বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
নভেরা এখন কোথায়?
শূন্য ঘরে গুমরে ওঠে অভিমান ।
ঘর ভরতি এপ্রিল মাসের ঝরঝরে রোদ। কালরাতে অবশ্য জোর বৃষ্টি হয়েছিল।
আজকের এই দিনের শরীরে সেসবের চিহ্নমাত্র নেই। বেলা তিনটের মতো বাজে। লেখার টেবিলে বসে আছে হাসনাত। টেবিলের ওপর বইপত্তর, অভিধান, লেখার খাতা -সবই এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে। তার মধ্যে হাসনাতের সদ্য প্রকাশিত বইটিও রয়েছে।
‘আহ্, সেরাফিনা’। হাসনাত দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। ওই উপন্যাসের জন্য জীবন এলোমেলো হয়ে গেল তার। বইটা চলল না। পুরো ফ্লপ।
বইটা লিখতে গিয়ে নভেরাকেও হারাল হাসনাত। মাত্র এক বছর আগে বিয়ে হয়েছিল। অনেক স্বপ্ন ছিল, সে সব স্বপ্ন এখন ধূলিস্মাৎ ... প্রকাশনা জগতে হাসনাতের জানাশোনা ভালো। এবারের বই মেলায় গ্রন্থকীট প্রকাশন থেকে ছাপা হয়ে বেরুল ২৭২ পৃষ্ঠার উপন্যাসটি। বিক্রি তেমন হল না।
তার ওপর অনেক টাকা গচ্চা গেল। কি কারণে যেন পাঠক নতুন লেখকের বই কিনতে চায় না। অস্থির বোধ করে হাসনাত। কয়েকটা কাগজে বইয়ের বিজ্ঞাপন দিন। খামাখা ঋন বাড়ল।
কত স্বপ্ন ছিল সেরাফিনা মারদির লাঞ্ছনার ইতিহাস তুলে ধরবে সচেতন পাঠকের কাছে। যে সেরাফিনা সম্বন্ধে ২ এপ্রিল, ২০১১, দি ডেইলি স্টার লিখেছে ... Serafina Mardi, the now-deceased gang rape victim, took her life in protest at the settlement forced on her family by community leaders and Shurshunipara Catholic Church in Godagari upazila...
কেমন অবসন্ন বোধ করছে হাসনাত।
আজকাল এমন হচ্ছে। মাথা ঝিমঝিম। রাতে ভালো ঘুম হয় না।
চোখে ঝাপসা দেখে। পাঞ্জাবির চশমা মুছে নিল। পাঞ্জাবিটা গিফট করেছিল নভেরা। লেখালেখি করত বলেই হাসনাতের প্রতি ঝুঁকেছিল নভেরা । নইলে বাংলার তরুণ প্রভাষক কবি সাদেক সাইফ-এর কী গভীর আকর্ষন।
ফরসা, ঝাঁকড়া, জলদ গম্ভীর কন্ঠস্বর। নভেরা বাংলা পড়াত, হাসনাত ইংরেজি। কলেজটি সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড়ে। কলেজ ছুটির পর দু’জনে একসঙ্গে পাশাপাশি ফুটপাতের ওপর অনেক ক্ষণ হাঁটত। কখনও মেঘ জমত আকাশে।
ঝিরঝির বৃষ্টিতে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যেত লেকের ধারের ঝকঝকে কোনও রেস্তোঁরায়। চা নিয়ে মুখোমুখি বসে থাকত । মানুষের জীবনে এমন সুখের দিনও আসে ... নভেরারা থাকত কলাবাগানে, নভেরার বাবা (খান মুহাম্মদ বজলুর রশীদ মৃধা) সরকারি চাকরি করেছেন, রিটায়ার করেছেন, ভীষণ অমায়িক বৃদ্ধ। তিনজনে মিলে বৃষ্টির বিকেলে কত না চা-মুড়ির আড্ডা হয়েছে। হাসনাত থাকত ভূতের গলি বড় ভাইয়ের সঙ্গে ।
বিয়েটা ঠিক হতেই দু’ রুমের ছোট্ট বাড়ি নিল ঝিকাতলার মনেশ্বর রোডে কলেজ কাছাকাছি হয় বলে ।
সেই বাড়ি এখন ফাঁকা ... সুনসান করে ... একা একা মন খারাপ আর অস্থিরতার মধ্যে কাগজের ওপর হিজিবিজি লেখার অভ্যাস আছে ... হাসনাত গদ্যে সাবলীল, কবিতা তেমন আসে না, তবুও ভাবনাগুলি কখনও কখনও সাঙ্কেতিক ভাষায় কবিতায় আশ্রয় পায় ...
