প্রযুক্তিকে ভালবেসে চলেছি অগ্রে..
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ভারত সীমান্তের কোল ঘেঁষে অবস্খিত ঐতিহ্যবাহী জেলা যশোর। ইতিহাস বলছে, ৩০ হাজার বছর আগে এখানে কোন ভূ-খন্ডরই অস্তিত্ব ছিল না। পুরোটাই ছিলো সমুদ্র। শুধু যশোর নয়, পশ্চিমে ভাগিরথী নদী, উত্তরে পদ্মা, পূর্বে মেঘনা এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর- এর মাঝখানে যে বিস্তৃীর্ণ ভূ-খন্ড বর্তমানে বিরাজ করছে তা অতীতে সমুদ্রের নীল জলে নিমগ্ন ছিল। গঙ্গা নদী তার শাখা-প্রশাখায় বালি, কাকর ও পলির সাহায্যে এ ভূ-খন্ড গঠন করেছে।
গঙ্গার পলি দ্বারা গঠিত এ ভূ-খন্ডটি গাঙ্গেয় উপদ্বীপ বা ব-দ্বীপ বলে পরিচিত ছিলো। ভৈরব ও কপোতাক্ষ ছিল পদ্মারই দুটি ধারা এবং তা যশোর জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত, সেহেতু এ নদী দুইটিই যে এ ভূ-খন্ড গঠন করেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলার ইতিহাস পর্যালোচনা করে র্আও জানা যায়, ভৈরব ব-দ্বীপ অঞ্চলের প্রধান দীর্ঘ নদ। তাই যশোর ভ-ূখন্ডের উৎপত্তির ইতিহাস ব-দ্বীপের গঠন প্রণালী ও উৎপত্তির ইতিহাসের সাথে একসূত্রে গাঁথা।
প্রায় ২৫ হাজার বছর আগে গঙ্গা নদীতে পলি জমে ভূমি গঠন শুরু হয়েছিলো বলে পন্ডিতরা মনে করেন।
এ থেকে বোঝা যায় যে ভৈরব নদী ও কপোতাক্ষ নদ তারও পর হতে ভূমি গঠনে ভূমিকা রাখে। যশোর অঞ্চলের ভূমির সঠিক বয়স নির্ণয় করা না গেলেও, পার্শ্ববর্তী ভূ-খন্ডের বয়সের সাথে তুলনা করে বলা যায় যে- এর বয়স বিশ হাজার বছরের কম নয়। ভূমি গঠনের প্রাথমিক যুগে জেলার অধিকাংশ স্খান পানিতে ডুবে থাকতো; এরই মাঝে ছিলো অনেক গুলো ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র দ্বীপ। ক্রমেই এই দ্বীপগুলো বড় হতে থাকে এবং কয়েকটি মিলে এক একটি বড় দ্বীপ গড়ে উঠতে থাকে। এ অঞ্চল যে একদিন ছোট ছোট দ্বীপে বিভক্ত ছিল তা আজও এখানকার অসংখ্য খাল-বিল-হাওড়-বাওড় ও মৃত নদী তা প্রমাণ করে।
চৌগাছা থানার বেড়গোবিন্দপুর গ্রামটি আজও একটি দ্বীপ আকারে সবার চোখে ধরা পড়ে। ক্রমেই দ্বীপে জন্মাতে থাকে বিভিন্ন প্রকারের গাছ-পালা যার ফলে সমগ্র ব-দ্বীপটিই একটি গহীন জঙ্গলে পরিণত হয়। এটিই পরবর্তীতে সুন্দরবন নামে পরিচিতি লাভ করে। অর্থাৎ আজকের এই যশোর জেলা একদিন সুন্দরবনেরই একটি অংশ ছিল বলে ইতিহাসবিদরা অনুমান করেন। তাছাড়াও কূপ খনন এবং টিউবওয়েলের পাইপ বসানোর সময় এ অঞ্চলে মাটির বহু নীচ থেকে বিভিন্ন গাছের পাতা এবং কাঠের টুকরা পাওয়া যায়।
