সুখ চাহি নাই মহারাজ—জয়! জয় চেয়েছিনু, জয়ী আমি আজ। ক্ষুদ্র সুখে ভরে নাকো ক্ষত্রিয়ের ক্ষুধা কুরুপতি! দীপ্তজ্বালা অগ্নিঢালা সুধা জয়রস, ঈর্ষাসিন্ধুমন্থনসঞ্জাত,সদ্য করিয়াছি পান—সুখী নহি তাত, অদ্য আমি জয়ী।
প্রথম অংশ এখানে
দৃশ্যঃ ১১(ক)/দিন/রেবেকার বাড়ি্র উঠান (রেবেকা, রাবিদ)
উঠোনের কোথাও বসে রেবেকা কুলোয় রাখা চালের ময়লা বাজছে। কাছেই উঠোনের আরেকদিকে রাবিদ বসে আছে।
রাবিদঃ রেবু, তোর মনে আছে, ছোটবেলায় এই উঠোনে খড়ি দিয়ে দাগ কেটে আমরা কত কুতকুত খেলতাম?
রেবেকাঃ (হেসে) তুমি তো যত দুনিয়ার মেয়েলী খেলায় ওস্তাদ ছেলে।
কুতকুত, দারিয়াবান্ধা, পুতুলের বিয়ে- আমাদের মেয়েদের সব খেলায় তোমার থাকা চাই-ই চাই!
রাবিদঃ ধুরো, আমার মতো ছেলের ওসব ফুটবল, কাবাডি টাইপ ড্যাশিং খেলা পোষাতো না।
রেবেকাঃ পোষাবে কি করে? তখন থেকেই তো দীপ্তির পিছনে ঘুরঘুর শুরু করেছিলে। দীপ্তি কুতকুত খেলবে, রাবিদ সাহেব হাজির। দীপ্তির পুতুলের বিয়ে, তো রাবিদ সাহেব হবেন বর পক্ষ।
রাবিদঃ হাঃ হাঃ হাঃ... আরে ওগুলো ছিল ছোটবেলার ইনফ্যাচুয়েশান।
রেবেকাঃ কি ফ্যাচুশান?
রাবিদঃ ইনফ্যাচুয়ে... থাক, তোর এতো ইংরেজী বুঝে কাজ নেই... সবে তো ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রী!
রেবেকাঃ যাই বলো না বলো, দীপ্তির প্রতি তোমার প্রেম প্রেম ভাবটা কিন্তু এখনো কাটেনি।
রাবিদঃ কাটাতে চাইলে না কাটবে! হাঃ হাঃ হাঃ... তাছাড়া দীপ্তি নিজেও তো আমাকে মনে হয়...
রেবেকাঃ এখনও “মনে হয়”? সিওর হবে কবে তাহলে? তুমি ঢাকায় থাকলে তোমার কথা চৌদ্দবার করে আমাকে জিজ্ঞেস করে... “রাবিদ ভাইয়া চিঠি লিখেছে কি না, ওর পড়ালেখা ভালো চলছে কি না, শরীর ভালো আছে কি না...” ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।
(রাবিদ নিরবে হাসতে থাকে। )
রেবেকাঃ ক্যাবলার মতো হেসো না তো! সত্যি করে বলো তো ভাইয়া, দীপ্তিকে তুমি ভালোবাস, তাই না?
রাবিদঃ উম্ম্... আমারও তাই ধারণা।
রেবেকাঃ ওকে বলেছো সে কথা?
(রাবিদ নিরবে হেসে “না” সূচক মাথা নাড়ে।
)
রেবেকাঃ এখনও বলোনি? আচ্ছা, তুমি এতো ভীতু কেন, বলো তো?
রাবিদঃ পৃথিবীর সবাইকে সাহসী হতে হবে, এমন দিব্যি তোকে কে দিলো, হ্যাঁ?
রেবেকাঃ (উঠে দাঁড়িয়ে) তাই বলে আমার ভাই হয়ে এতোটা ভীতু সুলভ আচরণ আমার মোটেই ভালো লাগে না।
(রেবেকা কুলো হাতে নিয়ে বাড়ির ভিতরে প্রস্থান করে। )
দৃশ্যঃ ১১(খ)/দিন/রেবেকার বাড়ি্র উঠান (রাবিদ, দীপ্তি)
রেবেকার শেষ সংলাপের জেড় ধরে ক্লোস শট্-এ রাবিদের রিএ্যাকশান দেখানো হবে। হঠাৎ কারো পায়ের শব্দে রাবিদ ঘুরে তাকায়। দীপ্তিকে এগিয়ে আসতে দেখা যাবে।
দীপ্তি রাবিদকে উপেক্ষা করে বাড়ির ভিতরে যেতে থাকে। পেছন থেকে রাবিদ দীপ্তিকে ডাক দেবে।
রাবিদঃ ভিতরে যাচ্ছো?
দীপ্তিঃ (থেমে দাঁড়িয়ে) হ্যাঁ।
রাবিদঃ একটু বসবে?
দীপ্তিঃ কেন?
রাবিদঃ কথা আছে।
দীপ্তিঃ বলো।
রাবিদঃ আহা বসোই না!
দীপ্তিঃ (কোথাও হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে) আছি তো। কি বলবে, বলো।
রাবিদঃ (উঠে দাঁড়িয়ে দীপ্তির কাছে এসে) আমার মনে হয়... আমার মনে হয়, আমরা দু’জন দু’জনকে ভালোবাসি।
দীপ্তিঃ হঠাৎ এ প্রসঙ্গ?
রাবিদঃ আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে হয়তো ভাবা যেতে পারে।
দীপ্তিঃ (কিছুক্ষণ নিরব থেকে)... কাপুরুষদের বিয়ে তো দূরে থাক, ভালোবাসতেও আমার ঘৃণা করে!
রাবিদঃ মানে?
