লীলাক্ষেত্রের গদ্য
১। মহারাজ্ঞী রাজহংসী। আপনি তরল থেকে তরল আলাদা করেন। আপনাকে সেলাম। শৈশবে ভেঙ্গুলের বাসা ভীষণ ভয় পেতাম।
বহু কোষ-কামরায় কী অপূর্ব সোন্দর এই বাসা। মৌ ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে, ভেংগুল বিষ। মাঝে মাঝে সুরেলা বাঁশী বিষের বাঁশি হয়। ফিরিঙ্গিদের তাড়াতে গিয়ে তা-ই হয়েছিলো। বিষ লাগে মাঝে মাঝে এই জীবন।
তখন আমি তরলে তরল মিশাই। বিষ খাই মধু দিয়ে।
২। বাঙালির প্রেমাবেগের কিছু নমুনা রবীন্দ্র-নজরুলে আছে। ষাট দশক মধ্যবিত্ত বাঙালির প্রেমভাব পরিগঠনের কাল।
সে-ই সময় প্রেমের গান তৈরি হলো হাজার হাজার। বাঙালির নিজস্ব যৈবন-জীবনে কামরস এর আগের দশকগুলোতে শুকনা। মরা গাঙে বাঙালি মধ্যবিত্ত এক ধরনের রোমান্টিক ধারা বহাইতে চাইল। অতীতের কালা, কাম, ভোমরা ও নিশিরাইতের সকল উজাড় করা রিক্তের বেদন, কালার বাঁশির সুর শহুরে বাঙালিরা ভুলে গেলো। এক ধরনের রোমান্টিসিজম তৈরি হতে লাগল।
সমাজে কিন্তু এই রোমান্টিসিজম নানাভাবে পত্র-প্রণয়, ঠার আর ইশারায় একটা আকার লাভ করা শুরু করলো।
৩। যে জাতি লীলা বোঝে না, সে প্রেম বুঝবে কী করে! লীলা মানে দেহে দেহে কছলাকছলি, কুস্তাকুস্তি, ডলা ডলি নয়। লীলা মানে যৌনতার জন্য কাঊকে রাজী করানো নয়, প্রেমের প্রাথমিক কাল পর্ব ও নয়। লীলা মানে লিপ্ততা, একেবারে একসুরে, তণুতপুস্যায় পরষ্পরের আস্বাদনে অন্তর্লীন।
নিজের কোন সোয়াদ নাই, আত্নাস্বাদনের আর কোন স্বমেহন পথ নাই। এই একত্রীভবন দেহের মিলনে হতেই হবে এমন কোনো কথা নাই। হলেও দোষের কিছু নাই। আমি লীলাবতীর সাথে অথবা লীলাবালির সাথে প্রেম করি। আমার প্রেমিকারা একে অপরের মধ্য লুকাই, লুকোচুরি খেলি।
লীলা মানে সময় বা কাল। বিরহ মানে কাল।
৪। ভেতর-বাহির এক করার স্বভাব আমাদের নাই। লীলাক্ষত্রে পদার্পণ করার সাথে একের মধ্যে অপর প্রস্তাবিত হয়।
আপনি আপনার প্রেমিকাকে বা প্রেমিককে আপনার অস্তিত্বের জগতের অংশ করে তোলেন। প্রতি অঙ্গ কান্না শুরু করবে প্রতি অঙ্গের লাগিয়া। এটা বঙ্গের বৈষ্ণব ধারা নয়। অঙ্গ এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়। অঙ্গে অঙ্গে অগ্নিউৎপাদক, উত্তাপ উনুনে যে বিগলিত দশা তার জন্য যা যা কবুল করতে হয় তার আদ্যপান্ত জানার যে রসতত্ত্ব তা বোঝার পাঠশালার নাম লীলাক্ষেত্র।
৫। লীলাক্ষেত্রে আপনি যখন চাষবাস করবেন তখন দেহের লাঙ্গল নিয়া হাজির হবেন না। মৃত্তিকার কোমলতার উপর খড়গহস্ত হবেন না। কয় চাষ দেবেন। লীলাক্ষেত্রে হাজার চাষ।
