স্বপ্ন বিলাসী আমি । স্বপ্নে নিজেরে খুঁজি । কল্পনায় বেঁচে থাকি । বাস্তবতা ভুলে যাই বারবার । প্রারম্ভিকাঃ
‘বারদী’ ।
যেখানে প্রাকৃতির সজীবতা আর নিবিড় নিস্তব্দতার মাঝে ভক্তির পূর্ণ অস্তিত্ত্ব বিরাজমান, যেখানে শান্ত বটগাছের মাথায় সুমধুর সুরে গেয়ে উঠে কোকিল, শালিক । যেখানে ভক্তদের পদচারনায় মুখরিত হয় চারপাশ । কেউ প্রান ভরে আহরন করে প্রাকৃতিক সুধা । আবার কোন এক ভক্ত নিরবে ফুল তুলে নিভৃতে মালা গাঁথে গুরু স্মরণে । সেখানেই ২২ বছর লীলা করে গেছেন মানবতার মুক্তিকামী মহাপুরুষ শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী ।
আশ্রমের অবস্থানঃ
এলাকাটির নাম বারদী । যার পূর্বদক্ষিনে বিশাল মেঘনা । ভারতের বরাক নদ যার উৎস । বরাক নদ থেকে বাংলাদেশের আরও কয়েকটি নদীতে মিশেছে । কুশিয়ারা, সুরমা আর মেঘনা ।
এখানকার মেঘনা এখনো ভরা বর্ষার মত ফোঁসে উঠে । বিস্তৃত এই মেঘনা নদীর এক পাঁশে আনন্দ বাজার । এই বাজারের গরম পুরি আর গরুর খাঁটি দুধের চা’য়ের স্বাদ ভূলার মত নয় ।
বারদী বাজারের পূর্বপশ্চিম-উত্তর কোনাকুনি লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রম । অন্য কোনে রয়েছে বিশাল জামে মসজিদ ।
প্রতিদিন সূর্য ডুবার প্রাক্কালে একদিকে পুরোহিতের কাসার ঘণ্টার সাথে তার মন্ত্রধ্বনি, অন্যদিকে মুয়াজ্জিনের মিষ্টি মধুর ধ্বনি এক আধ্যাত্মিক আবেশ সৃষ্টি হয় । তখন সকল কিছুর উর্ধ্বে পবিত্রতার এক শ্বেতসৌন্দর্রের জয়গান ধ্বনিত হয় ধরনী হতে ঊর্ধ্বলোক পর্যন্ত ।
বাৎসরিক উৎসবঃ
প্রতি বছর উনিশ জৈষ্ঠ এখানে সপ্তাহ ব্যাপী মেলা বসে । ১২৯৭ সালের এই দিনে পরমপুরুষ শ্রীশ্রীলোকনাথ ব্রম্মচারী মৃত্যুবরণ করেন । তার এই মহাকাল প্রয়াণের দিনটিকে ভক্তি শ্রদ্ধার মধ্য দিয়ে স্মরণ করার জন্যই এই মেলার আয়োজন হয় ।
আশ্রমের ঠিক সামনে বিশাল সবুজ মাঠ । এখানেই মেলা বসে । এই মেলাকে কেন্দ্র করে বিশাল আয়োজন করা হয় এখানে । নানান এলাকা থেকে হাজারও পন্য আসে । আসে বাহারী তৈজসপত্র, আহারের ফল ফলাদি আরও কত কি ।
হালে একসময় এখানে সার্কাস পার্টি আসত । সার্কাস পার্টির অদ্ভুত আর অসম্ভবপ্রায় প্রদর্শনী মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করে আগতরা । এই উৎসবে শুধু আশেপাশের মানুষজনই আসে, এমন কিন্তু নয় । বহুদেশে বহু ধর্মাবলম্বী মানুষের আগমন ঘটে এই মেলায় । এ এক বিশাল আয়োজন ।
এক সপ্তাহব্যপি চলতে থাকে রাতদিন ।
স্মৃতিচারণাঃ
বর্তমানে বারদীতে যাওয়ার ব্যবস্থা ভালো । কোন একসময় কোন সড়ক ব্যবস্থা ছিলো না । ব্রম্মপুত্র নদের পর নবীগঞ্জের ত্রিবেনী খালের মধ্য দিয়ে শীতলক্ষা পার হয়ে নৌকা পথে শহরে আসতে হতো, মেঘনায় লঞ্চ ছিলো দিনে একবার । অন্যদিকে প্রায় ছয় কিলোমিটার হেটে এসে তখন প্রভাকরদি থেকে ট্রেনে চেপে নবীগঞ্জ হয়ে শীতলক্ষ্যা পার হয়ে নারায়ণগঞ্জ আসতে হতো ।