দীপ্তিঃ তোমার লজ্জা করে না? একটুও বিবেকের তাড়না নেই তোমার?
রাবিদঃ দীপ্তি...
দীপ্তিঃ চুপ করো! সারা দেশের মানুষ যখন ঝাঁপিয়ে পড়ছে যুদ্ধে, কী করে নির্লজ্জের মতো ঘরে বসে থাকতে পারো তুমি? একটা নিরক্ষর চাষাও তোমার মতো শিক্ষিতের চাইতে বেশী বিবেকবান, খাঁটি দেশপ্রেমিক! এরকম একটা দুঃসময়ে কী করে পারো তুমি ভালোবাসার ফুলঝুরি ছোটাতে? কী করে পারো তুমি বিয়ের কথা বলতে? ছিঃ!
রাবিদঃ (কিছুক্ষণ নিরব থেকে) আমার সেই সাহস নেই, দীপ্তি।
মৃত্যু ব্যাপারটাই আমার কাছে আতঙ্কের।
দীপ্তিঃ বুকে আগুন থাকলে সাহস এমনিতেই জ্বলে উঠে, রাবিদ ভাই। শেয়াল কুকুরের মতো ওরা আমাদের মারছে, আমাদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে শেষ করে ফেলছে। সেই আগুনের একটু উত্তাপও কি তোমার ভিতরটাকে জ্বালাতে পারছে না? এ আমি কাকে ভালোবাসলাম তবে?
দীপ্তি হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কান্না চেপে ভিতর বাড়ি না যেয়ে যে পথ দিয়ে এসেছিল, সে পথ দিয়েই প্রস্থান করে। ক্যামেরা ধীরে ধীরে রাবিদের মুখ চার্জ করে।
রাবিদের চোখ জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।
কাট
Flash In
দৃশ্যঃ ১২/দিন/গির্জার ভিতরে (রেবেকা, হাসনাইন, ফাদার)
গির্জার ভিতরে দু’প্রান্তে রেবেকা ও হাসনাইন দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ পায়ের শব্দে দু’জনই ঘুরে তাকায়। ফাদার রডরিগেজের প্রবেশ।
ফাদারঃ (স্মিত মুখে এক হাত অর্ধেক উঁচু করে ধরে স্তোত্র পাঠ করবার ঢঙে)... “প্রজ্ঞা সনাতন জ্যোতির প্রতিবিম্ব।
আলোর চেয়েও প্রজ্ঞা লাভে প্রীত হলাম, কারণ প্রজ্ঞা থেকে বিকীর্ণ যে উজ্জ্বল দীপ্তি, তা নীদ্রাহীণ। নিজে অভিন্ন হয়ে থেকেও প্রজ্ঞা সবকিছু নবীন করে তোলে, ও যুগের পর যুগ পূণ্যবানদের প্রাণে প্রবেশ ক’রে তাদের করে তোলে ঈশ্বরের বন্ধু, তাদের করে তোলে নবী। যে জাতি অন্ধকারে পথ চলতো, তারা মহান এক আলো দেখতে পেল; যারা মৃত্যু-ছায়ার দেশে বসে ছিল, তাদের উপর আলো জ্বলে উঠল। ”
রেবেকাঃ ঈশ্বরের সুসমাচার।
হাসনাইনঃ বাহ্, সুন্দর বলেছেন।
ফাদারঃ আপনাদের বিরক্ত করলাম না তো?
হাসনাইনঃ মোটেই না।
ফাদারঃ তাহলে আপনাদের কথার মাঝপথে একপ্রস্থ চা হয়ে যেতে পারে। কি বলো, রেবেকা?
(রেবেকা মুচকী হাসে। )
হাসনাইনঃ চমৎকার প্রস্তাব!
ফাদারঃ চলুন, বাইরে যাওয়া যাক তবে।
ফাদার, রেবেকা ও হাসনাইন গির্জা থেকে বেরিয়ে যায়।
কাট
দৃশ্যঃ ১৩/দিন/গির্জার বাইরে (রেবেকা, হাসনাইন)
হাসনাইন গির্জার বাইরে কোথাও বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছে আর চারদিকে দেখছে। দূরে দু’জন সিসটারকে হেঁটে যেতে দেখা যায়। হাসনাইন গির্জার স্থাপত্যকলা দেখতে দেখতে আবার চারদিকে দৃষ্টি রাখে। এবার সে রেবেকাকে দেখতে পায়। রেবেকা মিউট ভয়েসে সিসটার দু’জনের সাথে কথা বলে হাসনাইনের দিকেই এগিয়ে আসছে।
হাসনাইন উঠে দাঁড়িয়ে রেবেকার দিকে এগিয়ে যায়।
রেবেকাঃ সরি, একটু দেরী হয়ে গেল। সিসটারদের কয়েকটা কথা বলার ছিল।
হাসনাইনঃ কোন সমস্যা নেই। আপনি এখন ফ্রি তো?
রেবেকাঃ (হেসে) হ্যাঁ, আপাততঃ।
হাসনাইনঃ তাহলে শুরু করা যেতে পারে।
(ব্যাক টু ক্যামেরায় রেবেকা ও হাসনাইনকে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যেতে দেখা যাবে। )
রেবেকাঃ (অফ ফয়েস) সেদিন বিকেলেই ভাইয়া গ্রামের আরো দু’জন ছেলের সাথে যুদ্ধে চলে গেলেন। সম্ভবত ট্রেনিং নিতে আগরতলা। তারপর দিন যেতে লাগলো...
কাট
Flash Back
দৃশ্যঃ ১৪/দিন/রেবেকার বাড়ির উঠোন (রেবেকা, মনিরা)
বাড়ির দাওয়ায় বসে মনিরা বেগম রেবেকার চুল বেঁধে দিচ্ছে।
ক্যামেরায় রেবেকার মুখ। হঠাৎ অফ ভয়েসে কান্না মিশ্রিত ফোঁপানীর শব্দ পেয়ে রেবেকা ঘুরে মনিরার দিকে তাকায়।
রেবেকাঃ মা, আবার!
