পরাঞ্জয়ী...
আমার এখন খুব ইচ্ছে করছে কী-বোর্ড টার সাথে যুদ্ধ করতে। কিন্তু কী লিখব সেটাই খুঁজে পাচ্ছিনা। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার ব্রেইনটা একটা ফুটবল। ভেতরটা একদম ফাঁকা! এখন সেরকম একটা সময়। এই ভরদুপূরেও বাসাটা একদম ভুতূড়ে লাগছে।
মনে হচ্ছে ল্যাপটপ থেকে চোখ ঘুরিয়ে পেছনে তাকালেই দেখব জট বাঁধানো চুল খোলা, সাদা ময়লা কাপড় পরা চোখ লাল কোন বুড়ি ঠিক আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তার গালে দাঁত নাই, কিংবা চোখের নীচে প্রকান্ড কোন কাঁটা দাগ অথবা গলায় শুকিয়ে যাওয়া সেলাইয়ের দাগ!
ঠিক ভয় পাচ্ছি না, কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। গতকাল বাপ্পি আর সাদ্দামের সাথে দেখা। আমরা একসাথে স্কুলে পড়তাম। বাপ্পি আর আমি একটানা ১১ বছর একসাথে পড়েছি।
এইচ এস সির পর কী এক অজানা কারনে ভীষণ মেধাবী ছেলেটা কোথাও চান্স পায়নি। সাদ্দামের সাথে ক্লাস সিক্স থেকে পড়ছি। এখন ও ইকোনমিক্স এ পড়ে আমি অন্য ডিপার্টমেন্টে। একই ভার্সিটি হওয়ায় মাঝে মাঝে সাদ্দামের সাথে দেখা হয়। বাপ্পির সাথে প্রায় ৫ বছর পর দেখা।
বাপ্পি আমাকে কুটিকাল থেকে চেনে বলেই অনেকটা বোঝে আমাকে। কত কথা কাল মনে করিয়ে দিল, আমি তো ওসব ভুলেই গিয়েছিলাম। স্রোতের বিপরীতে চলার অভ্যাসটা ছোটবেলা থেকেই ছিল। নিয়ম কানুনের মুখে ছাই ফেলে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বুঝিয়ে দিতাম চাইলেই নিয়ম ভাঙ্গা যায়। কে কবে নীরবে এই ডানপিটে চরিত্রটাকে আমার ভেতর বসিয়ে দিয়েছিল সে আর মনে পড়েনা।
বাপ্পি বললো আমি নাকি আমাদের বাসার সামনের জাম গাছে ডিকশনারি নিয়ে বসে থাকতাম। ইংরেজী ডিকশনারি। খুব হাসি পাচ্ছিল। যখন তখন স্যারদের চ্যালেঞ্জ করে বসতাম। অবশ্য সেখানে স্যাররাই দায়ী ছিলেন।
সবাই তখন স্যারদের কথা, কাজ কে বেদবাক্য মনে করতো। আমি পারতাম না। যতবার চ্যালেঞ্জ করেছি স্যাররা জিততে পারেন নাই। প্রথমত মফস্বল তারপরে আবার বিকট ধর্মপ্রবন এলাকাতে বড় হয়েছি। নব্বইয়ের দশকেও যেখানে স্কুলে যৎসামান্য কথা আদানপ্রদান হলেও স্কুলের গেইটের বাইরে ছেলে মেয়ে কথা বলা একদম নাযায়েজ(!)।
আমি সাইকেল চালিয়ে স্কুল করতে গিয়ে লোকের ছি ছি শুনেছি। কিছুটা মেধাবী ছিলাম বলে ছেলেদের সাথে কথা বলা নিয়ে এতটা হেস্তনেস্ত হতে হয়নি। তবুও সমাজকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আমি একটা পৈশাচিক আনন্দ পেতাম, সত্য কথা বলতে এখনও পাই।
এমন অনেক বিষয় ছিল, এখনও আছে যাতে মেয়েদেরকে চুপ করে থাকতে শেখানো হয়। যে সব বিষয়ে ছেলেরাই কথা বলবে, কিংবা এমন কিছু যাতে স্রেফ বড়রা কথা বলবে এমনকি ছোটরা যদি তাতে ওয়াকিবহাল থাকে তবুও চুপ থাকবে।
আমি কেন জানি পারতাম না। দুম করে বলে দিতাম। আজ এতদিন পরে এসেও দেখি সেই আমি আর এই আমির মধ্যে কোন তফাৎ নেই। তাই বাবা, মা সবাই খানিকটা ভয়ে থাকে আমাকে নিয়ে। অনেকে বলে এমন স্বভাবের কারনেই আমি হয়ত অনেক কিছু পাবনা, কিংবা হাতছাড়া হয়ে যাবে।
হয়ত গেছেও অনেক। ঐ যে সেই সংস্কার। স্রোতের উল্টো দিকে গুন টেনে চলবার ভয়াবহ সাহস!
