বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
ছোট একটি ডালায় কতগুলি রঙিন মাটির পুতুল। সতীশ সেটি মাথায় নিয়ে হাঁটছিল। রূপহাটির মেলায় যাবে সে।
পুতুল বিক্রি করে সন্ধ্যার আগে আগে ফিরে আসবে। আষাঢ় মাস। আজ সকাল থেকেই দিনটি ঝলমলে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। তবে রোদের বড় ঝাঁঝ। হাঁটতে- হাঁটতে ঘেমে যায় সতীশ।
রূপহাটির মেলায় যেতে ছোট্ট একখানি নদী পেরুতে হয়। নদীর নাম ঝুনঝুনি। সে নদীতে বিজন মাঝি খেয়া পার করে দেয় । আগে খেয়া বাইত বিজনের বাপ পরান মাঝি। পরান মাঝি গত বছর দেহ রেখেছে ।
তা এই বিজন ছেলেটি কিন্তু ভারি শান্ত শিষ্ট। একুশ-বাইশ বছর বয়েস। ফরসা। শক্তপোক্ত গড়ন। সতীশের মেয়েটি হারিয়ে না গেলে বিজনের হাতে তুলে দিয়ে শান্তিতে চোখ বুজত।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘাটে নেমে খেয়া নৌকায় উঠল সতীশ।
মৌলভী ইসমাইল ছাড়া নৌকায় আর কোনও যাত্রী নেই। মৌলভী ইসমাইল কে সতীশ ভারি ভক্তি শ্রদ্ধা করে। সতীশের হারিয়ে যাওয়া মেয়ে পদ্মর তিন বছর বয়েসে একবার শ্বাসনালীর প্রদাহ হয়েছিল। মৌলভী ইসমাইল ‘সাদুরি’ আরক খাইয়ে পদ্মকে সারিয়ে তুলেছিলেন।
সতীশ করজোড় করে প্রণাম জানায়। মৌলভী ইসমাইল মাথা নাড়েন। তাঁর পরনে ঘিয়ে রঙের পায়জামা-পাঞ্জাবীর ওপর কালো কুর্তা। কুর্তাটি পুরনো হলেও পরিস্কার। বৃদ্ধ মৌলভীর মাথায় একখানি লাল তুর্কি টুপি।
মুখ ভরতি পাকা দাড়ি। সত্তরের মতো বয়েস মৌলভীর । গায়ের রং ধবধবে ফরসা। আগে রোকনপুর মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন মৌলভী ইসমাইল; এখন এ গাঁয়ে-ও গাঁয়ে গরীব দুঃখী মানুষের ইউনানী চিকিৎসা করেন।
সতীশ নৌকার পাটাতনের ওপর পুতুলের ডালাটি রেখে জুত করে বসল।
বিজন নৌকা ছেড়ে দিয়েছে।
মৌলভী ইসমাইল জিজ্ঞেস করলেন, তোমার শরীরের গতিক কেমন হে সতীশ ?
এই যায়, এই আসে। সতীশ খানিকা তির্যকভাবে উত্তর দেয়।
হুমম। দিদির?
সতীশের স্ত্রী কিরণময়ী কে মৌলভী ইসমাইল দিদি বলে ডাকেন।
সতীশ বলল, আপনার দিদির শরীরও এখন ভালোই। ওই তো পুতুল গড়ে দিল, তাই নিয়ে এখন রূপহাটির মেলায় বেচতে যাচ্ছি।
বেশ, ভালো।
সতীশ এবার বিজন মাঝির দিকে তাকিয়ে বলল, ওরে বিজন, গত বছর তোর বাপ ম’লো। সংসারে তোর মা একা হয়ে গিয়েছে।
তা তুই এখনও বিয়ে করছিস না কেন?