এ গুলো এ অঞ্চলে বনভূমির অস্তিত্বেরই সাক্ষ্য দেয়। ক্রমেই বাঘ-ভালুক-স্বরীসৃপ ও বিভিন্ন প্রজাতির পাখিতে ভরে যায় এ বনভূমি। কিন্তু এই বনভূমি তখনও মানুষের বসবাস উপযোগী হয়ে উঠেনি। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে গঙ্গার নিóíাঞ্চল স্যাঁতস্যাতে ও মনুষ্য বাসের অনুপযোগী ছিল। ক্রমেই ভূপরিভাগ উঁচু হতে থাকে এবং এ অঞ্চলে বিভিন্ন জাতের মানুষ যথা আর্য-দ্রাবিড়-মঙ্গল-নমশুদ্র-পোদ-চন্ডাল-কৈবর্ত্য-হাড়ি-ডোম-বাগতি-বাউরি ও আদিম অধিবাসীরা এসে বসবাস গড়ে তুলতে থাকে।
নিষাদ, কিরাত ও বাগদি জাতির বসবাসও ছিল এখানে। বাগদীদের বাস ছিল বলে যশোর অঞ্চল বাগড়ী নামে পরিচিত ছিল।
ইতিহাস বলে, প্রায় তিন হাজার বছর আগে নমশুদ্র-পোদ-চন্ডাল-কৈবর্ত্য এ সব জাত চাষা এ অঞ্চলে এসে বনজঙ্গল পরিস্কার করে কৃষি কাজ শুরু করে এবং স্খায়ী আবাস গড়ে। এরাই এ অঞ্চলের প্রথম বা আদি বাসিন্দা। লোক বসতি গড়ে উঠার সাথে সাথে এ অঞ্চলের দ্বীপগুলির নামকরণ হতে থাকে।
প্রাচীনকালে এসব দ্বীপের কি নাম ছিল তা আজও অজানা রয়েছে। তবে বল্লাল সেনের রাজত্বকালে (১১৫৮ খৃ সমগ্র ব-দ্বীপ কতগুলো প্রধান দ্বীপে বিভক্ত ছিল এবং তাদের কি কি নাম ছিল তার বিবরণ পাওয়া যায় এড়ুমিশ্রের “কারিকা” নামক সংস্কৃত গ্রন্থে। “কারিকা” অনুযায়ী নব-দ্বীপ রাজ্য (গোটা ব-দ্বীপ) বারটি প্রধান দ্বীপে বিভক্ত ছিল। এ দ্বীপগুলি হল-অগ্রদ্বীপ, মধ্যদ্বীপ, চন্দ্রদ্বীপ, নবদ্বীপ, এড়ুদ্বীপ, প্রবালদ্বীপ, কুশদ্বীপ, অন্সদ্বীপ, বৃদ্ধদ্বীপ, সুর্যদ্বীপ, জয়দ্বীপ ও চন্দ্রদ্বীপ। মুর্শিদাবাদ ও তার নিকটবর্তী স্খান নিয়ে অগ্রদ্বীপ গঠিত এবং তারপর হতে দক্ষিণ দিকে সমুদ্র পর্যন্ত বাদবাকী এগারটি দ্বীপ বিস্তৃত।
এ দ্বীপগুলির মধ্যে অ্রদ্বীপ ও সূর্যদ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে আজকের এই যশোর জেলা। চৌগাছা, ঝিকরগাছা, শারসা, মনিরামপুর, কেশবপুর প্রভৃতি স্খান অন্সদ্বীপ এবং বার বাজার, খাজুরা, মুড়লী প্রভৃতি স্খান সুর্যদ্বীপের অন্তর্গত।
এ জেলা অসংখ্য অধিবাসী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিল। হিন্দু রাজত্বের সময় বৌদ্ধদের জোর পূর্বক হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত করা হয়। যোগী, ভড়ং, তাঁতী, মাহিষ্য, কপালি, নমশূদ্র প্রভৃতি জাতির লোকেরা অধিকাংশই বৌদ্ধ ছিল।
কায়েস্ত, ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য জাতির লোকেরাও এদেশে বসবাস করত।
যশোর নামের উৎপত্তি :
যশোর নামের উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত পাওয়া যায়। যশোর (জেসিনরে) আরবি শব্দ যার অর্থ সাঁকো। অনুমান করা হয় কসবা নামটি পীর খানজাহান আলীর দেয়া (১৩৯৮ খৃ। এককালে যশোরের সর্বত্র নদী-নালায় পরিপূর্ণ ছিল।
