আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লীলাক্ষেত্রের গদ্য: আমি ভূজঙ্গীর সাথে মিলনে উতালা



পিংকুর জন্য দ্বীতিয় কিস্তি লীলাক্ষেত্রের গদ্য ১২। আমার মাটি ছাড়া তোমার দুর্গা পুঁজা হয় না। আমি বেশ্যা। আমার কবরখোলা আলাদা। সমস্ত ভীতিকর সত্য উচ্চারণ তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ।

সারা সন্ধ্যা দশ খদ্দের, দশ নাগর, ‘বসাতে’ পারলে আমার পেটের ভাত হয়। পেট লাগানোর নাগর আলাদা কিসিমের। আমার জীবনে কোন লীলা নাই। আমি অসম্ভব সুন্দর। আমার খদ্দেররা আমাকে নিয়ে ফ্যান্টাসি করে।

আমার উদাম উলংগ নাগরের রুপ আমি দেখি। কী মজবুত পেশী। আরশি দিয়ে আরশ দেখি, বিম্বিত হ্য় আমারই মুখ তার ভেতরে। আমি নেত্রকোণে কাজল দিয়ে নিদ্রারিক্ত রাতের চিহ্ন মুছি। দহন বড়ো, জ্বালা বড়ো, আমায় ধরে জীবজীবনের অসুখ।

। তুমি আমার ঘোমটা সরাও নববধূর মতো। আমি তোমার লতার মতো নেতিয়ে থাকা চিহ্ন ধরে আদর-আদ্র কন্ঠ দিয়ে তোমার ভেতর প্রবেশ করি। ১৩। মানুষ তার খোদ্গুণে কিছু নয়, প্রাণ মাত্র।

বাকী সব গুণ মানুষ হয়ে উঠার আত্মস্থকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়। কিন্ত মানুষের মধ্যে নিহিত প্রাকৃতিক গুণ এমনই যে আত্মস্থকরণ কেবল তার পক্ষেই সম্ভব। কাব্য সেই প্রাকৃতিক নিহিত সম্ভাবনা যা মানুষের লিরিক্যাল নিসর্গ দশা। এই ‘দশা’ থেকে ভাবে উৎক্রমণ হবে ক’জনার মধ্যে তা কিন্তু প্রাকৃতিক নির্বাচন, এক অর্থে। একটা ফ্যান্টাসি বার বার ফিরে আসে।

প্রতিটি অঙ্গের আলাদা আলাদা শোভা আছে। সে-ই শোভা অনঘ, অঙ্গ বিন্যাস। প্রতি অঙ্গের বহ্নিদশা। আমার ভেতর এই ভাববহ্নিদশা কিশোরকালে হয়েছিলো। ১৪।

বাঙালি দেহের সুষমা ভাবে লয়। যখন আপন-যুগলে প্রলেতারিয়েতের মতো ভীষণ খাটছেন তখন দেহ থাকে ভাবে। অঙ্গের বিভূতি ছত্রখান জ্যামিতি। আপনার ফ্যান্টাসির জগতে এই রতিলিপ্ত দেহ নাও থাকতে পারে। তখন অন্য দেহ, অন্যের চোখ ঠারে ডাকে।

তখন একে লীন, অন্যে বিলীন দশা। তখন পুরুষ আসেন। সাক্ষী হয়ে থাকেন তিনি। দেহমঞ্জুষার এই অপরুপ অপরাপর সকল দেহ- আত্মস্থকরণ প্রক্রিয়ার যে অসামান্য ফ্যান্টাসি ম্যাটিরিয়াল তার প্রতি বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে আনন্দধামে স্থানু হওয়া ছাড়া উপায় নাই। কবি তা করবেন না।

কবি তার কল্পনাকে তার মগজ থেকে আলাদা করে চোখের সামনে রাখে। তখনই কবির স্নায়ুরজ্জু ধরে আনন্দ নিকেতনের দিকে তার রতিকাম কমলিনী নামতে নামতে দিগবিদিক শূন্য হাহাকার অঙ্গ- অঙ্গনে। সেইখানে সবকিছু একসাথে ফুটে। বাগান শোভিত হয়। পরাগে ও গর্ভধানে কমলার সুবাস।

অর্ধ –প্রস্ফুটিত সব কিছু পূর্ণবিকাশ অধীর। তখন সকল পদ্ম কমলিনী রাই। আমি অচেনা নদীর জলে শরীর জুড়াই। ১৫। আমি ছোটাছুটি শুরু করি।

ক্ষেত্রফলে। ভাগ দিলে ক্ষেত্রফলে, দিন যাবে বিফলে। লতিফার গুণে আমার সারা দেহে গুঞ্জন ওঠে। লতিফা, সূক্ষ্মবোধের সারস্বত ধারা, অঙ্গে ভেদে নয় ইন্দ্রিয়, নিদানে নিষ্পত্তি সকল। আমার লতিফা আমার স্নায়ুরজ্জু ধরে বেয়ে বেয়ে উঠছে।

দিওনা গো দেহভাগ, পস্তাবে পরমাদ। আকাশ অহল্যার দীঘি, আর বৃষ্টির জন্ম হবে না মেঘার ঘরে। আমার লতিফায়, আমার সূক্ষ্ম কলবের, হৃদপিন্ডের মধ্যে আমি গুঞ্জরিয়া উঠি। কতো কত কেন্দ্রে আমার ভাবমন্ডল ঘোরে। আমার চক্রধাম আর লতিফার কক্ষপথে তুমি আসো অপরূপা স্বর্গচ্যূত এই ক্ষণে।