বিজন মাঝি লাজুক হাসল। বৈঠা বাইতে বাইতে বলল, করব খুড়ো। মা ও খুব করে বলছে। শ্রীরামপুরের টুসুর দেবীর থানে মানত করেছে।
হুমম।
এই হিন্দুপ্রধান অঞ্চলের জনমানুষ মৌলভী ইসমাইল কে দেবতূল্য মনে করে। ইউনানী চিকিৎসার পাশাপাশি ঘটকালীও করেন বৃদ্ধ। তিনি বাজখাঁই কন্ঠে বললেন, সতীশ তো ভালো কথাই বলেছে রে বিজন। বল তো তোর জন্য পাত্রী দেখি।
দেখেন হৌজুর।
বলে লাজুক হাসল বিজন।
দেখতে দেখতে ঘাটে এসে ঠেকল নৌকা ।
ঘাটে নেমে ছাতা খুলে চর দৌতলপুরের পথ ধরলেন মৌলভী ইসমাইল । চর দৌতলপুরের কাচারির ইকরাম আলীর অনিদ্রা রোগ হয়েছে। গত সপ্তাহে ‘নওনেহাল’ আরক খেতে দিয়েছেন ।
নিদ্রা সুস্থির হল কি না- এখন সেই খবর নিতে চলেছেন।
সতীশ সবদরপুরের পথ ধরল।
ঝুনঝুনি নদীর ঘাট থেকে সবদরপুরের রূপহাটির মেলা পাক্কা দুক্রোশ পথ।
সতীশের বয়েস হলেও সে শক্ত সমর্থ বলে পথটুকু পেরুতে সমস্যা হল না। যেতে যেতে বার বার পদ্মর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল তার।
চার বছর বয়েসের পদ্ম সেই যে চৈত্রসংক্রান্তির মেলায় হারিয়ে গেল- মেয়েটির আর কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না। পনেরো বছর হল। কিরণময়ী কন্যার শোকে পাগল পারা। এত বছর ধরে কেঁদেকেটে কিরণময়ীর চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছে। পুতুল কিরণময়ীই তৈরি করে ।
ছোট সংসারে কেবল বুড়োবুড়ি। কোনওমতে চলে যায়।
দুপুর বেলা। মেলায় এন্তার ভিড়। রূপহাটির মেলাটি এ অঞ্চলে বিখ্যাত।
রূপহাটির মেলাটি এ অঞ্চলে ‘কোজাগরী মেলা’ নামেও পরিচিত। এক দিনের জন্য কোজাগরী মেলা বসে। আজ রাতটি আষাঢ়ী পূর্ণিমার রাত। কোজাগরী পূর্ণিমার আলোয় চরাচর উজল হওয়ার কথা। দিনের বেলায় রূপহাটির মেলাটি বসে।
সময় যত গড়াচ্ছে মেলায় ভিড় বাড়ছে।
মেলার দক্ষিণ প্রান্তে বেল নিয়ে বসেছিল শিবপুরের রথীন। অল্প বয়েসি ছেলেটাকে চেনে সতীশ। তারি পাশে পুতুলের ডালা রেখে বসেছে সতীশ । বিকেলের আলো ফুরাতে না ফুরাতেই প্রায় সব পুতুল বিক্রি হয়ে গেল।
তবে ঝাঁকা একেবারে শূন্য নয়। একটি মাত্র পুতুল আছে। নীল রঙের ছোট্ট একখানি রাধামূর্তি। কিরণময়ী বলেছিল, কেউ এই নীল রঙের ছোট্ট রাধামূর্তি কিনতে চাইলে তার কাছে পয়সা চেও না কিন্তু । এই নীল রঙের রাধামূর্তিখানি যার কাছে থাকবে সে হবে পরম ভাগ্যবতী।
ভাগ্যবতী? মানে ? তার মানে কোনও মেয়ে এই মূর্তিটা পছন্দ করবে বলছ?
হ্যাঁ, দেখো।
সতীশ চুপ করে রইল। কিরণময়ীর দেবী দুগ্গার মতো রূপ। কী সব অশরীরি ব্যাপার-স্যাপারও আছে। সতীশ ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।
কিরণময়ীর কাছে বেলি ফুলের গন্ধ ম ম করে। আঁকার হাতও ভালো। যে কোনও পুতুল গড়ার আগে এঁকে নেয় কিরণময়ী।
তা আজ বিক্রিবাটা মন্দ হল না। বেশ লাভও হয়েছে।
রাধামূর্তিটি যে পছন্দ করবে তাকে এমনিই দিয়ে দিলে খুব একটা ক্ষতি হবে না । ভাবতে ভাবতে একটা বিড়ি ধরালো সতীশ। চোখ মেলার ওপর ঘুরছে। সতীশের বয়স হয়েছে। অন্তত ষাটের কাছাকাছি তো হবেই।
চোখে অল্প ছানির দোষও আছে । খুকুর খুকুর করে কাশে। তারপরও বিড়ির নেশা ছাড়া যায় না।
হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে লাল রঙের ডুরে শাড়ি পরা একটি আঠারো উনিশ বছরের মেয়েকে দেখে ভীষণ চমকে উঠল সতীশ।
মেয়েটি যেন অবিকল পদ্মর মতো দেখতে।
পনেরো বছর আগে হারিয়ে যাওয়া পদ্মর মতো চোখমুখের গড়ন। পদ্ম বড় হলে ওই মেয়েটির মতোই দেখতে হত। সতীশ অবশ বোধ করে। তার চোখে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। মেলার গুঞ্জন তার মাথার ভিতরে জোরে ধাক্কা মারে ।
হাত থেকে বিড়ি খসে পড়ে। রথীনের দিকে তাকালো সতীশ। রথীনের বেচাকেনা শেষ। মন দিয়ে পয়সা গুনছিল। এ অঞ্চলে রথীনের চেনাজানা ভালো ।
সতীশ খানিক খুকুর খুকুর করে কাশল। তারপর রথীনকে জিজ্ঞেস করল, ঐ মেয়েটি কে গো?