আমি যার আশ্রয়ে থাকি
সে মাঝে মাঝে পাগল হয়ে যায়।
তখন আমার চশমাটা যায় হারিয়ে,
জানলা ভেঙে ঘরে ঢোকে বৈশাখী দানোর লেজ
আমি তার নুনমুখে চুমু খাই আশ্লেষে ...
কিংবা মোড়ের রেস্তঁরায় ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকি
দেখি জন¯্রােত রাস্তার অথৈ জল ভাসছে
শহরটিও থই থই ভাসছে কালো জলে
যে জলে ভেসে যায় আমার স্বপ্ন ...
আমার জীবন ...
আমার আত্মা
ফোন বাজল। শাহানা। শাহানা ছোট বোন।
মালীবাগ চৌধুরীপাড়া থাকে । ওর বড় মেয়েটা অসুস্থ। শাহানার স্বামী ফাটকা বাজারে লস করে লাপাত্তা। কিছু টাকা ধার চায় শাহানা। হাসনাতের কাছে এখন টাকা নেই।
ফোন অফ করে দিল হাসনাত। বইটা বের করতে অনেক টাকা বেরিয়ে গেল। শক্ত বোর্ড বাঁধাই, ঝকঝকে প্রচ্ছদ, অফসেট কাগজ। যে বইটি সেরাফিনা মারদির মৃতুর প্রতিবাদে আলোরণ তুলবে সেই বইটি দেখতে সাদামাটা হলে চলবে কেন? শাহানার মুখটি ভেবে গ্লানি বোধ করে। মৃতা সেরাফিনা মারদির কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে শরীরে ৭৫% বার্ন নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় । আশ্চর্য ! বইটা প্রকাশ পেল ওই মাসেই।
একজন লেখক এরচে বেশি আর কি করতে পারে হেনা?
বিয়ের পর নভেরাকে নিয়ে দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলায় বেড়াতে গিয়েছিল হাসনাত । বিরল উপজেলাটি শালবন আর সাওতাল অধ্যূষিত। দু’জনে শালবনে ঘুরে বেড়াত।
ঘুরে ঘুরে দেখত সাওতাল পল্লী। সে সময় পত্রিকায় বেরুল এক মর্মান্তিক সংবাদ। রাজশাহীর গোদাগারী উপজেলায় সেরাফিনা মারদি নামে এক সাঁওতাল কিশোরীকে এক দল সাঁওতাল যুবক গ্যাং রেইপ করে । (পরে আত্মহত্যা করে সেরাফিনা ...) নভেরা নারী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। খবরটা পড়ে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে।
হাসনাত সান্ত¦না দেয়। ... একদিন বিকেল। শালবনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল দু’জন। পবিত্র সরেন নামে স্থানীয় এক তরুণের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ওদের। সেও সঙ্গে ছিল।
শালবনের গভীরে একটা পরিত্যক্ত গির্জে। কেমন থমথমে পরিবেশ। আকাশে অনেক বাদুড় উড়ছিল। পবিত্র সরেন উনিশ শতকের প্রেক্ষাপটে মধ্যবয়েসি সাঁওতালি নারী আর এক বৃদ্ধ আইরিশ বিশপের এক করুন প্রেমকাহিনী বলল। রায়ান মারফি কে ভালোবেসেছিল সাঁওতালি নারী বাদলি সরেন কে ।
স্থানীয় সাঁওতালরা ক্ষুব্দ হয়ে দু’জনকেই পুড়িয়ে মারে। তখনই একটা বড় লেখার আইডিয়া এল হাসনাতের। গোদাগারীর সেরাফিনা মারদির বিপর্যয়ের কথা মাথায় ঘুরছিল। সিদ্ধান্ত নিল সেরাফিনা মারদি কে লেখায় ফুটিয়ে তোলার । উপন্যাসের নাম: ‘আহ্, সেরাফিনা’ ।
ভিলেন কাল্লাস মারদি, নির্মল মুর্মু, জুলিয়ান মারদি, জুয়েল মারদি, সেমোন হেমব্রম, সাইমন মুর্মু, পরিমল সরেন, ইলিয়াস মুর্ম এবং রঞ্জন মারদি। এরাই সেরাফিনা মারদি কে ৪ এপ্রিল ২০১০ গণধর্ষন করেছিল। হাসনাত লিখতে শুরু করে। উপন্যাসের থিম শুনে নভেরা উচ্ছ্বসিত। প্রথম প্রথম যথেষ্ট সার্পোট দিয়েছিল।
... লেখার সে কি ঘোর ... সেই ঘোরে পড়ে নভেরা কে পর্যন্ত ভুলে গেল, লেখার সময় নভেরা কাছে এলে অসহ্য ঠেকত। লেখাটা তখন চেপে বসেছে মাথায়। পাগলের মতো লিখছে, লম্বা ছুটি নিয়েছে, আইরিশ চার্চ সম্বন্ধে তথ্যাদি যোগার করতে একবার কলকাতা গেল, নভেরা যেতে চেয়েছিল ... একা থাকবে বলে নেয়নি ...
