নির্মাণ চলছে......
ফেনী থেকে ঢাকা আসবো। বাস স্ট্যান্ডে টিকেট কাটতে গিয়ে দেখি এক যাত্রীকে সিট খালি থাকা অবস্থায়ও টিকেট দিচ্ছেনা কাউন্টারের লোকজন। যাত্রী অনেক অনুনয় করলেও তাকে টিকেট দেয়া হচ্ছেনা। টিকেট দিতে পারে এক শর্তে- এ যাত্রী একসাথে দুটি টিকেট নিতে হবে এবং পাশের সিট খালি থাকবে। এর কারণ কি জানতে চাইলে টিকেট কাউন্টারের লোকজন বলে হিজড়াদের সাথে কেউ সিট নিতে চায় না।
আমি বললাম-আমার পাশের সিট দিন। উনি আমার পাশে বসবে। টিকেট কাউন্টারের লোকজন অবশেষে বললো- আপনার সমস্যা না থাকলে আপনার পাশে সিট দিতে পারি। আমি বললাম-সমস্যা নেই, দিন। বাস ঢাকার উদ্দেশ্যে ছাড়ে।
কিছুক্ষন নিরবতার পর জানতে পারি তার নাম রেনুবালা। তারপর এগুতো থাকে কথোপকথন। শিশু বয়স না পেরুতেই রেনুবালাকে ঘর থেকে বাহির করে দেয় তার বাবা মা। রেনুবালার ৩ ভাই ১ বোন। রেনুবালাসহ তার বাবা মায়ের ৫ সন্তান।
৩ বছর বয়সেই শরীরের পরিবর্তন দেখা দেয় তার। তখন থেকেই পারিবারিক ও সামাজিক বৈষম্যৈ স্বীকার রেনুবালা। স্কুলে ভর্তি হতেও পারেনি। ছোট্ট এক কুড়ে ঘরে ছিল তার দিন ও রাত যাপন। বাইরে বের হওয়া নিষেধ।
রেনুবালার বয়স যখন ১০ তখন তার বড় বোনকে পাত্রপক্ষ দেখতে এলে রেনুবালা হিজড়া হওয়ার কারণে ভেঙ্গে যায় বোনের বিয়ে। যেদিন পাত্রপক্ষ মুখ ফিরিয়ে নেয় সেদিনই রেনুবালার বাবা, মা তাকে চুল ধরে এক কাপড়ে ঘর থেকে বের করে দেয়। ঘর থেকে বাহির হয় রেনুবালা। ১০ বছরের রেনুবালা কোথায় যাবে? অসহায় হয়ে মন্দিরে গিয়ে কান্নাকাটি করেন রেনুবালা। মন্দিরেও তার বেশিক্ষন জায়গা হয়নি।
মন্দির কমিটির লোক বাহির করে দেয়। মন্দিরের বাইরে কান্নাকাটি করায় মন্দির কমিটির এক সদস্য হিজড়াদের একটি পাড়ায় তাকে তুলে দিয়ে আসে। তারপরের ঘটনাগুলো রেনুবালার আরো কষ্টের আরো গ্লানীর। আমাদের দেশে প্রায় সব হিজড়াদের এমন দূঃখবোধের গল্প রয়েছে। তারা না পায় পরিবারের কাছে আশ্রয়, না পায় সমাজের, না ধর্মের কাছে।
এদের জায়গা কোথাও নেই। অন্য সবার মতোই একজন হিজড়াও কোন মায়ের গর্ভে জন্মগ্রহণ করে। প্রকৃতির খেয়ালে আমাদের মায়ের মতোই কোন মায়ের গর্ভে, আমাদের পিতার মতোই কোন পিতার ঔরসে হরমোনজনিত সমস্যার কারণে শারীরিক ভিন্নতা নিয়ে জন্ম নেন কিছু হতভাগ্য মানুষ। যাদেরকে কোন একটা পর্যায়ে স্নেহময়ী মা, দায়িত্ববান পিতা, পরিবার ও সমাজ অস্বীকার করেন।
সমাজের বাকি অংশের মতো সে বাড়ার সুযোগ পায় না।
স্কুলে যাওয়ার সুযোগ তার হয় না। সমাজের ব্যঙ্গ, বিদ্রুপের হাত হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য এক সময়ে পরিবারের সদস্যরা তাঁকে রেখে আসেন তারই মতো হিজড়া সম্প্রদায়ের কাছে। তারপর পেটের দায় মেটাতে রাস্তায় ভিক্ষাবৃত্তি, শারীরিক অঙ্গভঙ্গি, পতিতাবৃত্তি, নতুন কোন শিশুর জন্ম হলে নাচগানের মাধ্যমে উপার্জন করতে হয় তাদের। আর এ উপার্জনের পথে তাদের সহ্য করতে হয় নানা দুঃসহ অভিজ্ঞতা। রাস্তাঘাটে কটুক্তি আর উপহাস তাঁদের নিত্যদিনের সঙ্গী।
স্বস্তিতে কোথায়ও বসবাস করবেন এ উপায়ও নেই। স্বাভাবিক পরিবেশ বলতে যা বোঝায় সেখানে কেউ তাদের থাকতে দিতে চায় না। ঢাকা শহরের বেশিরভাগ হিজড়াই বস্তিতে বসবাস করেন।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার ভাগের ৩৯ অনুচ্ছেদের ২ ধারার 'ক' উপধারা মোতাবেক রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। এই বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার সর্বোচ্চ স্বীকৃতি হচ্ছে নিজের পছন্দানুযায়ী প্রতিনিধি নির্বাচন।