সহস্ত্র চাষ। আপনাকে ভালো চাষী, কিষাণী হতে হবে। চাষের কারুকাজে পুষ্পপ্রস্তাবিত এই সময় নির্মাণ আমাদের প্রণয়কে করবে প্রাণাধিক। প্রণয় যখন প্রাণাধিক সত্য ভাবে আপনার মধ্যে অধিষ্ঠিত, আপনি তখন সম্প্রদানময় হয়ে ওঠেন। আমি ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে, দোলনে –হিন্দোলে একটা অদ্ভূত পাগল পাগল ভাবে অনন্ত দশায় পতিত হোন, আত্মহারা।
মূলে-কান্ডে, ঝাড়ে –বংশে নিবেদনময় এই লীলা।
৬। নিজের দেহের ডাক নিজে শুনতে পান। এই ডাক এতোই সূক্ষ্ম সুখকর ও নাদময় যে আপনি চঞ্চলা ও বৈতাল হয়ে ওঠেন। এই ডাক হংসধ্বনি রাগের মতো।
এই অশ্রুতপূর্ব ধ্বনি সঙ্গীতময় হয়ে আপনার শরীরে ছড়িয়ে যায়। এটা খুবই বিশুদ্ধ ধ্বনি, দেহের ডাক। এই ডাক ধ্বনিবিজ্ঞানের কোনো সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। আমি বহুবার এই ডাক শুনে এক অসামান্য কল্পনার জগত তৈরি করেছি। আমার জগতে হাজার হাজার এ্যান্টি-ম্যাটার ম্যাটিরিয়্যাল ফ্যান্টাসি আমি তৈরি করেছি।
আমার কল্পনার জগতে এলেই আমি ও অন্যরা সব দহনস্নিগ্ধ হই, পুড়ে ছাই হয়ে যাই। ভেতরে ভেতরে আমি যতোই গুনাহগার হয়ে পড়ি, আমার দেহ স্নেহস্নিগ্ধ হয়ে ওঠে। আমি রূপসী ও রূপবান হয়ে উঠি। এটা কোন ফ্রয়েডিয়ান লিবিডো নয়, এটা লীলার জন্য দেহের প্রস্ততি। এই প্রাথমিক কালপর্বে, বালেগ-পরবে যা কিছু দেহের কারখানায় তৈরি হয়, তা লজ্জা-লাজুক হয়ে কল্পনার কালিমা সব মুছে দিয়ে শিশিরের মত সন্তর্পণে ঝর্ণা হয়।
আমি সে-ই অচেনা নদীর জলে সিনানস্নিগ্ধ ও পাকপবিত্র হয়ে উঠি।
৭। এই প্রস্রবনমুখর সময়ে আমি বিকশিত সরোজিনী। আমি প্রস্ফুটন উন্মুখ। আমি সংকল্পে অটল, নিটোল জলে আমি কমলের কমলিনী হবো।
আমার কিসসা ছড়িয়ে পড়ুক চারদিকে, আমি কাহিনী হবো। আমার খৎনার সময় যেমন সবাই ওস্তাগিরের সামনে খিল খিল করে হেসেছিলো, এইবার ওরা সব দুঃখ পাক। আমার অনাবিষ্কৃত নিরল ঝরণায় আমি লোকচক্ষুর অন্তরালে পাক গোসল সেরে নেই। আমি প্রভাতের স্বপ্ন-বিভোর নহে নারী, নহ পুরুষ। আমি লিঙ্গ নিরপেক্ষ স্বমেহন।
তণুতন্ত্র জেগে উঠে। রসের ঢেউয়ে আমি নির্বোরোধ সতী হয়ে থাকি। কারণ, সমাজ আছে। সমাজ বহুকোষী। আমি তার এক কোষে থাকি।
আমাকেই আমি আস্বাদন করি। রতির কাছে রুজু থাকি। রঙ্গ ও লীলার নটরাজ হয়ে উঠি। চারদিকে সম্পর্কের ছড়াছড়ি। সব প্রাকৃতিক ও চিরায়ত সম্পর্ক ।