পূর্বে নদী বা খালের উপর সাঁকো নির্মিত হতো। খানজাহান আলী বাঁশের সাকো নির্মাণ করে ভৈরব নদী পার হয়ে মুড়লীতে আগমন করেন বলে জানা যায়। এই বাঁশের সাঁকো থেকে যশোর নামের উৎপত্তি। কোন কোন ইতিহাসবিদের মতে খানজাহান আলীর পূর্ব থেকেই এই যশোর নাম ছিল। অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেন যে, প্রতাপাদিত্যের পতনের পর চাঁচড়ার রাজাদের যশোরের রাজা বলা হত।
মহারাজ প্রতাপাদিত্যের পিতা বিক্রমাদিত্য ও তাঁর এক সহযোগি বসন্ত রায় গৌড়ের এক চরম অরাজকতার সময় সুলতানের অপরিমিত ধনরত্ন নৌকা বোঝাই করে গোপনে যশোরে প্রেরণ করেন। গৌড়ের ধনরত্ন বোঝাই অসংখ্য নৌকা যশোর পৌঁছিল। ধীরে ধীরে বন জঙ্গলে আবৃত্ত যশোরের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিষ্ঠিত হয় যশোর রাজ্য। নবপ্রতিষ্ঠিত রাজ্যের নামকরণ হল যশোহর।
প্রবাদ আছে গৌড়ের যশ হরণ করে এই শহরের শ্রীবৃদ্ধি হওয়ায় স্খানীয় পুরাতন নাম যশোর পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন নামকরণ হয় যশোহর। যশোর শব্দ যশোহর শব্দের অপভ্রংশ। যশোহর শব্দের অর্থ পরের যশ হরণকারী অধিক যশস্বী ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠান। ইংরেজ শাসকগণও এই নাম “ঔবংংড়ৎব” ব্যবহার করেছেন।
আবার সুন্দরবনের আরেক স্খানের নামও যশোর।
প্রাচীন যশোর আধুনা যশোর হতে ৮০ মাইল দুরে খুলনা জেলা শ্যামনগর থানার মধ্যে।
যশোর রাজ্যের বিবর্তন :
ষোড়শ শতকের শেষপাদে (১৫৭৪: খৃ প্রতাপাদিত্য যশোরের সুন্দরবন অঞ্চলে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতাপাদিত্যের পতনের পূর্বে ভবেশ্বর রায় মুঘলদের সহযোগিতা করে পুরস্কার স্বরূপ রাজা উপাধিসহ যশোরের চাঁচড়ায় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। যশোর রাজ্য ছিল আকারে বিশাল। রাজ্যের সম্মানে ও ঐতিহ্যে যশোর এককালে ছিল ঐশ্বর্যময়।
সপ্তদশ শতকের প্রথম দশকে রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজ্যের পতন ঘটে। মুঘল ও নবাবের হাতঘুরে জনপদের নি:শর্ত মালিকানা অষ্টাদশ শতকের ষাটের দশকে কোম্পানীর হাতে আসে। বেনিয়াদের স্বার্থে প্রশাসনিক করণে জনপদটি আকারে ছোট হয়ে ১৭৮৬ খৃ: যশোর জেলা নামে পরিচিতি লাভ করে। এটিই বাংলা প্রদেশে প্রথম গঠিত জেলা। সময়ের বাঁকে বাঁকে ভৌগলিক ও প্রশাসনিক প্রয়োজনে যশোর জনপদের রূপান্তর ঘটে।
মুর্শিদাবাদের নবাব সরকারের পতনের পর ১৭৭২ সালে কোম্পানী সরকার যশোর বা মুড়লী কসবায় রাজস্ব সংগ্রহের জন্য একজন কালেক্টর নিয়োগ করেন। ১৭৮২ সালে একজন ম্যাজিষ্ট্রেট যশোরের জন্য নিযুক্ত করা হয়। ৫ই আগস্ট ১৭৮৮ তারিখে মহকুমা কোর্ট যশোরের মুরলিতে স্খানান্তরিত হয়। এটি বাংলার প্রথম মহকুমা। ১৭৮৯ খৃষ্টাব্দে এই অফিস মুড়লীর পাশ্ববর্তী কসবা বা সাহেবগঞ্জে স্খাপিত হয়।
