আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সীমান্তবাসীর কানে এখনো বাজে ‘পানি পানি, বাঁচাও বাঁচাও’ ভারতে নিরাপত্তাহীনতায় ফেলানীর পরিবার

কি বলব

কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিতে নির্মমভাবে নিহত ফেলানীর ভারতে অবস্থানরত মা ও ভাই-বোনেরা চরম নিরাপত্তাহীনতার মুখে পড়েছে। শুক্রবার দুপুরে ফেলানীর বাবা নুর হোসেন নুরু কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাংলানিউজকে জানান, ঘটনা প্রকাশ হয়ে পড়ার পর ভারতীয় পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে তার স্ত্রী ও সন্তানেরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। নুরু জানান, বিএসএফের গুলিতে ফেলানী নিহত হবার পর বিষয়টি দেশ-বিদেশে আলোচিত হয়। এর ফলে ভারতে থাকা তার পরিবারের বাকি সদস্যরা বিপদে পড়ে যায়। পুলিশ তাদের খুঁজতে থাকে।

একইসঙ্গে ভারতের আসাম রাজ্যের গোয়ালপাড়া জেলার বনগাইগাঁও এলাকায় ৪০/৫০ হাজার টাকার মালামালসহ তার মনোহারি দোকানটি দখল করে নেয় ভারতীয়রা। সরেজমিনে নাগেশ্বরী উপজেলার রামখানার কলোনীপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, কন্যা হারিয়ে দিকভ্রান্ত অবস্থা হয়েছে নুর হোসেনের। নাগেশ্বরী উপজেলার দক্ষিণ রামখানার কলোনীপাড়া গ্রামে নিজেদের কোনও জমি-জমা না থাকায় চাচার বাড়িতে দাদা হাফেজ উদ্দিনের কবরের পাশে সমাহিত করা হয়েছে ফেলানীকে। কাঁদতে কাঁদতে নুর হোসেনের চোখের পানি যেন শুকিয়ে গেছে। কন্যার কবরের পাশে এসে প্রায়ই নির্বাক তাকিয়ে থাকেন করুণ দৃষ্টিতে।

ফেলানী নিহত হওয়ার ঘটনা তার মা জানেন কি না জিজ্ঞেস করতে তিনি জানান, ঘটনার ৫দিন পর মোবাইল ফোনে ফেলানীর মৃত্যুর খবর দেওয়া হয় মা জাহানারাকে। গত ৩ সপ্তাহে ২/৩ বার মোবাইল ফোনে কথা হলেও গত ৭/৮ দিন ধরে স্ত্রী সন্তানের আর কোনও খবর না পেয়ে দুঃশ্চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন নুরু। স্ত্রী জাহানারাসহ (৩৫) কিশোরী কন্যা মালেকা (১৩), ছেলে জান উদ্দিন (১০), আরফান আলী (৮), আক্কাস আলী (৭) ও সর্বকনিষ্ঠ কন্যা কাজলী (৪) কেমন আছে? কোথায় আছে? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন অসহায় এই পিতা। বাংলানিউজের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের মানবাধিকার সংস্থাসহ সরকারের কাছে নুরুর একটাই আকুতি, ভারতের বিড়ম্বনাপূর্ণ জীবন থেকে মুক্তি চান তিনি ও তার পরিবার। স্ত্রী ও ৫ সন্তানকে নিয়ে দেশের মাটিতে শান্তিতে থাকতে চান।

ভারত থেকে তাদের নিরাপদে বাংলাদেশে ফিরে পেতে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের কাছে আকুতি জানিয়েছেন তিনি। যে কারণে ভারতে অবস্থান ফেলানীর বাবা নুর হোসেন নুরু বাংলানিউজ প্রতিনিধিকে জানান, ভারতে তিনি যান প্রায় ১২/১৩ বছর আগে। প্রথমে দিল্লীতে ইটভাটায় কাজ শুরু করেন। পরে স্ত্রী জাহানারাসহ কন্যা ফেলানী ও মালেকাকে কে নিয়ে যান ভারতে। এরপর প্রায় ৭/৮ বছর আগে চলে যান আসাম রাজ্যের গোয়ালপাড়া জেলার বনগাইগাঁও।

সেখানে টুনিয়ারপাড় বাজার এলাকায় পান-বিড়িসহ মনোহরী দোকান ও রিক্সা চালিয়ে চলতো সংসার। ভারতে একে একে জন্ম নেয় ছেলে জান উদ্দিন, আরফান আলী, আক্কাস আলী ও সর্বকনিষ্ঠ কন্যা কাজলী। সেখান থেকেই ফেলানীকে বিয়ে দিতে বাংলাদেশে নিয়ে আসছিলেন তিনি। ভারতীয় অংশে যা ঘটেছিল সেদিন ভারতীয় ২ জন দালালের বিচারসহ কন্যা হত্যার দৃষ্টান্তমুলক বিচারের আকুতি জানিয়ে নুর হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, কুচবিহারের দিনহাটার সীমান্ত সংলগ্ন খেতাবেরকুটি এলাকার দালাল মোশাররফ ও আবুল হোসেন ৩ হাজার টাকার বিনিময়ে তাদেরকে কাঁটাতারের বেড়া পার করে দেবার চুক্তি করে। সে মোতাবেক ঘটনার আগের রাত ৮টায় (৬ জানুয়ারি) ফেলানী ও বাবা নুর হোসেন ওই এলাকায় আসেন।

