বাংলাদেশের সবচে' জনপ্রিয় লেখক, আমার অতি প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর সৃষ্ট জনপ্রিয় দু'টি চরিত্র হলো মিসির আলী ও হিমু। মিসির আলীর জগত যুক্তি নির্ভর। হিমুর কাজ অ্যান্টিলজিক নিয়ে।
আমার মাথায় আপাতত যে নির্দোষ পরিকল্পনাটি ঘুরাঘুরি করছে, তা হলো, হিমু এবং মিসির আলী সাহেবকে কোনো একটি বিয়ের মাহফিলে দাওয়াত করে ফেললে কেমন হয়? কাছে থেকে দেখমাম তারা কেমন!
এই লেখা হুমায়ূন আহমদের চোখে পড়ার কোনো সম্ভাবনা থাকার কারণ নেই।
তবুও কোনোভাবেও যদি লেখাটি তাঁর নজরে পড়ে যায়, অনুমান করে নিতে পারি তাঁর প্রতিক্রিয়া হতে পারে দু রকম।
১) তিনি এই ভেবে বিরক্ত হতে পারেন যে, আমি তাঁর মিসির আলী ও হিমুকে নিয়ে টানা-হেচড়া করছি! পাঠকের সামনে মিসির আলীকে মিসির আলীর মতো এবং হিমুকে হিমুর মতো হাজির করতেও পারিনি!
অবশ্য পরক্ষণেই আবার রাগ হোক আর বিরক্তি, এই ভেবে মিলিয়ে যাবার কথা, কোথাকার কেউ কী লিখলো, কী আসে যায়!!
২)আমার উপর উনার খুশি হবার হালকা একটি সম্ভাববাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। তিনি হয়তো ভাববেন, যাক, আমি মারা গেলেও আমার হিমু-মিসির আলী মারা যাবেনা। সময়ে সময়ে নতুন পোশাকে বেঁচে থাকবে। আমি তাদেরকে যেভাবে লালন-পালন করেছি,সেভাবে হয়তো অন্য কেউ পারবেনা।
মায়ের মমতা খালার কাছ থেকে পাওয়া যায় না। তাতে কী! খালার মমতাও কি খুব কম!!
তাহলে শুরু হোক মিসির আলী ও হিমুকে নিয়ে একটি ছোট গল্প-
বিয়ের আড্ডায় মিসির আলী, হিমুও
অনেকটা বিস্মিত হয়ে চমকে উঠলেন মাজেদা খালা!
তিনি ভাবতেও পারেন নি হিমু সত্যি সত্যি দেখা করতে চলে আসবে! হিমুর স্বভাবই হলো, তাকে যদি আসতে বলা হয়, ভুলেও আসবেনা। নিষেধ করলে ঘুর ঘুর করবে পাশে এসে। আজই ব্যতিক্রম হলো। বোশেখি রোদের তীব্র উত্তাপ, তাও আবার ভর দুপুরে কড়কড়ে হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে সামনে দাঁড়ানো হিমু'র জন্য মনটায় বিশেষ মায়া অনুভব করলেন মাজেদা খালা।
চারমাস পর হিমুর এ বাড়িতে আসা। খালুজান জনাব রফিকুজ্জামান ২৮৮ ধারা জারি করে রেখেছেন হিমু'র জন্য। পরিস্কার বলে দিয়েছেন, হিমু, তুমি যা চাও, তোমাকে তাই দেয়া হবে। বিনিময়ে তোমাকে আমার ছেলেটার নাগালের বাইরে থাকতে হবে। তুমি মহামানব হও।
আমার ছেলেকে সাধারণ মানব থাকতে দাও। ওর মহা মানব হলেও চলবে।
হিমু বলেছে, দেখুন খালুজান, শুভ্র'র মধ্যে এমন কিছু ব্যাপার আছে, যা সচরাচর সবার মাঝে থাকেনা। প্রকৃ্তি এই বিশেষ ব্যাপারগুলো সবাইকে দেয় না। শুভ্রকে দিয়ছে।
এ নিয়ে নিশ্চই প্রকৃতির বিশেষ কোনো পরিকল্পনাও আছে। আমাদের কি উচিৎ হবে প্রকৃতির মহাপরিকল্পনাকে পাল্টে দেয়া? সেই ক্ষমতা কি আমাদের থাকা উচিৎ...?
রাগে ফত ফত করতে করতে খালুজান তখন চিৎকার করে বলতে লাগলেন,
বেরিয়ে যা অপদার্থ কোথাকার! তোমাকে এ বাড়ির ত্রি-সীমানায় দেখলে গুলি করে মারা হবে।
( খালুজান রাগলে তুই-তুমির মিশ্রনে কথা বলেন)
......
কল্পনার জগতে চলে গিয়েছিলেন মাজেদা খালা। হিমু'র কথায় তার খেয়াল হলো তিনি এখন হিমুর সামনে অথবা হিমুই তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে!