তখনো এই মেলায় মানুষের কমতি ছিলো না । তখন প্রায় মাসখানেক পূর্ব হতে চলতে থাকতো এই মেলার প্রস্তুতি । সার্কাসের দল হাতি, বাঘ, সিংহ, ভালুক কত কত হিংস্র প্রাণী খাঁচায় করে নিয়ে আসতো । বিকাল হলে চলতো শক্ত সামর্থ্য গাট্টাগোট্টা মানুষের হাতে এই প্রাণীদের নিয়ে নানা কসরত । নানা অনুশীলন ।
দম বন্ধ হয়ে আসতো যখন উপর দিকে ত্রিশূল ছুঁড়ে দিয়ে চোখ বাঁধা অবস্থায় মাটিতে শুয়ে পড়তো সার্কাসের মেয়েটি । লোহার ভারী ধারালো ত্রিশূল তার বুকের দুপাশে দুটি আর ঠিক মাথা ঘেষে একটি শূল উপর থেকে এসে মাটিতে গেঁথে যেতো । এখন আয়োজন হয় আরো বড় । তবে ভিন্ন আঙ্গিকে । এখনও সার্কাস আসে, কুপের মধ্যে মোটর সাইকেলের খেলা হয় ।
হয় পুতুল নাচ । প্রায় সবকিছুই হয় । তবে কেরোসিনের হ্যাজাক লাইটের আলোতে যা দেখা যেত তা আর আসে না । পূর্বের ঐতিহ্য পুরাপুরি ধরে রেখেছে তা হলো নানা রকমের আর নানা সাইজের মিষ্টি। এক কেজি, দু কেজি সাইজের মিষ্টি ।
যার স্বাদ স্বর্গীয় । পেয়ারা, সন্দেশ, কালোজাম, বালুশাই কত কত রকমের মিষ্টি । বাতাসার কথা এই প্রজন্মের অনেকেই হয়তো জানে না । জৈষ্ঠের উনিশ তারিখ আশ্রমের চৌচালা ছাদের উপর ভক্তদের ছুঁড়ে দেয়া বাতাসার বৃষ্টি নামে। চলে হরির নামে লুট ।
এই লুট খুশির, আনন্দের।
আশ্রমের সঙ্কখিপ্ত বর্ণনাঃ
শ্রীশ্রীবাবালোকনাথ ব্রম্মচারীর আশ্রমের ঠিক দক্ষিণের উঠোনে, তাঁর সমাধিস্থলের পশ্চিমে, মূল গেটের ঠিক সামনে, পথ আগলে শত বৎসর ধরে কালের নানা ঘটনার সাক্ষী যে হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সে হলো বিশাল আকৃতির একটি বকুল গাছ । সে আজও তেমনি করে ছায়া দেয় । দেয় অসংখ্য পাপড়িযুক্ত হালকা মাটি রঙা ছোট ছোট সুগন্ধি ফুল ।
আশ্রমের ভেতরে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর বিশাল তৈলচিত্র ।
এখানে সকাল সন্ধ্যা পুজা হয় । মুল আশ্রমের পেছনে খোলা একটু উঠান পেরিয়েই বিশাল পাঁচতলা ভবনের যাত্রীনিবাস । পশ্চিমে আরও দুটি বিশালাকার যাত্রীনিবাস । যাত্রীদের যে কেউ থাকতে পারবে এখানে । এই জন্যে কোন অর্থ দিতে হবে না ।
একটু অবাক করনের বিষয়ই বটে, বর্তমান যুগে বিনে পয়সায় রাত যাপন ।
মহাপুরুষ লোকনাথ ব্রহ্মচারীঃ
যে দিগ্মীজয়ী মহামানবের আলোয় আলোকিত এই বারদি তিনি হলেন অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন মহাপুরুষ শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী । প্রাকৃতিক অসম্ভবকে সাধন করার সাধক ছিলেন তিনি । একশত ষাট বছরের মধ্যে বেশির সময় কাটিয়েছেন ধ্যান এবং যোগসাধনায় । হিমালয়ের নির্জন পাহারের গুহায়, গভীর অরণ্যে, পরিত্যক্ত পর্ণকুটিরে তাঁর এই সাধনা চলেছিলো বহুকাল ।