আমার মূলাধার চক্রে লহুময় লালে লাল দুনিয়া। পদ্মাপ্রখর, তেজে, ফিনকি দিয়ে খুন হয়ে যাই। আমলে লাহুতের এই ধ্বনি কাব্য হয় তোমার কাছে। এই মোহন চক্রমূলের যা যা কেন্দ্র আছে, তার তালাশ করি। তত্ত্ব –তালাশ শেষ হলে সানাই বাজাই।

তুমি আমার ছয় লতিফার যেখানেই বসো, আমি তোমার অতিক্রান্ত শৈশবের শব্দের প্রতিধ্বনি দিয়ে অভিবাদন জানাই। তোমার ভেতর ভেতর পড়ে আছি, আমায় ফেরত দাও। কালকুসুমের বাগানখানা, সঙ্গে শোভাও। আমার শীতকাতর শরীরে আমার প্রেম ও দেহের মধ্যে আর কোন ভেদরেখা নাই। আমি এক অনন্তদশায় নিপতিত।

১৬। আপনার ঘরে গেলাম। কোন বারবণিতা আপনাকে তার কক্ষে নেয় না, ঘরে নেয়। তার এক কক্ষই তার ঘর। ঘর এখানে একটি দার্শনিক প্রত্যয়, একটা ক্যাটাগরি।

তার লীলাক্ষেত্রের নিজস্ব ধারা, স্কুল আব থট। এই ঘরে বসত করা যায় না। ক্ষণকাল হিতাহিতজ্ঞানশূণ্য এক অনন্ত দশায় পড়া যায়। এই ঘরে প্রবেশাধিকার কেবল তারই আছে যার জীবনের উপর যে সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। না হলে সে শুধু সাধারণ রতিক্রিয়া দ্রুত সেরে প্যাডেল মারতে, চাকা ঘোরাতে, ভার বইতে বেড়িয়ে পড়বে।

ঘর ও কামঘরাণার এই আলোচনা আমার মধ্যে একটি অদৃষ্টপূর্ব দার্শনিক পরিমন্ডল তৈরি করে। এই পরিমন্ডলে আমরা যারা পদ্য বালক-বালিকা, হাওয়া ধরতে যাই ছুটে। বাবুই পাখির বাসার জন্য আমরা হাওয়ায় উড়ে উড়ে তাল গাছের মাথায় যাই। দেখি, বাসা নাই। চড়ুই নাই।

ওদিকে কালস্রোতে হাওয়া বয়ে যায়। বালিকা কূটকূট করে হাসে। বলে, তোরা হাওয়া ধরবি! কী করে ধরবি! হাওয়া তো গরম হয়ে দূরে চলে গেছে। তখন আমরা উষ্ণ প্রস্বেদনে কামারশালার ফোঁসফোঁস। আগুন ও বায়ুর খেলাধূলা।

আমার সব পুড়ে যাচ্ছে। আমি মোনার্ক প্রজাপতির জ্ঞাতি-বংশ হয়ে যাই। এই অপ্রাপ্তয়স্ক সন্ধ্যায় এক অবিনাশী সঙ্গীত আমার মধ্যে গুনগুনায়। প্রস্বেদনের আস্বাদনে আমরা ওষ্টতুষ্ট করে এক চুমকুড়ি বাজাই। সবাই জেগে ওঠে।

নেচে-কুদে, প্রমোদ-পরমাদে, রসে লীলায় আমরা নাদ করি। আমরা ছোবলে-ছোবলে বিষ নামাই। চোঙ্গলে চোঙ্গলে, জঙ্গের জঙ্গমে জম্পেশ শিৎকার চিক্কুরে ভুলে যাই সব, হয়ে যাই দ্বৈত-অদ্বৈত। প্রাণপ্রাঙ্গনে ফুল ফুটেছে। এক সমুদ্র তিয়াস।

জলধিনিমগ্ন হবো। রসতত্ত্ব রজোবীজে,জলে-কাদায় মাখামাখি। ১৭। কবিতারই কেবল বাণী বিকাশ ও পুনরুৎপাদনের ক্ষমতা আছে। তা-ই কবিকে শাসক শ্রেনী ভয় পায়।

কবিকে দিয়ে রাজনামা, রাজস্ততি লেখাতে পারলে জনমানসে দীর্ঘজীবি হওয়া যায়। কাব্য স্মৃতির স্বরলিপি। আমরা শরাবে সিক্ত করি আমাদের গোলাপি মগজ। আজ কবি তার গোলাপী মগজে বারবণিতার জীবগাঁথা তৈরি করছে। শাসক শ্রেণির নয়।

কবি সকল প্রচলিত বিধান ভেঙ্গে চুরমার, খান খান করে দেয়। কবি তাদের কাছে , তণুসঁপাসই [তণুমনবিপনন কেন্দ্র) দের কাছে নিশিথে নিরলে আদব-কায়দা শিখছে। মনোরঞ্জনই সত্যিকারের এটিকেট। কবিতা একটা জীবন্ত ব্যাপারে। শরীরের বাইরে ভাব অন্য কোথাও নাই।