তখন থেকে এই স্খানের নাম স্খায়ীভাবে যশোর হয়। এভাবে মুড়লী কসবার নাম ধীরে ধীরে ইতিহাসের পাতা থেকে পর্দার অন্তরালে চলে যায়। সেকালে প্রশাসনিক একক ছিল থানা।
ত্রিমোহনীর নিকট মীর্জানগর সমৃদ্ধ জনপদ ছিল এবং সেখানে থানা ছিল। পরে ১৮৬৩ খৃ: পর্যন্ত ত্রিমোহনীতে থানা থাকে।
১৮৬৪ সালে যশোর মিউনিসিপলিটি গঠিত হয়। অনেক ভাঙ্গা-গড়ার স্বাক্ষী হয়ে যশোর আপন ঐতিহ্যে উজ্জ্বল হয়ে আছে। বনগাঁ পিচের রাস্তা ১৮৬৬-১৮৬৮ কালপর্বে তৈরী হয়।
ভূগোলকে ২১’ ৪৫”- ২৩’ ৪৫” উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯’ ১৫”- ৮৯’ ৫৫” পূর্ব দ্রাঘিমাংশের ভূ-ভাগই যশোর। আদি যশোরের আয়তন ছিল ১৪ হাজার ৫শ ৬০ বর্গ কিলোমিটার (৫হাজার ৬’শ বর্গ মাইল) যার মধ্যে ৪৪ হাজার ৬’শ ১৬ বর্গ কিলোমিটার (১হাজার ৭’শ ৬০ বর্গ মাইল) সুন্দরবন।
যশোর-ঝিনাইদহ-মাগুরা-নড়াইল-খুলনা-বাগেরহাট-সাতক্ষীরা এবং কুষ্টিয়া ও ফরিদপুরের অংশ বিশেষ এছাড়া পশ্চিম বাংলার বনগাঁ মহকুমা যশোর রাজ্যভুক্ত ছিল। খুলনা মহকুমা বাগেরহাট ও সাতক্ষীরাসহ ১৮৮২ খৃ: যশোর জেলা হতে আলাদা হয়ে স্বতন্ত্র জেলায় উন্নীত হয়। এই কালপর্ব থেকে প্রাক-পাকিস্তান পর্বে যশোর জেলার আয়তন ছিল ৭ হাজার ৬;শ ৫০ বর্গ কিলোমিটার (২ হাজার ৯’শ ২৫ বর্গ মাইল)। কথিত কালপর্বে যশোর সদর (১৭৮৮), বনগাঁ ও মাগুরা (১৮৪৫), নড়াইল (১৮৬১) এবং ঝিনাইদহ (১৮৬২) এই পাঁচটি মহাকুমা যশোর জেলাধীন ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়।
বনগাঁ বাদ দিয়ে অন্য চারটি মহকুমা নিয়ে গঠিত হয় বৃহত্তর যশোর জেলা। এর সাথে যুক্ত হয় বনগাঁর শার্শা ও মহেশপুর থানা। সে সময়ে যশোরের আয়তন ছিলো ৬৫ হাজার ৭’শ ৯২ বর্গ কিলোমিটার (২ হাজার ৫’শ ৪৭ বর্গ মাইল)। ১৯৮২ সালে সামরিক সরকার প্রধান এইচ. এম. এরশাদ প্রশাসন গণমুখী করার লক্ষ্যে থানাকে উপজেলায় এবং মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করেন। ঝিনাইদহকে আলাদা জেলা হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয় ২৩ শে ফেব্রুয়ারী ১৯৮৪ সালে।
একই বছরের ১ লা মার্চ জেলা করা হয় মাগুরা ও নড়াইলকে। এর আগেই থানাসমুহ উপজেলায় উন্নীত হয়। বর্তমান যশোর জেলার আয়াতন ২ হাজার ৫’শ ৬৭ দশমিক ৭৭ বর্গ কিলোমিটার (৯’শ ৮৭ দশমিক ২২ বর্গ মাইল)।
আধুনিক যশোর জেলা ও প্রতাপাদিত্যের যশোর এক নয়। প্রাচীন ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত রূপই আজকের এই যশোর জেলা।
যশোরের সাথে জড়িয়ে আছে হযরত খানজাহান আলী, গাজী-কালু, গরীব শাহ ও বোরহান শাহ-এর মত মহাপুরুষদের নাম। খান জাহান আলী বহু পূর্ব থেকেই যশোর ও বারোবাজার হিন্দু বৈদ্য জাতির প্রাণ কেন্দ্র ছিল বলে অনুমান করা হয়। ময়নামতি, মহাস্খানগড় ও পাহাড়পুরের ন্যায় বারোবাজারের আছে সুপ্রাচীন ইতিহাস। যশোরে সর্বত্র ইতিহাসের খনি বিদ্যমান। এখানকার ভরত ভায়না, শৈলকুপা, মির্জানগর, বেড়বাড়ি প্রভৃতি অতি প্রাচীন স্খান।