রথীন মুখ তুলে খানিকটা অবাক হয়ে শুধালো, কার কথা বলছ খুড়ো?
ঐ যে ... ঐ মেয়েটি। উবু হয়ে বসে। আলতা কিনছে। লাল রঙের ডুরে শাড়ি পরা।
মাথায় গোলাপি ফিতে। ফরসা। দেবী দুগ্গার মতন চাউনি।
ওটি?
হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওটিই।
চিনিস ওকে?
চিনি না আবার। ওটি হৈল পরিমল মাঝির ছোট কইন্যে। বড়টির গত বছর অঘ্রানে বে হয়ে গেছে রোকনপুরের কলাতলায়। এখন ছোটটির জইন্যে পাত্র খুঁজছে পরিমল মাঝি। কেন সম্বন্ধ পাকাবে নাকি খুড়ো? তোমার যা বয়স-সম্বন্ধ করলি মন্দ হবে না।
বলে ঠা ঠা করে হেসে উঠল রথীন। সতীশ ভারি বিরক্ত হল। কি সের মধ্যে কি। তার বুকের ভিতরে যে বোশেখ মাসের ঝড় উঠেছে -সে খবর রথীনের নেই। বলল, থাম তো তুই হতচ্ছাড়া!
ধমক খেয়ে রথীন গম্ভীর হয়ে যায়।
সতীশ জিজ্ঞেস করে, কি নাম গো মেয়েটির?
পদ্ম।
চমকে ওঠে। পদ্ম! বলছিস কি তুই?
যা সত্যি তাই বলছি। জিগ্যেস করেই দেখ না। আমি মিথ্যে বলতে যাব কেন? রথীনের কন্ঠস্বরে অভিমান পরিস্কার।
সতীশ বিরবির করে বলে আমার হারিয়ে যাওয়া মেয়ের নামও পদ্ম।
কি বললে খুড়ো?
কিছু না। তা পরিমল মাঝি কই গো? সে কি মেয়ের সঙ্গে মেলায় এসেছে?
হ্যাঁ। এসেছে। ঐ যে মধু ময়রার সঙ্গে গুড়ের সন্দেশের দরদাম করছে।
ঐ যে নীল ফতুয়া পরা। মাথায় টাক। ধূতিখানি বাহারি।
ওহ্ । তা কোথায় থাকে গো পরিমল মাঝি?
দেবীর গাঁয়ের বিভূতি পাড়ায়।
বিভূতি পাড়া? কখনও নাম শুনেছি বলে মনে হয় না।
শুনবে কেন খুড়ো? তুমি তো আর এ অঞ্চলের নও।
তা ঠিক।
পদ্ম এদিকেই আসছে।
সতীশের বুকের বোশেখ মাসের তুফান প্রচন্ড হয়ে উঠল।
ডালার সামনে পদ্ম ঝপ করে বসল। বেলি ফুলের গন্ধ পেল সতীশ। কি সুন্দর মুখ। ডাগর ডাগর চোখ। ঘেমে গেছে।
নাকে রূপার নাকফুল।
ডালা থেকে রাধামূর্তি তুলে নিয়ে পদ্ম বলল, কি সুন্দর গো।
এটা তোমার পছন্দ হয়েছে?
খুউব। কি সুন্দর গড়ন-কে গড়েছে? তুমি?