ভাব আর সব নাজেল হওয়া সব ভাব, সবই এই প্রাণপ্রাঙ্গনে ফোটে। বস্তজগতে এমন কিছু নাই, যা কবিতার সাথে আমার সম্পর্ক কলংকিত করতে পারে। বিরস-কালের রসাস্বদনে বেঘোর হয়ে যাই। কবিতার সাথে প্রণয়মূলক এই আখ্যান, মহাবয়ানের জন্য যে তণুতান্ত্রিক প্রস্ততি দরকার। সে-ই যে বৈতরণী, সই, নীরে ভাসে, আমি শুধু তরঙ্গ।

আমি ঊর্মিস্মৃতি। ঢেউয়ের স্মৃতি। অচিন গাঙের প্রাচীন মাঝির ভাব-ভাওয়াইয়া এখন আমার নাগর হয়ে ফিরে আমারই গাঙকূলে। বাংলার প্রাচীন বিরহ রীতি না জানলে প্রেম করা হবে দায়। শুধু খাঁচার আশে পাশে ঘুর ঘুর, পিঞ্জিরার প্রাণ দেখা থেকে যাবে বহুদূর।

আলিঙ্গন পর্ব শুরুর আগে নিগুম জেনে নিতে হবে। কবি দেহভেদে সুন্দর-এই কথা মানে না। দুই পা নাই, হাত লিকলিকে, পঙ্গু, বামুন, নাক নাই- সবাইকে সুন্দর মনে করে। প্রাণ ও স্পন্দনময় সবকিছুই সুন্দর। তা-ই কবি ভিখারিনির সাথে প্রেম করে।

কবি নিজের মরদের কাছে হেরে যায়। কবি লিংগ-নিরপেক্ষ এক জগতে খাবি খায়। আমার কাছে মানুষ প্রধান। যৌন উত্তেজনার সামাজিক ও সম্পর্কগত যে দিকগুলো রয়েছে, সেগুলো আমার মধ্যে খুব একটা কাজ করে না। দেহ এখানে প্রধান।

মুচি, মেথরদের (এরা মহৎ) ব্যাপারে বরং আমার আকর্ষণ বেশী। কবি লাল বোতামে জব্বর এক মাল পেয়ে যায়। কবি জম্পেশ সন্ধ্যায় অতিক্রান্ত শৈশবের শব্দের প্রতিধ্বনির মধ্যে হারিয়ে যান। তার অনন্ত দশা হয়। ১৮।

এই তণুতান্ত্রিক প্রস্ততির জন্য সঙ্গোপন সাধন প্রথম পাঠ। এটা সাধন পথ। এই পথে দেহের চক্রমন্ডল চেনা জরুর। সানুশম্পা মন্ডলে, জঙঘার নিরুদ্দেশ ক্ষেত্রের দিকে যাত্রার আগে বুনিবন্ধ, তার আগেও তড়িৎ তর্পণ, যাকে আপনারা মৈথুন বলেন। এই প্রক্রিয়ারও আগে অধিষ্ঠান ও জাগ্রতকরণ দরকার।

তখন স্পর্শেই মুক্তি। তারও আগে ছটফটানি পর্ব। ১৯। আজ সকল প্রকার রিজন গেছে এন্তেকালে। সকল জ্যোতি নির্বাপিত।

কুপি বাতি জ্বালিয়ে বসে আছি। হাওয়ার প্রাণ রসায়ন উদ্ঘাটন করি। আগুন-হাওয়ার পাঠে মনোনিবেশ করি। ২০। প্রজাপতির রক্ত আমার শরীরে।

আমি প্রজাপতি পঞ্জিকায় কাল রাখি। মোনার্ক প্রজাপতির সাথে আমি ফুলের রস খাই। বসন্তের যে দিন, দিন ও রাত সমান, আমি সে-ই দিন যাত্রা করবো। আমি মরণের আগে আমার আওলাদের জন্ম দিয়ে যাবো। আমার আওলাদ আমার চেয়ে বেশী বাঁচবে।

আমি কাল-কলন্দর। স্পর্শেই মুক্তি, স্মরণে ত্বরণ। আমি সাদা জামা লাল বোতাম ভালোবাসি। আমি আলী আলী বলে অলি হয়ে যাই। আমি ফুলের রস পান করি।

শরীরে জোয়ার আসে। আমি মোনার্ক প্রজাপতির মত। আমি ও আমার উত্তরসূরীরা একই পথে হাঁটি। কখন ফুটবে ফুল, আমি তার অপেক্ষায় থাকি। আমি কিছুই খাই না।

আমার অন্ত্রে ফোঁটা ফোঁটা এসিড, আমার বৃক্কের দশলক্ষ ন্যাফ্রন, ফুলের রসে রসে প্রাণরসায়নের এক অনন্য দিগন্তে আমি পরিব্রাজক। ফড়িং থেকে সকোরস্কি হেলিকপ্টার। ফড়িং পঞ্চাশ কিলোমিটার বেগে দৌড়াচ্ছে। পিঁপড়ার পরিবার ও সামাজিক কমান্ড স্ট্রাকচার পাঠ করছি। ফড়িং র মত আমারও আছে তিরিশ হাজার চোখ।

আমার তিরিশ হাজার চোখ দিয়ে আমার বাংলাদেশের কমান্ড স্ট্রাকচার তৈরি করেছি। ফড়িং’ র চোখের সামনের দিগন্তরেখা ধরে আমি উড়ে উড়ে যাই। আমি কেঁপে কেঁপে উঠি। আমি হাওয়ায়, হিল্লোল-হিন্দোলে আমি উড়ছি। আমি বিবর্তিত নই।

