আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নীরব কাহিনী



একটাও জানালা খোলা যাবেনা। খোলা যাবেনা বাইরের বারান্দার দিকের দরজাটাও। কক্ষগুলোর মধ্যে সার্বক্ষণিক প্রজ্জ্বলিত বৈদ্যুতিক বাতি। জানালায় ভারী পর্দা ঝোলানো,যাতে বাইরে থেকে ভিতর দেখা না যায। গরমের সময়ে অসহ্য ভ্যাপ্সা গরম।

ত্রিশ থেকে পয়ত্রিশজন ছেলেমেয়ে পাচতলা ভবনের একেক কক্ষে। ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ থেকে এসে জমা হয়েছে ছয় থেকে সাত বছরের প্রায় ছয় থেকে সাতশ বাচ্চা। ভিন্ন ভিন্ন তাদের মানসিকতা,ভিন্ন ভিন্ন তাদের বাসার পরিবেশ। কেউ কেউ চঞ্চল কেউ ধীর,কেউ মেধাবী কেউবা নয়। তাতে কি এসে যায়।

এখানে কেউ উচ্চস্বরে কথা বলা যাবেনা,লাফানো কিংবা মারামারি করাতো দূরে থাক। একবার কক্ষগুলোতে ঢুকলে আর উপরতলায় বা নীচতলায় যাওয়া যাবেনা। সকাল আটটা থেকে দুপুর সাড়ে বারটা কিংবা একটা যাই বাজুক শুধু মুখ বুজে নিজের কাজ করে যেতে হবে। মাঝে বিশ মিনিটের ব্রেকের যে সময়টুকু পাওয়া যাবে তাতেও হাসতে মানা। হুম বন্ধুরা আপনারা কি বুঝতে পারছেন কোন জায়গার কথা বলছি?এটা হল আমার দেখা ঢাকার উত্তরার এক বিখ্যাত স্কুলের কাহিনী।

উত্তরা একটা আবাসিক মডেল টাউন। আবাসিক এলাকার ভিতর স্কুল হবার কারণে চারপাশ থেকে যাতে কমপ্লেইন না আসে তার জন্যেই এই ব্যবস্থা। অন্যান্য বেসরকারী স্কুলগুলোর মত এরাও গেটের বাইরে পতাকা উত্তোলন করে কিন্তু পতাকার রংদুটি কখনও ছেলেমেয়েদের চোখে পড়ে কিনা আমার জানা নেই। এরা সপ্তাহে একদিন এসেম্বলি করে গ্যারেজে দাড়িয়ে। জায়গার অভাবে বছরে কখনই বাতসরিক খেলাধুলা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়না।

একুশে ফেব্রুয়ারী পালন করে নির্দিষ্টদিনের একদিন বা দুদিন আগে কাগজের শহীদ মিনার বানিয়ে। গাদা গাদা হোমওয়ার্ক আর পড়ার বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয় গার্জিয়ানকে খুশি করবে বলে। কারণ অভিভাবকরাও তাই চায়। সেই সাথে ছড়িয়ে পড়ে স্কুলের সুনাম। ছাত্রের মানসিক অবস্থা কি হবে তা নাইবা ভাবা গেলো।

হায়রে আমার ছেলেবেলার গান,হারিয়ে গেল কই। কোথায় গেল খেলার মাঠ আর দুরন্ত কৈশোর,উপচে পড়া রোদ্দুরে হারিয়ে যাওয়া দুপুর। একদিন একটা ক্লাশ অফ থাকায় এক ক্লাশের কিছু ছাত্রকে নীচে নামিয়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরে কিছু সময়ের জন্যে ছেড়ে দিয়েছিলাম। (যদিও এর মাশুল গুনতে হয়েছিল। পাশের বাসা থেকে যথারীতি বিচার চলে এসেছিল) ওরা কিভাবে যে ওদের উছ্বাস প্রকাশ করেছিল,পাচ দশ মিনিট শুধু চিতকারই করেছিল ছাড়া পেয়ে।

ওদের উল্লাস দেখে আমার চোখ দিয়ে অজান্তেই পানি চলে এসেছিল। এত অল্পতেই এত খুশি এরা,ঠিক যেন খাচার পাখির মুক্ত হবার আনন্দ। নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছিল। কি নীরব নির্যাতন করা হচ্ছে এদের উপর। যে ধরনের নির্যাতনের কথা জোড়ালোভাবে কেউই উচ্চারন করেনা।

বাংলাদেশের শহরগুলোর প্রতিটা মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে এধরণের অসংখ্য স্কুল। সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রনালয় থেকে যে ১১টি নীতি জারি করা হয়েছে সেখানেও এ ধরনের নীরব নির্যাতনের কোনো উল্লেখ নেই। এই নির্যাতনগুলো কি আসলেই বিবেচনাযোগ্য নয়?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।