আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: স্বর্গের সিঁড়ি

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ শিউলিদের গ্রামেরই কোথাও রয়েছে আবহমান বাংলায় যাবার পথ। আশরাফ আজ ভালোবাসার বিনিময়ে ছাড়পত্র যোগার করে স্ত্রী আর ছেলেমেয়েদের নিয়ে যাবেন আবহমান বাংলায় ... রোদ ঝলমলে হাইওয়েতে ছাই রঙের টয়োটা হাইল্যান্ডারটি যেন বাতাসে ভাসছে। ২০০৭ সালের হাইব্রিড মডেল।

আশরাফই আজ ড্রাইভ করছেন । ড্রাইভার রশীদের মার অসুখ। তাকে ছুটি দেওয়া হয়েছে। এই অঞ্চলটা মোটামুটি পরিচিত তার। গাজীপুর শহর ছাড়িয়ে হাতের ডাইনে রেললাইন রেখে শ্রীপুর শহরের সাত কিলোমিটার আগে হাতের বাঁয়ে খানিক এগিয়ে গেলে শিউলিদের গ্রাম।

আশরাফ বাঁ দিকে টার্ন নিলেন। সরু রাস্তার দু’পাশে বাঁশঝাড় । খাল। আদিগন্ত ফসলের মাঠ। দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় ।

আশরাফের পাশের সিটে বসে রেহনুমা আদিগন্ত ফসলের মাঠের দিকে চেয়ে আছেন। রেহনুমার মায়াময় ফরসা ভরাট মুখটি অবিকল দেবী দূর্গার মতন দেখতে। কপালে বড় একটা লাল টিপ পরেছেন । চোখে কাজল এঁকেছেন। রেহনুমার পরনে আজ সাদার উপর সবুজ নকশা করা জামদানী শাড়ি ।

বেলি ফুলের মালা জড়িয়েছেন খোঁপায় । রেহনুমা অভিভূত হয়ে বাংলার গ্রামীণ রূপ দেখছেন। আহা, কি ঝলমলে রোদ! আর বৈশাখের উথালপাথাল হাওয়া। কবি যে বলেছেন ... এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি/ সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি। সে কথা কি আর মিথ্যে! গ্রামের দিকে এলেই কেমন হালকা লাগে।

শরীরে আটকে থাকা কৃত্রিম খোলশটি ঝরে যায়। স্বর্গে যাওয়ার সিঁড়িটি এখানেই কোথাও রয়েছে। ওটা শহরে নেই। পিছনের সিটে টুম্পা, শিউলি আর তমাল বসে। টুম্পার কোলে একটা আসুস নেটবুক।

কিবোর্ডের উপর আঙুল। গভীর মনোযোগ দিয়ে সদ্য তোলা ছবি এডিট করছে। ফরসা লম্বাটে মুখ; চোখের ওপর গোল ফ্রেমের চশমা। কেমন পড়–য়া পড়–য়া চেহারা। এবার ক্লাস সেভেনে উঠল টুম্পা।

শিউলির পরনে লাল রঙের সালোয়ারকামিজ পরেছে। কপালে লাল টিপ পরেছে। শিউলির চোখমুখ খুশিতে চকচক করছে। তিন মাস পর বাড়ি যাচ্ছে। খুশির আভা ছড়িয়ে আছে ওর শ্যামলা মুখে ।

শিউলি বছরখানেক হল এদের বাড়িতে কাজ করছে। তবে শিউলিকে মেয়ের মতোই দেখেন আশরাফ-রেহনুমা। তমাল বেশ লম্বা। গায়ের রং শ্যামলা। এক মাথা কোঁকড়া চুল।

কালো রঙের টিশার্ট পরেছে। তাতে সাদা অক্ষরে লেখা: ‘ফ্রম হিয়ার টু ইটারনিটি’। তমালের হাতে একটা সনি এরিকসন এক্সপেরিয়া মিনি প্রো। কানে সাদা হেডফোন। দু কানের পর্দায় আর্টসেলের হুঙ্কার।

অল্প অল্প মাথা নাড়ছে তমাল। এ বছর ও লেভেল শুরু করেছে তমাল। শিউলি বলল, মামা। আমরা আইসা পড়ছি। আমরা আইসা পড়ছি।

