একটা অসম্ভব ভাবনা মাথায় ঢুকে গেছে। শুধু যে ঢুকেছে তাই নয়, মৌমাছির মত বিরামহীন গুঞ্জনে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক অনুরণনে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। গুনগুন করে বলছে, চমৎকার একটা প্লট নিয়ে এসেছি, গল্পটা লিখেই ফেল এবার। প্লটটা আমার জানা। একঘেয়ে প্যানপ্যানানির চিরন্তন মহান কাহিনী।
বালক বালিকার ডায়েরিতে এমন লেখা অহরহ পাওয়া যায়। কিন্তু এই মধুমক্ষিকা যে একেবারেই রেহাই দিচ্ছেনা। একটা কাজ করা যেতে পারে, ওর প্লটে আমার পাকা মাথার কিছু বুড়োটে বুদ্ধির মিশেল দিয়ে জিনিসটাকে একটু ভারি করে তুলি, তারপর কিছু মোক্ষম কোটেশনের যুতসই প্রয়োগ। এ জিনিস ধারে তো কখনো কাটবেনা, ভারে কাটার একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা হয়ত তৈরি হবে। আর না হলেই বা কি।
এই ক্রমাগত গুনগুন তো থামবে। আর আমিও নটে গাছটা মুড়োল বলে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারব।
সব গল্পের মতই এই গল্পে কটা ছেলে আছে, কটা মেয়েও আছে। বেঁচে বর্তে থাকলে, অর্থাৎ গল্পটা কিছুটা প্রলম্বিত হলে এই সব বালখিল্যের দলও হয়ত বাবা মা হবে। সংসারে ঢুকবে, সেখানে দুঃখ পাবে আর দুঃখ দেবে।
সে অনেক পরের কথা, আপাততঃ দেখা যাক এই গুনগুনানি কতদূর টানা যায়।
এটা Absurd নাটক নয়, সুতরাং স্থান কালের কিছুটা বিবরণ না দিলে রীতিভঙ্গ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। আর সমালোচক যদি এ লেখার সন্ধান পায়, তো এমনিই তুলো-ধুনো করবে। তাই প্রথমেই রীতি-ভঙ্গ না করে ধুনুচির কাজ কিছুটা কমানো যাক। তাতে অনুলেখকের লাভ বই ক্ষতি নেই।
গল্পের শুরু হোক ঢাকায়। দুটো কারণে; প্রথমতঃ গল্পের অনুলেখক ঐ শহরটাকে এক সময় খুব ভাল করে চিনত। দ্বিতীয় কারণ মৌমাছির ধারনা এ গল্পের শুরু ওখানেই। অতএব ঢাকা। ১৯৭৪ এর ঢাকা।
মন্বন্তরের ঢাকা। রাস্তায় কংকালসার লাশের দেখা পাওয়া যায়। ক্ষুধার্ত জনতা ডাস্টবিন ঘাঁটে। কেউ রুখে দাঁড়ায় না। যাদের ঘরে খাওয়ার আছে তারা নিশ্চিন্ত।
খাওয়ার লুট হওয়ার কোন আশঙ্কা নেই। মাত্র দু বছর আগে যারা অমিত বিক্রমে রুখে দাঁড়িয়েছিল শত্রুর বিরুদ্ধে, বেয়নেটের আগায় স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে মেতে উঠেছিল উল্লাসে, তারা ক্ষুধার বিরুদ্ধে বড়ই অসহায়। ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। আশ্চর্য ব্যপার তখন দুটো। বাংলাদেশেরই কোন কোন অন্চলে তখন শস্যের প্রাচুর্য।
কিন্তু রহস্যময় কারণে সে খাবার পৌঁছচ্ছেনা দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের কাছে। অন্যদিকে পৃথিবীর অন্যতম সভ্য দেশ আমেরিকা ২.২ মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য বাংলাদেশের জন্য জমিয়ে রেখেছে। এই বিশাল দয়ালু দেশটার শুধু ক্ষুদ্র দুটি শর্ত; প্রজাবৎসল সম্রাটের সামান্য আবদার ; “আমার ভৃত্যের ভৃত্যেরা দুবছর আগে তোমাদের দেশে মাত্র কয়েক লক্ষ লোক মেরেছে, কিছু মেয়ের সম্ভ্রম লুটেছে, তা আমার চাকর বাকরেরা মাঝে মাঝে অমন কাজ করেই থাকে, লোক ওরা মন্দ নয়। ওদেরকে ছেড়ে দিতে হবে। বিচার টিচার এসব ঝামেলা করোনা বাবারা।
আর ঐ বদমাশ ক্যাস্ট্রোকে যে তোমরা পাট নামক মারণাস্ত্র পাঠাচ্ছ, ওই দুর্মুখ তো ওই অস্ত্র আমাদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করবে। সুতরাং পাটঅস্ত্র সম্বরণ কর। এ দুটি সামান্য ব্যপার মিটে গেলেই খাদ্য বোঝাই জাহাজ তোমাদের বন্দরে পৌঁছে যাবে। ” সম্রাট তার কথা রেখেছিলেন। খাদ্য এসেছিল আমাদের বন্দরে।