এরপর প্রচণ্ড শীতের মাঝে নির্ঘুম রাত কাটানোর পর ফজরের নামাজের সময় সীমান্ত অতিক্রমের জন্য জোরপূর্বক কাঁটাতারে রাখা মইয়ের ওপর তাদের তুলে দেয় দালালেরা। বাবা ও মেয়ে তারের শেষ সীমানায় পৌঁছামাত্র খুব কাছে থেকে ভারতের চৌধুরীহাট ক্যাম্পের বিএসএফ সদস্যরা গুলি চালায় তাদের ল্য করে। আচমকা গুলির শব্দে নুরু শরীরে কাঁটাতারে জখম নিয়ে ওপর থেকে ছিটকে পড়েন বাংলাদেশ অংশে। আর গুলি খেয়ে মেয়ে ফেলানী আটকে যায় উপরে কাঁটাতারের বেড়ায়। ফেলানীর নানা কবিরাজ রশিদ আলী ও চাচা আব্দুল মালেক জানান, কুড়িগ্রাম জেলার বানারভিটা ও কলোনিপাড়া এলাকাটি অত্যন্ত দারিদ্রপীড়িত।

অভাবের তাড়নায় এসব এলাকার বাসিন্দাদের অনেকেই দীর্ঘকাল যাবত ভারতের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে কাজ-কর্ম করে আসছেন। বিভিন্ন সময়ে ফেলানীর বাবার মত ভারতে কাজ করে এসেছেন এমন অনেকেই জানান, সেখানে অবর্ণনীয় দুর্ভোগকে সঙ্গী করে শুধু দু’মুঠো অন্নের সংস্থানে ইটভাটার কাজসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে থাকে এখানকার লোকজন। অপরদিকে নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে কম পারিশ্রমিকে এবং দ শ্রমিক পাওয়ার কারণে ভারতীয় পুলিশসহ অন্যান্য কতৃপক্ষ বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করে। মৃত্যুর আগে ফেলানীকে ধর্ষণ করা হয়েছিল! মৃত্যুর আগে ফেলানীর ওপর বিএসফ সদস্যরা পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে বলে গত বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি জাতীয় দৈনিকে খবর প্রকাশ করা হয়। নানী খোদেজা বেগমের উদ্ধৃতি দিয়ে পত্রিকাটিতে বলা হয়, ফেলানীর ওপর ব্যাভিচার করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে ফেলানীদের বাড়িতে উপস্থিত নানী খোদেজা বেগমকে প্রশ্ন করলে তিনি এ প্রতিনিধিকে জানান, এ ধরনের কোনও বক্তব্য তিনি দেননি। এছাড়া ময়না তদন্ত বোর্ডের তিন সদস্য কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালের জুনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. অজয় কুমার রায়, ডা. মাহফুজার রহমান মুকুল ও ডা. সোহেল আহমেদ বাংলানিউজকে জানান, একটি গুলি ফেলানীর বুকের পিছন দিক ভেদ করে সামনের দিক দিয়ে বেড়িয়ে গেছে। তবে ধর্ষণের কোনও আলামত বা চিহ্ন পাওয়া যায়নি। পুরো এলাকায় নিস্তব্ধতা! বিএসএফের গুলিতে নির্মমভাবে ফেলানী নিহত হওয়ার ২২ দিন পরও সীমান্তবাসী স্থানীয় নারী-পুরুষের কানে আজো বাজে গুলিবিদ্ধ ফেলানীর আত্মচিৎকার, ‘পানি পানি, বাঁচাও বাঁচাও’। উত্তর অনন্তপুর সীমান্তবাসীর প্রতিদিন ঘুম ভাঙ্গে ফেলানীর সেই আর্তচিৎকার মনে করে।

এমনিতেই সীমান্ত এলাকা, তারপরেও পুরো এলাকায় বিরাজ করছে যেন কবরেরও বেশি নিস্তব্ধতা। স্থানীয় মোহাম্মদ আলী (৩৫), হাজিরন নেসা (৩৫), গোলেনুর বেগম (৩২), গোলজার হোসেনসহ আরো অনেকে অবচেতনে প্রায়ই চমকে ওঠেন বাঁচার আকুতিতে মাত্র ১৫ বছর বয়সী ফেলানীর করুণ আকুতি...পানি পানি...বাঁচাও বাঁচাও শব্দে। বাবা নুর হোসেনসহ এলাকাবাসী মোহাম্মদ আলী, হাজিরন, গোলেনুর, গোলজার কেউই সেদিন সারা দিতে পারেননি ফেলানীর সেই সকরুণ আহ্বানে। কারণ, তাহলে হয়তো বিএসএফর গুলিতে লাশের সংখ্যা আরও বেড়ে যেত কয়েকটি।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।