খুব ছোটবেলায় মায়ের এক আলমারি ধর্মীয় বই পড়ে শেষ করেছিলাম। তারপর বাবা হাতে তুলে দিয়েছিলেন রবীন্দ্র, শরৎ, বঙ্কিম, সুনীলের কবিতা। আইয়ুব নবী-আর বিবি রহিমার কাহিনী পড়ছিলাম।
বিবি রহিমা কেমন করে অসূস্থ নবী কে সেবা করেন, তাঁর খাবার যোগাড় করতে নিজের মাথার চুল বিক্রি করে, তার শরীরের পোকা পরিস্কার করে ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই মাত্র ১১-১২ বয়সে প্রশ্ন জেগেছিল"যদি বিবি রহিমা অসুস্থ হতেন তাহলে নবীজি কি এভাবে সেবা করতেন?এমন করে জনপ্রাণহীন বনে গিয়ে বাস করতেন? কিংবা বিবি রহিমা যদি এভাবে তাকে সেবা না করতেন তাহলে তাঁকে কি মন্দ নারী বলা হত? কিংবা এত সেবা যত্ন করার পরও একজন আগন্তুকের কথায় চুল বিক্রি করার কথা শুনে তিনি ঘরে ফিরলে তাকে (রহিমা) বেত মারার শফত করলেন কিভাবে? আমি আজও এ প্রশ্নের জবাব পাইনি। মা ভেবেছিলেন ২৫০-৩০০ ধর্মীয় বই পড়ে মেয়েটা তার সুশীল কন্যা হবে। কিন্তু মা এখনও বোঝেনা ধর্ম আমাকে মানুষ হতে শিখিয়েছে ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢেকে গোয়ালের গাভী নয়, যে খড়ের জন্য মালিকের মুখ পানে চেয়ে থাকে, হালচাষ করে! আজও আমি আমার ভেতর সেই মানুষটাকে খুঁজে বেড়াই!
শরৎদা' একটু বেশিই জাকিয়ে বসেছিলেন আমার উপর। দেনা-পাওনা পড়তে পড়তে অলকার মাঝে নিজেকে আবিস্কার করলাম।
সমাজচ্যুত এক অনন্য সামাজিক মানুষ। সমাজ-সংসার কলঙ্ক কালিমার অনেক উর্ধে যে! কলঙ্ক যাকে ছুঁতে গিয়েও লজ্জায় সালাম ঠোকে! সেদিনই শিখেছিলাম ভালবাসলেও কঠোরও হওয়া যায়। সেদিন থেকে বাবার কঠোরতাকে আর কোন দিন নীষ্ঠুর মনে হয়নি! সেই থেকে আজ বারোটি বছর ধরে অপেক্ষা করছি "জীবনান্দে"র জন্য। অসম্ভব নীষ্ঠুর অথচ ভেতরে ভেতরে একটা দূর্দান্ত কিশোর! যে প্রতিনিয়ত আঘাত করবে আমায় অথচ আমাকে ছাড়া তার চলবে না এক মুহুর্ত! লোকের সামনে যে আমায় কাঁটবে ভাঙ্গবে অথচ নিজের ক্ষতের পরিচর্যা করতে আমাকে ডাকবে। শরৎদা'ই শিখিয়েছিলেন শত্রুতা থেকে যে ভালোবাসার জন্ম তার মৃত্যু নেই!! বারো বছরে পাইনি সেই জীবনান্দ চৌধুরী নামের নীষ্ঠুর পিচাশ সেই জমিনদারের দেখা।
ছেলেবেলায় যে পিশাচের প্রেমে পড়ে তার ভাগ্যে রাজপুত্তুরের ভালোবাসা সইবে কেন?!
আমি এমনই বাপ্পি। যাকে তুমি সম্পূর্ণ চেনো বলে দাবি করো। তোমার চোখে যে মেয়েটি অনেকবেশি স্পেশাল, স্পেশাল কারন সে ঘুরে দাঁড়াতে পারে। চঞ্চল মেয়েটা কখনও কাঁদেনা! তুমি ভুল জানো, আমি কাঁদি। অন্তসারশূন্য চোখে শুধু জল আসেনা।
আমার জিদ বেশি, আমি যা চাই আদায় করে ছাড়ি। আমি সাহসী। এমন অনেক বিশেষন আছে তোমার কাছে। স্রেফ একবারও বলোনি আমি একজন মানুষ! অথচ এটাই শোনার জন্য আমার এত যুদ্ধ!! আমি মানুষ হবই একদিন। তোমাদের সমাজের বাপের সাধ্য নেই আমাকে ঠেকিয়ে রাখবে!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।