আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এ দিন ভোলা যায়না।

. আমার নাইবা হলো পারে যাওয়া...
২৫শে মার্চের কালো রাত্রির আধারে ঢাকায় ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী ঢাকার বাইরের মানুষ জানতে পেরেছে ২৬/২৭ কি আরও পর। ২৫শে মার্চ রাত ১২টার পর হতে সিলেট শহরবাসী গোলাগুলির শব্দ পেলেও আসল ঘটনা বা কারন জানতে পারেনি। সিলেটে হঠাৎ করেই ২৬শে মার্চ সকাল থেকে যে কারফিউ দেয়া হয়েছিল কেউ তা জানত না। তাই ২৬শে মার্চ সকাল বেলায় প্রথম যারা পাকসেনার গুলির শিকার হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে, ছাত্র শিক্ষক, সাধারন মানুষ ছিলেন। সিলেট এইডেড হাই স্কুলের শিক্ষক জগলুল স্যার এবং সিলেট সরকারি বয়েজ হাই স্কুলের মেট্রিক পরিক্ষার্থী হাসান, এরা দুজন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন।

আহতদের সিলেট সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডাক্তার সামসুদ্দিন আহমেদ ও উনার সহকর্মিরা আহতদের চিকিৎসা করেন। গুলিতে জগলু স্যারের ডানহাতের চারটি আঙ্গুল উড়ে গিয়েছিলো। হাসানের বাম পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়। কারফিউ শিথিল হতেই হাসপাতালে মানুষে ভিড় লেগে যায়।

হাসানকে পাঁচ ব্যাগ রক্ত দেয়া হয়। আত্মিয় স্বজন নয়, আহতদের রক্ত দেয়ার জন্য সবাই উদ্গ্রিব ছিলো। তৎকালিন সিলেটের এমপি দেওয়ান ফরিদ গাজি ও রাজনৈতিক নেতা ছাড়াও অসংখ্য সাধারন মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আহতদের দেখতে গিয়েছিলেন। হাসপাতালের ঠিক সামনেই সরকারি মহিলা কলেজ। পাক-আর্মি সেই কলেজে ক্যাম্প করেছিলো।

ডাঃ শামসুদ্দীন আহমেদ এর স্ত্রী ঐ মহিলা কলেজের অধ্যক্ষা ছিলেন। বৃদ্ধা মা, ও ছোট সন্তানদের গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেও স্ত্রী “বেগম হোসনে আরা আহমেদ কিছুতেই স্বামীকে ছেড়ে যেতে রাজি হন নি। তাঁদের বড় ছেলে “জিয়াউদ্দীন আহমেদ” তখন মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্যে ঘরছাড়া। স্ত্রী, আত্মিয়-স্বজন সবার অনুরোধ অনুযোগ উপেক্ষা করে ডাঃ শামসুদ্দীন আহমেদ প্রানের ঝুঁকি নিয়ে হাসপাতালে রয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলো, তরুন ডাঃ জিয়া, ডাঃ শ্যামল কান্তি লাল, এ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার কোরবান আলী, ও কয়েকজন পুরুষ নার্স।

হাসপাতালের সামনে পাক আর্মি ঘাটি করার পরপরই ডাঃ শামসুদ্দীন মহিলা নার্সদের কাজ থেকে অব্যাহতি দিয়ে তাদের নিরাপদে সরে পড়তে বলেন। পাঁচ/ছয় দিন পর দুপুর বেলা ডাক্তার সামসুদ্দিন হাসপাতালে এসে রুগিদের বললেন, “তোমরা সবাই হাসপাতালের পিছন দিক দিয়ে বেরিয়ে যাও, যে কোন সময় আর্মি এখানে আসতে পারে”। জগলু স্যার হাসান কে কাধে করে হাসপাতালের পিছনের কাঁচা ড্রেনের মাঝে অবস্থান নিলেন। যারা হেটে যেতে সক্ষম, তারা গলি ঘুপচি দিয়ে ছুটতে লাগলো। হাসান কে ফেলে স্যার যেতেও পারছেন না, কাধে বয়ে তো আর ছোটা যাবে না।

