থালা ভর্তি গরম ভাত একমাত্র ন্যায়, আর সবই অন্যায়।
এ পাগলীটা কোথা হতে এতবারপুর বাজারে এসেছে তা নিয়ে নানাজন নানা রকম মতামত দেয়। তবে এ পাগলীর বাড়ী যে সাতগাওঁ কিংবা এর আশেপাশে নয় এ সম্পর্কে সকলেই একমত। ত্রিশোর্ধ পাগলীটাকে সবাই ময়না পাগলী বলেই ডাকে। কেন তাকে ময়না পাগলী বলে ডাকা হয়, কে তাকে এ নাম দিয়েছে তাও এতদিন পর কেউ ঠিকভাবে স্মরণ করতে পারে না।
সামদানী ব্রীজের কাছের চা-দোকানদার মতি মিয়া বলে যে, ময়না পাগলীরে আমি চিনি আইজ থেইকা দশ বছর হয়। তারে কোনদিন কারো সাথে দুইটা বাতচিত করতে দেখলাম না। তাইলে তার নাম যে ময়না এইটা লোকে জানলো ক্যামনে? চার দোকানে চা পানরত কিংবা সাদা কালো টেলিভিশনে বাংলা সিনেমা উপভোগরত অন্যরাও মতি মিয়ার কথায় সায় দেয়। এতবারপুর বাজারে ময়না পাগলীর আগমন কিংবা নাম নিয়ে যত বির্তকই থাক না কেন এতবাপুর বাজারে তার খাওয়ার অন্তত অভাব হয়না। এ দোকান ও দোকানের উচ্ছিষ্ট দিয়ে পাগলীর বেশ চলে যায় কিংবা চলে না, ময়না পাগলী একাধারে বোবা এবং পাগল বলে যেহেতু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনা, বাজারের সকলে ভেবে নেয় যে ময়না পাগলীর বেশ চলে যায়।
মুড়ি বিক্রেতা ছমির উদ্দিন বলে ময়না পাগলী বোবা না, সে নিজের সুবিধার জন্য বোবার ভান ধরে থাকে। ছমিরউদ্দিন নাকি তাকে একদিন আপনমনে বিড়বিড় করতে শুনেছে। যেহেতু ময়না পাগলী বিড়বিড় করে কি বলেছে তা ছমিরউদ্দিন বলতে পারেনা সেহেতু বাজারের অন্যরা এটাকেও মিথ্যাবাদী হিসেবে খ্যাত ছমিরউদ্দিনের আরেকটি মিথ্যা বলে ধরে নেয়। এতবারপুর বাজারের মুদির দোকানদার রইস মিয়ার মতে ময়নাকে এভাবে বাজারে থাকতে দেয়া বাজার কমিটির উচিত হচ্ছে না। সে অতি নোংরা অবস্থায় যেখানে সেখানে শুয়ে থাকে এমনকি তিনি নাকি ময়নাকে কয়েকবার বাজারের মসজিদের বারান্দায়ও শুয়ে থাকতে দেখেছেন।
এতে মসজিদের পবিত্রতা যে নষ্ট হয় এটা তিনি প্রায়শই বলে থাকেন। যেহেতু বাজারের অন্যান্য দোকানদাররা ময়নাকে কোথায় পাঠবে এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না কিংবা তাদের বেচাকেনার ভিড়ে ময়নাকে নিয়ে তেমন ভাবার অবসর পায় না সেহেতু ময়নারও এতবারপুর বাজার ছাড়া হয় না।
কাঠমিস্ত্রী মোঃ সেলিমের এতবারপুর বাজারে আসবাবপত্র তৈরী ও বিক্রির যে দোকান তার চালের উপরে খেয়াল করলে একটা ক্ষয়িষ্ণু ও বিবর্ণ সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। ভুল বানানে লেখা - " মেচার্স সেলিম ফার্নিচাস, প্রোঃ মোহাম্মদ সেলিম মিয়া, এখানে সকল প্রকর তৈরী ফার্নিচার পাওয়া যায় ও ফার্নিচর তৈরীর অর্ডার নেওয়া হয়"। সকল প্রকার ফার্নিচার বলতে মোঃ সেলিমের দোকানে বর্তমানে কমদামী কাঠের তৈরী দুইটি আলন, ৬টি চেয়ার ও ১টি ড্রেসিং টেবিল শোভা পায়।