আশরাফ ব্রেক কষলেন। শিউলি সবার আগে গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে যায়। ঢাকা থেকে মেহমান নিয়ে এসেছে। ইষৎ উত্তেজিত ছিল। আগেই অবশ্য মোবাইলে শিউলির বাবা তোরাবালির সঙ্গে কথা হয়েছে রেহনুমার।

একদিনের ব্যাপার। বিশেষ কিছু করার দরকার নেই বুঝলে। ভাতডাল রান্না করলেই চলবে। খাবার পানি আমরাই নিয়ে যাব। ওহ, এসে পড়েছি।

বলে টুম্পা নেট বুক অফ করে দেয়। তারপর ব্যাগ থেকে একটা ক্যামেরা বার করে গলায় ঝোলায়। ১৫.১ মেগাপিক্সেলের Canon EOS 500D. গত ফেব্রুয়ারি মাসে বাবা জন্মদিনে উপহার দিয়েছে ক্যামেরাটা। এই বয়েসেই টুম্পার ছবি তোলার ঝোঁক সাংঘাতিক। তমাল গাড়ি থেকে নামে।

তারপর পকেট থেকে মেনটোস বার করে একটা মুখে ফেলে। টুম্পা নেমে এলে ওর হাতেও একটি ধরিয়ে দেয়। থ্যাঙ্কস। টুম্পা বলে। তমালের কানে হেডফোন।

রেহনুমা ছেলের কান থেকে হেডফোন খুলে ধমকের সুরে বললেন, আহ্, বছরের একটা দিন অন্তত ন্যাচারাল সাউন্ড শোন না! তমাল ম্লান হাসে। তারপর মোবাইলের এমপি থ্রি প্লেয়ারটা অফ করে দেয়। ওদের দেখে শিউলির বাবা তোরাবালি এগিয়ে এল। তোরাবালি এদের পূর্ব পরিচিত। প্রতি মাসে একবার শিউলির বেতন আনতে ঢাকায় যায় ।

তোরাবালি মানুষটি তেমন বয়স্ক না হলেও তাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয় বলে এবং অপুষ্টিজনিত কারণে বৃদ্ধ এবং শীর্ণ দেখায়। বাংলার শোষিত কৃষকের প্রতীক যেন তোরাবালি। তার গায়ের রং কালো। মুখের ভাঙা চোয়ালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। বাড়িতে আজ মেহমান এসেছে বলে পরিস্কার লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরেছে তোরাবালি।

বাবার পাশে শিউলির দুই ভাইও দাঁড়িয়ে ছিল। ভাইদের মধ্যে নেয়ামত বড় আর মোনাফ ছোট। নেয়ামতের বয়স আঠারো-উনিশ। কালো শক্তসমর্থ শরীর। চেক লুঙ্গির উপর নীল রঙের শার্ট পরে আছে ও ।

বাবার সঙ্গে মাঠে যায় নেয়ামত। আর মোনাফের বয়স বারো তেরোর বেশি না। শ্যামলা মতন মিষ্টি চেহারার ছটপটে বালক। লাল রঙের গেঞ্জি আর নীল রঙের হাফ প্যান্ট পরে আছে মোনাফ। গলায় কাইতনে বাঁধা একটি চারকোণা রূপার তাবিজ ঝুলছে।

মোনাফের মুখে কেমন নিষ্পাপ আভা ছড়ানো । রাখাল বলেই হয়তো । পরীর দীঘির পাড়ে গরু চড়ায় মোনাফ । এসবই শিউলির মুখে শোনা। উঠানে কতগুলি প্লাস্টিকের চেয়ার পাতা।

আশরাফ একটা চেয়ারে বসলেন। তিনি আজ পায়জামা- পাঞ্জাবি পরেছেন। কোলাপুরি চপ্পলটি খুলে মাটির উপর পা রাখলেন। আহ! এক ঝলক শীতল অনুভূতি শরীরময় ছড়িয়ে পড়ল। শিকড়ে ফেরার অনুভূতি টের পেলেন।

