বিশেষ প্রতিনিধি ॥ বিএনপি-জামায়াত জোটের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের অন্যতম শরিক ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মুফতি ফজলুল হক আমিনীর ছেলে মাওলানা আবুল হাসানাত নিখোঁজের ১২ দিন পর শুক্রবার ভোরে রাজধানীর নবকুমার স্কুলের সামনে থেকে চোখ বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার হয়েছেন। তার ১২ দিন নিখোঁজ থাকার রহস্যজনক ঘটনার ব্যাপারে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত করছে। মাওলানা আবুল হাসানাত ১২ দিন কোথায় ছিলেন? এ নিয়ে রহস্যের জট পাকাতে শুরু করেছে। তার নিখোঁজ ঘটনা তদন্তে আমিনীর পরিবার থেকে কোন সহযোগিতা করা হয়নি বলে পুলিশের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তার নিখোঁজ হওয়ার পর বিলম্বে থানায় খবর দেয়া এবং শুক্রবার ফিরে পাওয়ার পরও বিলম্বে পুলিশকে অবহিত করার বিষয়টিতে রহস্য ঘনীভূত হচ্ছে।
আমিনীর ছেলে মাওলানা আবুল হাসনাত উদ্ধারের পর তিনি লালবাগের দলীয় অফিসে সকাল ১১টায় দলের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন, একটি সংঘবদ্ধ চক্র অপহরণ করেছিল তাকে। তবে কারা তাকে অপহরণ করেছিল তা জানাননি তিনি। অজ্ঞাত স্থান থেকে তাকে গাড়িতে হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় নবকুমার স্কুল ও ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসাসংলগ্ন মাঠের কাছে নামিয়ে দেয়। গাড়িতে থাকা ব্যক্তিরা আমিনীর ছেলেকে সেখানে ১০ মিনিট চুপচাপ বসে থাকার নির্দেশ দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যায়। আবুল হাসানাতের দাবি অজ্ঞাত অপহরণকারীরা তাকে মোবাইল ফোন দিয়ে যায়।
অপহরণকারীরাই তার স্ত্রীকে ফোন করে আবুল হাসানাতের অবস্থানের কথা জানায়। ১০ মিনিট হওয়ার পর তার শ্বশুর ও শ্যালক এসে তাকে নিয়ে যায় বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান তিনি। সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের মাওলানা আবুল হাসানাত বলেছেন, অপহৃত অবস্থায় তার চোখ সবসময় গামছা দিয়ে বাঁধা ও হাত হ্যান্ডকাফ দিয়ে আটকানো থাকত। এ সময় তাকে মাত্র দুই বেলা খাবার দেয়া হতো। অপহরণকারীরা তাকে এ সময় প্রতিদিন হত্যার হুমকি দিত বলেও তিনি অভিযোগ করেন।
তাঁকে ছেড়ে দেয়ার শর্ত হিসেবে অপহরণকারীরা তাঁর বাবা মুফতি আমিনীকে ২ মাস রাজনীতির বাইরে রাখতে এবং তাঁকে আগামী ৪ দিন ঘরের বাইরে না যেতে বলে। এই শর্ত মানা না হলে গুলি করে তাকে মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দেয় তারা। গত ১০ এপ্রিল সূত্রাপুরের টিপু সুলতান রোডে একটি কনফেকশনারি থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য পরিচয় দিয়ে ৬/৭ জন লোক মুফতি ফজলুল হক আমিনীর ছেলে মাওলানা হাসানাতকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এর পর থেকে তার আর হদিস মেলেনি। আবুল হাসানাতকে শুক্রবার ভোর ৪টায় বখশীবাজারে নবকুমার স্কুলের সামনে চোখ বাঁধা অবস্থায় পাওয়া যায়।
মুফতি ফজলুল হক আমিনী সংবাদ সম্মেলনে তার ছেলেকে ফিরিয়ে আনার জন্য দেশের সকল জনগণ, সাংবাদিক, আলেম-ওলামাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এ সময় তিনি তার ছেলেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে অপহরণ করা হয়েছে এবং তাঁর নির্দেশেই আবার ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। আমিনী বলেন, তিনি ও তার পরিবার এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তিনি সরকারের কাছে তার এবং পরিবারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা করার দাবি জানান। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আমিনী বলেন, আন্দোলন দমানোর জন্যই হাসানাতকে অপহরণ করা হয়েছিল।
মুফতি আমিনী বলেছেন, হাসানাত অপহরণের পর আমি খুব ভেঙ্গে পড়েছিলাম। তবে আলস্নাহ্র কাছে দোয়া করেছি। আমিনী নিজের ছেলেকে আগামীতে নিজের মতো ইসলামী আন্দোলনের সৈনিক হিসেবে দেখতে চান বলেও জানান আমিনী। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব আব্দুল লতিফ নেজামী, ইসলামী আইন বাসত্মবায়ন কমিটির ঢাকা মহানগর সভাপতি মাওলানা আবুল কাশেম প্রমুখ।
আবুল হাসানাত ১২ দিন যেভাবে ছিলেন ॥ তার হাতে হ্যান্ডকাফ।
চোখ বাঁধা লাল-সবুজ গামছায়।
এভাবেই কেটেছে ১২টি দিন। দিনে খাবার দুই বেলা। আর একটু পর পরই বলা হতো 'শেষবারের মতো খেয়ে নে'_এই বলে হুমকি দেয়া হতো। প্রতিদিনই হাসিমুখে অপহরণকারীরা জানতে চাইত 'তোর শেষ ইচ্ছা কী?' আমিনীর ছেলে মাওলানা আবুল হাসানাত এভাবেই সাংবাদিকদের কাছে অজ্ঞাত স্থানে তাকে আটকে রাখার বর্ণনা দেন।
