বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
ঐ গাছটার কি নাম বলতো মা?
তন্দ্রা গাছের দিকে তাকায়। বেশ উঁচু ঝাঁকড়া গাছ, প্রায় পাঁচ তলা বাড়ির সমান। তন্দ্রা চিনতে পারে না।
আহসান বললেন, ওটা হল আগর গাছ। সিলেটে খুব হয়। কেন, তোর জামান চাচাকে মনে নেই? তোর জামান চাচা আগরের ব্যবসা করত।
ওহ্। জামান চাচা কে মনে আছে তন্দ্রার।
জামান চাচারা থাকতেন সুনামগঞ্জের ধর্মপাশায়। তন্দ্রা অনেকবারই মেয়েবেলায় মা-বাবার সঙ্গে ধর্মপাশায় গিয়েছিল । জামান চাচা আগরের ব্যবসা করতেন? মেয়েবেলায় বড়দের ব্যবসা নিয়ে ছোটদের আগ্রহ থাকার কথা নয় ... জামান চাচার বড় মেয়ে শিরি আপার সঙ্গে খুব ভাব হয়েছিল তন্দ্রার, শ্যামলা মতন ভারি মিষ্টি চেহারা ছিল শিরি আপার ... লুকিয়ে কাঁদত ... কি যে গোপন দুঃখ ছিল শিরি আপার ... ক্লাস টেনে পড়ার সময় আত্মহত্যা করেছিল ... তন্দ্রা তখন ক্লাস সিক্সে পড়ত, ... শিরি আপার মৃত্যুর পর জামান চাচারা লন্ডন চলে যান ... শিরি আপার শ্যামলা মুখটি মনে পড়ে, দীঘল কালো চুল ছিল শিরি আপার ... সে কথা মনে পড়ায় অনেক বছর পর বিষন্ন হয়ে যায় তন্দ্রা ...
এই সকালে সাজেকজুড়ে অক্টোবরের সোনা রং রোদ ছড়িয়ে আছে। সাজেকের অপরূপ পাহাড়ি প্রকৃতিতে যেন খুশির বান ডেকেছে । অবশ্য সোনালি রোদ তন্দ্রার মুখেচোখে তেমন খুশি আর উজ্জ্বলতা ফুটিয়ে তুলতে পারেনি ... পুবদিকে মিজোরাম সীমান্ত।
সেই জনমানবশূন্য সীমান্তের ওপর ভাসমান শুভ্র মেঘের পুঞ্জ। ... আহ! যদি মেঘ হওয়া যেত। ওদিকে তাকিয়ে কান্না পায় তন্দ্রার । বাবা পাশে হাঁটছিল বলে কান্না গিলে ফেলল তন্দ্রা। আকাশের ওই অমলিন শূন্যতায় ভাসতে ইচ্ছে করছে ওর, ... এলোমেলো পাহাড়ি হাওয়ায় তন্দ্রার চুলগুলো উড়ছিল।
... আহ! পৃথিবীর পুরুষেরা যদি আমাকে না ছুঁতে পারত।
আকাশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতেই চোখ পড়ে সেই যুবকের ওপর ... সকালেও একবার দেখেছিল। লম্বা। মাথা নীচু করে ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটছে। একমাথা এলোমেলো চুল, শ্যামলা রং, মুখে অল্প দাড়ি, চোখে চশমা।
পরনে গ্রামীন চেকের নীল রঙের শার্ট আর নীল জিন্সের প্যান্ট, কাঁধে ঝুলি। তন্দ্রা চোখ সরিয়ে নেয়। ওর শরীর রি রি করে ... আজকাল পুরুষ মানুষ দেখলেই এমন উটকো অনুভূতি হয় ওর। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে ওঠে, হাতের তালু ঘামে ভিজে যায় ...এমন ঘেন্না হয় ... দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে ...
বাবার জন্য পালিয়ে যেতে পারে না ...