তাই সন্ধ্যার অন্ধকারের অপেক্ষায় থাকলেন। বিকেলের আগেই হাসপাতালে গুলির শব্দ শোনা গেলো। সন্ধ্যার অপেক্ষা বাদ দিয়ে হাসানকে টেনে হিচঁড়ে দাড়িয়া পাড়ার ভিতর দিয়ে গেলেন। গলির ভিতর অনেক বাড়ির সামনে উৎসুক মানুষের মুখ দেখতে পেয়ে অনুরোধ জানালেন, কাছেই জিন্দাবাজার এলাকায় হাসানের ফুফাতো ভাইএর বাসায় খবর দেয়ার জন্য। কিছুক্ষনের ভিতরে হাসানের ভাই এসে দু’জনকেই উনার বাসায় নিয়ে গেলেন।

হাসপাতালের মানুষ গুলোর কপালে কি ঘটেছে তা আর সেই মুহুর্তে জানা সম্ভব হলো না। পরদিনও কেউ ঘর হতে বের হতে পারলো না। টানা তিনদিন কারফিউ ছিলো। তিনদিন পর হাসপাতালে মানুষজন ছুটে গেলো। দেখা গেলো হাসপাতালে রক্তের নদীর মাঝে পড়ে আছে ডাক্তার সামসুদ্দিন আহমেদ, ডাঃ জিয়া, ডাঃ শ্যামল কান্তি লাল, ড্রাইভার কোরবান আলী, পুরুষ নার্স মাহমুদুর রহমান সহ আরও অনেক অসহায় রুগীর মৃতদেহ।

ডা; শামসুদ্দীন আহমদের চাচা এসে উনার লাশ সনাক্ত করেন। দেরী করার কোন উপায় নেই। চোখের সামনে জল্লাদের খাড়ার মতো ঝুলে আছে আর্মির ক্যাম্প। তাই সেই সব শহীদদের হাসপাতালের ভিতরের উঠানেই কবর দেয়া হলো। আজ সেই হাসপাতালের নামকরন করা হয়েছে শহীদ ডাক্তার সামসুদ্দিন হাসপাতাল।

হাসপাতালের পাশেই হয়েছে কেন্দ্রিয় শহীদ মিনার। সেখানে সব শহীদের নাম লেখা রয়েছে। ওষুধপত্র নেই, শুধু চুন হলুদ, আর পুরনো শাড়ী কাপড় দিয়ে গজ করে ক্ষত স্থানের চিকিৎসা চলেছিলো হাসানের। নিজের বাড়িঘরেও থাকতে পারতো না। কারন পাড়ার মধ্যেই তৈরী হয়েছিলো শান্তিকমিটির সদস্য।

উকিল গোলাম জিলানী। স্বাধীনতার পরেও যার কোন শাস্তি হয়নি। কিছু মুক্তিযোদ্ধা নামধারী মানুষের বদান্যতায় তিনি পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে তো সাধারন ক্ষমা ঘোষনা করায় গোলাম জিলানীর মতো সব রাজাকারেরাই দুধে ধোয়া তুলশি পাতা হয়ে যান। তারাই প্রভুত সম্পদ অর্জন করেন, তাদের সন্তানেরা সমাজের মান্যগন্য মাথা হয়।

আর মুক্তিযুদ্ধের শহীদের স্ত্রী বৃদ্ধ বয়সে রাস্তায় কলম ফেরি করে বিক্রি করেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা নিরাশ্রয়, অনাহারে মরে যায়। আর হাসানের মতো কিশোরেরা স্বপ্ন ভঙ্গের কষ্ট বুকে নিয়ে কিশোর থেকে যুবা, যুবা থেকে পৌঢ়ত্ত্বের পথে খুঁড়িয়ে চলে। মামা মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে এলে ভাগ্নের অভিমান ভাঙ্গাতে পারেন না। তার প্রশ্ন, “ কেনো এমন হলো? আমারও তো তোমার সাথে যুদ্ধে যাওয়ার কথা ছিলো”। পায়ের নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ক্ষত শুখিয়ে গেছে।

কিন্তু বুকের ক্ষত আজো দগদগে ঘায়ের মত যন্ত্রনা দেয়। আর সেই কষ্টের সাথে সাথে মনে করিয়ে দেয় ২৬শে মার্চের ঘটনা। একাত্তুর আমাদের জীবনের সাথেই জড়িয়ে আছে। একে ভোলা কি যায়? না, ভোলা সম্ভব? যুদ্ধে যেতে পারেনি বলে হাসানের খুব দুঃখ। আমি বলি “ একনদী রক্ত পেরিয়ে যে স্বাধীনতা এসেছে, সেই নদীতে তো তোমার রক্তও মিশে আছে, তবে এই দুঃখ কেনো”?
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।