এখন সেসব কথা মনে করে গ্লানি বোধ করে।
কিংবা নভেরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ঘোর কেটে গিয়েছে।
এখন অন্য কাউকে ভালো লাগছে। হয়তো নভেরার একটা অজুহাত দরকার ছিল। সে অজুহাত হাসনাতই তৈরি করে দিয়েছে ...উপন্যাস লেখার ঘোরে পড়ল ...... ঘোর কেটে গেবে কবে। এখন বাস্তবতা দাঁত বসাচ্ছে ... বেশ কয়েক মাসের ভাড়া বাকি। সংসারের খরচ শেয়ার করত নভেরা।
সেই নভেরার দেখা নেই ...। শেষবার দেখা হয়েছিল ফেব্রুয়ারির শেষে । নভেরার বাবা খান মুহাম্মদ বজলুর রশীদ মৃধা মাঝে মাঝে ফোন করেন । হাসনাতকে ¯েœহ করেন। বৃদ্ধ বেশ পড়–য়া।
হাসনাতের উপন্যাস পড়ে উচ্ছ্বসিত।
তাতে কী লাভ?
মোবাইল বাজল। নাঈম। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু, এখন একটা প্রাইভেট ব্যাঙ্ক চাকরি করে।
হ্যালো।
দোস্ত খবর কি?
এই তো। হাসনাতের গলা শুকিয়ে আসে।
আজ আসর বসবে মঞ্জুরের বাসায়। তোমাকে খবর দিতে বলল। সময় মতো চলে এসো।
নাঈম বলল।
ও কে।
নাঈম ফোন কেটে দেয়।
মঞ্জুর বাসা ওয়ারি। ওখানেই আজ আসর বসবে।
আসরে নানা রকম আয়োজন থাকে। হাসনাত কেবল মদটা খায়। ছাত্রজীবনে টুকটাক অভ্যেস ছিল। পরে ছেড়ে দিয়েছিল। এখন আবার শুরু করেছে।
নভেরা কে দেখে না। বুকের ভিতরে ভীষণ ছটফটানি। বইটাও ফ্লপ মারল ...
