যায়নবাদীদের দ্বারা ফিলিস্তিনী নির্যাতনের খবরে নতুনত্বের কিছু নেই এবং নির্যাতন কেবল শিশুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। যায়নবাদী ইয়াহূদীরা বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপনের সূচনা থেকেই স্থানীয় আরব অধিবাসীদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন, জোর-যুলুম, লুন্ঠন, হত্যা ও উৎখাত তৎপরতা চালিয়ে আসছে। বস্তুতঃ মানব প্রজাতির ইতিহাসে অন্য কোন জাতিই এহেন পৈশাচিকতার আশ্রয় গ্রহণ করে নি। এ সম্পর্কে প্রামাণ্য তথ্যপ্রমাণাদি বিভিন্ন সময় প্রচারমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তবে সংক্ষেপণের স্বার্থে তথ্যসূত্র উল্লেখ না করে এখানে এর ওপরে সংক্ষিপ্ত দৃষ্টিপাত করা হলো।
বহিরাগত যায়নবাদী ইয়াহূদীরা ফিলিস্তিনের মাটিতে প্রথম সন্ত্রাসবাদী হামলা চালায় ১৮৮৬ খৃস্টাব্দে; তারা ‘উয়ূন্ কারেহ্, মাল্বাস্ ও জামারিন্ গ্রামের অনেক অধিবাসীকে হত্যা করে এবং বাকীদেরকে তাড়িয়ে দিয়ে গ্রাম তিনটি দখল করে নেয়।
filistin
পরে তারা অসংখ্য পৈশাচিক অপরাধ সংঘটিত করেছে; হাজার হাজার ফিলিস্তিনীকে হত্যা ও লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনীকে ভিটেমাটি থেকে উৎখাত করেছে, তাদের ধন-সম্পদ লুন্ঠন করেছে, বাড়ীঘরে অগ্নিসংযোগ করেছে, বাড়ীঘর-জমিজমা দখল করেছে। যায়নবাদীদের পৈশাচিকতা ও সন্ত্রাসী তৎপরতা এখনো পুরোদমে অব্যাহত রয়েছে।
ইসরাঈল প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পূর্বে যায়নবাদীরা র্দী ইয়াসীনের চারশ’ অধিবাসীর মধ্যে ২৫০ জনকে হত্যা করে এবং নিহতদের অনেকের হত-পা, পেট ও কান কেটে ফেলে, চোখ তুলে নেয়, মাথার খুলি চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলে, নারীদের উদর কর্তন করে, মায়ের কোলে সন্তানকে হত্যা করে, অনেককে জীবন্ত পুড়িয়ে মারে এবং তরুণীদেরকে নগ্ন করে ইয়াহূদীদেরকে প্রদর্শন করে।
প্রথম আরব-ইসরাঈল যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ে (জুলাই ১৯৪৮) যায়নবাদীরা আল্লাদ্ ও রাম্লাহ্ শহরে শত শত লোককে হত্যা করে। এরপর ১৯৫৩ খৃস্টাব্দের চৌদ্দই অক্টোবর ক্বাবীয়াহ্ গ্রামে সত্তর জনকে হত্যা করে।
কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদ ইসরাঈলের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গহণের পরিবর্তে সামান্য তিরস্কার করে মাত্র। ফলে নাহালীন্ ও বাদ্রাসে ইসরাঈল একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে।
যায়নবাদীদের এ পৈশাচিকতা শুধু অধিকৃত ফিলিস্তিনেই সীমাবদ্ধ থাকে নি। ১৯৮২ সালে লেবানন দখলকালে তারা পঁচিশ হাজার লোককে হত্যা করে, দুই লাখ আশি হাজার জনকে আহত করে।
১৯৮২ সালের ১৬ থেকে ১৮ই সেপ্টেম্বর বৈরুতের ছ¡াব্রা ও শাতীলা ফিলিস্তিনী উদ্বাস্তু শিবিরে দখলদার যায়নবাদীদের সাথে যোগসাজশে তাদের তাবেদার তথাকথিত দক্ষিণ লেবানন বাহিনী (এসএলএ) হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও শিশু-বৃদ্ধকে হত্যা করে।
বিংশ শতাব্দীর আশির দশকের শেষ দিকে সূচিত ফিলিস্তিনী জনগণের গণজাগরণ (প্রথম ইন্তিফাযাহ্) দমনকালে প্রথম পাঁচ বছরে নিহত হয় এক হাজার ছয়শ’র বেশী। এ সময় গ্রেফতারকৃতদেরকে দেয়ালে ঠুকে মাথা ও কপালের চামড়া তুলে ফেলা, চুল উপড়ে ফেলা, চোখ তুলে নেয়া, হাত-পা ভেঙ্গে ফেলা, হাত-পা, পেট ও কান কেটে ফেলা; ইট-পাথরের আঘাতে মাথার খুলি চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়া, অসুস্থ লোকদের হত্যা, নারীদের উদর কর্তন, মায়ের কোলে সন্তানের শিরচ্ছেদ, জীবন্ত পুড়ে মারা, তরুণীদেরকে উলঙ্গ করে শহরের রাস্তায় ঘুরানো ছিলো যায়নবাদীদের নিয়মিত কর্মসূচী। ইসরাঈলের তাবেদার এসএলএ মিলিশিয়ারা দক্ষিণ লেবাননের খাইয়াম্ কারাগারে বন্দীদেরকে বৈদ্যুতিক শক্ দিতো এবং পৈশাচিকভাবে মারপিট করতো।