না গো মা। এটি আমি গড়িনি।
ভগবান আমায় সে বিদ্যে দেন নি।
তাহলে?
গড়েছে আমার স্ত্রী ।
তোমার স্ত্রী তো দেখছি খুব গুণবতী।
তা আর বলতে। বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সতীশ।
এর দাম কত শুনি?
দাম দিতে হবে না।
কেন?
এটা তোমায় আমি উপহার দিলাম।
যাঃ, তা হয় নাকি! তুমি বুড়ো মানুষ। পুতুল বেচে ক’টা কড়িই-বা পাও।
সতীশ মনে মনে বলল, আমিই জগতের সবচে ধনী রে মা।
তুই কত সুন্দর হয়ে গেছিস, বড় হয়ে গেছিস। কন্যার রূপের ছটায় পিতাও তো ধনী।
সতীশ খানিক খুকুর খুকুর করে কাশল। তারপর বলল, শ্রীরাধার মূর্তিখানি তুমি নিলে আমি খুব খুশি হব। জীবনে হাটের কেনা বেচাই কি সব মা।
কথাটা শুনে পদ্ম থমকে গেল। পুতুল বিক্রেতার চোখে জল দেখে নরম সুরে বলল, আচ্ছা, নিলাম। বলে পুতুল নিয়ে উঠে দাঁড়াল পদ্ম।
পায়ে পায়ে বাবার কাছে গিয়ে পতুল দেখাল। হাত তুলে দূর থেকে সতীশ কে দেখালো।
পরিমল মাঝির সঙ্গে কথা বলতে হয়। আসলেই পদ্ম তার নিজের মেয়ে কি না।
সতীশ শূন্য ডালাখানি তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর পরিমল মাঝির কাছে গিয়ে দাঁড়াল। আপন মনে বলল, ঈশাণ কোণে মেঘ জমে যাচ্ছে।
জোর হাওয়াও দিচ্চে। এখন এই বর্ষার ভিতর কী ভাবে বাড়ি ফিরি। এখান থেকে চর পাড়া কি কম দূর।
পরিমল মাঝি কথাটা ঠিকই শুনল। বলল, আমার নাম পরিমল।
আমি মাঝিগিরি করি। ইচ্ছে হলে আজ রাতটা আমার বাড়িতে থাকতে পার।
বলছ?
হ্যাঁ। বলছি। আমার মেয়েকে যখন বিনে পয়সায় পুতুল উপহার দিলে।
পুতুল তোমার মেয়ের পছন্দ হল যে। মুচকি হেসে সতীশ বলল।
পদ্মর গুড়ের সন্দেশও তো পছন্দ হল। তা বলে কি মধু ময়রা ওকে বিনে পয়সা গুড়ের সন্দেশ খেতে দিলে?
সতীশ এর কি উত্তর দেবে? সে মাথা চুলকায়।
চারধার অন্ধকার হয়ে আসছে।
কথা বলতে বলতে ওরা তিনজন হাঁটতে লাগল। তারপর মেলা ভাঙার স্রোতে মিশে বাঁশ বন আর ধানীর জমির
মাঝখান দিয়ে আলপথ ধরে হেঁটে একটা আমবন আর একটা তেঁতুলবন পেরিয়ে দেবীর গাঁয়ের বিভূতি পাড়ায় যেতে লাগল। জোর ঝোড়ো হাওয়া বইছিল। সতীশের হাত ফসকে শূন্য ডালি কোথায় উড়ে গেল। যাক।
পদ্মকে তো পেলাম। সতীশ মুচকি হাসল।
বাড়ি পৌঁছতেই ঝমঝম বৃষ্টি শুরু হল।
অন্ধকার দাওয়ায় বসে রইল সতীশ।
তার কেমন ঘোর লাগে।
চারিদিকে বৃষ্টির শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। আর অন্ধকার। আর বৃষ্টির শব্দ। কেমন ঘোর লাগে তার। গায়ে বৃষ্টির ছাঁট লাগে।
তার ভ্রুক্ষেপ নেই। একবার খালি কিরণময়ীর কথা মনে পড়ে গেল। রাতে বাড়ি না- ফিরলে দুশ্চিন্তা করবে ঠিকই । তবে বুঝবে ঝড়জলে কোথাও আটকে আছে। শক্ত মনের মানুষ কিরণময়ী।
এক সময়বৃষ্টি ধরে এল। ব্যাঙের ডাক শুরু হল। ভেজা বাতাস। বাতাসে শ্যাওলার গন্ধ। সতীশ বসে থাকে তো বসেই থাকে।
ঘরের ভিতরে সাড়া শব্দ নেই। কোথায় গেল সবাই? ঠাকুর আমায় কোথায় নিয়ে এলেন?