লীলা কার সাথে হবে, রঙ্গ কার সাথে হবে! কিন্তু মস্তিষ্ক স্বাধীন। সেখানে কারো প্রবেশাধিকার নাই। সেখানে অন্য এক লজিকবিদ্যা কাজ করে। সেখানে এসারের জ্যামিতিক শিল্প। সেখানে আমি আমার কমলপদ্মে আপনার আত্মনিবেদন গ্রহণ করি।
আমি আপনাদের অন্দরে ঢুকে যাই। ব্যক্তিগত স্পেসের যে ইউরো-কেন্দ্রিক ব্যাখ্যা তা থেকে আমি বেরিয়ে আসি। আপনার ‘ব্যক্তিগত অস্তিত্বের’ মধ্যে স্তরীভূত সীমারেখা আমি কল্পনার ক্ষমতা দিয়ে উলটে ফেলি, টপকে যাই, প্রত্যক্ষণের পরিধি ক্রমাগত বাড়তে থাকে, নাইট গ্যাগোলস এর আলো ধরার মতো, আপনি টের পান না যে অমাবস্যায় আলো থাকে।
৮। আমি অমাবস্যা ও চাঁদনীর অপেক্ষায়, ইন্তেজার।
মিলনমিত্রকলি ফোটাব, তার জন্য ইন্তেজার। প্রসূনধাত্রীবিদ্যা শিখবো, তার জন্য ইন্তেজার। আমি দস্তুরমতো আপনার জন্য অনন্তকাল ইন্তেজার, ও আমার প্রাণসখা। প্রেমের সর্বোচ্চ বিকশিত স্তরে প্রাণসখা ও সখী তৈরি হয়। এতো প্রাণ, প্রকৃতি ও সাংখ্য পুরুষ একসাথে আড্ডা দেয়।
৯। এই প্রণয় ইশতেহারে আমি প্রাণ, প্রকৃতি ও পুরুষের কথা বলছি। এই পুরুষ স্বামী নয়। সাম্যের প্রবর্তক জগতস্বামীর ওস্তাদ। যে নূহ নবী প্রাণরক্ষা আন্দোলন করেছিলেন, জোড়ায় জোড়ায় সব প্রাণ তার নৌকায় ঠাঁই দিয়েছিলেন সে-ই নূহের কসম আমি ইশক, মহব্বত ও দয়ার সাগরে একবার হলেও ডুবে মরতে চাই।
আমি পুরুষ নই, আমি পরম ও পুরুষের সম্পর্ক বোঝার জন্য ইসকুলের লাস্ট বেঞ্চের ছাত্র। আমার পুরুষের ব্যাখ্যা একবার দিয়া লই।
১০। আমার পুরুষ আমি চিনি না। দেখি নাই।
আমি দিশাহারা আপনার জন্য, আমার লীলার অপর, আপনের জন্য। আমার অধরাকে আমি ধরবার জন্য তার পিছু পিছু দৌড়াই। সে প্লাবনে ভেসে ভেসে আসে। অধরা। যাকে ধরা যায় না।
দৃশ্যমান বস্তুজগত আমাদের চোখে ঠুলি পরিয়ে দেয়। চোখ দিয়ে দেখতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠি। চোখের বাইরে যা কিছু তার ব্যাপারেও আমাদের ঈমান আছে। তা না হলে খোদা মানত না কেউ। কোন অথরিটি বলছে, কীভাবে বলছে, তার উপর নির্ভর করছে বিশ্বাস করা না করার ব্যাপারটি।
বিশাল মেদিনীমন্ডল ও গ্রহে –নক্ষত্রে দেদীপ্যমান এই মাখলুকাত বা আলমমন্ডলের বেশিরভাগ বস্তুই গোচরীভূত বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। ইন্দিয়গ্রাহ্যতাই শেষ বিচারে সবকিছুর শেষ কিংবা শুরু নয়। তবে ইন্দ্রিয়ের আধার যে জীবে, সে-ই জীবদশা ও জীবদ্দশার মধ্যে ঠাঁই না নিয়ে কোন উপায় নাই। তার মানে যা কিছু অধরা,তার আলোচনার আগে আলমন্ডল আমাকে টানছে। এই অধরাকে ‘দরবেশি’ কায়দায় কোন কেরামতি দিয়া ধরা যবে না।