যায়নবাদীরা ফিলিস্তিনী শিশু-কিশোরদের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালায় ও তাদের লক্ষ্য করে গুলী চালিয়ে থাকে। ইন্তফাযাহ্ কালে হতাহতদের অর্ধেকের বেশীই ছিলো পনর বছরের কম বয়স্ক শিশু-কিশোর।
ইন্তিফাযাহ্র প্রথম দুই বছরে যায়নবাদীদের হাতে ১৬ বছরের কম বয়স্ক শিশু-কিশোরদের ১৫৯ জন নিহত ও ৫০ থেকে ৬৩ হাজার আহত হয়।
এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এক রিপোর্টে বলা হয়, ইন্তিফাযাহ্ দমনের লক্ষ্যে ইসরাঈলী সৈন্যরা ব্যক্তিগত বাসভবন, ডাক্তারখানা, হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ ইত্যাদিতেও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে যার বেশীর ভাগ শিকার হয় শিশু, বৃদ্ধ ও রোগীরা যাতে অনেকের মৃত্যু ঘটে।
পাইকারী হারে গ্রেফতার, দীর্ঘদিন যাবত কারান্তরালে ফেলে রাখা, কারাগারে নির্যাতন, নির্যাতনের ফলে বন্দীর মৃত্যু ইত্যাদি ইসরাঈলের ফিলিস্তিনী বিরোধী প্রাত্যহিক কর্মসূচী।
সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার দেয়া মারণাস্ত্রে সজ্জিত ও তার রাজনৈতিক সমর্থনপুষ্ট যায়নবাদী ইসরাঈল ১২ই জুলাই ২০০৬ তারিখে পুনরায় লেবাননে সামরিক হামলা চালায় এবং দেশটির দক্ষিণাংশ দখল করার পর শেষ পর্যন্ত হিযবুল্লাহ্ গেরিলাদের প্রতিরোধের মুখে পরাজয় মেনে পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়। এ সময় যায়নবাদীরা লেবাননের নিরীহ বেসামরিক লোকদেরকে নির্বিচারে হত্যা করে।
যায়নবাদীদের গোটা ইতিহাসই মানবতাবিরোধী পৈশাচিক অপরাধে পরিপূর্ণ। এখানে আমরা তাদের পৈশাচিকতার একটি সংক্ষিপ্ত ও অসম্পূর্ণ খতিয়ান (ওপরে উল্লিখিত অপরাধগুলোর পুনরাবৃত্তি না করে) পেশ করছি ঃ
১৯৪৮ ঃ নাছিরুদ্দীন গ্রামের ৪০ জন বাদে সব লোককে হত্যা (১৩ই এপ্রিল)। কাবু গ্রামের বিশ জন এবং বায়তু দারেস্ গ্রামের সকল অধিবাসীকে হত্যা (৩রা মে)। বায়তুশ্ শূরা-র সকল অধিবাসীকে হত্যা (৫ই মে)। যায়তুন্ গ্রামের সকল অধিবাসীকে মসজিদে জমা করে মসজিদটি উড়িয়ে দিয়ে হত্যা (৬ই মে)।
১৯৫৪ ঃ জর্দানের মাহালিন্ গ্রামে ১১ জন বেসামরিক লোককে হত্যা (৪ঠা মার্চ)।
১৯৫৫ ঃ খান্ ইউনুস্-এ ২০ জন বেসামরিক লোককে হত্যা (৩১শে মে)। খান্ ইউনুস্ ও বানী শালাহ্-তে ৪৬ জন বেসামরিক লোককে হত্যা (২২শে আগস্ট)।
১৯৬৫ ঃ জর্দানী এলাকায় পাঁচ বার হামলা এবং সুর্মা গ্রামের ২০০ বেসামরিক অধিবাসীকে হত্যা (৬ই থেকে ২২শে মে)।
১৯৮৭ ঃ ইসরাঈলী সৈন্য কর্তৃক গাড়ী চাপা দিয়ে চার জন ফিলিস্তিনীকে হত্যা (৮ই ডিসেম্বর) Ñ যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইন্তিফাযাহ্ সূচিত হয়।
১৯৯৪ ঃ আল-খালীল শহরে হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর মাযার সংলগ্ন মসজিদে একজন ইসরাঈলী সামরিক অফিসার কর্তৃক ব্রাশ ফায়ারে ৬৩ জন ফিলিস্তিনীকে হত্যা (২৫শে ফেব্রুয়ারী)। একে কেন্দ্র করে সূচিত ছোট ইন্তিফাযাহ্ চলাকালে ১৯৯৬-এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আরো শতাধিক ফিলিস্তিনীকে হত্যা।
১৯৯৬ ঃ লেবাননের ক্বানা শহরস্থ জাতিসংঘ উদ্বাস্তু শিবিরে বোমা বর্ষণ করে অনেক নারী, বৃদ্ধ ও শিশু সহ ১৭০ জন বেসামরিক লেবাননীকে হত্যা (১৮ই এপ্রিল)।