মনিরাঃ (কান্না মিশ্রিত কন্ঠে) কতদিন হইয়া গেল তার কোন খোঁজ নাই!
রেবেকাঃ মোল্লা বাড়ির রুদ্র সেদিনই তো এসে খবর দিয়ে গেল যে সে ভালো আছে।
মনিরাঃ একটা চিঠি তো অন্ততঃ লিইখা পাঠাইতে পারতো!
রেবেকাঃ যুদ্ধের মধ্যে সবসময় এটা সম্ভব নয়, মা। সম্ভব হলে নিশ্চয়ই লিখতো।
মনিরাঃ এইটা কোন মাস রে?
রেবেকাঃ জুলাই।
মনিরাঃ একমাস হইয়া গেল শেষ খবর পাইসি। তাও রুদ্র আইসিল বইলা। নাইলে...
(মনিরা আবার কেঁদে উঠে। )
রেবেকাঃ মনটাকে শক্ত করো, মা।
তোমার দোয়াই এখন তোমার ছেলের একমাত্র সঙ্গী।
মনিরাঃ সারাদিনই তো আল্লাহ্র কাসে দোয়া করি, সে যেন ভাল থাকে, সুস্থ্য থাকে।
রেবেকাঃ তার সাথে সাথে আর যারা যুদ্ধে গেছে, তাদের সবার জন্যই দোয়া ক’রো একটু।
মনিরাঃ করি রে মা, সবার জন্য দোয়া করি। এই জালিমগুলার হাত থেইকা আমার সোনার ছেলেরা যেন দেশটারে জয় কইরা ফিরতে পারে...
রেবেকাঃ এই তো লক্ষ্মী মামুনীটা আমার! এবার একটু হাসো তো... কই হাসো!
(মনিরা জোর করে হাসার চেষ্টা করে।
)
কাট
দৃশ্যঃ ১৫/দিন/গ্রামের রাস্তা (দীপ্তি, জুলকারনাইন)
গ্রামের মেঠোপথ ধরে দীপ্তি হেঁটে যাচ্ছে। বিপরীত দিক থেকে পান চিবোতে চিবোতে জুলকারনাইনকে হেঁটে আসতে দেখা যাবে। দীপ্তিকে দেখেই জুলকারনাইন একটি আকর্ণবিস্তৃত হাসি হাসে।
দীপ্তিঃ স্লামালাইকুম, চাচা।
জুলকারনাইনঃ (টেনে টেনে)ওয়া...লাইকুমাস্...সালাম।
তা কই যাও, মা জননী?
দীপ্তিঃ একটু মনিরা খালার বাসায় যাচ্ছি, চাচা।
জুলকারনাইনঃ অ... ভালো ভালো। তা ওই বাসায় কার খোঁজে যাও, মা? ভাবীসাব তো শুনলাম একটু পেরেশানীর মইধ্যে আছে। জোয়ান পোলাটা নাকি তার মামা বাড়ি না কই যেন গেসে। ঘরে বাপ মরা যুবতী কইন্যা...বড়ই চিন্তা হয় তাগো লাইগা...
দীপ্তিঃ ইয়ে...চাচা...তাহলে আমি এখন যাই?
জুলকারনাইনঃ নিশ্চয়, নিশ্চয়... তয় একটা কথা বলি, মা।
তুমি ডাঙ্গর হইসো... দিনকালও এখন ভালা না...দ্যাহ না দেশের দুশমনেরা কি সব শুরু করসে? পাশের গ্রামে আবার আমাগো নওজোয়ান মিলিটারীরা আস্তানা গাড়সে। এই সময় এমন একা একা এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করাটা ঠিক সুবিধার না, বুজসো তো?
দীপ্তিঃ জ্বী, চাচা।
জুলকারনাইনঃ বুঝলেই মঙ্গল। তা যাও... আর হাঁ, তোমার বাবা মা রে আমার সালাম পৌঁছাইয়া দিও।
দীপ্তি ঘার নেড়ে হনহন করে এগিয়ে যায়।
জুলকারনাইন দীপ্তির চলে যাওয়া দেখতে থাকে।
কাট
দৃশ্যঃ ১৬/দিন/গ্রামের পুকুরঘাট (রেবেকা, দীপ্তি)
রেবেকা ও দীপ্তি পুকুরপারে কোথাও বসে আছে। দু’জনের মুখই থমথমে। দু’জনের বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা। এক সময় দীপ্তি নিরবতা ভাঙ্গে।
দীপ্তিঃ কোন খবর পেলি?
(রেবেকার নিরবতা। )
দীপ্তিঃ প্লিস চুপ করে থাকবি না। একটা কিছু বল!
রেবেকাঃ মোল্লা বাড়ির রুদ্র ছেলেটা শেষ খবর নিয়ে এসেছিল। সেটা তো তুই জানিসই।
দীপ্তিঃ নতুন কিছু?
রেবেকাঃ লোকমুখে কিছু উড়ো খবর পাওয়া গেছে।
দীপ্তিঃ (উৎসাহের সাথে) কি? কি?
রেবেকাঃ ভাইয়া সম্ভবত উত্তর রণাঙ্গণে আছে। খুব শিঘ্রীই নাকি দেখা করতে গ্রামে আসবে।
দীপ্তিঃ সত্যি? সত্যি বলছিস?
রেবেকাঃ দীপ্তি, উড়ো খবর যদিও, তবু প্লিস এসব কথা কাউকে বলতে যাবি না।
দীপ্তিঃ প্রশ্নই উঠে না, রেবেকা!