আমার প্রাণ এসেছে যে প্রাণমঞ্জিল থেকে সেখানে আমি গিয়েছি। আমি আমার রুহ দেখে স্তম্ভিত। আমি ফড়িং ও প্রজাপতি হতে চেয়েছিলাম। আমাকে মানুষ করা হয়েছে। আমি এখন অনেক বেশী মাতাল ও মাতোয়ারা।

তা-ই স্টোমাক আর বৃহদন্ত্রকে খাটিয়ে নিচ্ছি। কবি স্বাস্থ্য সচেতন হবে না। কবি হিসেবে আমি ভীষণই অ্যানারকিষ্ট। আমি সিন্ডাক্যালিস্তা এনারকিস্ত। অসুবিধা আছে।

কবি আয়াত তৈরি করে। কবির কোন আনুগত্য নাই। কবি রুমী রাগে নাচবে। নাচতে নাচতে লাল বোতাম খুলে পড়বে। একেকটা লাল বোতাম নক্ষত্রে দশটা করে রেস্টুরেণ্ট বানাবে।

ফকির লীলা পাগলা ফজল সে-ই বারের ম্যানেজার। অলীক অন্ধকারে আমি বসে আছি। এই অভিজাত অন্ধকারে আমি মগজের অক্সিজেন কমাতে থাকি। কারণ আমি বৃক্ষ। আমার দরকার কার্বন-ডাই অক্সাইড।

আমি প্রতিদিনের মধ্যরাতের মাতাল। আমি আমার খোদ গুণে খোদার দেখা পেলে বলবো, আমাকে প্রজাপতি করে দাও, মাবুদ। আমি এক বিচিত্র প্রজাপতি। আমি কারো দাসত্ব মানি না, পায়রুবি করি না। আমি আমাতেই স্বয়ম্ভু।

কবির তরক্কি হলে, কসুর হলে খোদা মাপ করে দেন। কারণ, কবিই একমাত্র আয়াতের উত্তরাধিকার। কালাম কেবল কবিরই উচ্চারণপ্রসূত। কবির সাথে আপদে-বিপদে থাকেন নজরুল। ২১।

আমি ফড়িং চোখে তোমাকে দেখছি। কিছুই আমার চোখ এড়ায় না। আমি ভূমি ও শূন্যবারামের সারস্বত অস্তিত্ব। ভাব-বিমান। আমার উড়ার সংকল্প নিয়েই জন্ম নিয়েছি।

আমাকে উড়তে দাও। আমি সব জানি, জ্ঞাত আছে অনন্ত দশা। আমি প্রসূনধাত্রীবিদ্যা শিখেছি। আমি আমার স্বল্প আয়ু নিয়ে তোমারই চারপাশে উড্ডিন, হে ফুল। তোলাদের প্রস্ফূটনের পর আমি রসপান করে মরে যাবো।

রসে আমি আত্মাআস্বাদনের সুখ পাবো। কাব্য যখন অস্তিত্বময় হয়ে ওঠে, কবি তখন নিরাকার হতে থাকে। কবি, চার্লস বুকাওয়াস্কির মত কেবলই লাল বোতামে যায়। কবির সাথে পৃথিবীর সবচে সুন্দর ফার্মগেটের মোড়ে ফকিরনী-প্রমীলাময় সুন্দরীর প্রেম হয়ে যায়। কবির চোখ উপড়ে ফেলা হয়।

কবি ফকিরনীর হাত ধরে ভিক্ষা করতে থাকে। মানুষের সৌন্দর্য্য ও যৌনতা কবি অন্তর দিয়ে বুঝতে চায়। জঙ্গ, উরুসন্ধি, ক্লিটোরাস, ভ্যাজাইনা, কাফ্রি মেয়েদের মত পুষ্ট ওষ্ঠ, বুনিময় স্তন- সব কবি মনের চোখে চাখতে চায়। তা-ই কবি,ফকির লীলা পাগলা ফজলের কাছে বায়াত নিয়েছে। কবি চোখ উপড়ে ফেলেছে।

কারণ, কবির ত্রিশ হাজার নয়নপুঞ্জ দরকার। আমার দহনদশা। আমি দহনস্নিগ্ধ হতে চাই। আমার ভেতরে এক কামারশালা আছে। সেখানে সারা দিনমান জ্বলছে আগুন।

আমার মনে আছে দহনস্নিগ্ধ খইয়ের মত ছড়ানো পবিত্র জুঁই। আমি জুঁই-ধবল এক জ্যোৎস্না রাতে পাগল হয়ে যাই। প্রথাগত বিদ্যার জোড় নাই। বুদ্ধিও তেমন প্রখর নয়। তাই আমার ভবিষ্যত ও বর্তমান পুরোটাই ফ্যান্টাসি।

সৎ থাকতে চাই কিন্তু পারি না। আমি এক ক্ষরণ ক্ষুব্ধ কালে আছি। নিজের সম্পর্কে কোনটা সত্য আর মিথ্যা আলাদা করতে পারি না। কারণ, আমার জীবনের পুরোটাই একটা বানানো গল্প। আমি গল্পের একজন নায়ক মাত্র।

তাও সাইড নায়ক। নায়কের বন্ধু। ক্লাউন। নিজেকে কী যে ভাবি আর কী যে বলি বানিয়ে বানিয়ে নিজের সম্পর্কে! আমার কোন বন্ধু নাই। ২২।