শিকড়জুড়ে থাকে শীতল পানির জলাধার। তারি ঠান্ডা ভিজে হাওয়ায় শরীর জুড়িয়ে গেল। টুম্পা এসে পাশে বসেছে। আশরাফ মেয়েকে বললেন, এই হল শিউলিদের পরিবার। টুম্পা, বলল হ্যাঁ।

এই বয়েসে শিউলিকে কেমন মাবাবা ছেড়ে আলাদা থাকতে হয়। টুম্পা ছোট্ট শ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে বলল, তাই তো। তোমাকে যদি মাবাবাকে ছেড়ে থাকতে হয় তখন কেমন লাগবে? বাজে লাগবে। সো, শিউলির জন্য সব সময় ফিল করো। করি তো।

শিউলির মাকে অবশ্য উঠানে দেখা গেল না। রেহনুমা ‘কি রে শিউলি তোর মা কই’ বলে বাড়ি ভিতরে চলে এলেন। বাড়ি মানে মাটির মেঝে আর মাটির দেয়াল। উপরে ছনের ছাদ। ভিতরে দুটি ছোট ছোট ঘর।

তারই একটা ঘরে গুটিশুটি মেরে ছিল শিউলির মা । কপালে লম্বা ঘোমটা। রেহনুমা একটা শাড়ি বাড়িয়ে বললেন, আপা এটা আপনার। ঘরে তেমন আলো নেই, সে কারণে শিউলির মায়ের এক্সপ্রেশন ঠিক বোঝা গেল না। শিউলিরা তিনবোন।

শিউলিই ছোট। শিউলির বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। শ্বশুরবাড়ি সাভার। মেজো বোন গাজীপুরে এক গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। আরও দুটি শাড়ির প্যাকেট শিউলির মায়ের হাতে দিয়ে রেহনুমা বললেন, আর এ দুটো আপনার বড় আর মেজ মেয়ের।

শিউলির বাবা আর ভাইদের জন্যও জামাকাপড় আনা হয়েছে। লুঙ্গি পাঞ্জাবি শার্ট গেঞ্জি। সেই প্যাকেটগুলি শিউলির মায়ের হাতে দিলেন রেহনুমা। কাপড়জামা ছাড়াও খাবার দাবারও ছিল। কেক বিসকিট আপেল চকোলেট।

সেই প্যাকেটগুলিও শিউলির মায়ের হাতে দিলেন রেহনুমা। শিউলির মার চোখে জল। টুম্পা ওর মায়ের পিছু পিছু এসেছিল। ওর হাতে কেনন ইওএস ৫০০ডি ঝলসে উঠল। পরবর্তীতে এই সাদাকালো ছবিটা একটা প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পেয়েছিল।

শিউলির মা নানারকম পিঠা তৈরি করে রেখেছিল। মুগ ডালের নকশী পিঠা, তেলের পিঠা, নারকেলের তিল পুলি । মোনাফ আর শিউলি একটা টিনের থালায় পিঠে সাজিয়ে অতিথিদের খেতে দিল । শিউলির বাবা তোরাবালির নিজস্ব জমি নেই। সে বর্গাচাষী।

হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে কোনওমতে টিকে আছে । তারপরও ধারদেনা করে হলেও অতিথি আপ্যায়নে কার্পন্য করেনি। আশরাফ আবেগ টের পেলেন। একটি তেলের পিঠা মুখে ফেলে আশরাফ বললেন, বাহ্ । কে করছে? আমার মায়ে।

মোনাফ বলল। ও এরই মধ্যে ওর জন্য আনা নীল গেঞ্জি আর কালো রঙের হাফপ্যান্ট পরে ফেলেছে। তমাল আর টুম্পা মনে হয় না এসব পিঠা খাবে । নাক কোঁচকাবে। সে জন্য জোর করলেন না আশরাফ।

অভ্যেস তো এক দিনেই বদলানো যাবে না। অবশ্য আশরাফ কে অবাক করে দিয়ে একটা মুগ ডালের নকশী পিঠা মুখে ফেলে টুম্পা বলল, কুল। আশরাফ খুশি হয়ে বললেন, ভালো লাগল তাহলে? হুমম। বলে নারকেলের তিল পুলিতে ছোট্ট কামড় দিল টুম্পা। দুপুরে খাবার বাড়া হল ভিতরের ঘরে একটা চৌকির ওপর।