একটু দেরি হয়েছিল, তা সেটা এমন কিছু নয়, মাত্র ১০-১৫ লক্ষ মানুষ ( না কি বাঙালি বলা উচিৎ ) মারা যাওয়ার পর। তা বিশ্বশান্তির জন্য এরকম হতেই পারে।
অনুলিখনের সমস্যা একটাই, বিশেষ করে লেখক যদি প্রত্যক্ষদর্শী হয়। নিজের গ্লানি, সমাজের গ্লানি মাথার ওপর চেপে বসে। প্রেমের গল্পে পড়ে অসুন্দরের ছায়া।
এই মূহুর্তে মনে হচ্ছে, সে দিনের সেই বিশাল ট্র্যাজেডি কতখানি আলোড়িত করেছিল এই উপাখ্যানের পাত্র-পাত্রীদের। চোখের সামনে মৃত্যুর মহৎসব দেখেও তারা মগ্ন ছিল যৌবনের মাধুরী আহরণে। জানি তখনকার সেই ১৭-১৮ বছরের ছেলে মেয়েদের তেমন কিছু একটা করার ছিলনা। কিন্তু রাস্তার বেওয়ারিশ লাশ কজনকে কাঁদিয়েছে তখন। তার চেয়েও বড় কথা, কজন মনে রেখেছে সেদিনের কথা।
দেশ যেমন ভুলে গেছে সেই ১৫ লক্ষ হতভাগ্য মানুষের কথা, তেমনি ভুলে গেছে এ গল্পের কুশীলবরা। যে মৃত্যুর দায় সমাজের তাকে এখন বানানো হয়েছে রাজনৈতিক হাতিয়ার। বছরে একটা দিনও যদি নির্দিষ্ট করা যায় এই ভাগ্যহত মানুষদের স্মরণে, তাহলে আমরা যারা তখন বেঁচে ছিলাম কিন্তু কিছুই করিনি, তাদের দায়ভাগ কমবেনা, তবে অনুতাপের একটা সুযোগ তো পাওয়া যাবে। আর এখনকার ছেলেমেয়েরা আমাদের কুৎসিত মুখ দেখে শিউরে উঠে বলবে, আমরা ওদের মত হবোনা। ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আমরা ঘটতে দেবনা।
বাংলাদেশ তার পাপ স্খালনের একটা সুযোগ নেবে কি? অত্যন্ত স্বার্থপরের মত বলি তাতে আমাদের প্রজন্মের অপরাধবোধ হয়ত কিছুটা কমবে।
ইতিহাস যে বিজয়ীরাই লেখে এ কথা সবাই জানে। তেমনি ইতিহাসে আমরা শুধু অর্জনের কথাই বলতে চাই। আমাদের ব্যর্থতার কথা আমরা লুকিয়ে রাখি। তারপর তা ধীরে ধীরে চাপা পড়ে যায় কখনো পলিমাটিতে, কখনো লাভার স্তরে স্তরে, আবার কখনো বা ধ্বংসস্তূপের মাঝে।
প্রত্নতাত্ত্বিক সেসব খুঁড়ে বের করেন প্রাচীন শিল্পের চমৎকার একটা নিদর্শন। সবাই মোহিত হন পূর্বসূরিদের শিল্পের উৎকর্ষতায়, পণ্ডিতরা নিমগ্ন হন নান্দনিক বিশ্লেষণে। পুরাকীর্তির সাথে সাথে যেসব অস্থিখন্ড উঠে আসে তার নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ হয় কিন্তু হাড়ের মালিকদের সুখ দুঃখের কাহিনী অজানা থেকে যায়।
অনেক ট্র্যাজেডির মত ১৯৭৪ এর ট্র্যাজেডিও ভুলে যাচ্ছে সবাই। এখনই সময় কিছু করার।
১৯৭১এর সঠিক ইতিহাস লেখার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে প্রায় ৪০ বছর পরে। সে তো বাঙালির অর্জনের ইতিহাস। আমরা যদি এখন আমাদের ব্যার্থতার ইতিহাসটা না লিখি, যদি সেই অসহায় মানুষগুলোকে স্মরণ করে তাদের কাছে ক্ষমা না চাই তা হলে আমাদের ৭১এর অর্জন একেবারেই ম্লান হয়ে যাবে।
গল্পের শুরুটা ছিল হালকা চালের। ইচ্ছেও ছিল নিছক একটা প্রেমের গল্প লেখার।
কিন্তু ১৯৭৪ সংখ্যাটা সব গোলমাল করে দিল। অনেক দিনের চিন্তা ভাবনা অবচেতনে যে এত বড় বেদনার জন্ম দিয়েছে, অনেক অপরাধবোধের সাথে এই অপরাধবোধটাও যে কুরে কুরে খাচ্ছে আমার মস্তিষ্কের অচেতন অংশকে জানা ছিলনা। এই ভাবনাগুলো হুড়মুড় করে বেরিয়ে এসে গল্পের কাঠামোটা ভেঙ্গেচুরে দিয়েছে। সেটাকে মেরামত করা যাবেনা। মেরামত না করা আমার দায়বদ্ধতার অংশ।
এত কিছু বলার পরে এটুকুও বলা উচিৎ যে এ গল্পের দু একজন সে সময় চোখের জল ফেলেছে, কোন কোন সময় বিচলিত হয়েছে এবং তারপর নিজের ভুবনে ফিরে গেছে। সংঘবদ্ধ ভাবে অবস্থার পরিবর্তন করা যায় কিনা এমন ভাবনা কারও মাথায় আসে নি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।