যা লিখি, হয়ত কিছুই লিখি না। যা লিখব হয়ত অনেককিছুই লিখব। আসল কথা হলো, গল্প ছাড়া কিছুই লিখতে পারি না
১))
প্রায় দশ বছর পর বাবাকে দেখলাম। শেষবার যখন দেখি, আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম দোতলা বাড়ির বারান্দায় নিশ্চুপ দেয়ালের মতো। দেয়ালের কান আছে এমন কথা মাঝে মাঝে শোনা যায়, আমিও সেদিন সেই শোনা কথার আদর্শ ধরে রাখার জন্য কিছু কথা শুনে ফেলেছিলাম।
নিচে দাঁড়িয়ে বাবা বলছিল, নামবি না খোকা?
আমি তখন দেয়ালের মতো অনঢ়। বাবা যখন দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল, তখন কিছুটা সচল হয়ে উৎসুক চোখ নিয়ে বাইরে এদিক-সেদিক তাকিয়েছিলাম।
এই দশ বছরে বাবা কত বদলে গেছে। বয়স যেন বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। মাস্ক মুখে, সারা হাত-পায়ে কিসব জানি লাগানো।
বাবাকে মনে হচ্ছে বৃদ্ধ কেউ। আমি পাশে গিয়ে তাকালাম কিন্তু বাবা দেখল না। পাশে মনিটরে অদ্ভুত কিছু চিহ্ন ওঠানামা করছে।
তোমার বাবা, এখন কোমায়। এজন্য আসতে বলেছিলাম।
পেছনে তাকিয়ে দেখি বয়স্ক মতো এক লোক। মলিন একটা শার্ট পড়নে। চোখে-মুখে রাজ্যের আধাঁর।
কোমা জিনিষটা কী এই সম্পর্কে খুব একটা ধারনা নেই। তবে বুঝে নিলাম, অবস্থা ভালো না।
লোকটাকে খুব চেনা চেনা লাগছে। চিনতে পারছি না।
মনের কথাটি বুঝতে পেরেই যেন তিনি বললেন, আমি তোমার আজমল চাচা। এসো বাইরে গিয়ে কথা বলি। নামটি শোনার সাথে সাথে ভেতরে স্মৃতির হুটোপুটি শুরু হয়ে গেল।
নাহ! তেমন কিছু মনে পড়ছে না।
ধীরপায়ে দুজন রুম থেকে বের হয়ে এলাম। হাঁফ ছেড়ে একটা নিঃশ্বাস নিলাম। নলবন্ধ বাবাকে দেখতে ভালো লাগছিল না। মনে হচ্ছিল, বাবা পেছন থেকে ডাক দিয়ে বলবেন- খোকা, এতদিন পর এলি? আবার চলে যাচ্ছিস? মন ভারী হয়ে গেল।
ছেড়ে দেওয়া নিঃশ্বাস দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে ফুসফুসে চাপ দিতে শুরু করল।
এরপর যা হলো তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। চাচা আমাকে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। কি বলব বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে থাকি স্থির।
আশরাফের চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে, তুমি কিছু সাহায্য করতে পারবে?
কথাটা কানে কট করে লাগল।
আর ব্যাথা গিয়ে লাগল বুকের কোথায় যেন।
এতদিন পর বাবা ডেকে পাঠিয়েছে, এই ভেবে উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে ছুটে এসেছিলাম। বাবার অবস্থা দেখে তীব্র একটা মন খারাপের অনুভূতি আমাকে অবশ করে ফেলছিল। টাকা নিয়ে সমস্যা শুনে আর থাকতে পারলাম না। চাচার বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে বললাম, নিয়ে আসছি আমি।
এক মুহূর্ত আর দাঁড়ালাম না।
বয়স হবার পর বুঝতে পারি, বাবা-মা’র বিয়েটি ছিল বিশাল একটি ভুল। বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে আর কৃষক বাবার ছেলে- বাংলা সিনেমার মতো ঘুরে ফিরে এক-ই স্ক্রিপ্টে জীবনের হিসেব লেখা হয় না। যদি বিয়ে না হতো আমার এই পৃথিবীতে আসার কোনো সুযোগ ছিল না। আমি ভুলে করে এসেছি কিন্তু ভুল করেও যেতে পারছি না।
আসলে যেতে চাই না। একটা ভুল মানুষ পৃথিবীতে কী করতে পারে, সেটা দেখার খুব শখ।
মেয়েদের দিকে আড়চোখে তাকাতে ভালো লাগে। পাশের বাসার এক কিশোরী মাঝে মাঝে বেণী দুলিয়ে সিড়ি দিয়ে নেমে যায়। কখনো দরজার ফুটো দিয়ে, কখনো সিড়িঘরের পেছনে দাঁড়িয়ে আমি তাকে দেখি।
একদিন তাকে দেখেছিলাম বৃষ্টিতে ভিজতে,চিলেকোঠার ঘরে বসে দরজার ফাক দিয়ে। মানুষকে যে কখনো পরী মনে হয় কিংবা মনে হতে পারে সেদিন-ই আমি প্রথম জেনেছিলাম। আমার একমাত্র বন্ধু রিশাদকে কথাটা বলতেই সে হেসে বলেছিল, তুই প্রেমে পড়েছিস। প্রেমে পড়লে মানুষ পেত্নীকেও পরী ভাবে। ভীষণ রাগ হয়েছিল আমার।
একবার ভেবেছিলাম রিশাদকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দিব। বলব- এই দেখ আমার পরী। বলা হয়নি। নিজেই পরিচিত হতে পারিনি। রিশাদকে কিভাবে পরিচয় করিয়ে দিব? পরিচয় হতে অবশ্য চাইনি কখনো।
যার জন্ম হওয়ার কথা ছিল না, তার আবার কিসের পরিচয়? কীসের প্রেম? রিশাদ আবার গল্প লেখে। ও বলেছে আমাকে নিয়ে একদিন গল্প লিখবে।
আজ, রাস্তা ধরে বাবার জন্য টাকা আনার জন্য যখন ছুটছি তখন হঠাৎ কথাটি মনে পড়ল। রিশাদ গল্পটা কিভাবে লিখবে আমার জানার খুব শখ। সেই শখটা এই মুহূর্তে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।
বাসায় ঢুকতেই মা’র সাথে দেখা।
কীরে কই গিয়েছিলি?