রেবেকাঃ এমনকি তোর ঘরের কাউকেও না।
দীপ্তিঃ আমার প্রাণ থাকতে আর কেউ জানবে না, রেবু।
(দু’জনের নিরবতা। )
দীপ্তিঃ রাবিদ ভাই যুদ্ধে গেল প্রায় ৫ মাস হয়ে গেল, তাই না?
(রেবেকা নিরবে মাথা নাড়ে। )
দীপ্তিঃ কেমন আছে লোকটা, কি খাচ্ছে না খাচ্ছে...
(দীপ্তি ফুঁপিয়ে উঠে। )
রেবেকাঃ এই, কাঁদবি না, একদম কাঁদবি না বলছি... (বলতে বলতে রেবেকা নিজেও ফুঁপিয়ে উঠে)।
(কিছুক্ষণ নিরবতার পর...)
দীপ্তিঃ আমি আসি রে।
তুইও বাড়ি যা, খালামনি একা আছেন।
রেবেকাঃ দীপ্তি।
(দীপ্তি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রেবেকার দিকে তাকায়। )
রেবেকাঃ ভাইয়াকে তুই অনেক ভালোবাসিস, তাই না রে?
দীপ্তি কোন উত্তর না দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ফ্রেইম আউট হয়। রেবেকার রিএ্যাকশান দেখানো হবে।
কাট
দৃশ্যঃ ১৭/দিন/রেবেকার বাড়ির উঠোন (জুলকারনাইন, মনিরা)
পান চিবোতে চিবোতে জুলকারনাইন বাড়ির উঠোনে এসে বাড়ির দিকে উঁকিঝুঁকি দেয়। তারপর গলা খাকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দেয়। তাতেও কাজ না হওয়াতে এবার জুলকারনাইন হাঁক পারে।
জুলকারনাইনঃ ভাবীসাব বাড়িত আসেন না কি? রেবেকা মা...আ...আ...
(মাথায় কাপড় টেনে এই সময় মনিরা বেগম ভিতর বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে। )
জুলকারনাইনঃ আস্সালা...মুয়ালাইকুম, ভাবীসাব।
মনিরাঃ ওয়ালাইকুমাস্সালাম।
জুলকারনাইনঃ সব খবর ভালো তো আপনাগো?
মনিরাঃ এই তো চলতাসে। খাড়ান আপনার জন্য চেয়ার...
জুলকারনাইনঃ না না না... চেয়ার লাগবো না। এই পথ দিয়া যাইতেসিলাম, ভাবলাম আপনাগো একটু কুশল সংবাদ জিগায়া যাই।
(মনিরা কি বলবে বুঝতে না পেরে জোর করে হাসে।
)
জুলকারনাইনঃ তা রেবেকা মা রে দেখতাসি না... ভালো আসে তো ও?
মনিরাঃ জ্বী ভাইজান, ভালো আছে। ও মনে হয় গোসল করতে ঢুকসে।
জুলকারনাইনঃ ভালো ভালো। সাফসুত্রা পাক-পবিত্র থাকা সুন্নত। নবীজীর বয়ান।
মনিরাঃ তা তো নিশ্চয়ই... হেঃ হেঃ হেঃ...
জুলকারনাইনঃ তা শুনলাম রাবিদ বাবাজী নাকি হের মামা বাড়ি গেসে?
মনিরাঃ ঠিকই শুনসেন ভাইজান। ওর বড় ভাগ্নিটার অসুখ, তাই ওরে কইলাম একটু দেইখা আইতে।
জুলকারনাইনঃ ঠিকই করসেন, ভাবীসাব। আত্মীয়-স্বজনের খোঁজখবর আপনজনেরা না করলে আর কারা করবো, কন? তয়... (চারিদিকে একবার দেখে নিয়ে গলার স্বর নীচু করে) বুঝেনই তো ভাবীসাব, দিনকাল ভালা না। জোয়ান পোলাপানের রক্ত গরম।
দালালগো উস্কানীতে ওরা অহন এই দেশটারে ফানা করবার চায়। এই জন্যই তো মিলিটারী নামসে আমাগো পাকিস্তানের হুকুমত রক্ষার স্বার্থে।
মনিরাঃ কথা তো ঠিকই।
জুলকারনাইনঃ আমি জানি রাবিদ অমন পোলা না... কারো সাথেও নাই পাসেও নাই। কিন্তু মিলিটারী তো অতশত বুঝবো না ভাবীসাব।
জোয়ান মর্দ দেখলেই মুক্তিবাহিনী সন্দেহ কইরা ধইরা লইয়া যাইবো। তাই আমি কইসিলাম কি যে ওরে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরা আইতে কন। বিপদ কি আর বইলা কইয়া আহে, কন?
মনিরাঃ তা তো ঠিকই।
জুলকারনাইনঃ আমি এই দশ গেরামের খেদমদগার মানুষ। তাছাড়া আপনেরা হইলেন আমার পরতিবেশী... তাই ভাবলাম এই ব্যাপারে আপনারে একটু সাবধান থাকতে কই।
এই আর কী... হেঃ হেঃ হেঃ...
মনিরাঃ বইলা ভালাই করসেন ভাইজান। আমি একা মাইয়া মানুষ, তাই অতটা চিন্তা করি নাই। ভাইজান তাইলে একটু চায়ের ব্যবস্থা করি?