তিঁনি মক্কা, মদিনা ঘুরে বেড়িয়েছেন । চেষ্টা করেছেন বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব স্থাপনের । তিঁনি সর্বব্যাপী মানুষের কল্যাণ সাধনে মগ্ন ছিলেন । তাঁর সম্পর্কে বহু অলৌকিক ঘটনার কথা বারদী এলাকার মানুষের কাছ থেকেও জানা যায় ।
জন্ম ও মৃত্যুঃ
শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন তথা জন্মাষ্টমী তিতিতে ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দের ৩১ আগস্ট বাংলা ১১৩৭ সনের ১৮ ভাদ্র কলকাতার অদূরে ২৪ পরগণার চৌরাশি চাকলা গ্রামে একটি ব্রাক্ষন পরিবারে আগমন ঘটে হিন্দু ধর্মের আধ্যাত্মিক ক্ষমতার মহাপুরুষ শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী ।
তার পিতার নাম রামনারায়ণ ঘোষাল ও মাতা কমলা দেবী । তিনি ছিলেন তার বাবা-মার ৪র্থ সন্তান । বাবার দেয়া নাম শ্রী লোকনাথ ঘোষাল । সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষিত হওয়া পর নাম রাখা হয় শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী । আবার ভক্তবৃন্দ কেউ কেউ বাবা লোকনাথ বলে ডাকতেন ।
ছেলেটির অসীম শক্তির কথা জানতে পেরেই গুরুদেব এ নামটি রেখেছিলেন ।
বাংলা ১২৯৭ সালের ১৯ জ্যৈষ্ঠ (১ জুন, ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে) শুক্লা ত্রয়োদশী তিথি রবিবার বেলা ১১ টা ৪০ মিনিটে লোকনাথ ব্রহ্মচারী দেহত্যাগ করেন । তিনি ১৬০ বছর লীলা করে গেছেন এই ভবে ।
আধ্যাত্মিক জীবনঃ
দীক্ষাগুরু হিসেবে ভগবান চন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় কয়েক বছর দেশে বাস করে লোকনাথ ও বেণীমাধব বন্দ্যোপাধ্যায় নামীয় শিষ্যদ্বয়কে সাথে নিয়ে কালীঘাটে আসেন । ঐ সময়ে কালীঘাট বর্তমানের ন্যায় দালান-কোঠায় নয়, ঘন জঙ্গলে পূর্ণ ছিল ।
জঙ্গলে বসে অনেক সাধু-সন্ন্যাসী নিজ নিজ অভীষ্ট কাজ করতেন । লোকনাথের গুরুজীও তাদেরকে ঐ কাজে নিযুক্ত করলেন । এভাবে চলল প্রথমে সারা দিন উপবাস । পরে সারাদিন সারারাত উপবাস । এই উপবাসকে বলে “একান্তর” ।
এরপর তিনদিন তিনরাত উপবাস । একে বলে “ত্রিরাত্র” । .........। এভাবে শেষে টানা ৩০ দিন ৩০ রাত উপবাস । এটাকে বলা হয় “মাসাহ’ ব্রত ।
এরপর এরপর গুরুদেব তাদের গাঁয়ে চিনি ছিটিয়ে পিপড়া ডেকে এনে পরীক্ষা করেন, তাদের ধ্যান ভঙ্গ হয় কিনা । এই পরীক্ষায় তারা সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন । পরে ভগবান চন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় তাদেরকে নিয়ে বারাণসীতে গমন করে যোগাবলম্বনে দেহত্যাগ করার পূর্বে ত্রৈলিঙ্গস্বামীর হাতে ভার দিয়ে যান । সেখানে স্বামীজীর সাথে তারা কিছুকাল যোগশিক্ষা করে ভ্রমণে বের হন ।