২০০০ খৃস্টাব্দের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে সূচিত দ্বিতীয় ইন্তিফাযায় (২০০৯-এর ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত) মোট ৬ হাজার ৩৪৮ জন ফিলিস্তিনীকে হত্যা যাদের দুই তৃতীয়াংশই ছিলো এমন লোক যারা ইসরাঈলীদের বিরুদ্ধে সংঘাতে অংশগ্রহণ করে নি।
২০০৬ ঃ ১২ই জুলাই ইসরাঈলী বাহিনী লেবাননে সর্বাত্মক হামলা শুরু করে এবং ১৪ই আগস্ট পর্যন্ত কম পক্ষে সাড়ে এগারশ’ লোককে হত্যা করে যাদের বেশীর ভাগই ছিলো বেসামরিক লোক।
লেবাননের তাইবে ও আইতা আশ্-শাব্ গ্রামে বোমা বর্ষণ করে ৫৭ জন বেসামরিক লোককে হত্যা (৫ই আগস্ট)। দক্ষিণ লেবাননের ‘আইনুল্ হাল্ওয়াস্থ ফিলিস্তিনী উদ্বাস্তু শিবিরে বোমা বর্ষণ; বোমা লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়া সত্ত্বেও ২ জন নিহত ও ১৫ জন আহত (৯ই আগস্ট)।
ইসরাঈল গাযাহ্র ওপর ২০০৮-এর ২৭শে ডিসেম্বর হামলা শুরু করে; থানাসমূহ, বিভিন্ন স্কুল, জাতিসংঘের গুদাম, হামাস সরকারের বিভিন্ন অফিস ভবন, গাযাহ্ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ভবন, জাতিসংঘ পরিচালিত একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ফিলিস্তিনী উদ্বাস্তু শিবিরের ওপর ব্যাপক বিমান হামলা চালায়। এতে ৫ হাজার বাড়ী, ১৬টি ভবন ও ২০টি মসজিদ পুরোপুরি ধ্বংস হয়, আরো ২৫ হাজার বাড়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ২৫২ জন শিশু সহ প্রায় এক হাজার ৪০০ ফিলিস্তিনী নিহত হয়।
যায়নবাদী ইসরাঈল ফিলিস্তিনী মুসলমানদের ওপর সাংস্কৃতিক নির্যাতনও চালায়।
তারা ফিলিস্তিনীদের বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়, ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় বই-পুস্তকের অনুবাদ নিষিদ্ধ করে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক স্তরে কয়েকটি সুরাহ্ পড়ানো ব্যতীত কোরআন মজীদ শিক্ষাদান নিষিদ্ধ করে, অন্যদিকে মাধ্যমিক স্তরে ইয়াহূদীদের ধর্মগ্রন্থ ‘ওল্ড্ টেস্টামেন্ট’ পড়ানো বাধ্যতামূলক করে। এমনকি তারা বেশ কিছু আয়াত বাদ দিয়ে ও বহু আয়াত বিকৃত করে কোরআন মুদ্রণের পদক্ষেপও প্রহণ করে।
বস্তুতঃ এ এক বিতর্কাতীত সত্য যে, ফিলিস্তিনের বুকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বাইরে থেকে ইয়াহূদীদের এনে ফিলিস্তিনী জনগণের আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে এবং সন্ত্রাসী কায়দায় তাদেরকে উৎখাত করে অবৈধভাবে কৃত্রিম রাষ্ট্র ইসরাঈল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অতঃপর এ রাষ্ট্রটির ইতিহাস হচ্ছে ফিলিস্তিনী ও লেবাননী জনগণের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও পৈশাচিকতার ইতিহাস। এহেন একটি মানবতাবিরোধী সন্ত্রাসী রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়ে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান একেবারেই অসম্ভব।
বরং ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানের একমাত্র পথ হচ্ছে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্র ঐক্যবদ্ধ সামরিক পদক্ষেপের মাধ্যমে সন্ত্রাসের হোতা এ অবৈধ রাষ্ট্রটির অস্তিত্ব ধরণীর বুক থেকে চিরতরে মুছে ফেলা। এখানে রয়েছে মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাস যা পুনরুদ্ধারের দাবিতে রমযানের শেষ শুক্রবার বিশ্বব্যাপি পালিত হয় আল-কুদস দিবস।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।