ভরত ভয়নায় সুউচ্চ মৃত্রিকার ঢিবি বিদ্যমান যা বৌদ্ধ আমলের ভরত রাজার বাড়ি হিসেবে পরিচিত। গৌঢ় বঙ্গের টাকশাল ছিল মুহম্মদাবাদে (উত্তর যশোর)। হোসেন শাহ, নসরত শাহ এই টাকশাল থেকে মুদ্রাংকন করেছিলেন। বাংলার অন্যতম স্বাধীন সুলতান শেরশাহ যশোর থেকে ভূষনা (ফতেহবাদ) পর্যন্ত একটি দীর্ঘ রাস্তা নির্মাণ করেছিলেন। এই রাস্তা দিয়ে তখন ডাক চলাচল করত।
সম্ভবত শেরশাহ ছিলেন এই ডাক চলাচলের প্রবর্তক। বেরইল গ্রামের নবগঙ্গার তীরে একটি ডাক চৌকির অফিস ছিল যা বর্তমানে চৌকির ভূঁই নামে পরিচিত। ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপায় শাহী মসজিদ যশোর জেলার অন্যতম প্রাচীন কীর্তি। যশোর শহরের দক্ষিণ দিকে অবস্খিত মুড়লী প্রাচীন ঐতিহাসিক স্খান। এখানে হাজী মুহাম্মদ মহসীনের প্রতিষ্ঠিত ইমামবাড়া অবস্খিত।
এর পশ্চিমে চাঁচড়া রাজবাড়ি। দানশীল জমিদার কালিবাবু যশোর কলিকাতা রাস্তা নির্মাণ করে স্মরনীয় হয়ে আছেন এখনও। রামনগরে অবস্খিত খানজাহানের খনন করা দীঘি, যা পিকনিক কর্ণার নামে পরিচিত। মীর্জানগর ও ত্রিমোহনীতে ইতিহাসের অনেক উপাদান রয়েছে। নওয়াপাড়া শিল্প বাণিজ্যের জন্য বিখ্যাত।
ছাতিয়ানতলা মুন্সী মেহেরুল্লার জন্মভূমি। বাসুড়ী গ্রামে খানজাহান খনন করা একটি বিশাল দিঘী দেখা যায়। সাগরদাড়ি- কপোতাক্ষ নদীর তীরে মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মভূমি। শোলখাদা গ্রামে বৈজ্ঞানিক ডাক্তার নীল রতন ধরের জন্ম। বাঘা যতিনের জন্ম ঝিনাইদহে।
বিজয়পুরে রাজা মুকুট রায়ের খনন করা দীঘি যা ঢোল সমুদ্র নামে পরিচিত। হরিশংকরপুরে প্রখ্যাত গনিতবিদ কে. পি বসুর জন্মস্খান। যশোরের বকচরে বিশ্ববিখ্যাত জ্যোর্তিবিদ রাধা গোবিন্দের জন্মস্খান। যশোরের কোটচাঁদপুর চিনি শিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। মহেশপুরে সূর্য বংশীয় রাজাদের শাসন কেন্দ্র ছিল।
লোহাগড়ার বড়দিয়া পাট ব্যবসায়ার কেন্দ্র। কালিয়া বাংলাদেশের মধ্যে একটি বৈদ্য প্রধান স্খান। লোহাগড়া ও সালনগরে আছে বিখ্যাত জোড়বাংলা মন্দির। বিদ্যানন্দকাটি গ্রামে খানজাহান আলী খনন করা বিরাট দীঘি অবস্খিত।
আজকের যশোর রাতারাতি বর্তমান অবস্খায় আসেনি।
ইউরোপীয় রেনেসাঁর প্রথম প্রভাব পড়ে কলকাতায়। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা এবং যশোরে। জনপদের মানুষ নতুন স্বপ্নচারী হয়ে ওঠেন। ফলে ভারতবর্ষে প্রথম পর্যায়ে চারটি ইংরেজি স্কুলের একটি প্রতিষ্ঠিত হয় যশোরে ১৮৩৮ খৃ:, যশোর জিলা স্কুল। ১৮৫৪ খৃ: স্খাপিত হয় যশোর পাবলিক লাইব্রেরী।