জীবনে একতরফা প্রেমে পড়েছি বহুবার, সম্পর্ক ও লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে। কিন্ত কাউকেই নিবেদন করা হয়ে উঠেনি। কেউ কেউ কখনও বলেনি, ভালোবাসে আমাকে। ভালোবাসা পাবার একটা অতৃপ্তি মনের মধ্যে আছে। এতেও তৃপ্তি, অবহেলার আনন্দ।

প্রত্যাখানের হাউস। কাউকে স্বপ্ন দেখাই না। কথা দেই না। কারণ আমি নিজেই স্বপন দেখি না, নিজের কাছে দেয়া কথাই নিজে রাখতে পারি না। নিজের কোন কোন সাফল্যকে খোয়াবের মত মনে হয়।

আমার ফ্যান্টাসী আমি কারো কাছে প্রকাশ করি না। ফ্যাণ্টাসীকে শত্রুরা ব্যবহার করতে পারে। কুনাশা ধরে মাঝে মাঝে আমাকেও। কালো ভোমরার খোঁজে আমি প্রমোদে মজিয়া থাকি। ২৩।

অধরা স্পেসে বসে শিল্পের জ্যামিতি খুঁজি। ইসকুলে আমাকে রচনা লিখতে বললে আমি প্রথাগত টেক্সটের টেক্সচার বদলে দিতাম। গদ্য ও পদ্যের সীমারেখা আমি ভাব ও ভাষাগত অর্থে আমি ভুলে যেতে চাইতাম। টেনে-টুনে স্কুলের গণ্ডি পার হয়েছি। আমি নিষিদ্ধ জ্ঞানের বলি।

তাই অক্ষর ও বই নিয়ে নাড়াচাড়ার যে পড়াশুনা, সেটা খুব আগায় নাই। এখন অক্ষর ব্যাবহার করছি। অনেক ভুল হবে। আমার প্রকৃতি যেমন করে আমাকে অভিভূত করত, প্রকৃতির প্রকাশ আমাকে দিওয়ানা করে দিত। আড়ালিয়া জলায় ফুটতো কী পবিত্র কমল নিকর।

পদ্মফুলে- ফুলে ভরা বহু জলা আছে আমার রাজশপুর গ্রামের বনে। তাই পদ্মপতায় শিশির কালি দিয়ে কবিতা লিখার খায়েশ বহু দিনের। সেই স্বাদ এখনো মিটে নাই। কিশোরকালে যখন বালেগ হয়ে উঠছিলাম, অই সময়টা পদ ও পদ্যের। মাথার ভেতর কতকিছু খেলা করে।

অনন্ত বৈশাখের ঝড় এসেছিলো বার বার এসেছিলো জীবনে। ঝড়ের সাথে সাথে আমার কৈশোর কখন যে উড়াল দিয়েছিলো, সে কথা বেশ মনে আছে। কোনো এক ফুটিফুটি প্রভাতে আমার চর্মচক্ষু দিয়ে জগত দেখার ব্যাপারটি আর রইল না। আমার ভেতর একটা আউলা-ঝাউলা ব্যাপার তৈরি হল। আত্মমগ্নতার নিরবতায় ডুবে থাকা।

এই নিজের ভেতর নিজে সব সংকট, কষ্ট, সব জ্বালা পোড়া, অঙ্গারভূক আমার ভেতরটা শুষে নিতো। আমার অতিক্রান্ত শৈশবের শব্দের প্রতিধ্বনি এখনও শুনতে পাই। আমার স্মৃতিতে যে পল্লীজননী তার প্রতি আমার অপার কৃতজ্ঞতা। আমার অই বনানীবিপুল পল্লিতে রঙ্গিলা-ঢকিলা সব চেনা-অচেনা বৃক্ষ, গুল্ম-তরুলতা। পদ্মপুকুর, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কত জলা- আড়ালিয়া, বাছইরগা, মইষ বা মহিষমারা, ফকির জলা।

আরো অনেক আছে। আপনার বনভোজনে যেতে পারেন। শুনেছিবাছইরগা, লোঙ্গা .. এগুলো টিপরা সর্দারদের নাম। আড়ালিয়া জলা কিংবা মহিষমারা জলার পাড়ে ঘুরতে ঘুরতে নিজেকে দরবেশ-দরবেশ লাগতো। এসব জায়গা যে কোন কবির জন্য নিভৃত সাধনক্ষণ হতে পারে।

২৪। তাই একদিন এক টিপরা সর্দার মহামতি লোঙ্গা আমার মধ্যে এসে হাজির। আকাশ যখন ঢুলু ঢুলু তখন আমি আপনার সাথে ছিপ নৌকায়, এই যে সমুদ্র লেজ তুলে পালাচ্ছে, ভূখন্ড তার পিছু পিছু। আমি লাল পিঁপড়ার চাক ধরে নবীন ভুমির ঘনশ্বাস, জল কাদায় মাখামাখি, প্রস্বেদননময় তার কাছাকাছি। এখানে এই কমলাঙ্কে আমার সাথে আপনি।

আমার বেদনা উঠেছে। জল ভূমি ভূমিষ্ঠা, আমার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবার বহু আগেই আপনি হে! মহামতি লোঙ্গা, বজ্র বর্ণিল কোন এক রাতে এলেন বসতির খোঁজে। যেমন কবি বলেছেন, না ডাকিলে জন্ম নাই/যেমন বজ্র ছাড়া মৎস্য জন্ম নয়/বেলা পড়ার আগে নাগর ফিরে আইস ঘরে/ আমার যে আজ বেদন উঠিবে। মহামতি লোঙ্গা, আপনি জানেন আমি কে। আমি জানি না।