জুলকারনাইনঃ শুকরিয়া ভাবীসাব। আজ না। রাবিদে আহুক, তারপর না হয় একদিন হের লগে বইয়া চা খাইতে খাইতে গপসপ মারুম।
আজ আসি... আমার আবার গঞ্জে একটু কাজ আসে।
মনিরাঃ ঠিক আসে, ভাইজান।
(জুলকারনাইন ফিরে যেতে গিয়েও আবার ঘুরে দাঁড়ায়। )
জুলকারনাইনঃ (নীচু স্বরে) রাবিদরে জলদি ফিরা আইতে কইয়েন, ভাবীসাব। স্লামালাইকুম।
জুলকারনাইন ফ্রেইম আউট হয়। মনিরার রিএ্যাকশান দেখানো হবে।
কাট
দৃশ্যঃ ১৮/রাত/রেবেকার বাড়ির উঠোন, বাড়ির ভিতর (রেবেকা, মনিরা, রাবিদ)
উঠোনে ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে। এছাড়া চারিদিক নিস্তব্ধ। একটা ছায়ামূর্তির মতো চাদরে নিজের মাথা ঢেকে রাবিদ বাড়ির দরজায় এসে ঠক ঠক শব্দে টোকা দেয়।
কাট টু শট্-এ ভিতর বাড়িতে বিছানায় মনিরা ও রেবেকা পাশাপাশি শুয়ে আছে। ঠক ঠক শব্দ কানে আসতে একসময় রেবেকার ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে একবার দরজার দিকে, আরেকবার মনিরার দিকে তাকায়। তারপর রেবেকা মনিরাকে ডাক দেয়।
রেবেকাঃ (মনিরার গায়ে আলতো ধাক্কা দিয়ে) মা, ও মা... মা, শুনছো?
(মনিরা ‘উঁ’ শব্দ করে চোখ মেলে।
)
মনিরাঃ কি হইসে, রেবু?
(এই সময় বাইরে থেকে রাবিদের চাপা ডাক শুনা যায়। )
রাবিদঃ (অফ ভয়েস) রেবেকা... রেবু... মা...
(রেবেকা ও মনিরা ধরমর করে উঠে দাঁড়ায়। রেবেকা ছুটে যায় দরজার দিকে। মনিরা ততক্ষণে হারিকেনের সলতেটা বাড়িয়ে দেয়। )
রেবেকাঃ (ফিসফিস কন্ঠে) ভাইয়া?
রাবিদঃ (অফ ভয়েস) রেবু, দরজা খোল।
আমি!
মনিরাঃ (অস্ফুট স্বরে) রাবিদ!
(রেবেকা দরজা খোলে। রাবিদ ঘরে প্রবেশ করতেই রেবেকা দরজা বন্ধ করে। মনিরা রাবিদের দিকে ছুটে যেয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে। )
মনিরাঃ রাবিদ! সোনা আমার! তুই আইসস!
রাবিদঃ শ্শ্শ্... জোরে কথা বলো না তো। কেমন আছো, মা?
মনিরাঃ তুই নাই, আমরা ভালো থাকি কেমনে, বাবা?
রাবিদঃ আমার জন্য হলেও তোমাদের ভালো থাকতে হবে, মা।
(রেবেকাকে) ভালো আছিস, রেবু?
(রেবেকা নিরবে চোখ মুছতে মুছতে মাথা নাড়ে। )
মনিরাঃ কোত্থেকা আইলি বাবা? কই ছিলি এতোদিন?
রেবেকাঃ আহ্, মা! এখন এতো প্রশ্ন করো না তো! (রাবিদকে) ভাইয়া, ভাত খাবি তো?
রাবিদঃ খাবো, মানে! খিদায় প্রাণ যায় যায় অবস্থা! তাছাড়া কতদিন বাসার খাবার খাই না!
রেবেকাঃ মা, তুমি ভাত বারার ব্যবস্থা করো। আমি এক্ষুণি একবার ওবাড়ি থেকে আসছি।
মনিরাঃ কোন বাড়ি? এই রেবু! এতো রাতে এইটা আবার কী পাগলামী।
রেবেকা ছুটে বেরিয়ে যায়।
রাবিদ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মুচকী হেসে উঠে।
কাট
দৃশ্যঃ ১৯/রাত/পুকুর ঘাট (রাবিদ, দীপ্তি)
পুকুরঘাটে রাবিদ দাঁড়িয়ে আছে। আস্তে আস্তে একটা ছায়ামূর্তি ফ্রেইম ইন করে। দীপ্তি একটু সেজেগুজে এসেছে। আঁটো করে বাধা চুল, ডুরেকাটা শাড়ি, চোখে কাজল, কপালে একটা টিপ।
রাবিদ দীপ্তিকে দেখে কিছুক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকে। কেউ কোন কথা বলে না, শুধু অপলক দৃষ্টিতে দু’জন দু’জনার দিকে তাকিয়ে থাকা।
রাবিদঃ অপূর্ব সুন্দর লাগছে।
(দীপ্তি মাথা নীচু করে। রাবিদ দীপ্তির চিবুকে হাত রেখে তার মুখটা তুলে ধরে।
দীপ্তি চোখ বন্ধ করে। তার দু’গাল বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ছে। )
রাবিদঃ আমাকে দেখবে না?
(দীপ্তি ধীরে ধীরে চোখ খুলে রাবিদের দিকে তাকায়। )
রাবিদঃ (স্মিত মুখে) কি দেখতে পাচ্ছো, বলো... তোমার দেখা সেই কাপুরুষকে?
দীপ্তিঃ তুমি অনেক শুকিয়ে গেছ, রাবিদ ভাই।
রাবিদঃ শুকিয়েছি কি সাধে? সবই তোমার বিরহে...
দীপ্তিঃ (হেসে) এমন দুঃসময়ও ঠাট্টা করা মনে হয় একমাত্র তোমাকেই মানায়।
রাবিদঃ (কপট গাম্ভির্য) আমি ঠাট্টা করছি? প্রতিটা অপারেশনে যাবার আগে তোমার মুখ ভেসে উঠতো আমার দু’চোখের পাতায়... সেই চেনা মুখ...
দীপ্তিঃ আর আমি?... তোমার একটা খবর পাবার আশায় প্রতিটা মূহুর্ত দুঃসহ যন্ত্রণায় কেটেছে আমার... রেবুকে প্রতিদিন একবার করে তোমার সম্পর্কে প্রশ্ন করে করে জ্বালিয়ে মেরেছি। তুমি হুট করে একদিন এসে হাজির হবে- এই আশায় থেকে থেকে প্রতিনিয়ত আয়নায় নিজেকে সাজিয়েছি...