স্বাধীনতার ৩৮ বছর পর্যন্ত এরা ভোট দিতে পারেননি। এ মৌলিক অধিকার থেকে তাদের ৩৮ বছর বঞ্চিত করা হয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাদেরকে ভোট প্রয়োগের ক্ষমতা দেয়া হলেও অনেক হিজড়াদের অভিযোগ তাদেরকে জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার ক্ষেত্রে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। বাংলাদেশের সংবিধান রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির ১৫(ঘ) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হিসেবেই স্পষ্ট বলছে
‘সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতাপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্খিতিজনিত আওত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারী সাহায্য লাভের অধিকার। ’
এছাড়াও মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা হলো : দাসত্ব হতে মুক্তির অধিকার, ভোটের অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, কাজের অধিকার, মানসম্মত জীবন-যাপনের অধিকার, আইনের আশ্রয় ও নির্যাতন থেকে মুক্তির অধিকার এবং বিবাহ ও পরিবার গঠনের অধিকার।
ধর্মেও এদের ব্যাপারে স্পষ্ট কিছু নেই। এদের মৃত্যুতে জানাযা হলেও থাকে না মানুষের অংশগ্রহণ। মসজিদ মন্দিরেও এদের আশ্রয় মেলে না।
হিজড়াদের যৌনতা গতানুগতিক নয়। এটা একটু ভিন্ন।
বলতে গেলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরা এদের মতো জীবন-যাপন করে যা ইসলাম প্রধান দেশ হিসেবে জনগণ সহজে মেনে নেয় না। এমন কি ব্রিটিশ শাসন আমলে হিজড়াদের বিতাড়িত করা হয়েছে এবং হিজড়াদের যৌনতার বিরুদ্ধে আইন করা হয়েছে। ব্রিটিশ আইনে হিজড়াদের যৌনতাকে সডোমি হিসেবে চিহ্নিত করে এবং পেনালকোট এ ধারা ৩৭৭ তে বলা হয়েছে যে, এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই যদি আইন হয় তাহলে তারা কোথায় যাবে। ওদের যৌনতার অধিকার এবং মানবাধিকার কে নিশ্চিত করবে যদি রাষ্ট্র না করে।
পরিবারে সম্মানের সঙ্গে বসবাসের অধিকার, চাকরির অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার এবং তাদের ভালবাসা পাওয়ার অধিকার আছে। তারা কাজের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় বলে অনেকেই অনৈতিক কর্মকাণ্ড জড়িত হয়ে পড়ে।
অথচ সমাজের স্বাভাবিক আচরণ পেলে এই হিজড়ারাই হতে পারতেন একেকজন স্বাবলম্বী মানুষ। এদের মাঝ থেকেই সৃষ্টি হত প্রকৌশলী, চিকিৎসক, শিক্ষাবিদ কিংবা কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে খেটে খাওয়া মানুষ। মানবীয় আচরণ ও রাষ্ট্র প্রদত্ত নিরাপত্তার দ্বারা আমরা অবশ্যই সমাজের চির অবহেলিত এ সম্প্রদায়টিকে সমাজের মূল স্রোতে আনতে পারি এবং তা করণে আমাদের সাংবিধানীক বাধ্যবাদকতাও রয়েছে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদের ২ ধারায় বলা আছে, " মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধাদান নিশ্চিত করিবার লক্ষ্যে রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন"। সংবিধানের এ নির্দেশনা অনুযায়ী অনগ্রসর শ্রেণী হিসেবে হিজড়া সম্প্রদায়ের উন্নতির জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিক কর্মসূচি নেয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও বাধ্যবাদকতার মধ্যে পড়ে (সংবিধানের এ নির্দেশনা মোতাবেকই মহিলা, উপজাতি, অনগ্রসর জেলাসমূহের অধিবাসীদের জন্য সরকার বিশেষ কোটা ও কর্মসূচি গ্রহণ করেছে)। আমরা জানি যে, একটি দেশের উন্নতি মানে দেশের সকল শ্রেণীর সকল পর্যায়ের জনগোষ্ঠীর উন্নতি। তাই দেশের সকল পর্যায়ের সুষম অর্থাৎ দেশের সার্বিক উন্নতির জন্য আমাদের অবশ্যই এ অবহেলিত হিজড়া সম্প্রদায়কে সমাজের মূল স্রোতে আনতে হবে। বিশ্বের দরবারে নিজেদেরকে একটি সভ্যজাতি হিসেবে পরিচিত করতে হলে এর কোন বিকল্প নেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।