হাসান আরিফ
ভারতের ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম শিপমেন্ট মঙ্গলবার আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে আগরতলায় পেঁৗছে _ফাইল ফটো
বাংলাদেশের বুক চিড়ে সড়কপথে ভারতের জন্য বিনাশুল্কে ট্রানজিট সুবিধা কার্যকর হয়েছে। ভারতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের সরঞ্জামবাহী ৩২৬ টন ভারী চারটি ট্রেইলার গত রোববার কলকাতা থেকে যাত্রা করে আশুগঞ্জ হয়ে মঙ্গলবার ত্রিপুরায় পেঁৗছেছে। এর মাধ্যমে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রানজিট সুবিধা নেয়া শুরু করল। অথচ এ ব্যাপারে এখনো কোনো চুক্তি হয়নি। তৈরি হয়নি কি-নোট পেপারও।
এমনকি ট্রানজিটের ব্যাপারে সরকারের স্পষ্ট কোনো ধারণাও নেই। তার পরও জনগণকে অন্ধকারে রেখে সরকার তড়িঘড়ি করে ভারতকে ট্রানজিট দিয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিবেশী পরাশক্তি ভারত তার প্রভাব খাটিয়ে কোনো প্রকার চুক্তি ছাড়াই বাংলাদেশের ওপর দিয়ে তাদের পণ্য পরিবহন শুরু করেছে। অথচ এক দেশের পণ্য আরেক দেশের ওপর দিয়ে যেতে হলে সে দেশের আর্থিক লাভ-ক্ষতির বিষয়টি আগে নির্ধারণ করে চুক্তি করতে হয়। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে তা না করেই পণ্য পরিবহনের অনুমতি দিয়েছে সরকার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার ট্রানজিটের আড়ালে ভারতকে আসলে ট্রান্সশিপমেন্ট দিয়েছে। ট্রানজিটের মূল কথা হচ্ছে, এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়ার পথ। আর এখন যা হচ্ছে তা হলো, ভারতের এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যাওয়ার পথ, যাকে ট্রান্সশিপমেন্ট বলা হয়। এটি ভারতের কৌশল। কারণ ট্রানজিটে ভারতই সবচেয়ে বড় বাধা।
এ ক্ষেত্রে ভারত রাস্তা দিলে বাংলাদেশও তার পার্শ্ববর্তী অন্য দেশ নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে পারবে। আর রাস্তা না দিলে নেপাল ও ভুটান বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারবে না। তবে এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত ভারতের কোনো ইতিবাচক মনোভাব দেখা যায়নি।
জানা গেছে, বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ট্রানজিট-সংক্রান্ত কোনো নীতিমালা তৈরি করতে পারেনি। তবে নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে বলে বিভিন্ন সূত্র দাবি করেছে।
গত বছরের ৩১ মে আশুগঞ্জ বন্দর ব্যবহার করে কলকাতা থেকে আগরতলায় ভারতের পণ্য পরিবহনের চুক্তি করে বাংলাদেশ। এর আগে জানুয়ারিতে নয়াদিলি্ল সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের যৌথ ইশতেহারের আলোকে সরকার মে মাসে আশুগঞ্জকে পঞ্চম বন্দর ঘোষণা করে। আশুগঞ্জে আন্তঃমহাদেশীয় ট্রান্সশিপমেন্ট কেন্দ্র চালুর ঘোষণাও দেয়া হয়েছিল তখন। পরে সরকার ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রেড (আইডাবিস্নউটিটি) চুক্তিতে এক সংযোজনীর মাধ্যমে আশুগঞ্জ দিয়ে ত্রিপুরায় ভারতীয় কার্গো ট্রান্সশিপমেন্টের অনুমোদন দিয়ে আশুগঞ্জকে দ্বিতীয় ট্রান্সশিপমেন্ট পয়েন্ট ঘোষণা করে।
এ ব্যাপারে সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এবং অর্থনীতিবিদ ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, সরকার আগে ঘোষণা দিয়েছিল ট্রানজিটের বিনিময়ে কোনো ফি নেবে না, যা ঠিক ছিল না।
এখনো সরকারের উচিত ট্রানজিট দেয়ার আগেই ফি নির্ধারণ করা, যা করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। তবে ট্রানজিটে কোনো শুল্ক হয় না বলেও তিনি জানান। কারণ এ ক্ষেত্রে ভারতের পণ্যই আবার ভারতে যাচ্ছে। তবে সাবেক এ অর্থ উপদেষ্টার আশঙ্কা, সরকার যেহেতু আগে থেকে ফি নির্ধারণ করেনি, পরে ফি নির্ধারণ হলেও তা আদায়ে জটিলতা দেখা দিতে পারে। কারণ ভারত ফি না দেয়ার জন্য তখন অন্য বাহানা তুলতে পারে।
তাই সবকিছুর আগে এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি হওয়া দরকার ছিল, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ তার সুবিধা নিশ্চিত করতে পারত।
ড. মির্জ্জা আরো বলেন, কথা ছিল ভারতকে ট্রানজিট দিলে ভারতও নেপাল-ভুটানকে ট্রানজিট দেবে। এতে নেপাল ও ভুটান বাংলাদেশের নৌবন্দর ব্যবহার করতে পারবে। এখন যেখানে ট্রানজিট ব্যবহারের ফি-ই নির্ধারণ করা হয়নি, সেখানে নেপাল-ভুটান ট্রানজিট শিগগিরই দেবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকারের উচিত ছিল ট্রানজিট দেয়ার আগে এর ফি নির্ধারণ করা।