অজ্ঞাত স্থানে একটি বাড়িতে তাকে ১২ দিন আটকে রাখেন কয়েক ব্যক্তি। ওই ব্যক্তিদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য বলেও দাবি করেন হাসানাত। তবে কোন্ বাহিনীর তা জানাতে পারেননি। শুক্রবার ভোরে ঘুম থেকে ডেকে তোলা হয় তাকে। এরপর তাকে চোখ বাঁধা অবস্থায় সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে একটি গাড়িতে তোলা হয়।
হাসানাত অনুমান করে বলেন, গাড়ি করে ওই স্থান থেকে লালবাগ আসতে মাত্র ১০ মিনিট সময় লেগেছে। হাসানাত দাবি করেছেন, তাকে রাজধানীরই কোন এক স্থানে রাখা হয়েছিল। তাকে একটি বহুতল বাড়িতে রাখা হয়। যেখানে যেতে সিঁড়ির চারটি ধাপ পার হতে হয়। তাকে আটক রাখা হলেও তার ওপর কোন শারীরিক নির্যাতন করা হয়নি।
তবে তাকে প্রায়ই অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করা হতো। বলা হতো, 'তোর বাবা চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেছে। তোর বাবাকে রাজনীতি না করতে বলবি। ' হাসানাত জবাবে বলেছিলেন, 'আমি আব্বাকে বলব, কিন্তু আব্বা আমার কথা শুনবেন না। ' হাসানাত জানান, তাকে দিনে দুই বেলা খাবার দেয়া হতো।
প্রতি বেলায় মানসম্মত খাবার দেয়া হয়। প্রথম দিনই তাকে খাসির বিরিয়ানি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। এরপর টানা ১১ দিন রোজা ছিলেন হাসানাত। এ সময় তাকে ভোরে সেহরিতে ফলমূল ও ফলের শরবত খেতে দেয়া হয়। ইফতারিতেও দেয়া হতো ফলসহ নানা মুখরোচক খাবার।
তবে ১২ দিনের মধ্যে একদিন তাকে গোসলের সুযোগ দেয়া হয়েছে। হাসানাত আরও জানান, তাকে যে বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছিল, সেখানে সব সময় পাঁচ-ছয়জন তার পাহারায় থাকত। মুক্তি পাওয়ার পরও তার আতঙ্ক কাটেনি বলে জানিয়েছেন হাসানাত। পুলিশ কর্মকর্তারা যা বলেছেন ॥ ঢাকা মহানগর পুলিশের উর্ধতন এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, আবুল হাসানাত নিখোঁজ হওয়ার পর সুত্রাপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছিল। কিন্তু ঘটনার তদনত্মে পুলিশকে কোন সহযোগিতা করা হয়নি।
আবার ফিরে আসার ঘটনা জানার পর তিনি সূত্রাপুর থানার ওসিকে ঘটনা তদনত্মের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। পুলিশের একটি টিম মুফতি আমিনীর ছেলে মাওলানা আবুল হাসানাতের বক্তব্য রেকর্ড করার জন্য যোগাযোগ করছে। তিনি বলেন, নিখোঁজ নিয়ে অনেক বির্তকের সৃষ্টি করানো হয়েছে। তাই প্রকৃত ঘটনা কারা ও কোন্ উদ্দেশ্যে তাকে গোপন করেছিল তা বের করে জনগণকে জানানো হবে। আবুল হাসানাতের ব্যবহূত মোবাইল ফোনের সিডিআর (কল রেকর্ড) পরীৰা করে দেখা হচ্ছে।
গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা জানান, আবুল হাসানাতের নিখোঁজ ও ফিরে আসার ঘটনাটি খুবই রহস্যজনক। শুক্রবার সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে থানায় দায়ের করা একটি অবহিতকরণ জিডির (জিডি নম্বর-১০৩৫)। এই জিডির মাধ্যমে মুফতি ফজলুল হক আমিনীর ছেলে হাফেজ মাওলানা আবুল হাসানাতের ফিরে আসার ঘটনাটি জানতে পারি। তার উদ্ধার হওয়ার পৌনে ৫ ঘণ্টা পর অবহিত করা হয় পুলিশকে।
জিডিতে মুফতি ফজলুল হক আমিনীর মেয়ের জামাই মাওলানা যুবায়ের আহমদ উলেস্নখ করেছেন, গত ১০ এপ্রিল রাজধানীর ধোলাইখাল এলাকা থেকে সাদা পোশাকধারী লোকজন মাওলানা আবুল হাসানাতকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।
এর ১২ দিনের মাথায় শুক্রবার ভোর ৪টায় বকশীবাজার নবকুমার ইনস্টিটিউটের সামনের রাসত্মায় তাকে নামিয়ে দেয়া হয়। পরে তিনি মোবাইলের মাধ্যমে তার নবকুমার ইনস্টিটিউটের সামনে তাকে আদৌ কেউ নামিয়ে দিয়েছে নাকি তিনি নিজেই এখানে এসেছেন তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
সূত্রাপুর থানার এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মাওলানা আবুল হাসানাতকে কারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল আবার কারাইবা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে তা তদনত্ম না করে কিছুই বলতে পারছি না। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর বোঝা যাবে তিনি এতদিন কোথায় ছিলেন? মাওলানা আবুল হাসানাত নিজেই আত্মগোপন করে নাটক সাজিয়েছেন কিনা তাও তদনত্মে বের হয়ে আসবে বলে পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।