বর্তমানে এটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরাতন লাইব্রেরী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লাইব্রেরী ভবন অধিগ্রহণ করা হলে (১৯৪২) লাইব্রেরীকে পৌরসভা ভবনে রূপান্তর করা হয়। ১৯৬৪ সালে দ্বি-তল লাইব্রেরীর নতুন ভবন তৈরী হয়। শিক্ষাবিদ কাজী মোতাহার হোসেন ভবনের প্রাণদান করেন। ১৯২৮ সালে সাংস্কৃতির বিকাশে স্খাপিত হয় যশোর ইনস্টিটিউট।
যশোরের প্রখ্যাত উকিল শ্রী অবিনাশ চন্দ্র সরকার তৈরী করেন পিতার নামে বিশ্বনাথ হল। যশোরের সংস্কৃতি অঙ্গনে নাম দু’টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ১৩ ই জুলাই, ১৮৬৪ ঘোষিত হয় যশোর পৌরসভা। জীবনের আবশ্যকীয় আনুসঙ্গগুলো উঁকি দিতে শুরু করে যশোরের বিভিন্ন অঙ্গণে। কসবা এলাকা আকর্ষণীয় হয়ে উঠে রাতারাতি।
বিদ্যুতের আলোতে ঝলসানো যশোরের বয়স সাত দশকের চেয়ে বেশী। সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের বিপরীতে অবস্খিত কলিন্স ওয়াটার ওয়ার্ক ভবন (১৯১৪) শহরে পানীয় জল সরবরাহের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আজকের পুরানো পৌর-ভবনের পিছনের লালদিঘীর পানির উপর শহরবাসীর বৃহদাংশের জীবন নির্ভর করতো। ১৯২২ সালে যশোরে প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুল ও হাসপাতাল। ইউরোপীয় ধাঁচের অনেক ইমারত যশোর জনপদের রেনেসাঁর প্রমাণ।
কলকাতার সাথে যশোরের রেল-যোগাযোগ শুরু হয় উনবিংশ শতকের আটের দশকে। তখন যশোর ছিল বাংলার একটি অতি গুরুত্বপূর্ন জেলা শহর। বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় ও চতুর্থ দশকে প্রতিষ্ঠিত হয় যশোর বিমান বন্দর। তখন বিমান ছিল স্বপ্নের পাখি। প্রায় এই সমসাময়িককালে ঢাকা বিমান বন্দর প্রতিষ্ঠিত হয়।
তখন যশোরের সাথে শুধু কলিকাতা নয়, ঢাকাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন শহরের সাথে আকাশ পথে যোগাযোগ স্খাপন হয়।
কেবল একটি বা দু’টি অধ্যায়ের নয়; প্রতিটি অঙ্গণে রয়েছে যশোরের সমৃদ্ধ ইতিহাস।
সাগর থেকে দ্বীপ, আর দ্বীপ থেকে আজকের এই যশোর। এক সময় ছিলো পশু-পাখির বাস আর বনজঙ্গল; আর এখন আধুনিক বিশ্বের আধুনিক মানুষের বসবাস। এভাবেই যশোর তথা ব-দ্বীপের ইতিহাসের পদযাত্রা।
তবে আশংকার কথা- পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, আগামী কয়েক দশকের মধ্যে যশোরসহ বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চল সমূদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে।
সম্পাদনা :
মো: হাসানূজ্জামান বিপুল - প্রতিষ্ঠাতা, যশোর ওয়েবসাইট
তৈহিদুর রহমান - প্রিন্সিপাল অফিসার, ইসলামী ব্যাংক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।