রেহনুমা অবশ্য চেয়ারে বসলেন। নেয়ামত তালপাখা নিয়ে বাতাস করতে লাগল। রেহনুমা বললেন, বাতাস করতে হবে না। তুমিও আমাদের সঙ্গে খেতে বস। আয়োজন সামান্য।

ভাত লাল শাক বেলে মাছের ঝোল আম ডাল আর দই। খেতে খেতে আশরাফ জিজ্ঞেস করলেন, কে রেঁধেছে রে শিউলি? তোর মা? হ। সব আমার মায়ে রানছে। শিউলির বদলে মোনাফ চটপট উত্তর দেয়। অপূর্ব।

রেহনুমা আপনমনে হাসলেন। নাগরিক মুখোশ খুলে শিকড়ের কাছে ফিরে এসে সম্পূর্ন নতজানু না-হলে বাংলার এই রান্নার অপূর্ব স্বাদ আস্বাদন সম্ভব না। রেহনুমার পাশে বসে খাচ্ছে তমাল। রেহনুমা ফিসফিস করে ছেলেকে বললেন, এখন এই একুশ শতকে বিশ্বের উন্নত দেশগুলির মানুষ যেভাবে বাঁচতে চায়, বাংলাদেশের গ্রামের মানুষ কিন্তু সেভাবেই বেঁচে আছে। গ্রিন? তমাল বলল।

হ্যাঁ। গ্রিন। গ্রামের মানুষ পরিবেশের ক্ষতি করে না। এরা যেন কখনোই এদের পরিবেশ থেকে উৎখাত না হয়ে যায় সেটা দেখা আমাদের দায়িত্ব। তমাল মাথা নাড়ল।

আমডাল খেতে ভালো লাগে ওর। মাও ভালো রাঁধে ... তবে মাটির চুলার রান্নার স্বাদই অন্যরকম। টুম্পা ভাতে লাল শাক মেখে অল্পই খেল। কিন্তু দইটুকু খেয়ে ভারি খুশি হয়ে বলল, ইস! দইটা কি ভালো! টকটক । আবার মিষ্টিও।

মায়ে ঘরে পাতছে। শিউলি বলল। শিউলির মায়ের দিকে তাকিয়ে আশরাফ বললেন, আপনি একবার চলুন না ঢাকায়। আমাদের ওখানে ক’দিন বেড়িয়ে আসবেন। এই কথায় শিউলির মা লজ্জ্বায় জড়োসরো হয়ে পড়লেন।

তিনি নিভৃতে থাকেন। তার উপর ফোকাস করা হলে তিনি তো কুন্ঠিত হবেনই। শিউলির কাছে শুনলাম আপনার নাকি চোখের কি সমস্যা আছে? হ। মায়ের চোখ দিয়া পানি পরে। মোনাফ বলল।

ঠিক আছে। চিকিৎসা যা করার করব। বলে তোরাবালির রেহনুমা বললেন, আপনি ওকে নিয়ে একবার ঢাকায় আসুন। চিকিৎসার জন্য ভাববেন না। আইচ্ছা।

তোরাবালির মুখচোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। শিউলির মা-ই এ সংসারের কর্ত্রী। যে আজ অপরিচিত মানুষের ভালোবাসায় মুগ্ধ । সন্তুষ্ট । শহরের পাথর ভাঙা নারী শ্রমিকের মতো তাকে যতই দীনহীন দেখাক না কেন, আবহমান বাংলায় যাবার ছাড়পত্রটি কিন্তু তারই হাতে।

শিউলির কানে কানে ওর মা কি যেন বলল। শিউলি মাথা নাড়ল। তারপর বলল, মামী পরীর দীঘির পাড়ে যাইবেন? রেহনুমা বললেন, তুই যে পরীর দীঘির গল্প করিস সেই পরীর দীঘি? হ। বলে শিউলি মাথা নাড়ে। হাসে।