লোকনাথ পশ্চিম দিকে দিয়ে আফগানিস্তান, মক্কা, মদিনা ইত্যাদি স্থান অতিক্রম করে আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূল পর্যন্ত গমন করেছিলেন।
মক্কাদেশীয় মুসলিম জনগোষ্ঠী তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন। সেখানে আবদুল গফুর নামে এক মহাপুরুষের সাথে পরিচিত হন। পরে তিনি বেণীমাধবকে সাথে নিয়ে উত্তরের পথে গমন করেন। তারা সুমেরু এলাকা গমনের ইচ্ছায় প্রাক-প্রস্তুতি উপলক্ষে শৈত্যপ্রধান এলাকা হিসেবে বদরিকা আশ্রমে অবস্থান করে সেখান থেকে আধুনিক পরিজ্ঞাত সীমা অতিক্রম করে উত্তরে বহুদূরে চলে যান। সেখানে সূর্যোদয় না হওয়ায় সময় নির্ণয় করা যায় নাই; তবে তারা সে পথে ২০ বার বরফ পড়তে ও গলতে দেখেছিলেন।
শেষে হিমালয় শৃঙ্গে বাঁধা পেয়ে তারা পূর্ব দিকে গমন করে চীন দেশে উপস্থিত হন এবং ৩ মাস বন্দী থেকে মুক্তিলাভ করেন। তারপর উভয়ে চন্দ্রনাথে আগমন করে কিছুকাল থেকে বেণীমাধব কামাখ্যায় এবং লোকনাথ বারদী গ্রামে গমন করে বাস করতে থাকে। সে সময় থেকেই “বারদী’র ব্রহ্মচারী” হিসেবে লোকনাথ পরিচিতি পান।
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আধ্যাত্মিক শক্তি সম্বন্ধে অনেক কিংবদন্তি প্রচলিত আছে । কেউ কেউ বলেন, তিনি জাতিস্মর; দেহ হতে বহির্গত হতে এবং অন্যের মনের ভাব অবলীলায় তিনি জানতে পারতেন ।
এছাড়াও, অন্যের রোগ নিজ দেহে এনে রোগীকে রোগমুক্ত করতে পারতেন । মানুষের অন্তরের ভাষা তিনি জানতেন । বুজতেন পশু-পাখি ও কীট-পতঙ্গের ভাষা ।
বানী অমৃতঃ
“রণে, বনে, জলে, জঙ্গলে যখনই বিপদে পড়িবে, আমাকে স্মরণ করো আমিই রক্ষা করব । “
“আমার বিনাশ নেই, শ্রাদ্ধও নেই, আমি নিত্য পদার্থ ।
“ অর্থাৎ তিনি হলেন গিতায় বর্ণিত পরমাত্মা ।
“সদগুরুই হচ্ছে স্বয়ং ভগবান, ভগবান ভিন্ন কেহ সদগুরু হতে পারে না । “
নিজেকে বড় না করে তাকে বড় কর । নিজে কর্তা না সেজে তাকে কর্তা জ্ঞান করার চেষ্টা কর । তবেই ত্যাগ আসবে ।
“
সমাপ্তিঃ
বারদীর লোকনাথ আশ্রম এখন শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থ স্থানই নয়, বরং ধর্ম বর্ণ জাতি নির্বিশেষে সকল ধর্মের, সকল মানুষের কাছে এক মিলন মেলায় রুপ নিয়েছে ।
নাগরিক ব্যস্ততা আর ইট-কাঠের জীবন নিয়ে যখন ক্লান্ত দেহ-মন, আর ঘুম ভাঙ্গা থেকে শুরু করে ঘুমুতে যাওয়া পর্যন্ত সামগ্রিক জীবনের একঘেয়েমিতে হাঁপিয়ে উঠার আগেই ঘুরে আসতে পারেন “বারদী”, শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী আশ্রম থেকে । ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।