সহসা চায়ের তৃষ্ণা পায়। ফ্লাস্কে চা ছিল। শেষ।
এখন আর রান্নাঘরে যেতে ইচ্ছে করছে না। সে লেখালেখি করে বলেই চা তৈরিতে পটু। দৈনিক ১৫/২০ কাপ চা চাই। কে এত চা তৈরি করে দেবে? বরং সে নিজেই কাজটা সেরে নেয়। গুড় চা পছন্দ করে হাসনাত।
বিরক্ত হয়ে একটা সিগারেট ধরালো হাসনাত। হাত কাঁপছে। কলেজে যাওয়া দরকার, নইলে চাকরি থাকবে না। ছুটি ফুরিয়েছে কবে। কলিগরা সব ফোন করে।
হাসনাত এড়িয়ে যায়। সাহিত্যমনস্ক বলেই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অসম্ভব জনপ্রিয় হাসনাত। তাদের ২/১ জন ফোন করে। হাসনাত এড়িয়ে যায়। ... কলেজে যেতে ইচ্ছে করে না।
বইটা আলোরণ তুলল না। কলিগদের কাছে দাঁড়াতে সঙ্কোচ হয় ... নভেরা নাকি কলেজ যায় ...কলিগদের মধ্যে রেহনুমার সঙ্গেই কেবল ফোনে কথা হয়। রেহনুমা হাসনাত আর নভেরার কলিগ এবং কমন ফ্রেন্ড। কলেজে গিয়ে একবার নভেরার মুখোমুখি দাঁড়ানো যায় ...কিন্তু যখন রেহনুমার মুখে শুনল নভেরা কলাবাগানে বাবার বাড়ি থাকে না ...তখন ...তখন কথাটা শুনে ভয়ানক চমকে উঠেছিল হাসনাত।
... তাহলে নভেরা এখন কোথায় থাকে?
শরীরে এক পিচ্ছিল অনুভূতি হয় হাসনাতের ... তার ভুঁরু কুঁচকে ওঠে।
নভেরার তো কোন ঘনিষ্ট পুরুষবন্ধু নেই। কিন্তু এই কথাই-বা উঠছে কেন? ওঠার কি কারণ নেই? যখন এ শহরের বিবাহিতা স্ত্রীরা অনায়াসে শরীর তুলে দিচ্ছে অন্য পুরুষের কাছে, যখন সে রকম রগরগে ভিডিও ফুটেজ আর দূর্লভ নয়, যখন স্কুলকলেজের ছাত্রছাত্রীদের মোবাইল থেকে মোবাইলে সে সব অন্তরঙ্গ যৌন দৃশ্য বিলি হয় ব্লু টুথের মাধ্যমে ...আশ্চর্য! কি অনায়াসে সম্পর্কগুলি ভাঙছে আজকাল, যেন দাম্পত্য সম্পর্ক মেলায় কেনা দু-পয়সায় পলকা খেলনা-একদিনের বেশি টেকে না ।
হাসনাত শিউড়ে ওঠে।
কিন্তু, নভেরার কোন ঘনিষ্ট পুরুষবন্ধু তো নেই।
পরক্ষনেই মনে হল ছিঃ ছিঃ আমি এমন কথা ভাবছি কেন?
কিন্তু, নভেরা এখন কোথায়?
মাস দুয়েক আগে রেহনুমা বলল কবি সাদেক সাইফ-এর ইদানীং বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে।
লোকটার গভীর আকর্ষন। ফরসা, কাঁধ অবধি ঝাঁকড়া চুল, জলদ গম্ভীর কন্ঠস্বর। নভেরা তার কবিতার প্রশংসা করত। ... কিন্তু, তা বলে ... যাঃ, তাই হয় নাকি!
কিন্তু, নভেরা এখন কোথায়?
টিভিটা চলছে। অবশ্য ভলিউম কমানো।
এটিএন নিউজের খবর চলছে। রাজপথে একদল কাফনের কাপড় পরা মাদ্রাসার ছাত্রকে ধাওয়া করছে পুলিশ । একজন মাদ্রাসা ছাত্রের চেহারা অবিকল মাহবুবের মতো ... শরিয়তপুরের ১৪ বছরের হেনাকে যে ধর্ষন করেছিল। হাসনাতের শরীরের রক্তে ঝড় ওঠে। এরা হেনাদের দোররা মারার জন্য ওত পেতে থাকে, এরা দেবে সম্পত্তিতে সমানাধিকার? ধিক! সরকারই -বা এই ইস্যু এখন কেন তুলল? ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে প্রগতীবাদী হয়ে ওঠার জন্য ... যাতে পরের বার ক্ষমতায় আসতে পারে? বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর আরও পুরস্কার চাই বলে? ...আসবে সবই পলিটিক্স।
হেনা আর সেরাফিনাদের বাঁচাতে কোনও শক্তিশালী পক্ষ নেই। ... তাহলে এরা মারা যেতেই থাকবে?
সব কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে ...