অধরার আমল আধ্যাত্মবাদী কোন ব্যাপার নয়। অধরা আসমানে নাই। এটা গায়েবি কোন ব্যাপার না।
এর আগে একটু অন্য প্রসংগর জের টেনে রাখি। দুইটা দিক।
একটা হোল, একটা বিষয়কে আপনি কীভাবে বয়ান করবেন, বোঝানোর জন্য, চেনানোর জন্য; অন্য দিকটা হল, মানুষটা আসলে কী; যেমন, আমাকে বললেন যে, আমি বাঙালি। বর্ণণায় ঠিক আছে। কিন্তু এই বলে যদি আমার ব্যাপারে এটা ঠাহর না করেন যে, আমি বাংলা ভাষায় যা কিছু ভাব, চিন্তা, দর্শন আমার প্রকাশস্বরুপ আপনাদের কাছে পেশ হয়, তাতে আমি বাঙালী হয়ে থাকতে চাই না, বাঙালীর সংকীর্ণ, রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠার মানেগুলোকে ভেঙ্গে চুরমার করে আমি যে আপনাদের ভূ-খন্ডের হয়ে থাকতে চাই না, আপনাদের ঐতিহ্যের স্মারক করে আমাকএ যে অপমান করছেন, সে-ই দিকে খেয়াল করতেও বলি। লালন সাঁইজি কালাম দিয়েছেন [তিনি রচনা করেন নাই],
আলম নানা প্রকারের। আমার আগ্রহের জায়গা হল, ইলমের আলম ও হুকুমের আলম।
এই হুকুমের আলম মানে প্রকৃতির মধ্য প্রতিনিয়ত স্ব-গুণে,নিজের অস্তিত্বের স্বভাবে যা বিধান আকারে মানুষ অবশ্য পালনীয় আকারে মানুষ ও জীবের জন্য বিধান। এই বিধান পালনে নড়চড় হলে, গাফিলতি বিপদের অন্য কারণ হতে পারে। ল’ ইন কালেকশন – যা ইচ্ছা নিরপেক্ষভাবে পরম [পুরুষ] তার সাথে আমার ইলমের আলম ও হুকুমের আলম জগতের অগুণতি অস্তিত্বের প্রাণসখা হয়। হুকুমের আলম মানে আপনাকে অন্য কোন অস্তিত্ব হুকুম দিচ্ছে না। এটা প্রাকৃতিক বিধানের সমষ্টি।
এই বিধানকে সূত্রবদ্ধ করতে পারলে তখন বিজ্ঞান নামক যা কিছু কায়েম হয় তা এই বিধানকে আত্মস্থ করার একটি প্রক্রিয়া মাত্র। এই অধরা ভাবে দাখিল হয়, প্রস্তাবিত হয়।
সাংখ্য ভাবলোকের পুরুষ ও প্রকৃতি আলাদা। এই দর্শন মতে পুরুষের বৈশিষ্ট্যঃ (বলে রাখা ভালো,পুরুষের সহস্ত্র সংজ্ঞা আছে)
• পুরুষ মানে “অস্তিত্বময় কিন্তু দেখা যায় না” এমন সত্তা, যা অনন্তকাল ধরে, চিরকালই [ সময়ের আগ থেকে, কিন্তু প্রাণ নাই তো পুরুষ নাই] প্রকৃতির বাইরে। পুরুষ মানে রুহানী, [বিশুদ্ধ চৈতন্যের নূরখন্ড,সত্তায় সংগুপ্ত,আকিদা], যা ‘প্রকৃতি’ থেকে আলাদা।
এর কোন নাম নাই, ভাবের হাটে চট করে চিনে ফেলার মত কোন বৈশিষ্ট্য বা বস্তু [গুণ] নাই। এটা সূক্ষ্ম, মোহনমিহি,নিরাকার ও সামান্য, বিরাজ করে সর্বত্র। বুদ্ধি, মন কিংবা ইন্দিয়ের ধরাছোঁইয়ার বাইরে। সময়, দেশকালপাত্র এবং ঘটনা, রূপান্তর, উৎক্রমণ ও উত্তরণ নিরপেক্ষ। [ প্রস্বেদনে শুধু তার আস্বাদন, সে কাঁচা বাঁশের খাচা ছেড়ে যায়, সে আমার নিয়ত সাথী, তবু তার সাথে দেখা হয় না]