আমরা আবার রজোবীজে রিক্তরুদ্র কালকল্লোল, আমরা বসুধাবিপণী বিতান। আমরা আবার জমজ-জড়ুলে চিনে ফেলি দু’জনায়। পিংকুর জন্য তৃতীয় কিস্তি লীলাক্ষেত্রের গদ্য ২৫। শাল ফুল ফুটেছে। সারা শালবনে যৌনগন্ধী সুবাতাস।

যারা শাল ফুলের ঘ্রাণ এখনো আস্বাদন করেননি, এই ফরেস্ট বিটে আসুন। আপনি মাইল খানেক হাঁটলে লোঙ্গার বাড়ি পাবেন। মহামতি লোঙ্গার অন্তর্ধান হয়েছে ১৭৮১ সালে। লোঙার দাদীর নাম ছিলো গুধী। এখনও কমলাঙ্ক গ্রামে গুধীর পুষ্করীণি নামে একটি পুকুর আছে।

আমরা আজ যৌনগন্ধী এই শালবনের গল্প বলবো। শালফুলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। জঙ্গলে ঢুকলে আপনার নাক অবশ হয়ে যাবে। শরীরে মাদল বাজবে। একবার শালবনে ঢুকে এতোই কামকাতর হয়ে পড়েছিলাম যে নিজেকে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা করত।

আমাদের সকল কামকলার প্রাথমিক পাঠ এই শালবনে, আশেপাশের শণখোলায়। যে বয়সে যৌনতা আসে লিঙ্গ-নিরপেক্ষ ভাবে। নিজেকে কখনো নারী, কখনও পুরুষ মনে হয়। কেঊ যদি নারী ভাবে তবে নারী-পুরুষের এক মিশাল অনুভূতি তৈরি হয়। মানুষের প্রথম গোপন রতিলীলা মানুষের জন্য এক পরম সম্পদ।

হউক তা নারীর সাথে, না হয় হোক না পুরুষ। প্রথম নিবেদনের উত্তাপ দুর্ভিক্ষের পর প্রথম নিজের জমিনের ভাত পেট ভরে খেলে যেমন সারা জীবন মনে থাকে, তেমন। সারা জীবন তা মনে থাকে। এই শালবন এক ফ্যান্টাসি অরণ্য। এখান থেকেই আমার ফ্যান্টাসির শুরু।

ফ্যান্টাসি এক ধরনের কুদরত। এখানকার কিছু বর্ণনা দেয়া যাক। ২৬। একবার ভোর রাতে দেখা গেল শালবনের সব গাছ মাথা নুয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিরিক্ষির এই দৃশ্য যিনি দরশন করেছিলেন তিনি লোঙার দুই কন্যা- ভূজঙ্গী ও নীলাঙ্গি।

খুব ভোরে হাঁটা তাদের স্বভাব। দেহের মধ্যে কী সব কান্ড-কারখানা চলতে থাকে। কিছুটা প্রকাশ পেয়ে যায়, কিছুটা অগোচরে কাজ করে যায়। বনানীর খুশবুস্নাত বাতাস আমার বাড়ি ঘিরে আছে। ২৭।

লোঙ্গাকে মহারাজ ঈশ্বরকুমার গুপ্তের দরবারে হাজির করা হয়েছে। মহারাজ মৃগয়ায় যাবার আগে কিছু বিচার সম্পাদন করতে যান। লোঙ্গার অপরাধের বয়ান আগে দেয়া দরকার। মহারাজের লোক বেড় শিকারের জন্য লোঙাকে তার ভাই-বেরাদর, গোষ্ঠি-জ্ঞাতি নিয়ে সবরকম প্রস্তুতি রাখতে বলেছিলো। বিশিষ্ট কোকি সর্দারও তার আমন্ত্রণ প্রত্যাশী –এই মর্মে বার্তা পাঠিয়েছিলো।

কিন্তু লোঙা কোন প্রস্তুতিতো দূরে থাক, কোকি সর্দারের বার্তাবাহকের কাছে কোরবোক ভাষায় এই ফিরতি খবর পাঠিয়েছিল যে, এখন বসন্ত। বনের পশু-পাখি সবাই জোড়া বাধছে মাতাল হয়ে। প্রজনন ও প্রণয়ের এই মৌসুমে বেড় শিকার মহারাজের জন্য অমঙ্গল হতে পারে। কারণ, মহারাজের স্বর্গীয় পিতৃদেব এই প্রথা মেনে চলতেন। দোসরা কারণ যা গত একশ’ বছরেও ঘটে নাই, তা’ হলো এইবার শালফুলের সুবাস মহুয়ার মত।

লোঙার গোত্রের সবাই প্রায় একই স্বপ্ন দেখছে। শাল মঞ্জুরীর সর্পদশা। শাল মঞ্জুরি তাদের যেন বা ডাকে। এই জংগল এখন বেড় শিকারের জন্য অনুপযোগী। মহারাজ যেন দয়া করে বিবেচনা করেন।

