সত্য একবার বলতে হয়... সত্য বারবার বললে মিথ্যার মত শোনায়... মিথ্যা বারবার বলতে হয়... মিথ্যা বারবার বললে সত্য বলে মনে হয়...
পর্ব-১
সময়: বিকেল ৪.৪৫।
টি.এস.সির ভেতরে বারান্দার ঠিক মাঝামাঝি একটা জায়গায় একা একা বসে ছিল একটি মেয়ে।
শ্যামলা, ছিপছিপে গড়ন, চোখে-মুখে একটা স্পষ্ট কাঠিন্য। ঘর্মাক্ত চেহারায় চিন্তা আর অস্থিরতা ছাপ। খুলে রাখা লম্বা চুলগুলোকে একটু পর পর খুব সন্তপর্ণে ঠিক করে নিচ্ছিল।
কপালে বিরক্তির রেখা টেনে বারে বারে মুঠোফোনটির দিকে তাকাচ্ছিল মেয়েটি! আশা করছিল একটা ফোন-কলের।
-উফ্!!বিরক্ত লাগতেছে!
-ধূর! চলে যাবো নাকি??
-নাকি আরেকটা ফোন দিয়ে দেখব?
-নাহ্! আমি ফোন দিব ক্যান?
-একবার দিছি। ধরে নাই! আমি আর দিব না! যার দেখা করার কথা তার যদি মাথা ব্যথা না থাকে তাইলে আমি ক্যান তারে নির্লজ্জের মত বারবার ফোন দিব!??
কথাগুলো নিজেই নিজেকে বলল তরু। খুব ইগো-কনফ্লিকশানে ভুগছিল মেয়েটা! ছেলেটার সাথে আজ দেখা করার কথা! সময় ঠিক করা হয়েছিল বিকেল চারটা বেজে তিরিশ মিনিট। অথচ অলরেডি পনের মিনিট পার হয়ে গেছে!
-যাদের সময় জ্ঞান নেই তারা কেন অন্যকে এক্সাক্ট টাইমে আসতে বলে নিজে দেরি করে?
আজকে শুক্রবার।
তাই প্রতিদিনের চে আজ টি.এস.সি একটু বেশিই জমজমাট। চারপাশে তরুণ-তরুণীরা জুটি বেঁধে বসে আছে। কেউ কেউ হাতে হাত রেখে আবার কেউ কাঁধে মাথা রেখে বসে বসে বন্ধু বা বান্ধবির সাথে জীবনে কি পেল আর কি হারালোর হিসেব মেলাচ্ছে। কয়েকটা কাপলের উগ্র আচরণে তরু ভ্রুকুটি করতে থাকে।
-পাবলিক প্লেসকে কেন যে মানুষ নিজের ড্রয়িংরুম বা বেডরুম ভেবে বসে থাকে! অসহ্য!!
কারো জন্য ওয়েট করার অভ্যাস নেই তরুর।
আর এভাবে এত লোকজনের মাঝে তো প্রশ্নই আসে না! সবাই নিশ্চয়ই ওকে ফলো করছে! ওকে অপেক্ষা করতে দেখে মনে মনে হাসছে আর ভাবছে দেখ বোকা মেয়ের কান্ড! কি লজ্জা!
এসব পাঁচ-সাত ভাবতে ভাবতে ফোনে ভাইব্রেট হল! স্ক্রিনের ব্যাক-লাইট টা ক্রমাগত জ্বলছে নিভছে। লেখাটা দেখল.. ফায়সাল কলিং। তার কাংক্ষিত কলার। হঠাৎ করে রেগে যাওয়াটা তার বিরাট একটা সমস্যা এবং এতক্ষণে ফায়সালের ফোন দেখে সে রেগে গেল। তুলেই বলল,
-আমি চলে যাচ্ছি! বাই!
ওপাশ থেকে...
-প্লিজ না না! আমি নীলক্ষেত থানার কাছে।
জ্যাম! এইতো আর একটু প্লিজ?
