে স্বাগতম জানিয়েছে।
এদের চেয়ে isolated কোনও tribe পৃথিবীতে আর হয়ত পাওয়া যাবে না যারা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্য প্রয়জনে হিংস্র ভাবে ঝাপিয়ে পরেছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ই, দুজন জেলে কর্তৃপক্ষের আদেশ লঙ্ঘন করে সেন্তিনেলিজ জলসীমা অতিক্রম করে এবং সংগত কারনেই এদের বর্ষার আঘাতে নিহত হয়। উদ্ধার তৎপরতায় নিয়োজিত হেলিকপটার এর দিকে তীর এবং বর্শা নিক্ষেপ এর কারনে শেষ পর্যন্ত সেটিও বাতিল করতে হয়। জানা যায় জেলেদের গর্ত খুড়ে তাতে সমাহিত করা হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।