পুজিঁ থাকলে যে মোঃ সেলিম একদিন তার দোকানটাকে শহরের ফার্নিচারের দোকানের চেয়েও উন্নত করবে এটা সে প্রায়শই বলে বেড়ায়। বাজারের অন্যরা যারা খাটে ও শো-কেসে মোঃ সেলিমের খোদাই কর ময়ূর দেখেছে তারা কেউ কেউ তার একথা বিশ্বাসও করে। বাজারের অন্য অনেক দোকানদার এর মতো মোঃ সেলিমও দোকানেই থাকে। বাজার থেকে মাইল দেড়েক দূরেই মোঃ সেলিমের বাড়ী। বাড়ীতে মা এবং এক বোন।
তার বাবা মনু মিস্ত্রী ছিল সাতগাঁও এলাকার সবচেয়ে নাম করা কাঠমিস্ত্রী। ধানের গোলা, কাঠর বাড়ী, ঘরের চালে টিন লাগানা ইত্যাদিতে মনু মিস্ত্রীর সুনাম ছিল বেশ। বাবা বেচেঁ থকতেই মোঃ সেলিম তার বাবার কাছ থেকে হাতুড়ি, শাবল চালানো শেখে। বাবার মতো বড় বড় কাজের দিকে তার ঝোঁক ছিল কম। স্থানীয় এতবারপুর আকবর আলী উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়া মোঃ সেলিম নিজকে কাঠমিস্ত্রীর বদলে কাঠশিল্পী পরিচয় দিতেই ভালবাসে।
এলকায় যারা মোঃ সেলিমের তৈরী আলনা, খাট কিংবা ড্রেসিং টেবিল ব্যবহার করেছেন তারা জানেন মোঃ সেলিম কত নিখুঁতভাবে ফার্নিচারের গায়ে তার শিল্পের স্বাক্ষর রাখে। এতদঅঞ্চলে কাঠে মোঃ সেলিমের মতো কর ময়ূর আর কে আকঁতে পারে। এতবারপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মোন্নাফ যে চেয়ারটিতে বসেন তার মাথার উপরে যে চমৎকার পেখম মেলা ময়ূরটি দেখতে পাওয়া যায় তা মোঃ সেলিমেরই করা। মোঃ সেলিম যখন বাইশ, শাবল আর হাতুড়ি দিয়ে একমনে কাঠের ফ্রেমে ফুল আর লতার নকশা আকঁছিল হঠাৎ করে তার দোকানের সামনে ময়না পাগলীকে নোংরা চট বিছিয়ে বসে থাকতে দেখে তার মেজাজ খানিক বিগড়ে যায়। সে পাগলী তার দোকানের সামনে থেকে চলে যাওয়ার জন্য রাগতকন্ঠে ধমক দেয়।
মোঃ সেলিমের রাগতকন্ঠ শুনেও পাগলীর কোন ভাবান্তর হয় না অথবা পাগলী হয়তো মোঃ সেলিমের রাগত কন্ঠ শুনতেই পায়নি। ভাবান্তরহীন পাগলীকে দেখে মোঃ সেলিমের রাগ আরো বেড়ে যায়। মোঃ সেলিম হাতে কাঠ নিয়ে পাগলীকে খোচাঁ দেয়। খোচাঁ খেয়ে পাগলীর ভাবানন্তর হয়। মোঃ সেলিমরে রাগত মুখ দেখে সে পাগল হলেও বুঝে যায় এখানে বসা নিরাপদ নয়।
দুপুরের খাওয়া তার ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। সে বাজারের প্রাচীন আমগাছের ছায়ায় শুয়েঁ পড়ে।
বৃষ্টিটা আজ ভালোই পড়ছে। টিনের যে ছিদ্র শুস্ক মৌসুমে বুঝা যায় না বর্ষা এলেই সেগুলো নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়। মোঃ সেলিম প্রতি বর্ষাতেই ভাবে টিনগুলো বদলাবে কিন্তু কিভাবে কিভাবে জানি আর বদলানো হয় না।
ফলে প্রতি বর্ষাতেই যখন টিনের ছিদ্র দিয়ে ফোঁটা ফোটাঁ করে পানি দোকান ঘরে পড়ে মোঃ সেলিম তখন নিজেকে গালি দেয়। রাতে বাড়ীতে খেতে যাবে না যাবে না করেও মোঃ সেলিম ছাতা আর টর্চ হাতে বাড়ীর দিকে রওনা দেয়। প্রায় প্রতিরাতের মতোই খাওয়ার সময় মোঃ সেলিমের মা রাহেলা খাতুন তার বিয়ের কথাটা উঠায়।