ফোন রেখে হ্যান্ডব্যাগ থেকে বের করে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বকে দেখল। শেষবারের মত নিজেকে গুছিয়ে নিল তরু।
তারপর একজোড়া কপোত-কপোতির দিকে টেরা চোখে তাকিয়ে ওদের প্রেমলীলা দেখতে লাগল। মনে মনে ভাবল, এমন জুটি দেখলে ঈর্ষা হয়। কি অদ্ভুত সুন্দর।
ভালোবাসা কি আসলেই এত মধুর হয়?
আরো কিছুক্ষণ পরে একটা ছেলে এসে টি.এস.সিতে ঢুকল। কিছু না বলে কয়ে ওর পাশে এসে বসে পড়ল। বসেই হালকা করে তার চুলে টান দিল। তরু হতভম্ব ভাব কাটিয়ে তুলতে না তুলতেই ছেলেটা বলে উঠল,
-হাই, আমি ফায়সাল। কোন ভুল করে না থাকলে তুমি তরু? রাইট? অ্যাম স্যরি।
আমি ঘুমিয়ে পড়ছিলাম। তাই লেইট হয়ে গেল! স্যরি!!
-হুম। আমিই তরু। আমাকে চিনলেন কিভাবে?
-তোমার চুল। বলছিলা না অনেক লং এন্ড স্ট্রেইট? ঢুকেই দেখলাম একমাত্র তুমিই আছ যার হেয়ার লং এন্ড স্ট্রেইট এবং যে একা একা বসে আছে।
-ও! তাই? যদি না হয়ে অন্য কেউ হলে শিউর গণপিটুনি খেতেন।
এই প্রথম ছেলেটার দিকে পুরোপুরি তাকাল ও।
অসম্ভব হ্যান্ডসাম, রুচিশীল পোশাক পরা, পরিপাটি পরিচ্ছন্ন একটা ছেলে। গায়ের রং হলদেটে, চুল গুলো ব্যাক-ব্রাশ করা। চোখগুলো অস্বাভাবিক ধারাল...ক্যাটস আই না ঠিক।
কেমন যেন... সবুজাভ। তাকানো যায় না। মনে হয় যেন মনের ভেতরের সব কথা ঐ দু'টো চোখ দিয়ে এখনি পড়ে ফেলবে! বয়স দেখলে চব্বিশের বেশি কেউ বলবে না। অথচ তরু জানে ছেলেটির বয়স ছাব্বিশ শেষ!
সে চোখ ফিরিয়ে নিল। ফায়সাল বলতে লাগল,
-গনপিটুনির সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও রিস্কটা নিয়ে দেখলাম আরকি এই বলে হেসে দিল ফায়সাল।
আর তুমি এখনও আমাকে আপনি করে বলছ কেন? আজিব!! তুমি করে বল!
-আসলে আমার খুব লজ্জা লাগছে। আমি নিজের থেকে বয়সে বড় কাউকে সহজে তুমি বলতে পারি না। ট্রাই করব।
-হাহাহাহাহাহ!!! এত ফরম্যাল!! মাই গড!! দেখো মেয়ে আমার সাথে এত ফরম্যালিটি দেখাতে হবে না। আমি আপনি না... তুমি শুনতেই বেশি পছন্দ করব।
আমার যেহেতু শুনতে কোন সমস্যা নেই তাহলে তোমার ডাকতে কি সমস্যা? এই বলে আবার ঠোঁটে কামড় দিয়ে এক চোট হেসে নিল ফয়সাল।
কোন ছেলের এত সুন্দর চাহ্নি আর নিখুঁত হাসি তরু মনে হয় এই জীবনে প্রথম দেখল! আর হঠাৎ করে ওর বুকের ভেতরটায় যেন কেমন করে উঠল। মনে হল এই ছেলেটাকে সে আগেও দেখেছে। ছেলেটার সাথে তার একটা জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্ক আছে। অবিচ্ছেদ্য কিছু একটা।
আশ্চর্য! অথচ আজই ওদের প্রথম দেখা! এসব ভেবে আবারো লজ্জা পেল সে।
এভাবেই প্রথম দেখার পর কথা শুরু হয়। মিনিট বিশেক থাকার পর ওরা সেখান থেকে বের হয়ে সোহরাওয়ার্দি ধরে হাটতে হাটতে কার্জনে পৌঁছায়। দুজনেরই তাড়া ছিল। তাই সেখান থেকে ছেলেটা মেয়েটাকে রিকশা করে দেয়।
রিকশায় উঠে তরু বিদায় জানাল,
-আচ্ছা। আজ তাহলে আসি? ভালো থেকো। আল্লাহ হাফেজ।
-সেটা ঠিক আছে। বাট নাউ এ্যাটলিস্ট মেক এ্যা রুম ফর মি....বলে তরুকে সরে বসতে ইশারা করল।
আমিও তোমার সাথে যাব।
তরু অবাক হয়ে জানতে চাইল,
-কোথায় যাবা?
