মানুষ মহাবিশ্বে অভিজান চালাচ্ছে। কিন্তু এখনো মহাসাগরের গভীরে লুকিয়ে আছে আরও অনেক অজানা রহস্য। মহাকাশে বুদ্ধিমান প্রাণীর সম্ভাবনা সিরিজ লিখতে গিয়ে হঠাৎ করেই খেয়াল চাপলো মহাসাগরের নিচের রহস্য নিয়ে কিছু লিখবার। সেই খেয়াল থেকেই এই পোষ্ট লেখা...
বিজ্ঞানীরা এই রহস্য ভেদ করবার জন্য নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন। মহাসাগরের জীবজগৎ যেমন বিচিত্র তেমনি বিচিত্র এর ভূপ্রকৃতি।
সাগরের এই তলদেশে সূর্যের আলো পৌঁছাতে পারেনা। তাই নিকষ অন্ধকার এখানে। এই চির তিমিরের রাজ্যে কি ঘটছে তা জানার জন্য মেরিন বায়োলজিস্ট এবং জিয়োলজিস্টরা সাগরের তলদেশে পাঠিয়েছিলেন স্বয়ংচালিত যন্ত্রযান এবং ক্যামেরা। বিস্ময়কর সব তথ্য পেয়েছেন তারা।
অ্যাটল্যান্টিক মহাসাগরের তলদেশে ১১৫০০ ফুট নিচে পাঠানো হয়েছিলো ৪৪০০ ওয়াট শক্তিসম্পন্ন আলো, সঙ্গে পানির নিচে অতি উচ্চ চাপ সইবার ক্ষমতাসমৃদ্ধ শক্তিশালী হাই র্যেজুলেশনের ক্যামেরা।
সমুদ্রের পানি এখানে ৩৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণ। কারণ সমুদ্রতলের ম্যাগমা পানিকে উত্তপ্ত করে তোলে। এই উত্তপ্ত পানির সাথে শীতল পানির সংযোগে সৃষ্টি হত ঘূর্ণাবর্ত, কুয়াশা এবং চিমনীর মত আকৃতিপ্রাপ্ত বিভিন্ন রকমের পাথর। এখানে ব্যাকটেরিয়াসহ অন্যান্য জীবের আবির্ভাব ঘটেছে অভূতপূর্বভাবে। সূর্যের আলো এখানে পৌছায়না তাই এখানে জন্ম নেয়া মেরিন প্ল্যান্টগুলোতে কেমোসিন্থেসিস প্রক্রিয়ায় জীবনচক্র আবর্তিত হয়, ব্যাকটেরিয়ার মত অণুজীবদের বাস এখানে।
এদের মাঝে বাস করে ট্রান্সলুসেন্ট বা আলোকস্বচ্ছ চিংড়ী। এই চিংড়ীগুলোর কোনো চোখ নেই। সাগরতলের নিকষ অন্ধকারে কিছুই দেখা যায়না তাই বিবর্তন আর অভিযোজনের অমোঘ নিয়মে দৃষ্টিহীন হয়ে পড়েছে এরা। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো যদিও এসব চিংড়ী দৃষ্টিহীন কিন্তু এদের পিঠের অংশে রয়েছে রডোপসিন। রডোপসিন হলো এক ধরণের আলোক সংবেদী কণিকা যা মানুষ সহ অন্যান্য উন্নত জীবদের চোখে বিদ্যমান।
রডোপসিনের উপস্থিতিতে এসব চিংড়ী কিছু দেখতে না পেলেও আলোর উপস্থিতি বুঝতে পারে অর্থাৎ আলোতে সংবেদনশীলতা প্রকাশ করে। কিন্তু এই অন্ধকার জগতে আলো আসবে কোত্থেকে!