(রাবিদ এবার দীপ্তির একটা হাত ধরে। )
রাবিদঃ আমি খুব শীঘ্রিই আবার আসবো, দীপ্তি। একবারে দেশ স্বাধীন করে ফিরবো। আমি চাই তখনও যেন তুমি এমনি করে সেজে আমার জন্য অপেক্ষা করো।
কি? করবে না অপেক্ষা?
দীপ্তিঃ করবো। তুমি দেখে নিও।
(রাবিদ স্মিত হেসে দীপ্তির দিকে তাকিয়ে থাকে। )
দীপ্তিঃ কতদিন থাকবে তুমি?
রাবিদঃ আজ রাতেই তো সবে এলাম। শীঘ্রি ফিরে যেতে হবে, হয়তো দু’চার দিনের মধ্যেই।
অনেক কাজ এখনও পরে আছে দীপ্তি।
দীপ্তিঃ একদিন আমিই তোমাকে অপমান করেছিলাম যুদ্ধে যাচ্ছো না বলে। এখন এই আমারই তোমাকে যেতে দিতে মন চাচ্ছে না।
রাবিদঃ এটা শোননি? “যাওয়া বলে কিছু নেই, সবি ঘুরে ফিরে আসা...”।
(এই সময় অফ ভয়েসে রেবেকার গলার শব্দ শুনা যাবে।
)
রেবেকাঃ (অফ ভয়েস, গলা খাকারির শব্দ) টাইম ওভার। খাবার রেডি।
রাবিদঃ দেখ কান্ড! কাবাব মে হাড্ডি!
রাবিদ ও দীপ্তি পরষ্পরের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে উঠে।
কাট
দৃশ্যঃ ২০/রাত/রেবেকার বাড়ির উঠান, বাড়ির ভিতর (রেবেকা, মনিরা, জুলকারনাইন, রাবিদ, আর্মি)
গভীর রাত। বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।
মনিরা ও রেবেকা বিছানায় ঘুমাচ্ছে।
Mixed To
রাবিদের ঘরে বিছানায় রাবিদ ঘুমিয়ে আছে।
Mixed To
বাড়ির উঠোন। জুলকারনাইন গায়ে একটা চাদর মুড়ি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে ক্ষীণ চাঁদের আলো।
সেই আলোয় জুলকারনাইনকে স্পষ্ট চেনা যাচ্ছে। জুলকারনাইন এবার গলা খাকারী দেয়।
জুলকারনাইনঃ রাবিদ বাবাজী বাড়ি আসছো শুনলাম। বাবা রাবিদ... একটু বাইরে আসো বাবা। জরুরী দু’খান কথা আছে।
Mixed To
রাবিদ ধরমর করে উঠে বসে। অফ ভয়েসে জুলকারনাইনের গলা আবার ভেসে আসে। রাবিদ ঘরের একটা ফুটোতে চোখ রেখে বাইরের উঠোনে জুলকারনাইনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পায়। রাবিদের ভ্রু জোড়া কুঁচকে উঠে। অফ ভয়েসে আবার জুলকারনাইনের গলা শুনা যায়।
সে রাবিদকে ডাকছে। কাট টু শট্-এ রাবিদকে পা টিপে টিপে রেবেকাদের ঘরে প্রবেশ করতে দেখা যাবে। ততক্ষণে রেবেকা ও মনিরা দু’জনই জুলকারনাইনের গলার আওয়াজ পেয়ে উঠে বসেছে।
মনিরাঃ এতো রাতে কেন ডাকে এই হারামজাদা?
রাবিদঃ বুঝতে পারছি না, মা। তবে লোকটা যে একটা দালাল, এ খবর ইতিমধ্যেই আমার কানে এসেছে।
তোমরা ভয় পেও না। দেখি ব্যাটা কি জন্য এসেছে।
রেবেকাঃ না! তুমি বাইরে যাবে না ভাইয়া!
মনিরাঃ রেবেকা ঠিকই বলসে। তুই এতো রাতে বাইরে যাবি না। দরকার হইলে বইলা দে কাল সকালে আসতে।
(জুলকারনাইনের ডাক আবার বাইরে থেকে ভেসে আসে। )
জুলকারনাইনঃ (অফ ভয়েস) একটু বাইরে আসো বাবা। তোমার ভালোর জন্যই বলতেসি। তোমারে একটা ব্যাপারে সাবধান করতেই তোমার চাচার এতো রাইতে কষ্ট কইরা আসা...
রাবিদঃ আমাকে যেতে দাও, মা। একটা রাজাকারকে ভয় পাবার মতো কাপুরুষ আমরা মুক্তিযোদ্ধারা নই।
দেখি কি বলতে চায় লোকটা। বেশী তেরিবেরি করলে ঘারটা মটকে দেব।
রেবেকাঃ ভাইয়া প্লিস। আমার মন বলছে লোকটার উদ্দেশ্য ভালো নয়।
মনিরাঃ দোহাই লাগে বাবা, তুই বাইরে যাইস না।
রাবিদঃ (মনিরাকে জড়িয়ে ধরে) একজন মুক্তিযোদ্ধার মায়ের ভয় পেলে কি চলে? কিচ্ছু চিন্তা করো না। এই রাজাকারের বাচ্চার এতো সাহস নেই যে আমার কোন ক্ষতি করে।
(রাবিদ দরজা খোলে। পেছন থেকে মনিরা ডেকে উঠে। )
মনিরাঃ রাবিদ! বাপধন আমার...