২
শরীরে মধ্য-অক্টোবরের সোনালি রোদ মেখে সাজেকের উচুঁনীচু পাহাড়ি পথে অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিল মৃদুল । কারা যেন পাতা পুড়িয়েছে।
পাঙ্খোরা সম্ভবত। পাশেই পাঙ্খো গ্রাম। শুকনো আগর পাতা পোড়ার টক টক গন্ধ। কেমন মাদক মাদক ভাব এনে দেয়।
মৃদুলের পায়ের নীচে পাটল রঙের ধুলোময় পথ।
সেই পথের ওপর গাছের ছায়ার ইকড়ি-মিকড়ি। মৃদুল বিভোর হয়ে হাঁটতে থাকে। মনটা নানা কারণে বিক্ষিপ্ত হয়ে ছিল । তবে সাজেকের মনোরম পাহাড়ি প্রকৃতি ওর দুঃখবোধ সব শুষে নিচ্ছিল ব্লটিংপেপারের মতো। কাল দুপুর থেকে নির্ভার বোধ করছে সে।
কাল দুপুর নাগাদ সাজেক পৌঁছেছে ও ... রাঙামাটির জেলার বাঘাইছরি উপজেলার একটি ইউনিয়ন সাজেক। সাজেক রাঙামাটি জেলার অন্তর্গত হলেও খাগড়াছড়ি দিয়েই আসতে হয়। এটির অবস্থান খাগড়াছড়ি জেলা থেকে উত্তর-পুর্ব দিকে। রুটটা এমন: খাগড়াছড়ি - দিঘীনালা - বাঘাইহাট - কাসলং - মাসালং - সাজেক। সাজেক-এর অপরুপ পাহাড়ি প্রকৃতির জন্য মৃদুলের দুঃখবোধ শুষে নিচ্ছে।
ও পাতা পোড়া গন্ধে আচ্ছন্ন হয়ে হাঁটছিল।
দু' পাশে কফি গাছ। কমলার বাগান। পাঙ্খোদের গ্রাম। রুইলুই পাড়া থেকে কংলাক মৌজার ছিপুই পাড়া তিন কিলোমিটার।
মুল সাজেক বলতে যে স্থানকে বুঝায় সেটি হলো 'রুইলুই' এবং 'কংলাক' নামের দুটি বসতি, স্থানীয় ভাষায় 'পাড়া'। সমতল ভুমি থেকে এ দুটি বসতির উচ্চতা প্রায় ১৮০০ ফুট ...দূরে পাহাড় চূড়ায় গির্জা। টিনের। স্থানীয় লুসাইরা খ্রিস্টভক্ত। মৃদুল সে কথা ভেবে সিগারেট ধরায়।
তার গায়ে এখনও সামান্য জ্বর আছে। জিভ ভারী আর তেতো ঠেকছে। জ্বরটা টের পাচ্ছে কাল বিকেল থেকে, সাজেক পৌঁছোর পর । সামনেই বিডিআর এর চৌকি। তারপর ছোট উপত্যকা।
পুবে ভারতের মিজোরাম রাজ্য। উপত্যকার ওপরে অথই শূন্যতায় কেবল কার বসানোর কাজ চলছে। ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে আদিম প্রকৃতি । সাজেক এখন আর নির্জন পাহড়ি জনপদ নয় ... ক্যাবল কার বসানো হচ্ছে, বসানো হচ্ছে টয়ট্রেন; বেশ কিছু রুচি সম্মত ছিমছাম মোটেলও গড়ে উঠেছে সাজেকে। আধুনিকতার পাশাপাশি পুরনো ঐতিহ্যও চোখে পড়ে।
ওর সামনে দু’জন আদীবাসী তরুণি। পিঠে বোঝা নিয়ে হাঁটছে। বোঝায় শুকনো হলুদ মনে হল। মৃদুলের মনের অস্বস্তি আর অশান্তি এই আদিবাসী প্রকৃতিতে মিশে যেতে থাকে। হঠাৎ মৃদুলের চোখ আটকে যায়।
পথের পাশে ঘাসের ওপর একটা কমলা গাছের তলায় একজোড়া খঞ্জনি পাখি। তিড়িংবিড়িং করে নাচছে। কোথ্ থেকে এল ওরা ? এ সময় এখানে থাকার কথা তো নয়। খঞ্জনি তো পরিযায়ী ... শীতের সময়ে বাংলাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকে। কিন্তু এখন তো সবে অক্টোবরের মাঝামাঝি।
ভেবে ভেবে ও কূলকিনারা পায় না।
হঠাৎই ওর এক কাপ চা খেতে ইচ্ছে হয় ...