আসলে সাগরতলের জগত গাড় অন্ধকার হলেও এখানেও রয়েছে বিচিত্র আলোর সমাহার। এখানে উত্তপ্ত জলের সাথে খনিজের বিক্রিয়ায় ইনফ্রারেড রশ্মির বিকিরণ ঘটে। ইনফ্রারেড রশ্মি মানুষের চোখে ধরা পড়েনা কিন্তু এই “অন্ধ” চিংড়ীরা এই আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা প্রকাশ করে। এই সংবেদনশীলতার ফলে তারা আলোক বিচ্ছুরন ঘটায় এমন খাদ্যসমৃদ্ধ চিমনীগুলো খুঁজে পায়।
আবার অতি উত্তপ্ত জলে নিজেদের সিদ্ধ হওয়া থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারে। রিমিকালিস এক্সাকুলাটা নামের এই চিংড়ীরা অদ্ভুত কিছু আচরণ করে। এদের শিশু, তরুণ ও বয়স্কদের গ্রুপ সম্পূর্ণ আলাদা। কি কারণে তরুণ চিংড়ীরা বয়স্কদেরদের থকে দূরে থাকে এবং আলাদা ধরণের খাদ্য গ্রহণ করে বিজ্ঞানীরা সে সম্পর্কে নিশ্চিত নন।
লস্ট সিটির একটি একটিভ চিমনীর ছবি
সাগরতলের ভূপ্রকৃতিও কম বৈচিত্র্যপূর্ণ নয়।
আটলান্টিক সাগরেরতলে ২৩০০ ফুট গভীরে ভূতাত্ত্বিক ডেবি কেলি এবং তাঁর সহযোগীরা এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখেন। তারা দেখেছিলেন, একটা সাদা চিমনি থেকে উত্তপ্ত জল নির্গত হচ্ছে। এর চারপাশে রয়েছে লাল পাথরের অরণ্য। একেকটি পাথর প্রায় ২০০ ফুট দীর্ঘ। এই অঞ্চলটির নাম তারা দিয়েছিলেন লস্ট সিটি বা হারানো শহর।
এটা যেন রূপকথার রাজত্ব যা সাগরতলে সৌন্দর্য বিলিয়ে মুগ্ধ করে যাচ্ছে সাগরে বেড়ে ওঠা প্রাণীদেরকে! ওই সাদা চিমনী থেকে যে উত্তপ্ত জল নির্গত হয় তার সাথে অন্যান্য পদার্থের রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে এই নানা আকৃতির সৌধমালা গড়ে উঠেছে। গুহার ভিতরে থাকা স্ট্যালামগাইটের মতই আকৃতি এগুলোর।
এই লস্ট সিটির কাছাকাছি রয়েছে মধ্য-মহাসাগরীয় প্রাচীর। এখানে আগ্নেয়গিরি রয়েছে। আগ্নেয়গিরিগুলো জীবন্ত।
প্রায়ই জলন্ত লাভা নির্গত হয় এগুলো হতে। সাগরের পানির সংস্পর্শে এসে লাভা অদ্ভুত আকার ধারণ করে। এ অঞ্চলে থাকে সালফাইডের চিমনীগুলো থেকে ৪০৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রার উষ্ণ জল নির্গত হয়। মধ্য-আটলান্টিক প্রাচীর থেকে নয় মাইল দূরে এই লস্ট সিটির অবস্থান। ১.৫ মিলিয়ন বছর আগের পাথরে গড়া লস্ট সিটির পরিবেশ আদিম পৃথিবীর পরিবেশের অনুরুপ।
ব্যাকটেরিয়া এবং আরও কিছু অণুজীব এই লস্ট সিটির বাসিন্দা। অণুজীব ছারাও কিছু কিছু রেকফিশ লস্ট সিটির পাথুরে স্তম্ভগুলোর মাঝে ঘুরে বেড়ায়।
কার্বোনেট চিমনীর মাঝে রেক ফিশগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে।
লস্ট সিটির কিছু কিছু সৌধ তিন/চার তলা ভবনের সমান উঁচু। আকৃতিতে অনেকগুলো দেখতে প্রায় গির্জার মতন।
মনে হয় যেন আটলান্টিসের হারানো নগরী অথবা কিং সলোমনের দুবে যাওয়া নগরীর সৌধমালা এগুলো।
মিড আটলান্টিক প্রাচীরের কাছে কিছু কিছু পাথরে বিজ্ঞানীরা অদ্ভুত নিদর্শন পেয়েছেন। পাথরের উপর অসংখ্য ছোট ছোট হেক্সাগোনাল বা ষড়ভুজ খোদাই করা রয়েছে। অনেকটা মৌচাকের ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠের মত এর আকৃতি। জার্মান প্যালিয়েনটোলজিস্ট ডলফ সেলইশার মনে করেন এগুলো ৬০ মিলিয়ন বছর আগের প্যালিও ডিকটাইয়ান নোডোসাম এর ফসিল।
কেঁচোর মত এই জীব আজ থেকে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে বাস করত। এরাই ওইসব পাথরের বুকে বাসা বেঁধে থাকত। এদের বাসা বাঁধার ফলেই পাথরের বুকে অমন হেক্সাগোনাল ছোট ছোট গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।
হ্যান্স ক্রিসচিয়ান অ্যান্ডারসনের বিখ্যাত রূপকথা লিটল মারমেইড। সাগরতলের বুড়ি ডাইনীর বাগানের বর্ণনা আছে সে রূপকথায়।
সব মৃত পাথর আর মৃত জীব দিয়ে সেই বাগান সাজিয়েছিল বুড়ি। সাগরতলের নিকষ অন্ধকার রাজত্ব দেখে হঠাৎ করে কল্পনায় এসে যায় সেই বুড়ি ডাইনীর বাগানের কথা! তবে এখানে জীবন্ত জীব আছে, আছে তাদের অদ্ভুত জগত।
মহাকাশের রহস্যভেদ করার পাশাপাশি বিজ্ঞানীরা সাগরতলের এসব রহস্যকেও জয় করবেন এই প্রত্যাশা রইলো…..
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।