আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পোলাওয়ের সুবাস

শেখ হাসিনা রান্নাঘরে, রাঁধুনির অ্যাপ্রন পরে তিনি হাঁড়িতে খুন্তি নাড়ছেন, সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত এই ছবিতে বলা হচ্ছে, তিনি তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্মদিনে পোলাও রাঁধছেন। বাঙালিদের কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রান্না হলো মায়ের হাতের রান্না। কাজেই মা শেখ হাসিনা যদি ছেলে জয়ের জন্মদিনে পোলাও রাঁধেন, আর সেই ছবি জনতা দেখতে পায়, সবার মনে একটা স্নিগ্ধ অনুভূতিই তৈরি হয়। আবার সজীব ওয়াজেদ জয়, যিনি আওয়ামী লীগ সভাপতির তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা, যোগ দিয়েছেন যুবলীগের ইফতার অনুষ্ঠানে, সেখানে মাতামহের মতো তর্জনী উঁচিয়ে তিনি বলেছেন, তাঁর কাছে তথ্য আছে, আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসবে। এই নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় উঠেছে।

বিরোধী নেতারা প্রকাশ্যে—অন দ্য রেকর্ড—বলছেন, তার মানেটা হলো, ওরা নীলনকশার নির্বাচন করবে। কারচুপি করবে। এবার ব্যাপারটা খোলাসা করতে এগিয়ে এসেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। তিনি জানাচ্ছেন, তাঁরা জনমত জরিপ করে দেখেছেন, আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা ঠিক আছে, তাঁর দল নির্বাচনে ভালো করবে। স্বয়ং শেখ হাসিনার কণ্ঠে এই ব্যাখ্যা শুনে নিশ্চিত হওয়া গেল।

শেখ হাসিনার কাছে জনমত জরিপের ফল আছে, আগামী নির্বাচনে জনগণের ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ পুনর্নির্বাচিত হবে।
নিশ্চিত হওয়া গেল, কথাটা কেন বললাম। তার মানে হলো, দেশে একটা ভোট হতে যাচ্ছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট বলছে, রোজার পরে তারা লগি-বৈঠার চেয়েও ভয়াবহ আন্দোলন করবে। লন্ডনে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জ্যেষ্ঠ পুত্রও আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

এই সরকারের মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে, আগস্টে ঈদ, মধ্যখানে সেপ্টেম্বর, তারপর অক্টোবর। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হলে অক্টোবরের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে হবে। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরেরও একটা উক্তি দেখলাম পত্রিকান্তরে, ২৫ অক্টোবরের মধ্যে সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দেবে।
সামনে আছে জোর লড়াই। তারই যেন সাজ সাজ রব বিরোধী শিবিরে।

সরকারি লোকজন বলছেন, নির্বাচন হবে এবং তা হবে পৃথিবীর অন্য সব গণতান্ত্রিক দেশে যেমন করে হয়, তেমন করে, নির্বাচিত সরকারের অধীনে। তাঁরা এক দিনের জন্যও অনির্বাচিত সরকার দেশে দেখতে চান না। বিএনপি বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া এই দেশে কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। লগি-বৈঠার আন্দোলনের চেয়েও নাকি ভয়ংকর আন্দোলন হবে।
বাজিছে দামামা।

তখন দুটো কথা আমাদের সুড়ঙ্গের প্রান্তে একটুখানি আলো দেখায়। একটা হলো, শেখ হাসিনা ও সজীব ওয়াজেদ জয়ের কাছে তথ্য আছে, আওয়ামী লীগ জনমত জরিপে এগিয়েই আছে। আরেকটা হলো, বিএনপি নেতার বক্তব্য, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে নির্বাচন হলেও বিএনপি জোট বিপুলভাবে জয়লাভ করবে। বিশেষ করে সদ্য সম্পন্ন পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারি দলের গো-হারা অবস্থা বিরোধী দলকে বিপুলভাবে উজ্জীবিত করেছে। এ ছাড়া একাধিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে, বিরোধী দল এখন সরকারি দলের চেয়ে বেশি জনপ্রিয়।