যাব। আশরাফ জানতে চাইলেন, দীঘি পর্যন্ত গাড়ি যাবে তো? নেয়ামত বলল, গাড়ি যাইব। তয় আমবনের আগে নাইমা যাইতে হইব। আশরাফ আর রেহনুমা একে অন্যের দিকে তাকালেন । তার মানে আমবনের পরই আবহমান বাংলার শুরু ... আবহমান বাংলা যেহেতু যান্ত্রিকতাশূন্য- ওখানে গাড়ি যাওয়ার কথা না ।

তাদের মুখচোখ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। কত দিনের আশা ছেলেমেয়ে দুটিকে একবার আবহমান বাংলায় নিয়ে যাবেন। আজ সে আশা পূর্ণ হতে চলেছে। সবাই গাদাগাদি করে হাইল্যান্ডার-এ উঠল। রেহনুমা পিছনের সিটে ছোটদের সঙ্গে বসলেন।

তোরাবালি সামনের সিটে আশরাফের পাশে। আশরাফ শিউলিদের গ্রামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে চান। সে ব্যাপারে তোরাবালির সঙ্গে কথা বলা দরকার। স্কুল প্রতিষ্ঠায় জমাজমির প্রয়োজন। তোরাবালি জমির খোঁজ করবেন বলে জানাল।

গাড়ি চলছে। টুম্পা বলল, নেয়ামত ভাই? কও। পরীর দীঘির নাম পরীর দীঘি কেন? মোনাফ সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমি জানি। আমি জানি। আমি কমু? হ্যাঁ, বল।

শুনি। মোনাফ বলতে থাকে, অনেক দিন আগে আমাদের গেরামে একঝন জমিনদার আছিল গেরামে পানি নাই পানি জমিনদারে তখন দীঘঈ কাটাইলেন তয় দীঘত পানি না আইলে জমিনদার তখন স্বপন দেখলেন তোমার মাইয়া পরীরে দীঘত নাইমা যায় তাইলে দীঘত পানি উঠব পরী বাপের কথা শুইনা পরী দীঘত নামলে দীঘত পানি উঠল। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলি বলে হাঁপাতে লাগল মোনাফ। কত কালের কথা। শুনতে শুনতে টুম্পা অবাক হয়ে যায়।

ফোস করে ছোট্ট শ্বাসও ফেলল পরীর দুঃখে। আকাশে মেঘ জমেছে। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। তবে বৃষ্টি হলেও বড় ধরনের ঝড়ের আশঙ্কা নেই বলে তোরাবালি জানাল। তোরাবালি অভিজ্ঞ মানুষ।

তার কথা বিশ্বাস করা যায়। তোরাবালির কথামতো আমবনের কাছে গাড়ি থামালেন আশরাফ। সবাই গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে লাগল। আমবনের ভিতর দিয়ে সরু পথ। চারিদিকে তাকাতে তাকাতে হাঁটছিল তমাল।

অন্ধকার নির্জন আমের বনে বোলের মাদক গন্ধ ভাসছিল বাতাসে। আমগাছের ফাকে একটা পুকুর। পদ্ম ফুটে রয়েছে। একটি বড় রাজহাঁস। ওপাশে কলাঝোপ।

মাটির বাড়ি। পরিচ্ছন্ন নিকানো উঠান। খড়ের স্তূপ। ও বাড়িতে কারা থাকে? তমাল অবাক হয়। রেহনুমা তমালের পাশে হাঁটছিলেন।

বললেন, কিছু দিন ধরে তোর বাবা এক্সটেনডেড ফ্যামিলি থিউরি নিয়ে ভাবছে। এক্সটেনডেড ফ্যামিলি থিউরি মানে? তমাল অবাক। এক্সটেনডেড ফ্যামিলি থিউরি মানে নানা প্রয়োজনে যাদের সংস্পর্শে আমাদের আসতে হয় তাদেরকে একই পরিবারের সদস্য ভাবা। যেমন শিউলি, ড্রইভার রশীদ। ড্রাইভার রশীদের কথাই ধর।

রশীদর মার অসুখ। রশীদের দেশের বাড়ি বরিশাল। রশীদ ছুটি নিয়ে বরিশাল চলে গেল। অন্য কেউ হলে রশীদকে কি সহজে ছুটি দিত? দিত না। আমরা দিলাম।