৩
পাহাড়িয়া পথে হাঁটতে হাঁটতে আড়চোখে মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন আহসান । তন্দ্রার মুখটা ঘেমে গেছে। অনিন্দ্য সুন্দর শ্যামলা মুখটি গম্ভীর। মায়ের মুখ কেটে বসানো।
সে কথা মনে হতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আহসান । ২ বছর হল ফিরোজা মারা গেছেন। ভাগ্যিস! নইলে টুসুমনির (আহসান মেয়েকে টুসুমনি বলে ডাকেন) দূভার্গ্যরে কথা জানলে অসম্ভব কষ্ট পেত আফরোজা। নিকট আত্মীয়র কাছে অ্যাবিউস হয়ে কী গভীর দুঃখ সহ্য করছে মেয়েটা ... আফরোজার খালাতো ভাই আজম ইব্রাহীম ... লন্ডনে থাকে, ব্যবসা করে, ...বহু বছর পর দেশে ফিরে চট্টগ্রামের মুরাদপুরের বাড়িতে উঠেছিল ক’দিনের জন্য। মাঝবয়েসি লোক, অবশ্য কান্ডজ্ঞানহীন, সুযোগ বুঝে টুসুমনির চূড়ান্ত সর্বনাশ করে।
টুসুমনি সবে কলেজের পাঠ শেষ করেছে ... আজম ইব্রাহীম abuse করার পর টুসুমনি নিজেকে গুটিয়ে নেয়। সে সব কথা মনে পড়তেই মনটা বিষিয়ে যায় আহসানের ...
পথের পাশে একটি রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্ট মানে চারধারে বাঁশের খুঁটি আর তার ওপরে খড়ের ছাউনি দেওয়া বেশ বড়সরো একটা চালাঘর। সাইনবোর্ডে ইংরেজিতে লেখা : ‘কফি-পট’। এ ধরনের রেস্টুরেন্টে চা-কফি পাওয়া যায়, সঙ্গে কেক-বিসকিট।
রেস্টুরেন্টের সামনের জায়গাটুকু ফাঁকা। এক পাশে কফি গাছ আরেক পাশে কমলা গাছ। কমলা গাছটি নির্জীব, প্রায় মৃত ... তন্দ্রার মতোই।
আহসান বললেন, এই টুসুমনি?
তন্দ্রা সীমান্তের ওপারের আকাশের শুভ্র মেঘের কথা আর শিরি আপার কথা ভাবছিল বলে অন্যমনস্ক হয়ে ছিল। এখন সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলল, বল।
এক কাপ চা খাবি?
এখন কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না ওর। তবুও বলল, খাব।
আয়।
রেস্টুরেন্টের ভিতরে কাউন্টারে ফরসা একটি মেয়ে বসে । লুসাই বলে মনে হল।
গলায় চেইন, তাতে ক্রশ ঝুলছে। ভিতরে বাঁশের তৈরি চেয়ার টেবিল। ওরা পিছনের দিকে বসল। মোটামুটি ফাঁকা। একজন ইউরোপীয় বৃদ্ধ বসে।
হাতে বাইবেল মনে হল। একমনে পড়ছেন। দূরে পাহাড় চূড়ায় টিনের গির্জার কথা মনে হল তন্দ্রার । ও শুনেছে স্থানীয় লুসাইরা খ্রিস্টান।
সেই যুবকটিকে ঢুকতে দেখল তন্দ্রা ।
ওর শীত করে । ওই চশমা পরা দাড়িঅলা লোকটা কোন্ মেয়েকে কষ্ট দিচ্ছে কে জানে।
৪
মৃদুল পিছনের দিকে বসল। একটু পর যে জিন্স আর সবুজ গেঞ্জি পরা মেয়েটি কফি দিয়ে গেলে তাকে কেন যেন মিজো বলে মনে হল। ওর বন্ধু রানা সিকদার এসব এলাকা চষে বেড়িয়েছে।
রানা ‘গ্রন্থকীট’ প্রকাশনীর প্রধান নির্বাহী। ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে। সাজেক আসার আগে রানার সঙ্গে কথা হয়েছে। রানা বলেছে, সাজেক থেকে ভারতের মিজোরাম রাজ্যটি বেশ কাছে, প্রায় দুই ঘন্টার হাঁটার দুরত্ব । এ জন্য সাজেকের আদিবাসীদের জীবনযাত্রায়, পোষাক-পরিচ্ছদে আধুনিকতার ছাপ পড়েছে।
মেয়েরা প্রায় সবাই পশ্চিমা স্টাইলে জিন্স প্যান্ট, গেঞ্জি বা টি-শার্ট পরে। তাদের প্রায় সবারই ছেলেমেয়েকে বাংলাদেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না দিয়ে মিজোরামের উন্নত এবং ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল-কলেজে পড়ালেখার জন্য পাঠায়। এ কারনে তাদের অনেকেই ইংরেজিতে কথা বলতে অভ্যস্ত। পাহাড়ী জীবনযাত্রায় তারাই সবচেয়ে উন্নত ...