• পুরুষ আছে সর্বত্র, প্রাণস্বরুপে, যাকে আমরা আত্মা বলি।
কাল, ঘটনমান বর্তমান, অতীত কিংবা অন্যভাবে বলা যায় প্রাণ ও প্রকৃতি নিরপেক্ষ। এটা নিঁখুত, কোন খুঁত নাই, পরম।
• সবচে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, তার কোন সক্রিয়তা নাই, নির্বিকার,কোন ঘটনার কারণ নয়, কোন ঘটনা ঘটায় না। কিন্তু সাক্ষী আবার সবকিছুর। এই পুরুষ মৌলিক, কোন কিছুর সমাহার এর মধ্যে ঘটে না।
• সাংখ্য মতে পুরুষের নানা প্রকারভেদ আছে। হাজার হাজার অগুণতি পুরুষ আছে। অসীম সংখ্যক পুরুষ আছে। অমর। এক পুরুষ থাকলে, এক আত্মা উড়িয়া গেলে সকল আত্মার মুক্তি ঘটে যেত।
• আবার কইতাছে সাংখ্যওয়ালারা (বৈদিক-বেদান্তবাদিরা)যে, সব আত্মাই নাকি আদতে প্রায় এক রকম ( প্রকৃতির মধ্যে, আবার বলছে প্রকৃতির মাঝারে পুরুষ পরপুরুষ, প্রকৃতি থেকে আলাদা, আসলে তো প্রকৃতির বাইরে কিছু থাকে না, যেমন, আমরা বলি রুহানি জগত।
• সবচে খাস কথা হলো, পুরুষের যখন মুক্তি, ওনি কোথাও যান না, তার কাল-কলন্দর বা পরিব্রাজক হবার সুযোগ নাই। সে স্থানুবৎ নয়, আবার চলিষ্ণু নয়। বাইরের দিক দিয়ে দেখলে, এক আত্মা অন্য আত্মা থেকে পৃথক, একটার সাথে আরেকটার দেখাদেখি, মাখামাখি, মেলামেশা নাই। প্রত্যেক আত্মারই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে, ব্যক্তিত্ব আছে।
• যে স্বরূপে, যতোবার জন্মান্তর হউক না কেন, আত্মা অপরিবর্তিত থাকে। প্রকৃতি আন্ধা, সে কিছু দেখতে পায় না। তার দৃদৃক্ষা নাই। তার নিজের রুপ নিজে দেখে না। কিন্তু পুরুষ দেখে।
আলাদা আলাদা সৃষ্টির কাজ কারবারের সাক্ষি হেতাইন। সে সব দেখে। সর্বদ্রষ্টা। দেখে প্রকৃতির মধ্যে মিলে গিয়ে , মিশে গিয়ে, একীভুত হয়ে। প্রকৃতি তার নিজের ফ্যানোম্যানা তো দেখে না।
সাক্ষী হয় পুরুষ। আত্মা, বিরাজবিনয়ি, এই উদাসি পুরুষ আবার সত্তা, কর্তাসত্তার কাজের দর্শক। তিনি সাক্ষি, তিনি দ্রষ্টা বা নীরব দর্শক, তিনি মধ্যস্থতাকারী ( না তিনি তা নন, তিনি প্রকৃতির অন্তস্থ ও মধ্যস্থ, তিনি একা, নিরল-নীরব কৈবল্য, তিনি উদাসীন, নির্বিকার [ তা’হলে ইনাকে দিয়া কাম কী]