হেনা হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। দোররা-জর্জরিত দেহ। চিকিৎসক নির্লিপ্ত। কত রোগীই তো আসে।
এভাবে একটি কিশোরীর মৃত্যু ঘনিয়ে আসে, যাকে নিয়ে লেখা যায় মহাকাব্য ... যে মহাকাব্যের নাম হতে পারে ... হেনা এক স্ফুলিঙ্গের নাম ...যে ছারখার করে দেবে পৃথিবীর সব ফতোয়াবাজদের ...
দুপুরের রোদ মুছে যেতে থাকে। হাসনাত অসহায়ভাবে দেখে। মাসটা এপ্রিল। চকিতে টি এস এলিয়ট এর একটি কবিতার লাইন মনে পড়ে যায় তার ... April is the cruellest month ... এলিয়ট কেন লিখেছিলেন এ রকম ভয়ানক কথা? ‘আমরা ফাঁপা মানুষ!’ ‘আমরা ফাঁপা মানুষ!’ আমরা হেনা আর সেরাফিনাদের মেরে ফেলি ...
এইসব এপ্রিল দিনে একটানা রোদের নিশ্চয়তা নেই। দগ্ধ আকাশে মেঘের আনাগোনা।
দলছুট অবাধ্য হাওয়ারা জানালায় এসে আড়ছে পড়ছে। দূরের মেঘ তাড়িয়ে নিয়ে আসছে। আজ বৃষ্টি হবে কি? হতে পারে। জানালার নীচে গলি। রিকশার টুংটাং শব্দ দোতলায় উঠে আসছে।
হাসনাতের কেমন ঘোর লাগে।
কলিংবেল বাজল।
কে এল এ সময়?
হাসনাত এর ভুঁরু কুঁচকে যায়। উঠে দরজা খুলতে যায়।
আশ্চর্য! নভেরা দাঁড়িয়ে।
কালো ব্লাউজ। আর সবুজ পাড়ের সাদা সুতীর শাড়ি পরেছে আজ। শ্যামলা মিষ্টি মুখটি বড় মলিন, বড় গোল ফ্রেমের চশমা। মুখটা বিষন্ন। কেন যেন মনে হয় অনিদ্রা রোগে ভুগছে।
আমার কিছু জিনিস আছে। নিয়ে যেতে এসেছি। নভেরা বলল।
এসো।
হাসনাত সরে যায়।
বেলি ফুলের বাসী গন্ধ পায়। তার বুকটা ঢিপ ঢিপ করছে।
... ৬২ বছর বয়েসি আইরিশ যাজক রায়ান মারফি সাদা রঙের চার্চের একটি প্রকোষ্ঠে বসে আছেন। হঠাৎই তিনি বেলি ফুলের টাটকা গন্ধ পান। বাদলি সরেন প্রকোষ্ঠে ঢুকেছে।
আজও কলাপাতায় মুড়ে ভাত রেঁধে এনেছে । সঙ্গে শজারুর টকটকে লাল ঝাল মাংস। আজকাল এই মাঝবয়েসি সাঁওতালি নারীটি রায়ান মারফির সমস্ত সত্তা আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সাঁওতালি ভাষা রপ্ত করেছেন মারফি, কিছু দিন হল তিনি বাদলি-র নাম রেখেছেন সেরাফিনা। কেন? তা তিনি নিজেও জানেন না।
সেরাফিনা বিধবা। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়েস। চার্চের কাছাকাছি শালবনের গভীরে কুঁড়েঘরে থাকে। গায়ের রং -যেমন হয়- কালো । তবে সামান্য নড়াচড়াতেই পৃথুলা শরীরজুড়ে কালো মেদের তরঙ্গ উছলে ওঠে ...বৃদ্ধ বিশপের নুব্জ দেহে ফিরে আসে কাম, ফিরে আসে যৌবন ... (আহ্, সেরাফিনা থেকে ...)