দরজায় দাঁড়ানো হিমু হাসি হাসি মুখ করে বলল,-
ভালো আছেন খালা! আপনাকে কিন্তু খুব সুন্দর লাগছে! ঠিক মোনালিসার মতো। মোনালিসাকে চেনেন তো? অই যে! লিওনার্দ্য দ্য ভিঞ্চি'র আঁকা বিখ্যাত ছবি! আচ্ছা খালা, শিল্পী তার স্ত্রীর ছবি না একে মোনালিসার ছবি আকতে গেলেন কেনো বলেন দেখি?
চোখ লাল করে তাকালেন মাজেদা খালা।
তিনি ভেবেছিলেন এই চার মাসে হয়তো হিমুর স্বভাব-চরিত্রের কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। দেখা যাচ্ছে যথা পুর্বং তথা পরং।
তিনি চেষ্টা করছেন রাগ এবং বিরক্তি চাপিয়ে রাখতে। কতক্ষণ পারবেন বুঝা যাচ্ছে না। যথাসম্ভব চেহারা স্বাভাবিক রেখে বললেন,
ফাজমামো করিস না হিমু।
আমার সাথে তোর ফাজলামোর সম্পর্ক না।
কী বলছো খালা! তোমার সাথে ফাজলামো করবো কেনো। খালার সাথে ফাজলামো করে কেউ? আচ্ছা খালা, তোমার পা'টা কি ভালো করে ধোয়া আছে?
আমার পা ধোয়া আছে নাকি পায়ে গোবর মাখা, তাতে তোর কি?
না, মানে তোমার পা ছুঁয়ে একটু কদমবুচি করতে চাইছিলাম। গত রাতে স্বপ্নে দেখলাম...
আবার ফাজলামো?
সরি খালা। এবার একটু সরে দাড়াও তো।
নাকি ডেকে এনে দরজা থেকেই ফিরিয়ে দেবে!
দাঁত কিড়মিড় করে এক পাশে সরে গেলেন মাজেদা খালা। ভেতরে প্রবেশ করে সোজা বাদলের ঘরের দিকে হাটা শুরু করলো হিমু। নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলেন মাজেদা খালা। আশ্চর্য এক ছেলে! তিনি খবর পাঠিয়ে আনালেন। অথচ এসে একবারও জিজ্ঞেস করলো না, তাকে কেনো ডেকে আনা হলো ! তাঁর উচিত হিমুর উপর প্রচন্ড রাগ করা।
সেটা করতে পারছেন না। মা মরা এই ছেলেটার উপর তিনি রাগ করতে পারেন না, আর পারলেও বেশিক্ষণ সেই রাগ ধরে রাখতে পারেন না। এটাই তাঁর বড় দুর্বলতা।
.....
হিমুকে দেখে প্রায় চিৎকার করে উঠলো বাদল-
আরে হিমুদা যে! কখন এলে? কোথায় ছিলে এতোদিন? আমার মন বলছিলো আজ তোমার সাথে আমার দেখা হবে। জানো হিমুদা, আমি তোমার বিখ্যাত জলতত্ত্ব আয়ত্বে নিয়ে এসেছি।
অই যে! গলা পর্যন্ত পানির নিচে রেখে জোসনা দেখা। বুঝলে হিমু ভাই...
কথা শেষ করতে না দিয়েই হিমু বললো, তাড়াতাড়ি তৈ্রি হয়ে নে। তোর চশমাটা খুঁজে পেয়েছিস তো?
বাদল কোনো কথা না বলে আলমারি খুলে সদ্য ইস্ত্রি করা কড়কড়ে হলুদ একটি পাঞ্জাবি বের করে ফেললো। কোথায় যাওয়া হচ্ছে, কেনো যাওয়া হচ্ছে,কোনো প্রশ্ন নেই। হিমুভাইয়ের সাথে কোথাও ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ মঙ্গলে একখন্ড জমির মালিকানারচে'ও বেশি আনন্দের।
অন্তত বাদলের তাই ধারণা।
হিমু বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে বাদলের দিকে! যদিও বিস্মিত হবার ক্ষমতা হিমুদের দেয়া হয়নি। সাধারণতঃ অন্যকে বিভ্রান্ত করা ও হকচকিয়ে দেয়াই হিমুদের কাজ। কিন্তু আজ হিমু নিজেই কিছুটা বিভ্রত হয়ে গেলো! বাদল যে এভাবে সত্যি সত্যিই হলুদ পাঞ্জাবি (অবশ্যই পকেট ছাড়া) বানিয়ে ফেলবে,এটা হিমুও ভাবেনি।
বাদলের রোম থেকে বেরিয়ে এসে ড্রইং রোমে ঢুকতেই মাজেদা খালার মুখোমুখি হলো দু'জন।
কিরে হিমু! এসেই চলে যাচ্ছিস? ঘটনা কী? আমি তোকে খবর দিয়ে আনালাম। একবারও তো জিজ্ঞেস করলিনা, কেনো ডেকেছি?