একটু পর প্রদীপ জ্বালিয়ে পদ্ম এল। হাতে মাটির পাত্র। তাতে জল। বলল, তুমি হাতমুখ ধুয়ে নাও।
ভাত বাড়ছি। বলে প্রদীপ রেখে চলে যায় পদ্ম।
সতীশ হাতমুখ ধুয়ে নিল। মনে মনে ভাবল, মেঘবৃষ্টিতে আজ রাতের আষাঢ়ী পূর্ণিমা ভেস্তে গেল।
পদ্ম একটি কাঁসার থালায় আতপ চালের ভাত আর বেগুন ভর্তা নিয়ে এল।
খেয়ে পরম তৃপ্তি পেল সতীশ। জিগ্যেস করল, কে রাঁধলে শুনি?
পদ্ম বলল, কে আবার? আমি। মেলা থেকে ফিরে শুনি মার জ্বর।
খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ল সতীশ।
পর দিন সকালে ঝরঝরে রোদ উঠেছে।
সতীশ দাওয়ায় এসে বসল। উঠানে রোদ। থিকথিকে কাদা। কাদার ওপর মুরগী আর লাল রঙের একটা কুকুর ঘুরছে। ওপাশে কলাঝোপ।
তারপর পুকুর।
পদ্ম একটি কলাইয়ের থালায় মুড়ি রেখে গেল। বলল, বাবা ভোরে বেড়িয়ে গেছে। আজ মইনুদ্দীনের পুকুরে জাল ফেলা হবে।
আমারও যাবার সময় হল মা।
সতীশ বলল।
দাঁড়ান। আমি মাকে ডাকছি। আপনি আমায় রাধামূর্তি উপহার দিলেন। মা তোমাকে একটি বার চোখে দেখতে চায়।
বলে চোখের পলকে ভিতরে চলে গেল পদ্ম।
পদ্মর মা এল। মাঝবয়েসি প্রসন্ন চেহারা। নাম মৃণালিনী।
পদ্ম বলল, আমার মা।
সতীশ মাথা নাড়ে।
মৃণালিনী প্রণাম করে ।
শরীরের গতিক এখন কেমন? শুনেছি নাকি জ্বর এসেছিল?
হ্যাঁ। শরীর এখন ভালো।
বেশ।
মৃণালিনী মেয়েকে বলল, যা না মা। ওর গামছায় কিছু চিড়ে গুড় বেধে দে না। একটু পর উনি যাত্রা করবেন। পথে খিদে পেলে যা হোক একটা গুড় চিড়ে খাবেন। চর পাড়া কি কম দূর।
পদ্ম গামছা নিয়ে ভিতরে চলে যায়।
সতীশ এক মুঠো মুড়ি মুখে ফেলে জিজ্ঞেস করল, সত্যি করে বলুন তো আপনিই কি পদ্মের গর্ভধারীনি?
মৃণালিনী ফুঁসে উঠল। মুখখানি সহসা কালো হয়ে উঠল। বলল, ওমাঃ একি কতা বলছেন আপনি । দশ মাস দশ দিন যন্ত্রণা সহে তাহলে কে পদ্ম কে গর্বে ধরল শুনি? আপন কন্যেকে নিয়ে মিথ্যে বললে ভগবান রুষ্ট হবেন।
সতীশ মাথা নেড়ে বলল, বুঝেছি বুঝেছি আর বলতে হবে না।
আমাকে কেন আপনি এ কথা জিজ্ঞেস করলেন? মৃনালিনীর কন্ঠস্বর তীক্ষ্ম।
সতীশ বিষন্ন সুরে বলল, আজ থেকে পনেরো বছর আগে আমার মেয়ে চৈত্র সংক্রান্তির মেলায় হারিয়ে গেছে। আমার মেয়েটি দেখতে পদ্মর মতো।
ওহ্।
এবার বুঝেছি। মৃণালিনীর মুখেচোখে নরম ভাব ফুটে উঠল। তাই বিনে পয়সা পুতুল দিলেন?