(কাট টু শট্-এ রাবিদ তখন জুলকারনাইনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।
জুলকারনাইনের মুখে একপ্রস্ত হাসি। )
জুলকারনাইনঃ আমি ঠিকই খবর পাইসি যে তুমি আজ রাত্তিরে বাড়িত আইস। তা চুপে চুপে আইবার দরকারটা কি ছিল বাপধন? তুমি চোর, না ডাকাইত, না... মুক্তিবাহিনী, এ্যাঁ?
(দরজার চৌকাঠে ততক্ষণে মনিরা এসে দাঁড়িয়েছে। )
রাবিদঃ কাজের কথায় আসেন চাচা। এতো রাতে আমার বাড়িতে কি মনে করে?
জুলকারনাইনঃ কি মনে করে, বুঝতে পারো না? কুত্তার বাচ্চা দালালের ঘরের মুক্তি! তোমার মুক্তিগিরি আইজ আমি ছুটাইতেসি...
(বলতে না বলতেই কয়েক জোড়া আর্মির বুট রাবিদের চারপাশ ঘিরে ধরে।
একটা ধস্তাধস্তির শব্দ শুনা যায়। তারপর অফ ফয়েসে একটা কন্ঠস্বরঃ “লে চালো ইয়ে হারামী মুক্তি কো। কুইক!” ভয়েস ওভারে একটা জিপ গাড়ির শব্দ। ক্যামেরা প্যান করে দরজার চৌকাঠে দাঁড়ানো মনিরার উপর এসে থামে।
মনিরাঃ (অস্ফুট স্বরে)... ওরা কি আমার রাবিদরে ধইরা নিয়া গেল? ও রেবু... কথা কস না কেন? এ্যাঁ?
(ক্যামেরা ধীরে ধীরে রেবেকার মুখের উপর এসে থামে।
হারিকেনের মৃদু আলোয় রেবেকার চোখ জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। )
কাট
Flash In
দৃশ্যঃ ২১/দিন/গির্জার বাইরে (ফাদার, রেবেকা, হাসনাইন, ছেলে-বুড়োর দল)
গির্জার বারান্দায় ফাদার চেয়ারে বসে আছে। সামনে মাটিতে বসে কিছু ছেলে-বুড়োর দল ফাদারের বাণী শুনছে।
ফাদারঃ “যা আদি থেকে ছিল, যা আমরা শুনেছি, যা নিজেদের চোখেই দেখেছি, যা আমরা চোখ নিবদ্ধ রেখেই দেখেছি, ও আমাদের হাত সেই জীবনবাণীর যা স্পর্শ করেছে- হ্যাঁ, সেই জীবন আত্মপ্রকাশ করেছিল; আমরা তা দেখেছি, তার বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছি, আর তোমাদের কাছে সেই অনন্ত জীবনেরই সংবাদ জানাচ্ছি... যা আমরা দেখেছি ও শুনেছি, তোমাদের কাছে তারই সংবাদ জানাচ্ছি, তোমরাও যেন আমাদের জীবনের সহভাগী হতে পার; পিতার সঙ্গে ও তাঁর পুত্র যীশুখ্রীষ্টের সঙ্গেই আমাদের এই জীবন-সহভাগীতা। আর আমরা এই সমস্ত কথা লিখছি, আমাদের আনন্দ যেন পূর্ণ হয়...”
(ফাদারের বাণীবর্ষনের মধ্যেই ক্যামেরা প্যান করে মাটিতে বসা মানুষগুলোকে দেখাবে।
তারপর ধীরে ধীরে ক্যামেরা প্যানরত অবস্থায় দূরে বসা হাসনাইনের উপর চার্জ করবে। একটু দূরেই বসা রেবেকার উপর গিয়ে ক্যামেরা থামবে। হাসনাইন রেবেকার দিকে এগিয়ে গিয়ে পাশে বসবে। )
হাসনাইনঃ ফাদার খুব সুন্দর করে ভক্তদের বাণী দেন, তাই না? শুনতে বেশ লাগে।
(রেবেকা স্মিত হেসে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।
)
হাসনাইনঃ আমরা হয়তো আপনার গল্পের প্রায় শেষের পথে, তাই না?
রেবেকাঃ ঠিক ধরেছেন।
হাসনাইনঃ তারপর?
রেবেকাঃ (কিছুক্ষন শূণ্য দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকার পর)... তখন সেপ্টেম্বর মাস...
কাট
Flash Back
দৃশ্যঃ ২২/দিন/রেবেকার বাড়ির উঠান (রেবেকা, মনিরা, দীপ্তি)
বিস্রস্ত আলুথালু বেশে মনিরা উঠানের দাওয়ায় বসে আছে। একটু দূরেই রেবেকা কোথাও হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দীপ্তি ধীরে ধীরে ফ্রেইম ইন করে। মনিরা দীপ্তির উপস্থিতি টের পেয়েও তার দিকে তাকায় না।
দীপ্তি মনিরা ও রেবেকা থেকে একটু দূরত্ব রেখে দাঁড়ায়। বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা।
দীপ্তিঃ আমরা চলে যাচ্ছি।
(মনিরা ও রেবেকা এবার একসাথে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে দীপ্তির দিকে তাকায়। )
দীপ্তিঃ আমরা এ অঞ্চল ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছি, খালামনি।
(মনিরা ও রেবেকার নিরবতা। )
দীপ্তিঃ তোমরা কি কেউ কিছুই বলবে না?
রেবেকাঃ যেখানেই যাস, ভালো থাকিস দীপ্তি।
(দীপ্তি এবার রেবেকার কাছে এগিয়ে আসে। )
দীপ্তিঃ একটা অনুরোধ রাখবি?