মৃদুল কফি তে চুমুক দিতেই তিড়িংবিড়িং করে নাচা খঞ্জনি পাখির কথা মনে পড়ে গেল ওর। পাখি দু’টি কি সুখি! ... অথচ, দোলা আর আমি সুখি হতে পারলাম কই? দু’বছর বিয়ে হয়েছে।
দোলার সঙ্গে অ্যাডজাস্ট হচ্ছে না, কী এক অশান্তি বয়ে বেড়ায় দোলা-সবাইকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারে। দু-বার আত্মহত্যার অ্যাটেম্প নিয়েছিল ... সারাক্ষণ মানসিক অস্থিরতায় ভোগে। একজন প্রখ্যাত Psychiatrist- এর সঙ্গে কথা বলেছিল মৃদুল; প্রফেসর এম . রশীদের ধারণা: দোলাকে অল্প বয়েসে কেউ abuse করেছিল । দোলার বড় বোন ফিরোজা সে কথা স্বীকারও করেছে ... স্কুলের পড়ার সময় ঘটনাটি ঘটেছিল । মৃদুল কি আর করবে? ওর দুভার্গ্যকে মেনে নিয়েছে ও।
ওদের সেটল ম্যারেজ। একটা সুইডিশ ফার্মে চাকরি করে মৃদুল; ছাত্র জীবনে সৌখিন ফটোগ্রাফার ছিল, পাখি ক্লাবের মেম্বার ছিল ... বিয়ের পর এক এক করে সব ছাড়তে হয়েছে। এক সময় কবিতা লিখত। এখন একা একা মনে মনে লেখে। দোলার মুখটা স্মরণ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মৃদুল ।
তার মাত্র ৩২ বছর বয়স । এই বয়েসেই জীবনের ওপর কেমন বৈরাগ্য এসে গেছে। কে দোলার অমন সর্বনাশ করল!। অস্থির বোধ করে মৃদুল। কফিতে চুমুক দেয়।
হঠাৎ কি মনে পড়তেই ঝুলি থেকে একটা বই বের করে। Leslie D.Alldritt -এর লেখা Buddhism. মৃদুল ক’দিন ধরে বইটা পড়ছে। বইটা অনুবাদ করার কথা ভাবছে। রানার সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলা দরকার। ‘গ্রন্থকীট’ বইমেলার জন্য কাজ শুরু করে দিয়েছে।
... বুদ্ধ মানুষকে ধ্যান-এর পথ দেখিয়েছেন, প্রশান্তির পথ দেখিয়েছেন। ধ্যান সম্বন্ধে চমৎকার একটি অধ্যায় আছে বইটিতে । ধ্যানের পদ্ধতি সম্বন্ধে মোটামুটি একটা ধারনা জন্মে ... মৃদুল জানে আজ রাতটা হবে গভীর জোছনার। ও আজ রাতে ধ্যানে বসবে। সারারাত ধ্যান করে কাটাবে ।
জীবনের অন্তত একটি রাত ধ্যান করে কাটাবে। সাজেকের নির্জন উপত্যকায়। আগে কখনও ধ্যানে বসেনি, আজ বসবে, ভুলে যাবে সমস্ত দুঃখযন্ত্রণা ...