সরকার যেহেতু আগে ফি নির্ধারণ করেনি, তাই এখনই উচিত দ্রুত ফি নির্ধারণ করা। একই সঙ্গে ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেয়া উচিত, তারা যে পণ্য ট্রান্সশিপ করেছে, ফি নির্ধারণের পর তা পরিশোধ করতে হবে। নয়তো ভারত এই ফি না-ও দিতে পারে।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ট্রানজিট দেয়ার আগে সরকারের উচিত সব ধরনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। কিন্তু সরকার তা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
বাংলাদেশ ট্রানজিট বিষয়ে কোনো কাজ সম্পন্ন করার আগেই রাজনৈতিক কারণে বন্ধু দেশ ভারতকে রুট ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। তাই ভারতকেও একইভাবে বাংলাদেশের বন্ধুত্বের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। ভারতের উচিত দ্রুত নেপাল ও ভুটানকে ট্রানজিট দেয়া, যাতে ওই দেশ দুটি বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করতে পারে।
জানা গেছে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পালাটানায় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য 'ওভার ডাইমেনশনাল কার্গো' বা ওডিসির আওতায় (শুল্ক ছাড়া) কমপক্ষে ৮৬ জাহাজ পণ্য আসছে। এর মধ্যে পাঁচটি জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করা হয়েছে।
প্রথম দফায় গত ৯ মার্চ ভারতীয় এবিসি কোম্পানির একটি জাহাজ ১৪০ টন ওজনের বিশাল দুটি 'টারবাইন' নিয়ে কলকাতা থেকে আশুগঞ্জে আসে। এমভি সাইকা নামের জাহাজটি গত ২২ ফেব্রুয়ারি কলকাতার খিদিরপুর নৌবন্দর ছেড়ে আসে। পরে ১২ মার্চ এমভি মোস্তাদির-২ ও এমভি সোনালী ১৬ মার্চ, এমভি হেংগিং-২ নামের অপর একটি জাহাজ ২০ মার্চ এবং আরো একটি জাহাজ ২৪ মার্চ আশুগঞ্জ নৌবন্দরে পণ্য খালাস করে।
এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ১৯৭২ সালের চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারত তার দেশের পণ্য নিচ্ছে। এ জন্য বাংলাদেশ কোনো শুল্ক নেবে না।
তবে ভারত বাংলাদেশকে বার্ষিক ফি দেবে। এই ফির পরিমাণ কত হবে, তা এখনো নির্ধারণ হয়নি। তবে ট্রানজিট-সংক্রান্ত নতুন নীতিমালা তৈরি হলে তখন ধারণা পাওয়া যাবে, বাংলাদেশ ভারত থেকে কী পরিমাণ বার্ষিক ফি পাবে। তিনি বলেন, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ-ভারত ট্রানজিট-সংক্রান্ত যে চুক্তি করেছিল, তার মেয়াদ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। তবে চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে ভারতকে পণ্য নেয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, ট্রানজিট বিষয়ে কি-নোট পেপার তৈরির জন্য একটি কোর কমিটি কাজ করছে। এ কমিটির চেয়ারম্যান বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ মজিবুর রহমান। সদস্য সচিব হয়েছেন কমিশনের সদস্য ওয়াসিউদ্দিন আহমেদ। কমিটি খুব শিগগিরই কি-নোট পেপার সরকারের কাছে জমা দেবে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ট্রানজিট-সংক্রান্ত কি-নোট পেপার তৈরির বিবেচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে_ ট্রানজিটের জন্য সড়ক, রেল ও নৌপথের রুট নির্ধারণ; প্রস্তাবিত ট্রানজিট বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/প্রতিষ্ঠানের করণীয়; ট্রানজিট সুবিধা বাস্তবায়নের জন্য ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে সম্ভাব্য বিনিয়োগের পরিমাণ; এ বিনিয়োগে সুবিধাভোগী দেশগুলোর অংশীদারিত্বের পরিমাণ; ট্রানজিট রুটের মেরামত ও সংরক্ষণের জন্য বাজেট প্রাক্কলন; অন্যান্য দেশে ট্রানজিট সুবিধার জন্য বিদ্যমান চার্জ/ফি আদায় পদ্ধতি; ট্রানজিট সুবিধাপ্রাপ্তির ফলে ভারতসহ সুবিধাভোগী দেশগুলোর পরিবহন ব্যয় সাশ্রয় এবং ওই সাশ্রয়ে বাংলাদেশের প্রাপ্য অংশ; ট্রানজিট ট্রাফিকের ফলে বাংলাদেশের পরিবেশের ক্ষতি এবং ওই ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ; ট্রানজিট ট্রাফিকে উত্তর-পূর্ব ভারতের বৃহত্তম রাজ্য আসামের সম্পৃক্ততা; ট্রানজিটের কস্ট বেনিফিট বিশ্লেষণ এবং ট্রানজিট সুবিধার বিনিময়ে ভারতসহ অন্যান্য সুবিধাভোগী দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগের সম্ভাব্যতা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ১০০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তির মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে সহজ যোগাযোগ স্থাপন। ওই রাজ্যগুলোকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বহির্বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত করাও ভারতের দীর্ঘদিনের ইচ্ছা। সে জন্য সড়ক বা রেলপথে যেসব অবকাঠামো দরকার, বাংলাদেশের তা নেই। তাই ঋণের টাকায় ভারত এসব অবকাঠামো করিয়ে নেবে। আর এসব করতে যে কাঁচামাল প্রয়োজন হবে, তা-ও কিনতে হবে ভারত থেকেই।
এর অর্থ হচ্ছে, ভারত তার দেশের টাকা দেশেই ফেরত নিয়ে যাবে। বাংলাদেশ বসে বসে সুদ গুনবে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।