পুরুষ নামক এই যে মিঞাভাই, মনে হইতাছে, নির্গুণ, কারো সাতে পাঁচে নাই। মধ্যবিত্ত কবির মত কেবল ঘরে বসিয়া বিপ্লবের কবিতা লেখে আর র্যাইবের ভয়ে ক্রসফায়ার নিয়া একটাও কবিতা লেখনি দিয়া কালি ও কাগজে দাখিল হ্য় না এই সাংঘাতিক সাংখ্য পুরুষ ভাইজানের কোন লিংগ নাই। তবে ইনাকে না বুঝলে ভাবজগতে আপনি আন্ধার পিঠে ল্যাংড়া হইয়া পথ চলবেন।
কিন্তু এইবার সিরায়াস হই। পুরুষ অকর্তা। কিন্তু প্রকৃতি কর্তাগিরি করে, তবে সে জানে না যে ঘটন পটিয়সী। যে পাত্রে, আধারে (খুলির ভেতর ঘিলু, তার মধ্য হইতে স্নায়ুরজ্জু বাইয়া বাইয়া কোষে আর জিনে, হাড়ে আর মজ্জায় এই রহস্যময় বাসনা, কামনা, কল্পনা- সব ছাপিয়ে আবার সব কিছুকে ব্যাখ্যার ক্ষমতার নাম ‘জ্ঞান”) জ্ঞান থাকে, তা প্রকৃতি। হেতুতে মগজ স্বয়ং জ্যান বা জ্ঞান হয়ে যায় না।
অতএব, বুদ্ধি যদি বিছমিল্লায় না থাকে, বুদ্ধি মগজে প্রাকৃতিকভাবে উদ্ভূত নয়। তবে ইন্দ্রিয় ও এর অ্যান্টিনা একেবারে প্রাকৃতিক। আবার জ্ঞান না থাকলেও বুদ্ধি হতে পারে, যদি না একেবারে বুধ্য কেউ না হয়। দেহের চলন-বলন, নড়ন-চড়ন জ্ঞান না থাকলে চলবে। নিজের মধ্যে কর্তাশক্তির আবির্ভাব তো হবে না।
ক্ষমতাবান হয়ে উঠা, ক্ষমতা জন্ম দেয়ার জন্য তো সত্তা স্বয়ং “ পুরুষের’ উপস্থিতির গুণে নিয়ামক নিজ কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে। সে জন্য পুরুষ হলেন তিনি যিনি আমায় জ্ঞানের সূত্রে হাতে খড়ি দেন। কিন্তু তার সাথে আমার চিন-পরিচয় হয় না। কিন্তু লগে লগে আছে। আমি মিছিলে যাই, বুঝি আছে।
আমি যখন সামান্যকে সত্য করি, বুঝি আছেন। আমি যখন বিশেষ থেকে নির্বিশেষে যাই, বুঝি আছি। আমি যখন বলি, তিনিই পুরুষ, আর সব প্রকৃতি, বুঝি আমার মাঝার তার আনাগোনা। আমার জীব- জীবনের দশার ভেতর, আমার সত্তা অর্থাৎ আমার ধড়ের ভেতর, আমুন্ডনখাগ্রে, সন্ধানের, বুদ্ধির একেবারে আলাদা সূত্র নিয়ে আমার সংগে তার বিরাজ-দশা ঘটে আমার সাথে, আমির সাথে এক হয়ে। আমি তার এজেন্ট হয়ে যাই।
বেদে যার দেখা নাই- সেই জ্ঞান, চাষে-বাসে, ভাবে- বোধে, তত্ত্ব-তালাশে আমার কর্তাসত্তা তার এজেন্ট হয়ে যায়। আমার নিথর দেহ তার তরঙ্গে বস্তু চিনে নতুন রঙে। প্রাণ প্রকৃতির সাথে আমার লীলাখেলা হয়। আমার দেহপটে ফটিক স্বচ্ছ জলে আমি নিজে সাঁতার কাটি আসি। আবার তারই লীলায় তারই খেলায় একই জলে গরম সিনান হয়।
তাই বুদ্ধি এবং বোধের আধার দেহের ভেতর তাহার উপস্থিতি বা গদিনশীন হলে, ঐক্য আমায় প্রশ্নকত্তা করে, আমি সবকিছুকে প্রশ্ন করি বুঝে নেবার জন্য। আমি নিথর দেহের তরংগ হন তিনি। সহজ হয়ে সবকিছু জাগ্রত হয়। তিনি সূর্য হয়ে আসেন যেন জলের জন্য, তিনি আগুন হয়ে যান চলে যান কামারশালার লোহা ধন্য। তিনি গুণকে করেন নিজের গুণে গুণান্বিত।