(রেবেকা উত্তর না দিয়ে দীপ্তির দিকে তাকায়। )
দীপ্তিঃ যদি কখনও, কোনদিন যদি... ও ফিরে আসে... তবে ওকে বলিস, আমি ওর জন্য অপেক্ষায় আছি।
থাকবো।
(রেবেকা শূণ্য দৃষ্টি মেলে দীপ্তির দিকে তাকায়। মনিরা হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠে। দীপ্তির চোখেও পানি। )
দীপ্তিঃ আসি, খালামনি।
(দীপ্তি এবার রেবেকার দিকে তাকায়। তারপর আর একটা কথা না বলে প্রস্থান করে। ক্যামেরা এবার ধীরে ধীরে রেবেকার মুখ চার্জ করে। রেবেকের সারা মুখে কী এক দৃঢ়তার অভিব্যক্তি। )
রেবেকাঃ (স্বগতঃ) আমি ক্যাম্পে যাবো।
ভাইয়া নিশ্চইয়ই ওখানে কোথাও আছে...
কাট
দৃশ্যঃ ২৩/দিন বা রাত/গ্রামের পথ (রেবেকা, জুলকারনাইন)
রেবেকা গ্রামের মেঠোপথের এক ধারে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে জুলকারনাইনকে ছাতা মাথায় (যদি দৃশ্যটা দিন হয়) হনহন করে পাশ দিয়েই হেঁটে যেতে দেখা যাবে।
রেবেকাঃ জুলকারনাইন চাচা!
(নারী কন্ঠের ডাকে জুলকারনাইন হঠাৎ হকচকিয়ে যায়। )
জুলকারনাইনঃ কে? কে?
রেবেকাঃ (গাছের আড়াল থেকে বেড়িয়ে এসে) ভয় নেই। আমি রেবেকা।
জুলকারনাইনঃ রেবেকা? ওহ্... রেবেকা...মানে আমাদের রেবু! হেঃ হেঃ হেঃ... তা কি মনে...
রেবেকাঃ আমার ভাই কোথায় আছে, আপনি তা জানেন, তাই না?
জুলকারনাইনঃ ইয়ে মানে... সঠিক বলতে পারমু না, তবে আন্দাজ করতে পারি।
(জুলকারনাইন পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে। )
রেবেকাঃ ভাইয়া মিলিটারী ক্যাম্পে আছে। আপনি আমাকে সেখানে নিয়ে যাবেন।
জুলকারনাইনঃ (ঠোঁট বেকিয়ে কী যেন ভেবে নিয়ে) তুমি যাইতে চাও? সত্যি যাইতে চাও?
রেবেকার রিএ্যাকশান দেখানো হবে।
রেবেকা এক দৃষ্টিতে জুলকারনাইনের দিকে তাকিয়ে আছে।
কাট
Flash In
দৃশ্যঃ ২৪/দিন/মাতা মেরীর বেদী (রেবেকা, হাসনাইন)
ক্লোস শট্-এ ক্যামেরার ফ্রেইমে হাসনাইনের মুখ।
হাসনাইনঃ আপনি তাহলে ভাইকে খুঁজতে ক্যাম্পে গেলেন? সত্যিই গেলেন?
রেবেকাঃ (শূণ্যের দিকে দৃষ্টি মেলে) গেলাম।
হাসনাইনঃ তার পরিণতি কি হতে পারে, এটা জেনেও গেলেন?
Flash Cut
দৃশ্যঃ ২৫/রাত/মিলিটারি ক্যাম্প (রেবেকা, মিলিটারি) )[/sb
অন্ধকার স্যাতস্যাতে একটি ঘরের কোণ। রেবেকা হাঁটু গেড়ে দু’হাত দিয়ে হাঁটু আঁকড়ে ধরে গুটিশুটি হয়ে বসে আছে।
টুকরো টুকরো শট্-এ মিলিটারীর বুট, কোমর থেকে বেল্ট খুলে নেওয়া, বুটজোড়া রেবেকার দিকে এগিয়ে যাওয়া, ক্লোস শট্-এ রেবেকার ভয়ার্ত বিস্ফারিত চোখ-মুখ ইত্যাদি দেখানো হবে।
কাট
দৃশ্যঃ ২৬/দিন/মাতা মেরীর বেদী (রেবেকা, হাসনাইন)
ক্লোস শট্-এ একবার হাসনাইন ও তারপর রেবেকার অভিব্যক্তি দেখানো হবে। রেবেকার চোখের কোণায় একফোঁটা অশ্রুবিন্দু। রেবেকা চট করে চোখের পানিটুকু মুছে নেয়। দু’জনের কিছুক্ষণের নিরবতা।
হাসনাইনঃ আপনার মা কি এখনো...
রেবেকাঃ পাঁচ বছর হলো উনি স্বর্গে চলে গেছেন। তারপর থেকেই আমি এই চার্চে।
(নিরবতা)
হাসনাইনঃ আমাকে এবার উঠতে হবে। অনেক ধন্যবাদ এতোখানি সময় দেবার জন্য।
রেবেকাঃ আপনাকেও ধন্যবাদ এতোক্ষণ ধরে আমার কথা শুনবার জন্য।
চলে যাবার আগে শুধু একটা প্রশ্ন ছিল আমার।
হাসনাইনঃ বলুন।
রেবেকাঃ শুরুতেই আমাকে বলেছিলেন যে এই সাক্ষাতকারের জন্য আপনি নিজে বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞ থাকবেন। আপনি একটা পত্রিকার হয়ে এসেছেন। কিন্তু এই বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞ থাকার ব্যাপারটা একটু খুলে বলবেন কি?
হাসনাইনঃ (উঠে দাঁড়িয়ে) কারণ... কারণ যে জুলকারনাইন চাচাকে আপনি চিনতেন, আমি তারই ছেলে, হাসনাইন।
হাসনাইন আর এক মূহুর্ত অপেক্ষা না করে ঘুরে হাঁটা শুরু করে। রেবেকা হাসনাইনের চলে যাবার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এই সময় ঢং ঢং করে গির্জার ঘন্টা বেজে উঠার শব্দ শুনা যায়।
Freeze
সমাপ্ত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।