তাছাড়া লোঙ্গা বলেছিলো, প্রকৃতি আপন মহিমায় প্রাণ কল্লোলময়। আমার প্রাণ ও অন্যান্য প্রাণসকলের মধ্যে দুধমা ও দাইমাসুলভ সম্পর্ক আমাদের প্রাণধরম। আমরা সাধারণত মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতির বিষয়ে উদাসীন। মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে জীবনের মাজেজা ও প্রাণধর্মের সার কথা বুঝতে পারি। প্রাণ ও প্রয়াণের সম্পর্ক থেকেই আমরা জীবনের মর্ম উপলব্দি করতে পারি।

অতএব আসুন প্রাণ রক্ষার সংকল্পে সিদ্ধ হয়ে জগত রক্ষা করি। সবকিছুকে সমূলে বিনাশ করা থেকে বিরত থাকি। প্রাণের ব্যকরণ প্রাণেই নিহিত। মহারাজের বার্তাবাহক এই খবর নিয়ে রাজধানীতে ফিরে গেলো। ২৯।

মহারাজের বার্তাবাহক এই খবর নিয়ে রাজধানীতে ফিরে গেলো। দরবারে যেন ব্জ্র পড়ল, ঠাডা পড়ল। সব যেন গজব হয়ে গেলো। জ্ঞান রাজকীয়। প্রজাদের জ্ঞান চর্চার কোন অধিকার এখনো দেয় নাই।

তবে রাজা মহান। তিনি পরিবারে কিংবা গোষ্ঠীর ভেতরে জ্ঞান সাধনায় কোন বাধা দেয় না। প্রজা জ্ঞানবান হলে রাজার জন্য ভালো নয়, তবুও এই রাজা এই ন্যায় স্থাপন করেছেন। লোংগাকে বুনো লতা দিয়ে বেধে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সাধারণত হাতি বাধার জন্য এই লতা ব্যবহার করা হয়।

৩০। শাল ফুল ফোটা একটা সাংবাৎসরিক ব্যাপার। প্রতি বছরই ফোটে। এবার তা’হলে এবার আবার কী হলো। এবার স্বপ্নদশায় ফুল সর্পস্বরূপে আসে।

এটাই কুলক্ষণ। প্রকৃতি যে কোন বিপর্যয়ের আগে ইশারা দেয়। মানুষের মনের সাথে প্রকৃতির একটা যোগাযোগ আছে। আমরা সবসময় চিহ্ন, ইংগিত আমরা টের পাই না। এবারের শাল ফুল বড়ো বেশী যৌনগন্ধি।

জঙ্গলের কুঁচও অনেক বেশী লাল। সব বুনো ফুল আজ অতি-উজ্জ্বল। কিন্তু জ্যোস্না ফ্যকাশ, রক্তশূন্য পশ্চিম আকাশ। এই সব অলুক্ষণের ইঙ্গিত। মহামতি লোঙা এইসব বুঝতে পারে।

কিন্তু এই সব ভাব প্রকাশ করার জন্য কোন ভাষা নাই। তাই তার চোখ ছলাৎছল। তার কথা কাউকে বোঝাতে পারছে না। প্রকৃতি যে মহান শিক্ষক এটা তার দাদা শিউশিঙ্গা বার বার করে তাকে বলে গেছেন। রাজার কাছ থেকে দূরে থাকার কথাও তিনি বার বার বলে গেছেন।

আর শালফুল সংক্রান্ত বিষয়ে প্রায় হাজার পাতা তিনি কোরবোক ভাষায় লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তবে তিনি এ ব্যাপারে মুখ খুলতে মানা করে গেছেন। তিনি এই গ্রন্থ লুকিয়ে রেখেছেন। এই গ্রন্থে ৩৩৩ পাতায় যা বলা হয়েছে, তার বাঙলা অনুবাদ এই রকমঃ যে বৃক্ষ তরঙ্গে তরঙ্গে বাড়ে তার প্রতি সদয় হবো। লতায় লতায়, ফুলে ফুলে সুশোভিত থাকে তার মূল দেহ।

এত উঁচা আর ঘাড়ে-গর্দানে এত মজবুত কিন্তু কোন দেমাগ নাই। যে বৃক্ষ ধীরে বাড়ে তার আছে অনন্তের বিহবল নাদ। শাল অমর। প্রকৃতিকে পুনরুৎপাদন করে প্রকৃতির সাথে প্রকৃত সূত্রে গাঁথে আমাদের। সব ফুল চোখে পড়ে না।

শাল ফুল ফোটা দেখতে কেউ আসে না। কিন্ত মৌ-নাগর সব জানে না। এইখানের মৌ-মাতাল সময় প্রত্যক্ষ কর। যে বছর পাতা অতি সবুজ শালপাতার ঘরে, ডালে ডালে, হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ পিঁপড়ার ডিম সহ বাসা ঝুলছে। কী সাদা! এইসব ডিম।

৩১। লেবাঙ বুমানি আর গরিয়া নাচ হবে। নাচতে নাচতে বনের সকল ছড়ার জলে হিল্লোল উঠবে। এই নাদময় নৃত্যে বনের পশুদের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হবে। আকাশ থেকে মেঘ ও মেঘা নেমে আসবে।

মেয়েদের চুলে শনালু ফুলের গুচ্ছ। নাচে চেহারা খোলে। দুরকি (২) গাছের ফোটা ফলের মত বুনি। বুনির নাচন কেউ আর দেখছে না। বান ডেকেছে দেহে।