উভয়পক্ষই যখন দেখতে পায়, ভোট হলে তারাই জয়লাভ করবে, তখনই দেশে ভোট হয়। শেখ হাসিনা ও সজীব ওয়াজেদ জয়ের কাছে থাকা তথ্যই এখন আমাদের কাছে আশার সূত্র, যেহেতু তাঁরা জানেন, ভোট হলে তাঁরা জিতবেন, কাজেই তাঁরা ভোট দেবেন। একই কথা প্রযোজ্য বিরোধী পক্ষের জন্যও। তারাও জানে, ভোট হলেই তারা জয়লাভ করবে। হাওয়া এখন তাদের পক্ষে।

কাজেই তারা নির্বাচনে অংশ নেবে এবং দেশে ভোট হবে।
দেশে ভোট হোক, এটাই আমরা চাই। এবং সেটা কেবল একটা নিয়ম রক্ষার ভোট নয়, জনমতের প্রকৃত প্রতিফলনের ভোট। আমরা বিশ্বাস করি, দেশের মানুষ ভোট দিতে কখনো ভুল করে না, এবারও করবে না। জনগণের রায়, সেটা আপাতত যত তেতোই হোক না কেন, আমাদের মেনে নিতে হবে।

গণতন্ত্রের চেয়ে ভালো পদ্ধতি পৃথিবীতে আপাতত দেখা যাচ্ছে না। আমরা জানি, আমাদের গণতন্ত্র মানে নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র, প্রায় রাজতন্ত্র ও পরিবারতন্ত্র, লুটপাটতন্ত্র, তবুও গণতন্ত্রই একমাত্র বিকল্প, গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হবে চোখের মণির মতো।
আর কোনো জনপ্রিয় দল কিংবা মতকে জোর করে দমন করে রাখা যায় না, ক্ষমতার বাইরেও রাখা যায় না। ইয়াহিয়া খান চেয়েছিলেন ১৯৭০-এর নির্বাচনের পরে, নির্বাচিত ব্যক্তিদের ক্ষমতার বাইরে রাখতে। ফল ভালো হয়নি।

আলজেরিয়া, মিসর, তুরস্কের অভিজ্ঞতা বলছে, যারা জনপ্রিয়, যারা নির্বাচনে জিতে আসে, তাদের ক্ষমতার বাইরে রাখার চেষ্টা সুফল বয়ে আনে না। তাতে রক্তক্ষয় হয়। দেশের উন্নতি হয় না। আর বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা বলে, জনগণ যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে কাকে তারা জয়ী করবে, তখন সেই জনমত পাল্টানো যায় না, জনমতের প্রবল হাওয়া সব ষড়যন্ত্র উড়িয়ে নিয়ে যায়।
আমাদের গণতন্ত্র আমাদের সরকার আমাদের রাজনীতি আমাদের শাসনযন্ত্র নিয়ে আমাদের এক শ একটা অভিযোগ আছে।

কিন্তু তা সত্ত্বেও বলতে হবে, বাংলাদেশ বহু দিক থেকে ভালো করছে। সুশাসন পেলে, রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকলে এই দেশের উন্নতি, এই দেশের মানুষের বিজয় কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। ড. অমর্ত্য সেন যে বারবার বলছেন, বাংলাদেশ ভারতের থেকে বহু বিষয়ে ভালো করেছে, তা এমনি এমনি বলেননি। ভারতে শৌচাগার ব্যবহার করে না শতকরা ৫০ ভাগ মানুষ, বাংলাদেশে সংখ্যাটা ৮ ভাগ। সবাই মিলে চেষ্টা করলে এটাকে শূন্য ভাগে নামিয়ে আনা এখনই সম্ভব।

আমাদের গড় আয়ু ভারতীয়দের চেয়ে বেশি। শিশুমৃত্যু রোধ, নারীমৃত্যু রোধে আমরা ভালো করছি। সহস্রাব্দ লক্ষ্য পূরণে অনেক ক্ষেত্রে আমরা সময়ের চেয়ে এগিয়ে আছি।
পরিচিত এক উন্নয়নকর্মী গিয়েছিলেন নীলফামারীর এক গ্রামে। তাঁর অনুসন্ধানের একটা বিষয় ছিল এই যে বাংলাদেশ সহস্রাব্দ লক্ষ্য অর্জনে ভালো করছে, এটার স্বরূপটা বোঝা।