আমি কিছু না বলে চুপচাপ ঘরে চলে আসি। মা কোথায় টাকা রাখে আমি জানি। সেখান থেকে কিছু টাকা সরিয়ে নিব। রিশাদ একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তোর মা’র উপর তোর কী খুব রাগ?
আমি চুপ করে ছিলাম।
কিছু বলতে ইচ্ছে হয়নি। মা’র উপর আমার রাগ নেই। একদম নেই। এই কথাটি রিশাদ বুঝতে পারত। মা’র উপর রাগ থাকবে কেন? আমাকে ঠিকভাবে মানুষ করার চেষ্টা করেছেন।
বাবার সাথে তার সমস্যা ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি সেখানে কী করব?
রুমে ঢুকে নিয়ে পুরনো ডায়েরীর ভাজে লুকানো একটি চিঠি বের করলাম। চিঠিটি আমি কলেজে ভর্তি হবার সময় লিখেছিলাম, বাবাকে। ছোট্ট চিঠি।
বাবা,
আজ আমার কলেজে প্রথম দিন।
আমি অনেক বড় হয়ে গেছি। তুমি হয়ত জানো না, আমি এখন একা একা হাঁটতে পারি, দৌড়াতে পারি, যে কোনো জায়গায় যেতে পারি। কিন্তু, জানো বাবা আমি এখন আর চকোলেট খেতে পারি না। তুমি প্রতিদিন অফিস থেকে আসার পথে চকোলেট নিয়ে আসতে। এখন আর কেউ না।
বড়দের কেউ হয়ত ওসব দেয় না। আমি জানি, তুমি ঠিক দিতে। আমারও খুব ইছ করে খেতে।
চলে যাবার আগের মাসেই বলেছিলে সাইকেল কিনে দিবে। এখনো আমার সাইকেল চালানো শেখা হলো না।
অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করে, খোকা তুমি বড় হয়ে কি হবে? আমি তাদের কিছু বলি না। তোমাকে বলি- আমার একটা টাইম মেশিন বানানোর খুব শখ। সময়কে পেছনে নিয়ে যাব। তোমাকে তখন আর একা একা যেতে হবে না। আমিও পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে আসব।
মা’র জন্য তখন খারাপ লাগতে পারে। এক কাজ করলে কেমন হয়, সময়কে পিছিয়ে ওখানে নিয়ে যাব, যেখানে তোমাদের ঝামেলা শুরু হয় নি?
আজ প্রায় তিন বছর পর চিঠিটা পড়ে হেসে ফেলি। বয়সের তুলয়ায় বড় মানুষের চিঠি। নাকি ছোট?
শার্টের বুকপকেটে চালান করে দেই চিঠিটা।
২))
হসপিটালে পৌছে দেখি চাচা উদভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি করছে।
একবার আমাকে শুধু বললেন, তোমার বাবা মারা গেছে। মা’কে ফাঁকি দিয়ে আনা টাকাটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বাইরে তখন বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। আবার চাচাকে দৌড়ে আসতে দেখলাম, আমার দিকে। বললেন টাকা আনতে পেরেছ?
আমি হাত বাড়িয়ে বিশ হাজার টাকার দু’টো বান্ডিল এগিয়ে দিলাম।
যাও, ভেতরে গিয়ে দেখে এসো। টাকাটা হাতে নিয়ে তিনি বিল পরিশোধ করতে ছুটে গেলেন বলেই মনে হলো।
চুপচাপ বের হয়ে এলাম। বৃষ্টির সাথে সাথে এখন বাতাস বইছে। নিমিষেই রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে গেছে।
চোখ দিয়ে মনে হয় জল পড়ছে। আমার নতুন বাবা যখন মাঝে মাঝে আমাকে কুত্তার বাচ্চা কিংবা আরো ভয়ঙ্কর কিছু বলে গালি দেন তখনো আমি কাঁদিনি। আজ অবশ্য কাঁদার মতো একটি দিন। বৃষ্টির বড় বড় ফোটায় স্নাত হচ্ছি বলে খুব সম্ভবত চোখের জলকে আলাদা করতে পারছি না। মনের ভেতর কেমন যেন গুমড়ে ওঠা একটি অনুভূতি।
আমি হাঁটতে থাকি, কোথায় কোন দিকে জানি না। এক ফাকে বুকপকেটের চিঠিটি উড়িয়ে দিলাম। ভেজা রাস্তায় নির্মম পতনের পর বৃষ্টিজলে ধুঁয়ে যেতে থাকে অক্ষরগুলো। টের পাই, মনের ভেতরে অক্ষরগুলো যেন প্রতিমুহূর্তেই জ্যান্ত হয়ে রক্তাক্ত করছে ভেতরটাকে। এদিক-সেদিক তাকিয়েও কোথাও রক্তের ফোঁটা দেখতে পাই না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।