৫
কংলাক মৌজার ছিপুই পাড়ায় একটা মোটেল উঠেছে তন্দ্রারা । মোটেলটি নতুন, নাম -‘রোয়াতী’জ লজ’। সাদা রং করা কাঠের দোতলা বাড়ি।
জানালার রং অবশ্য সবুজ; সামনে পিছনে ছিমছাম বাগান। বাগানে নানা রকম ফুলের গাছ, সূর্যমূখীর ঝাড়। কফি গাছ। কমলা গাছ। ঢাল, তারপর উপত্যকা ... দূরে মিজোরামে নীলাভ পাহাড়শ্রেনি ...
মোটেলটি স্থানীয় এক পাংখোয়া নারীর ।
নাম: লাল রেম রোয়াতী। মাঝারি উচ্চতা, ঈষৎ লালচে চুল, ঈষৎ তির্যক চোখ, ফর্সা ডিম্বাকৃতির মুখ। চমৎকার বাংলা বলে। বেশ আলাপী। আহসানের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, আহসানকে মিজোরামের চুরুট উপহার দিয়েছে রোয়াতী।
বেশ ভালো ব্যবসা গুছিয়ে নিয়েছে রোয়াতী। আধুনিক সুযোগ সুবিধা থাকায় বিদেশি পর্যটকরা মোটেলটি বেশ পছন্দ করে ।
তন্দ্রাদের রুম দোতলায়। ঘর লাগোয়া বারান্দা। বারান্দায় দাঁড়ালে মিজোরাম সীমান্ত অবধি দৃষ্টি চলে যায়।
তখন হৃদয়ে এক অদ্ভূত অনুভূতি হয়। সেই সঙ্গে প্রগাঢ় নির্জনতা তন্দ্রার মানসিক যন্ত্রণার কিছু উপশম হয়ে যায় ...
সন্ধ্যার পর গোছল করতে বাথরুমে ঢুকল তন্দ্রা । বাথরুমে গরম পানির ব্যবস্থা আছে। তন্দ্রা গোছল সেরে বেরুলেই খেতে যাবেন। খাবার ব্যবস্থা নীচতলায়।
আহসান কফি নিয়ে বারান্দায় বসলেন । ষাট বছরের মুখচোখে দুশ্চিন্তার গভীর ছাপ । টুসুমনি মানুষের কাছে কষ্ট পেয়েছে, ... টুসুমনি যদি শান্তি পায় ... ওকে প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে এসেছেন আহসান। প্রকৃতির কোলে এসে মেয়েটির কতদূর উপশম হল, শান্তি পেল-উদ্বেগ সে কারণেই। এখনও কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
আগের মতোই চুপচাপ। গুটিয়ে রেখেছে।
ফোন বাজল। শরীফা। আহসানের ছোট বোন।
চট্টগ্রামের মেহেদীবাগ থাকে । আহসান বললেন, হ্যালো, শরীফা বল।
তোমরা কেমন আছ ভাইজান?
ভালো।
তন্দ্রা?
তন্দ্রা ভালো
আগের চেয়ে ভালো?
এখনও বোঝা যাচ্ছে না। চাপা মেয়ে তো।
তবে অস্থিরতা কমেছে বলে মনে হল।
ভালো। তা তোমরা ফিরবে কবে?
আহসান বললেন, এখনও বলতে পারছি না, তবে যদ্দিন তন্দ্রার ভালো লাগে তদ্দিন থাকব ...