মিলনে লৌহ ও আগুন পরষ্পরের মধ্যে গুণের আদান-প্রদান করেন। বিরাজমান পুরুষ, না ডাকলেও আছেন যিনি, আসেন যিনি তা-ই করেন। যেই মাত্র আমার দেহে, আমার ভেতর ( সত্তা) মিলন ঘটে তার, এই মিলনের কারণ কিংবা ফল, আমি ক্ষমতাদানের কর্তা হয়ে উঠি। সকল আলম মন্ডলে আমার বিচরণ শুরু হয়। আমি সকল দিব্য-দহন শুষে শুষে দহনস্নিগ্ধ হই, আমি সকল নেয়ামতের ভাগিদার হই।
পরলোকের অধিষ্ঠান হয় আপন লোকে। প্রকৃতিকে দেখভাল করার জন্য তিনি জীবের মধ্যে হাজির হয়ে প্রাণ প্রকৃতির রাজনীতি শেখান আমাদের। পুরুষ আবার সাক্ষি-কর্তা। তাই এই শরীর, মন, ইন্দ্রিয় অনুভবে- আস্বাদনের খায়েশ যদি কর্তার তৈরি হয় পুরুষ লাগবে।
১১।
এইসব আত্মরতিমগ্ন ক্ষণে অন্যত্র প্রস্তাবিত হই, অন্য দৃশ্যপটের অংশীদার হয়ে উঠি। মাঠে নবীন ঘাস। বসন্তে এই সব তৃণশিশু প্রসব করে মাঠ। বিরান বিস্তারিত এই মাঠের বুক চিরে আছে অনেক কোণাকুনি পথ। জীবনের জম্পেশ প্রকাশ।
এখন ভর-কালিঞ্জা। পরম শ্রদ্ধেয় হাসা-হাসি ডগমগ করে খোয়াড়মুখি। হংসই পারে সব জল এক ঝটকায় ঝেড়ে ফেলতে।
মাঠের দিকে তাকালাম। নিরলে শিশির ঝরে।
এখন সবারই, আঁধার ও আলোর বাসিন্দাদের, যার যার আবাসে, কিংবা খাবার সংগ্রহে অথবা নিশিতে চরে বেড়াতে, বেশ তাড়া। যখন চরে বেড়াতে চরণ চলে, তখন কোন বাধা কেউ মানে না। জগতে খাদ্য সম্পর্কের বাইরে কেবল একটি কারণেই অপরাপর প্রাণির সাথে মরণের সম্পর্ক স্থাপিত হয়, অন্যের ভুবনে প্রবেশ করা, আক্রমণ করা কিংবা আতকা মুখোমুখি হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে চেনা-অচেনার ভয়তরাস। এই সময় ফিরে এসো, ঘরে।
জলের লাল শাপলা এই সময়টায় বেশ ডগমগ হয়।
শিশির সন্তর্পণে সেখানেও ঝরেছে খানিকটা। জলও শান্ত, অনেক জলজ।
লাল-বকসাদা শাপলা। ফুটে আছে। প্রকাশিত।
হাওয়ায় কিছুটা হিন্দোলিত। আমি তাকিয়ে আছি। আমার দৃষ্টি চোখাচোখিময়। আমাকেও এই সুন্দর দেখে। আপনি এতো সোন্দর।
আমি আর আপনি কালা ভোমর-ভোমরা হয়ে কালা ও রাধার জন্য পরিভ্রমণ পরিশ্রান্ত। আজ সকল প্রকার রিজন গেছে এন্তেকালে। সকল জ্যোতি নির্বাপিত। কুপি বাতিও নিভে গেছে। তবে বেণা আছে।
অগ্নি-আকর। আমার শরীরে এখন দহন-দশা। আসুন নিরালায় নিভৃতনের গুনগুন হয়ে উঠি এই ভ্রমরবিজনক্ষণে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।