কেন? কারণ আমরা ‘এক্সটেনডেড ফ্যামিলি’ তে বিশ্বাস করি। ওহ্ । জানিস তো এক সময়ে বাংলাদেশে যৌথপরিবার ছিল? হ্যাঁ। সেটি এখন ভেঙে গেছে। যৌথ পরিবার গঠিত হয় একই শ্রেণির মধ্যে।

কিন্তু এক্সটেনডেড ফ্যামিলি বা সম্প্রসারিত পরিবারের কনসেপ্ট আরও গভীর। সম্প্রসারিত পরিবার তত্ত্ব শ্রেণিবৈষম্য অস্বীকার করে । তমাল চুপ করে থাকে। রেহনুমা বললেন, আমরা কেউ তো আর চিরদিন বাঁচব না। আমাদের দিয়ে যাতে সমাজে অবহেলিত মানুষের সামান্যতম উপকার হয় সে চেষ্টাই আমাদের করা উচিত।

আজ যে আমরা শিউলিদের শাড়ি-কাপড় উপহার দিলাম। ওরা কত খুশি হল। আর একটা কথা মনে রাখবি তমাল। বাংলার পন্ডিত এবং কবিসাহিত্যিকদের স্থান বিশ্বের প্রথম সারিতে। তাঁরা সারাজীবন বাংলার বঞ্চিত মানুষের কল্যাণের কথা উন্নতির কথা ভেবেছেন।

এবার বল তুই কি ভাবছিস? তমাল বলল, মা আমিও এক্সটেনডেড ফ্যামিলির পক্ষে। আমি তোমায় কথা দিলাম। আমি চিরদিনই এর পক্ষে থাকব। যতদিন বেঁচে আছি এক্সটেনডেড ফ্যামিলি থিউরি স্টাবলিশ করার জন্য কাজ করে যাব। আর আমি যেখানেই থাকি না কেন বারবার এই গ্রামে ফিরে আসব।

এদের সুখে-দুঃখে এদের পাশে থাকব। রেহনুমার চোখে পানি এসে গেল। তিনি ছেলের হাত স্পর্শ করলেন। বললেন, আমবনের শেষে আবহমান বাংলার শুরু। বাঙালি হলেই আবহমান বাংলায় যাওয়া যায় না।

আবহমান যেতে হলে প্রথমে পূণ্য অর্জন করতে হয়। আজ আমরা শিউলিদের পরিবার আপন করে নিয়ে সে পূণ্য অর্জন করেছি। কেবল বাংলার মানুষকে গভীর ভাবে ভালোবাসলেই আবহমান বাংলায় যাওয়ার ছাড়পত্র মেলে ... কিন্তু, মা, আবহমান বাংলায় যাওয়া কেন এত ইম্পোটেন্ট? জীবন সার্থক করাই তো জীবনের লক্ষ। তাই না ? জীবনে একবার অন্তত আবহমান বাংলায় দাঁড়ালে বাঙালির জীবন সার্থক হয়। ওহ্ ।

আমবনের শেষে বিস্তির্ণ মাঠ। ওই হল তেপান্তের মাঠ। রেহনুমা বললেন। সামনেই বড় একটি বট গাছ ডালপালা ছড়িয়ে । আকাশজুড়ে কৃষ্ণবর্ণের মেঘ ছড়িয়ে আছে।

তার নীচে কালো রঙের অথই জলের বিস্তার। পরীর দীঘিটি বিশাল । চারপাশে বেশ উঁচু পাড় । এ দিককার পুরনো ইটের তৈরি ঘাটটি বেশ ছড়ানো। ঘাটে এখানে ওখানে শ্যাওলা জমে আছে ।

ঘাটের উপর একটি দশবারো বছরের মেয়ে দাঁড়িয়ে। মেয়েটি অদ্ভূত সুন্দর দেখতে। ফরসা দুধে আলতা গায়ের রং । লালচে কোঁকড়া চুল; কাজল কালো চোখ। কে ও? ও হইল পরী।

বাহ্ পরীর দীঘির পরী। মোনাফ হি হি করে হেসে ওঠে। তো পরী কই থাকে ? নেয়ামত হেসে বলল, পরীর দীঘির পরী যে কই থাকে কেউ জানে না। তয় পরীর সঙ্গে মোনাফের বহুত খাতির । মোনাফে গরু নিয়া মাডে আইলে তখন পরীও আসে।