হ্যাঁ।
তারপর পদ্মর হাত থেকে চিড়ে গুড় ভর্তি গামছাখানি নিয়ে পদ্ম কে আর্শীবাদ করে ধূতির খুঁটে চোখের জল মুছে সতীশ চর পাড়া রওনা হল।
সতীশ বাড়ি ফিরে এল দুপুর নাগাদ।
সকাল থেকেই শরীর দূর্বল ঠেকছিল। এবার জ্বরে পড়ল । পাশের বাড়ির পরেশ কে দিয়ে মৌলভী ইসমাইল কে খবর পাঠাল করুণাময়ী। বিপদেআপদে মৌলভী ইসমাইলই ভরসা। বিকেলের দিকে মৌলভী ইসমাইল এলেন।
নাড়ি টিপে, চোখের রং দেখে বললেন, হুমম। জন্ডিসের ধাত দেখছি। তিনবেলা একটা করে কাবেদ নৌশাদুরী বড়ি খেতে হবে। তাতে জ্বর নিবারণ হবে। বলে ব্যাগ খুলে বড়িগুলি কিরণময়ীর হাতে দিলেন।
মৌলভী ইসমাইল হাট থেকে এসেছিলেন। পল্টু ঘোষ গরম গরম জিলাপি ভাজছিল। দিদির জন্য তাও সেরখানেক এনেছিলেন।
কিরণময়ীর চোখে জল এসে গেল।
জ্বরগ্রস্থ সতীশের মনে সারাক্ষণ পদ্মের মুখ ভাসছে।
পদ্মর কথা কিরণময়ী কে কিছু বলল না সতীশ। শুনলে কিরণময়ী কষ্ঠ পাবে।
সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে সেরে উঠল সতীশ । পুতুলের ডালা নিয়ে হাঁটে বেচতে গেল । ফেরার পথে পত্নীতলায় বিজন মাঝির সঙ্গে দেখা।
বিজন মাঝির পরনে নতুন লুঙ্গি, নতুন ফতুয়া। হাতে মিষ্টির হাঁড়ি। সতীশের শরীর তখনও দূর্বল ছিল। মুখে তেতো তেতো ভাব। তা সত্ত্বেও সতীশ হেসে বলল, কি রে বিজন ... তোকে দেখে মনে হচ্ছে তুই শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিস?
বিজন লাজুক হেসে বলল, আমি তো বিয়ে করে ফেলেছি খুড়ো।
বিয়ে করে ফেলেছিস! বলিস কি!
হ্যাঁ গো খুড়ো।
বিয়ে করে ফেলেছিস! বেশ বেশ। তা তোর বউ কোন্ গায়ের মেয়ে রে?
শ্রীরামপুরের দেবীর গাঁয়ের।
বেশ, বেশ। দেবীর গাঁ শুনে কি একটা ভাবনা চকিতে উঁকি দিয়ে গেল।
সতীশ জিজ্ঞেস করল, তা বিয়ের সম্বন্ধ কে করল রে?
ইসমাইল হৌজুর। ।
বলিস কি!
হ্যাঁ গো খুড়ো। মৌলভী সাহেব আমার শ্বশুর বাড়ির চিকিৎসা করেন। সেই সূত্রেই সম্বন্ধ নিয়ে এলেন।
দু’ সপ্তাহ মৌলভী ইসমাইলের সঙ্গে দেখা হয়নি। হয়তো বিজনের বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। সতীশ বলল, তা তোর বউকে নিয়ে একদিন আমার বাড়ি আয় বিজন। তোর খুড়িকে দেখিয়ে নিয়ে যাস।
যাব খুড়ো।
বিজন বলল।
এক বিকেলে বিজন এল। ভাদ্র মাস। বিকেলের দিকে মেঘ জমেছিল আকাশে ।
আশ্চর্য! নতুন বউয়ের সাজে পদ্মকে চমকে উঠল সতীশ।
পদ্মও কম বিস্মিত হয়নি। সতীশের পদধুলি নিল।
সতীশ ঘুরে চট করে ঘরে ঢুকে বলল, দেখ কে এসেছে।
কিরণময়ী কাগজের ওপর পার্বতীর নকশা আঁকছিল। মুখ তুলে বলল, কে এসেছে?
পদ্ম এসেছে।
পদ্ম এসেছে?