তিনি বলছেন, ব্যাপারটা কোনো জাদু নয়, এটা এমনি এমনি ঘটেনি। অনেক বাস্তব কারণে ও পদক্ষেপের জন্য এই উন্নতি ঘটেছে। গ্রাম বদলে গেছে। প্রথমত বদলেছে গ্রামের মানুষের মন, তারা এখন অনেক বেশি সচেতন। নারী-শিশু-প্রসূতি মৃত্যু কমেছে, কারণ বাল্যবিবাহ কমে গেছে, মেয়েরা স্কুলে যায়, মেয়েরা গার্মেন্টসে কাজ করে এবং মেয়েরা এনজিও কর্মকাণ্ডে যুক্ত থেকে স্বাবলম্বী ও আত্মমর্যাদা সচেতন হয়েছে।

শুধু তা-ই নয়, তারা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যায়, তাদের স্বাস্থ্য অধিকার আদায় করে নেয়। ফলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর সেবার মানও বাড়াতে হচ্ছে। আর আছে সেফটি নেটওয়ার্ক। নিরাপত্তাবলয়। এর পরিধি বাড়ানো হয়েছে এবং তার সুবিধা গ্রামবাসী আদায় করে নিচ্ছে।

মোবাইল ফোনের বিস্তৃতি, এনজিও কর্মকাণ্ড, সরকারি উদ্যোগ, লেখাপড়ার প্রসার, সেফটি নেটওয়ার্ক—সবটা মিলে গ্রাম তো আর সেই পিছিয়ে পড়া অন্ধকার জনপদ হয়ে নেই।
অন্যদিকে আছেন আমাদের প্রবাসী শ্রমিকেরা। তাঁরা বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাচ্ছেন। আরও পাঠাবেন। দেশে শিল্পায়ন চলছে, গার্মেন্টস থেকে শুরু করে ওয়ালটন—সবই তো সাফল্যগাথা।

২০ বছর পরে দেশটা অর্থনৈতিক দিক থেকে উন্নত হয়ে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন দরকার উন্নয়নবান্ধব রাজনীতি। এখানে ড. মুশতাক খানের তত্ত্বটাই বারবার করে মনে পড়ে। মাথাপিছু আয় যে দেশে বেশি নয়, সে দেশে সুশাসন আসে না। আগে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, তারপর সুশাসন।

তার পরামর্শ হলো, যেখানে যেখানে উন্নতি হচ্ছে, সেখানে আসলে আছে উন্নয়নবান্ধব সরকার। এমন না যে উন্নয়নবান্ধব সরকার মানে দুর্নীতিমুক্ত শাসন। তারা আগে চায় উন্নয়ন, তারা এমন দুর্নীতি করে না, যাতে উন্নয়ন প্রকল্পই ভেস্তে যায়। সেতু বানালে সেটা সব দিক থেকে সুন্দর ও টেকসই করেই বানায়, তাতে যার যা কমিশন খাবার, তা যে সে খায় না, এমন নয়।
আগামী তিন মাস আমাদের জন্য খুব একটা ক্রিটিক্যাল সময়।

আমাদের প্রত্যাশা হলো, গণতন্ত্র অব্যাহত থাকুক, ভোট হোক, ভোটে সব পক্ষ অংশ নিক, ভোটে জনগণের মতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটুক। তারপর যারাই ক্ষমতায় আসে, আমরা তাদেরকে স্বাগত জানাব। তারপর তারা যদি জনবিরোধী কাজ করতে থাকে, তখন এই দেশের সদা জাগ্রত জনগণই তা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশ অতীতে অনেক কঠিন সংকটের ভেতর দিয়ে গেছে, প্রতিবারই সেই সংকট থেকে উত্তরিতও হয়েছে। এবারও হবে।

শুধু এই কথাটা আরেকবার বলি, পৃথিবীর অন্য দেশের ঘটনাবলি থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে, জনগণের রায়কে যেন কোনো অজুহাতেই আমরা পাল্টে দেওয়ার বা দমন করার চেষ্টা না করি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই আগামী নির্বাচনে জয়ের সুবাস পেতে শুরু করেছে, সেটাই আমাদের জন্য দিচ্ছে স্বস্তির সুবাতাস, তা পোলাওয়ের সুবাসের চেয়ে কম কি!
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। ।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।