সব ভাসাবে। ভূতি জামগাছের রস দিয়ে রাঙানো ঠোঁট। চুমকুড়ির প্রতীক্ষায়। গত এক মাস ধরে ছাগলের দুধ পান করেছে সকল নৃত্যপটিয়সীরা। নৃত্যই আদি অবিনাশি গান, নৃত্যেই নির্বাণ।

সকল দুঃখ আনন্দ রূপে হেলে-ঢলে, জ্যোতি হয়ে অনন্তে মিলায়। দেহের অনন্ত দশাই নৃত্য। রাজা ও তার সাথীরা গত এক মাস ধরে হলকা-পেস্ট (৩), ছাগলের দূধ আর মধুর সাথে মিশিয়ে রাতের খাবারের পর নিয়মিত খাচ্ছে। বেড় শিকারের আগে রতিক্রিয়া একটি প্রচলিত রীতি। লোঙা তার এই পরোক্ষ অস্বীকৃতির ফল কী হবে জানে।

মহারাজ তাকে দরবারে ডেকে পাঠাবেন। রাজ জ্যোতিষের সামনে হাজির করা হবে। তার উপর নির্ভর করছে লোঙ্গার জীবন। জ্যোতিষের ভাষ্য (লোঙা পর্ব) এগারশ’ বঙ্গাব্দে বাঁশফুল প্রস্ফুটন। তার আগে প্রজাপতিদের মধ্যে ব্যস্ত উড়াউড়ি লক্ষ্য করা গিয়েছিল।

বাঁশ ঝাড়ে বককূল সেদিন ফিরে আসেনি। কেমন একটা ব্যাপার। দু’একটা পাখি কাছাকাছি এসে দেখেও গেলো। শিল্পরসিক চড়ুইগুলো সকাল থেকেই বাসা নির্মাণ সামগ্রীর খোঁজে বের হয়েছে। প্রণয় ও প্রজননের জন্য মানুষের গৃহের মতই তাদেরও বাসা চাই।

তবে চড়ুই শত শত বাসা তৈরি করে। যত বাসা ততো পিয়ারি। চড়ুই ক্লান্ত হলে সর্বনাশের আর শেষ নাই। সেই সালে কোন চড়ুই বাসা বাধে নাই। আমাদের গোত্র ভিত্তিক সমাজ।

আমি রাজ জ্যোতিষি। আমি আকাশের নক্ষত্র মাটিতে নামাই। বাঁশপুষ্প বিকশিত হবার আগে বিনাশের লক্ষণ আগে থেকেই প্রতিভাত হয়। বাঘ বাড়ির কাছাকাছি চলে আসে। ধান কাটার পর ক্ষেতে মাছের দেখা মেলে না।

পদ্ম ফোটে কিন্তু ম্রিয়মান, রাতের শিশিরেও সতেজ হয় না। আরো অনেক কুলক্ষণ আছে। যেমন, প্রচুর রিফিউজি লতা (৪) জন্মাবে, গ্রাস করবে। প্রকৃতিতে খাদ্য ও বৈচিত্র্যের সকল আধার বিপন্ন হয়ে পড়বে। কিন্তু শাল ফুল নিয়ে জ্যোতিষ শাস্ত্র নীরব।

শুধু একটি পংক্তি আছে। শালের দেহে শুদ্ধ কষ আছে। ৩২। যখন আমি জাগনা থাকি, ঘুমিয়ে গেলে স্বপন আসে, তোমার সাথে রোদন লীলায় কখন যে হয় হাতেখড়ি; বাচবিচারের সকল সীমা পার হয়ে যাই, কখন যে হয় দিগবিদিশা, আমার ভেতর আমি আর তোমার ভেতর আমি; কার বিহনে কালকরাতে বৃক্ষ যেমন কাটা গুড়ি, আমি তেমন ন্যাড়া বনে বনমোরগের পেখম খুঁজি। ক্লান্ত দুপুর ভ্রান্তি ছড়ায়, কেমন জানি লাগে আমার; এই যে দেখো_ তোমার খোঁপায় মেঘ জমেছে মেলা_ একটু দিও ঝড়ের আভাস, আমি যেন ঝড়-জখমে ডালেফুলে তোমার কাছে নুয়ে পড়ি।

আমার বেলা পড়ে যায়, আমার যায় পড়ে যায় বেলা, আমার সকল খোয়াব সত্য হবে; যেমন ধরো, আমরা দু'জন খুব পড়েছি এই বসুধা বিদ্যা নিকেতনে। আমার বাঁশের কলম, শিমের কালি... কিংবা আমার ঝর্ণা কলম_ সব লিখেছে, শুধু তোমায় বলতে মানা প্রিয়তমা। । লোঙার দুই কন্যা- ভূজঙ্গী ও নীলাঙ্গির সাথে আমি নাচতে থাকি। নাচতে নাচতে আমি আত্মুরতিময়তায় আচ্ছন্ন, চারদিকে একটা প্রণয়প্রজনন উতালা উতালা ভাব।

নৃত্য সকল শুদ্ধ স্বরের জন্য আরাধ্ননাময় আকুতি হয়ে উঠে। ৩৩। আমি ভূজঙ্গীর সাথে মিলনে উতালা। কিন্তু কীভাবে! নীলাঙ্গি যে সাথে সাথে। শালবনে আরো আছে রাজরক্ষী।

পদ্ম ফোটার কালে শরীর কাঁপে। আমি শ্রীচাঁন তার গুপ্ত চন্দ্রের দোলা দেখি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।