হ্যাঁ গো। তোমার পদ্ম ঘরে ফিরে এসেছে।
বল কি! কই দেখি-
কিরণময়ী দাওয়ায় এসে দাঁড়ালেন।
পদ্ম কিরণময়ী থেকে থমকে দাঁড়াল। এমন জ্যোর্তিময়ী রূপ।
আগে কখনও দেখেনি ও। অভিভূত হয়ে প্রণাম করে।
থাক থাক মা। বেঁচে থাক। বলে পদ্মকে বুকে জড়িয়ে নিল কিরণময়ী।
আর মনে মনে বলল, দেব দেবীর মূর্তি গড়তে গড়তে ভগবানকে কত করে বলেছি তুমি আমার মেয়েটিকে আমার বুকে ফিরিয়ে দাও। মৃত্যুর আগে আমি যেন আমার পদ্মকে নিজ চোখে একবার দেখতে পাই। আজ তুমি ফিরিয়ে দিলে। আমার আশা পূর্ণ করলে ঠাকুর।
পদ্ম কিরণময়ীর আলিঙ্গন মুক্ত হয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, আশ্চর্য!
আশ্চর্যের কি হল মা? কিরণময়ী জিজ্ঞেস করল।
এ বাড়ির সব আমার কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। মনে হয় আগে দেখেছি। পদ্ম বলল।
কিরণময়ী হেসে বলল, জগৎই যখন তোমার মা তখন তো সব তো চেনা চেনাই ঠেকবে।
সতীশও কথাটা শুনে অবাক হল।
পদ্ম জিগ্যেস করল, বাড়ির পিছনে পানা পুকুর আছে না?
তা আছে। এখন অবশ্যি মজে গিয়েছে।
পানা পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে যজ্ঞিডুমুরের গাছ ...
হ্যাঁ। তাও আছে।
উত্তর ধারে বাঁশ বন।
আছে।
বাঁশ বনের ভিতর টুসুর দেবীর থান?
আশ্চর্য! এবার সতীশ আর কিরণময়ী সত্যিই চমকে উঠল। পদ্ম চার বছর বয়েসে চৈত্র সংক্রান্তির মেলায় হারিয়ে গিয়েছিল । ওর কি বাঁশ বনের ভিতর টুসুর দেবীর থানের কথা মনে আছে? ভারি আশ্চর্য তো!
বিজন মাঝি বুঝছিল না কিছু। সে বোকার মতো দাওয়ার ওপর ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।
কিরণময়ী স্বামীকে বললেন, শোন, ঘরে তোমার মেয়ে আর মেয়ে জামাই এসেছে। এদের মিষ্টি মুখ করাও। এখন একবার হাটে যাও।
না না থাক। পদ্ম বলে ওঠে।
সতীশ বলল, থাকবে কেন-আমি এখুনি হাটে যাচ্ছি। আজ তোমায় আমি সেতু ময়রার গরম গরম রসগোল্লা আর পল্টু ঘোষের রসালো জিলাপি খাওয়াব মা। সেতু ময়রার গরম গরম রসগোল্লা আর পল্টু ঘোষের রসালো জিলাপি মুখে দিলেই বুঝতে পারবে কোন গাঁয়ে তোমার বিয়ে হয়েছে।
সতীশের কথা শেষ হল না- মৌলভী ইসমাইল এসে দাঁড়ালেন উঠানে । হাতে মিষ্টির হাঁড়ি।
সতীশ বলল, আসুন আসুন। আজ আমার কী সৌভাগ্য। আজ আমার ঘরে চাঁদের হাঁট বসেছে।
মৌলভী ইসমাইল হেসে বললেন, আমি চাঁদের হাট না হলেও গাঁয়ের হাট থেকেই এলাম। সেতু ময়রা গরম গরম রসগোল্লা তৈরি করছিল।
ভাবলাম দিদির জন্য সের দুয়েক নিয়ে যাই। আর পল্টু ঘোষ গরম গরম রসালো জিলাপি ভাজছিল। হাতে সের খানেক ধরিয়ে দিল। গত মাসে ওর ছেলের হামজ্বর হয়েছিল। আরক ওন্নাব খাইয়ে ঠিক করেছিলাম কিনা।
মৌলভী ইসমাইল- এর কথায় অনেক দিন পর শোকার্ত কিরণময়ী হেসে উঠল। তার চোখ দুটি অশ্রুতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলেও সহসা মেঘ কেটে ঝলমলে রোদ উঠে চারিদিকে সোনালি আলোয় ভরে তুলল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।