এই তুমি কোথায় থাক? পরী কথা না বলে চুপ করে রইল। মোনাফ বলল, পরী কথা কয় না। রেহনুমা স্বামীর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন, মেয়েটি কি মায়াবী আর মিস্টিরিয়াস আশরাফ বললেন, আবহমান বাংলা থেকে উঠে এসেছে মায়াবী তো হবেই ...আর এসব গল্পই বাঁচিয়ে রেখেছে তোরাবালীদের। এসব রূপকথাই গত তিন হাজার বছর ধরে বাংলার মানুষকে তার কঠিন জীবনে বাঁচিয়ে রেখেছে। আর আমরা কিনা এই মায়াময় জগৎ ফেলে কংক্রিটের তৈরি শহরে বাস করে করে দিন দিন যান্ত্রিক হয়ে উঠেছি।

আফসোস! পরী তাহলে গ্রাম-বাংলার গল্প থেকে উঠে এসেছে বলছ? হ্যাঁ। হঠাৎ বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি ঝরতে শুরু করল। । দূরের দিগন্ত বৃষ্টিবিন্দুর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যেতে লাগল। দৌড়ে সবাই বট গাছের নীচে চলে এল।

টুম্পার কাছে দামি ক্যামেরা। তমালের কাছে দামি মোবাইল। ওগুলি বৃষ্টিতে ভিজলেই সমস্যা। ওগুলি তোরাবালির হাতে দিল ওরা। ঘাটের ওপর দাঁড়িয়ে শিউলি নেয়ামত পরী আর মোনাফ বৃষ্টিতে ভিজছিল।

হই হই করে নাচছিল। ‘যা। তোরাও ওদের সঙ্গে গিয়ে ভিজ। ’ বলে তমাল আর টুম্পা কে ঠেলে দিলেন আশরাফ। ওরা ছুটে যায় বৃষ্টিমুখর দীঘির ঘাটে ।

একটু পর টুম্পা হাত তুলে চেঁচিয়ে রেহনুমাকে ডাকল ... মা তুমিও এসো না! আত্মজার সে ডাক রেহনুমা উপেক্ষা করতে পারলেন না। তিনি পায়ে পায়ে বৃষ্টি-উৎসবের দিকে এগিয়ে যেতে । তার কপাল থেকে টিপ খসে পড়ে, কাজল ভিজে গলে পড়তে থাকে। পরনের জামদানী শাড়িটি ভিজে ভিজে ফুটে ওঠে এক মাতৃমূর্তি। যেন তিনিও আবহমান বাংলার এক সুপ্রাচীন মাতৃদেবী।

যে মাতৃদেবীর আরাধনার উৎসব উদযাপিত হয় বৈশাখের অঝোর বৃষ্টির ভিতর । রেহনুমা চিৎকার করে তাঁর চিরকালীন বন্ধুটিকে ডাকলেন, আশরাফ! তুমিও এসো না। আজ যে আবহমান বাংলার বৈশাখী বৃষ্টিউৎসব। তুমি কি ভিজবে না? আশরাফ কি দেবীর আহবান উপেক্ষা করতে পারেন? দেবীই যে সৃষ্টির মূল। বৃষ্টির ধূসর চাদর ছিঁড়ে ছিঁড়ে বৃষ্টিস্নাত পূজারীদের ভিড়ের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন আশরাফ।

বৃষ্টি যেন তার তীব্র তীক্ষ্ম শর বিদ্ধ করতে করতে খসিয়ে ফেলতে চায় তার শরীরের বাদবাকি নাগরিক মুখোশ-খোলশ। ... সামান্য দূর থেকে এসবই দেখছিল বটের তলায় প্রাচীন নিষাদের মতো দাঁড়িয়ে থাকা তোরাবালি ... যে মানুষটি বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে ভিজছে বাংলার বিখ্যাত বৃষ্টিতে... যে মানুষটি তার শৈশবেই দেখেছেন তেপান্তরের মাঠে স্বর্গে যাওয়ার সিঁড়িটি ... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.