নভেরা আধো-অন্ধকার খাওয়ার ঘর পেরিয়ে বেডরুমের দিকে যেতে থাকে।
হাসনাত সেই অবিশ্বাস্য দৃশ্যটির দিকে চেয়ে থাকে। সে কি করবে বুঝতে পারে না। ভীষণ সঙ্কুচিত বোধ হচ্ছে তার। সে রান্নাঘরের দিকে যেতে থাকে । নভেরার জন্য এক কাপ চা তৈরি করবে ।
নভেরা চিনি ছাড়া ‘র চা’ খেতে ভালোবাসে। রান্নাঘরে অন্ধকার। হাসনাত সুইচ টিপে আলো জ্বালাল। বদ্ধ বাতাসে বাসী হলুদের গন্ধ । আজকাল দু-বেলা বাইরেই খাচ্ছে ... ধীরে সুস্থে চুলা ধরায়।
এরই মধ্যে হাওয়ারা অশান্ত হয়ে উঠছে। জানালার কপাটে ধাক্কা মারছে। তার মানে বৃষ্টি হবে। বৃষ্টিতে কি নভেরা আটকে যাবে না? মেঘ জমতে শুরু করেছে আকাশে। তখন? তখন নভেরা কি ভাবে যাবে? ইচ্ছে করেই কি বৃষ্টির সম্ভাবনাময় মেঘলা দিনে এসেছে ও?
চায়ের কাপ নিয়ে খাবার ঘরে এল হাসনাত।
নভেরা কোথায়? এখনও বাথরুমে? ও চা খাবে তো? যদি না খায়? এতদিন পরে এল? চা খাবে না। কেবল জিনিস নিতে এল? বসবে না? কথা বলবে না? আমি কি জিগ্যেস করব ... তুমি কি কবি সাদেক সাইফ-এর সঙ্গে থাক? ওই লোকটার সঙ্গে তোমার কি সম্পর্ক? জান না কবি সাদেক সাইফ একটা লম্পট? রেহনুমা বলেনি? এক ছাত্রীর সঙ্গে কেলেঙ্কারী করেছে। এসব কথা জিগ্যেস করা কি ঠিক হবে?
নভেরা বেরিয়ে আসে। হাতে একটা ব্যাগ। কোনও কথা না-বলেই দরজার কাছে পৌঁছে গেল।
কত কথা বলার ছিল। বলা হল না।
সহসা সম্বিৎ ফিরে পেল হাসনাত ...
কই, কেউ তো আসে নি । কেবল ঘরটা মেঘের ছায়ায় কালো হয়ে উঠছে। না, নভেরা আসেনি।
নভেরা ভীষণ অভিমানী মেয়ে। নভেরা আর আসবেও না। যদিও ওর এই সংসারটা অবিকল আছে। থাকবে। চিরদিন অবিকল থাকবে।
ঠিক আগের মতোই থাকবে। সংসার আগলে রাখবে হাসনাত। গভীর শূন্যতা নিয়ে বাঁচবে। নভেরার জন্য কখনও খুব খারাপ লাগলে মঞ্জুরের ওখানে গিয়ে আকন্ঠ মদ গিলবে। কিংবা ছোট বোন শাহানাকে নিয়ে আসতে পারে।
তাহলে শূন্য ঘর ভরে উঠবে। এখনও সব শেষ হয়ে যায়নি, এখনও বাঁচার অনেক পথ খোলা আছে ...
...আর ... আর সে তো কোনও ভুল করেনি, একটা উপন্যাস লিখে সেরাফিনার ওপর লাঞ্ছনা-নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছে মাত্র, মেইনস্ট্রিম থেকে একজন লেখকের প্রতিবাদ করা দরকার ... উপন্যাস লেখার সময় নাভেরাকে কিছু অবহেলা করা হয়েছে ঠিকই তবে সে ভুল করেনি ... হাসনাত তার উপন্যাসে কাল্লাস মারদি, নির্মল মুর্মু, জুলিয়ান মারদি, জুয়েল মারদি, সেমোন হেমব্রম, সাইমন মুর্মু, পরিমল সরেন, ইলিয়াস মুর্ম এবং রঞ্জন মারদির কথা লিখেছে। এরাই ৪ এপ্রিল ২০১০ সেরাফিনা মারদি কে সম্মলিত ভাবে ধর্ষন করেছিল। এই পাষন্ডদের কথা লেখা দরকার ...আরও লেখা দরকার ... উনিশ শতকের প্রেক্ষাপটে মধ্যবয়েসি সাঁওতালি নারী আর এক বৃদ্ধ আইরিশ বিশপের করুন প্রেমকাহিনী । রায়ান মারফি কে কেন ভালোবেসেছিল সাঁওতালি নারী বাদলি সরেন ? কি ছিল দু’জনের আত্মার স্বরূপ? কেন স্থানীয় সাঁওতালরা ওদের ওপর ক্ষুব্দ হয়ে উঠল? এবং দু’জনকেই পুড়িয়ে মারল? বাদলি সরেন কে ভালোবেসে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের পবিত্রতা নষ্ট করেছিল বৃদ্ধ এক আইরিশ বিশপ? তাহলে সেরাফিনার ওপর অত্যাচার করে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের পবিত্রতা কোথায় গেল?