হিমু বললো,দেখো খালা। আমরা সবাই প্রকৃতির পরিকল্পনার অংশ। এই যে তুমি বললে, আমাকে তুমি ডেকে আনিয়েছ, এটাও কিন্তু ঠিক না। তুমি আমাকে আনাওনি।
প্রকৃতিই আমাকে এখানে পাঠিয়েছে। আর প্রকৃতির যদি ইচ্ছে হয় তোমাকে দিয়ে আমাকে কিছু বলানোর, তবে তাই হবে। না হলে তো হবে না। খামাখা টেনশান নিয়ে তো লাভ নেই। তাছাড়া আমার তো মনে হচ্ছে, তুমি কেনো আমাকে খবর দিয়েছিলে, সেটাই এখন মনে করতে পারছোনা!
বিব্রত ভঙ্গিতে তাকাচ্ছেন খালা।
সত্যিই তিনি মনে করতে পারছেন না হিমুকে তিনি কেনো ডেকে পাঠিয়েছিলেন! অস্বস্থিবোধ করতে লাগলেন তিনি। প্রসঙ্গ পাল্টে শুধু বললেন, এই ভর দুপুরে যাচ্ছিস কোথায়?
হিমু বললো, আচ্ছা খালা, তোমার পরিচিত কোনো মানসিক ডাক্তার আছেন যিনি মানুষের ভুলে যাওয়া নিয়ে কাজ করেন? থাকলে ইমিডিয়েট উনার সাথে তোমার একবার দেখা করা দরকার।
আবার ইয়ার্কি?
ইয়ার্কি বলছো কেনো খালা? আজ ২০ তারিখ না? আজ না মাজারুল এর বিয়ে! গত ৫ বছরের রিহার্সেল দেয়া নাটক মঞ্চায়নের তারিখ না আজ?
এতক্ষণে যেন ঘর কাটলো মাজেদা খালার। সত্যিই তাঁর মনে ছিলোনা আজ তাঁর মেজ বোন ফাতেমার ছোট ছেলে মাজারুলের বিয়ে! কিন্তু পরক্ষণেই বললেন, কিন্তু তুই তো অসব সামাজিকতামার্কা অনুষ্ঠানকে পাত্তা দিস না। তাহলে আজ কী হলো?
শোনো খালা।
আমি অখানে রোস্ট খেতে যাচ্ছিনা। আমি যাচ্ছি অন্য কারণে। তাছাড়া এই যে তুমি সামাজিকতার কথা বললে, সমাজ বলতে তো কিছু মানুষের একিভূত চাল-চলন, আচারানুষ্ঠান। আচ্ছা ধরো, কোনো এলাকায় কাকতালীয়ভাবে এমন কিছু মানুষের বসতি গড়ে উঠলো যারা প্রত্যেকেই মন্দ লোক। তখন তাদের আচারানুষ্ঠান বা সামাজিকতার তুমি কি আমাকে ফলো করতে বলবে?
কথা তো আরো আছে।
কিছু মানুষকে তৈ্রি করা হয়েছে সামাজিক নিয়ম-নীতি মেনে চলার জন্য। আর কিছু মানুষকে নতুন নিয়মের জন্ম দেয়ার জন্য। তারা নিয়মের জন্ম দেবে। তারপর নবজাতক সেই নিয়মকে লালন-পালন করে যুক্তির পোষাক পরিয়ে বিস্তৃত করে দেবে পঞ্চদিকে। চতির্দিকে না বলে পঞ্চদিকে কেনো বললাম জানো খালা?
বকবক বন্ধ কর।
আমার সাথে জ্ঞান ঝাড়বিনা বলে দিলাম। তুই যেতে চাস যা। নতুন নিয়মের জন্ম দে। একটা না, হাজারটা দে। আমার ছেলেটাকে সাথে নেয়ার দরকার নাই।
অর নতুন নিয়মের জন্মদাতা না হলেও চলবে।
কী বলছো খালা! আজ বিয়ে বাড়িতে ব্যাতিক্রমধর্মী কিছু একটা হবে। মূলতঃ এ কারণেই আমার যাওয়া। বিখ্যাত সব ব্যাক্তিরা জড়ো হবেন। মিসির আলি সাহেব থাকবেন বিশেষ মেহমান হিসেবে।
রূপাকেও আসতে বলা হয়েছে। অবশ্য সে আসবে কি না- বুঝতে পারছিনা।
আচ্ছা খালা, তুমি কি রূপাকে একটা ফোন করে বলে দেবে সে যেন অবশ্যই উপস্থিত থাকে! লজিক এবং অ্যান্টি লজিকের এমন মিলনমেলা সে বোধ'য় আর পাবেনা কখনো। তুমিও চলোনা খালা। ভালো লাগবে।
কথা শেষ করে বাদলের হাত ধরে বেরিয়ে পড়লো হিমু। নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলেন মাজেদা খালা। অনেক ভেবেও তিনি বের করতে পারলেন না হিমুকে তিনি ঠিক কী জন্যে ডেকেছিলেন! তাহলে কি তাকে সত্যি সত্যিই কোনো মানসিক ডাক্তারের সাথে দেখা করা দরকার!!
চলবে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।