শরীফা বললেন, মা মরা মেয়ে, আমার অনেক টেনশন হয়।
চিন্তা করিস না। আমরা ভালো আছি।
একটু পর ফোন রেখে মিজো চুরুট ধরালেন আহসান। গন্ধটা চমৎকার। মিজো চুরুট এর আগে কখনও খাওয়া হয়নি। যাওয়ার সময় কিনে নিয়ে যাবেন। বেশিক্ষণ অবশ্য চুরুটের স্বাদ ভালো লাগল না।
আজকাল মাঝে মাঝে বুকে পালপিটিশন হয় ...একজন চিকিৎসকের সঙ্গে কথাও বলেছেন, ভালো কিছুর আশ্বাস দিতে পারেন নি ডা. দেবাশিষ বিশ্বাস। সময় কি তাহলে খুব বেশি নেই? সেকথা ভাবতেই বেদনার্ত হয়ে ওঠেন আহসান ... জীবনের হিসেব-নিকেশ এখনও তো চূড়ান্ত হল না ... তন্দ্রার বিয়ের কথাও ভাবছেন। তবে মানসিক যন্ত্রনায় কাতর মেয়ের কাছে বিয়ের কথা তোলাও তো সহজ নয় ...
৬
মাঝরাত। ... ঘুমিয়েছিল তন্দ্রা। আজকাল রাতে ঘুম হয়না তেমন।
আজ কী কারণে হল। খাওয়ার পর অনেক ক্ষণ বাবার সঙ্গে গল্প করল। আজকাল ঘুমাতেও ভয় করে। স্বপ্নেও হায়েনরা পিছু নেয়, ঘাড়ের ওপর দাঁত বসায়। তখন গা শিউরে ওঠে, গা ভিজে ওঠে।
ডাক্তার ট্র্যাঙ্কুলাইজার দিয়েছেন খেতে ...ওসব খেতে ভালো লাগে না ...
কী এক পাখির ডাকে তন্দ্রার ঘুম ভেঙে যায়। টি টি টি টি করে ডেকে ডেকে উড়ে গেল পাখিটা । আধো-অন্ধকার ঘর। বাতাসে হাসনাহেনার বাসী গন্ধ। চোখ মেলে দেখল জানালায় জোছনার শুভ্র আলো আর উথালপাথাল হাওয়ায় জানালার পরদা দুলছে ।
উঠে দাঁড়ায় তন্দ্রা ।
মাথার ভিতরে মৃদু যন্ত্রনা টের পেল। নিঃশ্বাস অবশ্য স্বাভাবিক। পাশের ঘরে বাবা ঘুমিয়ে আছে। ও দরজা খুলে বারান্দায় চলে আসে, সাজেকের অশান্ত পার্বত্য হাওয়ারা ধাক্কা মারে ওকে ... চেয়ে দেখল-আজ রাতে ফুলের বাগানের জোছনার ঢল নেমেছে ।
আর কী নির্জন চারপাশ ... বাতাসে সূর্যমূখী ঝাড়ে কাঁপন লেগেছে। বাগানের শেষে জায়গাটা ঢালু হয়ে উপত্যকায় নেমে গেছে। ওখানে সারি সারি আগর গাছ, কমলার গাছ।
কমলা গাছের নীচে কে যেন বসে আছে।
কে?
পরিচিত মনে হল।
সেই যুবকটি না? যাকে আজ দেখেছিল তন্দ্রা। আশ্চর্য! যুবকটা ধ্যানে বসেছে। দৃশ্যটায় কি ছিল- অদ্ভূত প্রশান্তি বোধ করে তন্দ্রা। যুবকটা ভারতীয় যোগীদের ভঙ্গি তে বসে আছে। ধ্যান করছে সম্ভবত।
আশ্চর্য মানুষ তো। এত রাতে না ঘুমিয়ে ধ্যান করছে। তন্দ্রা মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে যেতে থাকে। ওই অপার্থিব দৃশ্যটি দেখতে দেখতে ভালো লাগে তার । বুকের ওপর থেকে খসে পড়তে থাকে এতকালের চেপে-বসা পাষাণ।
জোছনায় ধ্যানমগ্ন ছবিটি দেখতে দেখতে তন্দ্রার গোপন দুঃখ আর শোকতাপ অর্ন্তহিত হতে থাকে .. কে যেন ওর খুব কাছে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলে - মাঝে মাঝে পুরুষের অমন সুন্দর নিষ্পাপ ভঙ্গি না দেখতে পেলে জগতের দুঃখগ্রস্থ মেয়েরা কী ভাবে বাঁচবে?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।