এই প্রশ্নই তুলেছে উপন্যাসে ...
সেরাফিনার করুন পরিনতিতে কি একটা মর্মান্তিক ব্যাপার আছে।
সেরাফিনা বাংলাদেশে সংখ্যালঘু। তাদের ওপর চলে অত্যাচার নির্যাতন ... মূল¯্রােতের লোকজন শালবন উজাড় করে দিচ্ছে, সাঁওতালদের বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ করছে। যে কারণে সেরাফিনাদের একজোট হয়ে থাকার কথা। অথচ বাস্তবে দেখা গেল আপন গোষ্ঠীতেও সেরাফিনা নিরাপদ না। কিশোরী মেয়েটি অত্যন্ত নির্মম ভাবে ধর্ষিতা হল আপন গোষ্ঠীর যুবকদের কাছেই ... (আশ্চর্য এই ... হেনা বাংলাদেশের মূলধারার একজন।
অথচ তার মৃত্যুও হল আপন গোষ্ঠীর কালা-কানুনের জন্য ...) ... সেরাফিনাকে যারা ধর্ষন করেছিল, তারা ১ লক্ষ ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে মীমাংসা চেয়েছিল, নিষ্পত্তিতে স্থানীয় গোষ্ঠীপিতা এবং পুরুষতান্ত্রিক গির্জাপিতাদেরও সম্মতি ছিল । সেরাফিনা হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ে, ১ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা এদের কাছে অনেক, তবু দৃঢ়চেতা কিশোরী মেয়েটি রাজি হয়নি, সে ধর্ষকদের বিচার চেয়েছে, না পেয়ে ক্ষোভে দুঃখে অপমানে শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এ বিষয়ে ডেইলি স্টার লিখেছে ...Cornelius (সেরাফিনার বাবা, কৃষিশ্রমিক) said Moheswar Soren, Lobin Hembrom, Jotin, Monir Murmu, Amin, Bhawani, Fabian Murmu and Moti Mardi were among those who forced him to accept the settlement. Serafina's mother Susana Soren alleged that instead of taking actions against the rapists, the community leaders fined her husband Tk 1,200 for yelling at the rapists. Godagari Pargapa Parishad president Biswanath Tudu, among other community leaders, headed the settlement. He said the settlement was aimed to maintain peace. “While both the sides accepted the judgment, what is the problem here?” he asked. Dhonai Soren, president of Kakonhat Poura Pargana Parishad, said he had walked out of the meeting to protest the fining instead of a trial. Soon after the settlement, the accused started roaming freely again, adding to the humiliation and torments Serafina had been going through. After she set herself ablaze on February 17, she was admitted to the surgery ward of Rajshahi Medical College Hospital.
আহ, সেরাফিনা ...
তোমার মৃত্যুযন্ত্রণার কাছে আমার এই দুঃখার্ত সময় কী এমন কঠিন ...
হাসনাত পাথরের মূর্তির মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে । নভেরাশূন্য ঘরে আপন শূন্যতাকে উপলব্দি করতে থাকে ... আর শহরটার আকাশ জুড়ে আরও ঘন মেঘ জমে ওঠে ... খাওয়ার ঘরটা অন্ধকার হয়ে যেতে থাকে ... জানালার পাল্লায় ঝড়ো বাতাসের আত্মাহুতি ... অবিকল সেরাফিনা যেন .. যেন হেনার গল্পটাও লিখে সর্বনাশের চূড়ান্ত কিনারায় দাঁড়াতে বলছে ... হেনার গল্পটা লেখার সময় পৃথিবীর সবাইকে অস্বীকার করতে বলছে ...
উৎসর্গ: হেনা এবং সেরাফিনা মারদি ...এ রকম মৃত্যু আর দেখতে চাই না ...
তথ্যসূত্র:
Click This Link
Click This Link
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।