-সেগুনবাগিচায় নামালেও চলবে। পল্টনে নামালেও চলবে।
বলতে বলতে তরুর মতামতকে পাত্তা না দিয়ে রিকশায় উঠে বসল ফায়সাল।
তরু হতভম্ব হয়ে বলল,
-ওকে, মাই প্লেজার!
ফায়সাল মূলত ঢাকা কলেজে ইংলিশে মাস্টার্সে পড়ছে।
সেই সাথে সাত বছর ধরে ঢাকা থিয়েটারের সাথে কাজ করছে। ঢাকা থিয়েটারের জন্য সেলিম আল-দীন একটা নতুন নাটক লিখেছেন, "নিমজ্জন"। সেটা চতুর্থবারের মত শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় মঞ্চস্থ হবে। নিমজ্জনের একটা ক্যারেক্টার করত ফায়সাল। সেগুনবাগিচাতে ওদের ঢাকা থিয়েটারের পুরো গ্রুপের রিহার্সেল হত।
তাই তরুর কাছে সেগুনবাগিচা পর্যন্ত লিফট চায় সে।
এভাবে পথে পথে নানা কথা আর হাসি তামাশায় কখন যে পথ শেষ হয়ে যায় কেউ টের পায় না।
ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। বাসায় ফিরেডানে বায়ে না তাকিয়ে সোজা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল তরু। আয়নায় নিজেকে দেখে রীতিমত অবাক।
চোখে মুখে কি একটা আভা, অন্যরকম দীপ্তি। মেয়েরা প্রেমে পড়লে যেমন মিটিমিটি করে হাসে, তেমনি এক রহস্যময়ী হাসি!
ও কি কখনও সৌন্দর্যের পূজারি ছিল?
যদি না-ই হয়ে থাকে তাহলে কেন এই ছেলেকে এত ভালো লাগল? ফোনে যখন দুইটা মাস কথা হল তখনতো ওর কাছে এতটা ভালো লাগেনি। ছেলেটার মাঝে ড্যাম পার্সন্যালিটি দেখেনি!
যখন ছেলেটা ওকে না দেখে প্রপোজ করেছিল তখন সাথে সাথে কাউকে না দেখে ভালোভাবে না জেনে কোন সম্পর্ক বা ভালোবাসায় বিশ্বাসী নয় বলে ফিরিয়ে দিয়েছিল। তারপর ফায়সাল যখন নিজেকে ভালোভাবে জানাতে চাইল তখন বারবার ফিরিয়ে দিয়েছিল।
তারপর গত কয়েকদিন ধরে যখন ছেলেটার হাজারো অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে আজ শেষমেষ দেখা করতে গেলো তখন কেন এমন হল? যাবার আগে তো ঠিক করে গিয়েছিল এসেই মানা করে দেবে।
তাহলে এখন এত অস্থির লাগছে কেন? কেন এরকম একটা অদ্ভুত ফিলিংস হচ্ছে?
একেই কি লাভ এ্যট ফার্স্ট সাইট বলে?!
হাসতে হাসতে সে গেয়ে ওঠে 'বৃত্তালপনা'...
~"জীবনের আলাপন, কত যে মায়া
শত মানুষের ভীড়ে, তোমায় পাওয়া
ভুলে ছিলাম "ভালোবাসা চাই"
ভালোবাসি না আমি তোমাকে, বলেছিলাম
ভালোবাসিনা আমি তোমাকে, কখনও না
ভালোবাসিনা আমি তোমাকে, স্বপ্ন দেখে যাও..
ভালোবাসিনা আমি তোমাকে, একদমই না
তুমি আমার কে?~"
(চলতে থাকবে। )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।