- বাবা, সৈয়দ আলীতো আর একটা মাইয়ার খবর নিয়া আইছে। তুই সময় কইরা একবার দেইখ্যা আয়।
- মা, তুমারে আমি কতবার কইছি মিনুর বিয়া না দিয়া আমি বিয়া করুম না। তুমি হুন না ক্যান। চাচারে কইয়া দিও আমার লাইগ্যা যেন কোন মাইয়া টাইয়া না দেখে।
- মিনুর কপালে যা আছে তা হইবো, তুই আর কতদিন বিয়া না কইরা থাকবি? বয়সতো তোর কম হয় নাই।
- মা, যেটা কইছি সেইটা শুনো।
আমি অহন বিয়া করতে পারুম না, ব্যাস।
ছেলের উচ্চকন্ঠ শুনে আর কথা বাড়াতে সাহস পায় না রাহেলা। বাটি থেকে বড় পুটিঁ মাছটা ছেলের পাতে তুলে দেয় রাহেলা।
খাওয়া শেষে মায়ের বাটা থেকে একটা পান মুখে দিয়ে পুনরায় দোকানের দিকে রওনা দেয় মোঃ সেলিম। হাল্কা করে বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে।
মোঃ সেলিম ছাতাটা মাথায় দিয়ে লুঙ্গিটা হাটুঁর উপর গুটিয়ে নিয়ে হাঁটা শুরু করে। বাজারের কাছাকাছি এসে মোঃ সেলিম দেখতে পায় বাজারে বিদ্যুত নাই। মোঃ সেলিম শব্দ করে কারেন্টরে গালি দেয়। বর্ষার দিনে কারেন্টটা এত জ্বালায়। বর্ষার রাত দশটা বাজার আগেই বাজার ফাঁকা।
যে কয়েকজন দোকানি দোকানঘরেই থাকে তারাও দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে শুয়ে পড়েছে। মোঃ সেলিম তার ফার্নিচার দোকানের সামনে এসে দেখতে পায় ময়না পাগলী চট মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে দোকানের সামনে। মোঃ সেলিম পাগলীরে দেইখ্যাই একটা ধমক দেয়- আর জায়গা পাস না, এখানে শুয়ে আছিস ক্যান? মোঃ সেলিমের ঝাঝাঁলো কন্ঠশুনে জড়তড়ো হয়ে উঠে দাড়ায়ঁ পাগলী। মোঃ সেলিম দোকানের ঝাপঁখুলে ঢুকে পড়ে দোকানে। একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে অন্ধকার দূর করার চেষ্টা করে।
অন্ধকার কতটা দূর হয় বুঝা যায় না তবে আলো জ্বলে উঠে। অন্য একটা আলোও ঝিলিক দিয়ে যায় মোঃ সেলিমের মনে। সে ঝাপঁ খুলে দেখে ময়না পাগলী দোকানের বেড়ার সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মোঃ সেলিম ময়না পাগলীকে ডাক দেয় .. আয়, ভেতরে আয়। মোঃ সেলিমের নরম কন্ঠশুনেও ময়নার কোন ভাবান্তর হয় না।
সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। মোঃ সেলিম এদিক-ওদিক তাকিয়ে এগিয়ে যায় ময়না পাগলীর কাছে। ময়না পাগলীর হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় দোকান ঘরের ভেতর। হঠাৎ বাতাসের ধমকায় মোমবাতি নিভে যায় অথবা মোঃ সেলিম নিজেই ফুঁ দিয়ে নিভেয়ে দেয়। মোমবাতি না নেভালেও তেমন কিছু আসতো যেতো না, মোঃ সেলিম যে আদিম খেলায় মগ্ন হয়েছে ময়না পাগলীর সাথে তা দেখার জন্য এতবারপুর বাজারের কেউ সে রাতে জেগে ছিলো না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।