বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
গ্রামের বাড়ি না গেলে কি হয় মা ? ল্যাপটপ-এর ডিসপ্লে থেকে মুখ না সরিয়ে জিজ্ঞেস করে সারা । দু-হাত কিবোর্ডের ওপর সেফায় হেলান দিয়ে মেঝের ওপর বসে আছে ও।
কি বলছিলস তুই! তোর দাদুর মৃত্যুবার্ষিকী।
বিরক্ত হয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন জাহানারা । সারার গায়ের রং ফরসা, কাঁধ অব্দি ছাঁটা চুল, চোখে ছোট্ট চারকোণা ফ্রেমের চশমা-আজকালকার মেয়েরা যেমন পরে। সারার মুখচোখেও বিরক্তির ভাব ফুটে উঠেছে। মুখ দিয়ে অদ্ভূত শব্দ করল । গ্রাম-ট্রাম ওর ভালো লাগে না।
তার ওপর যা গরম পড়েছে। এই গরমে কেউ গ্রামে যায়? ওর চোখের সামনে ঝকঝকে ডিসপ্লেতে ফেসবুক। ক’দিন হল ফেসবুকে ওর এক নতুন বন্ধু হয়েছে। সালমান। অবশ্য নিকটা ফেইক কিনা এখনও ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
লাস্ট উইকে কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছিল সালমান, নতুন কিছু ছবি আপলোড করেছে। সেসবই এখন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সারা। আর মজার-মজার মন্তব্য করছে। ছবিতে অনেকগুলি জিন্স পরা স্মার্ট ছেলে- এদের মধ্যে ঠিক কোনটা সালমান বোঝা যাচ্ছে না।
রূপা ঘরে ঢুকল।
হাতে একটা প্লেট, তাতে কতগুলি নাড়–। বলল, নাও মা, খাও। সারা তো আর এসব খাবে না। তুমি একাই খাও।
কথাটা সারা শুনল না মনে হয়।
জাহানারা নাড়– নিতে নিতে জিজ্ঞেস করলেন, তুই ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে নিয়েছিস তো রূপা?
হ্যাঁ, মা। রূপা মাথা নাড়ল। ওকে ভীষণ খুশি খুশি দেখাচ্ছে। কতদিন পর গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে। গতকাল রাতে একটা অদ্ভূত স্বপ্ন দেখেছে রূপা ।
সে কথা মনে হতেই গা শিরশির করে ওঠে। ও জানে ওর একটা গোপন স্বপ্ন পূরণ হবে। এবং সেটা হবে গ্রামের বাড়িতেই ...
রূপা ওর মায়ের পাশে বসল। জাহানারা মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন। শ্যামলা মতন মিষ্টি মুখ।
চোখ দুটি কেমন ডাগর-ডাগর । ওই শান্ত মুখের দিকে তাকালে শান্তি পান জাহানারা। সারা আর রূপা পিঠেপিঠি বোন- তবে দু বোনের মধ্যে তেমন মিল নেই। সারা সচরাচর রান্নাঘরে যায় না, ওর খাওয়া মানে ফাস্ট ফুড; সারাক্ষণ ল্যাপটপ কিংবা মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকে। রূপা সেরকম নয়, ও রান্নাবান্না করে, মায়ের কাছে শেখে ।
তাছাড়া ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট নেই রূপার। তবে ও যে কম্পিউটার এড়িয়ে চলে -তা কিন্তু নয়, রূপা জানে-কম্পিউটার জিনিসটা বাদে এ যুগ অচল, রূপা কেবল কম্পিউটারে জরুরি কাজগুলিই করে । দু’বোনই এবার এইচ এস সি পরীক্ষা দেবে। লালমাটিয়ায় পড়ছে।
জাহানারা হেসে বললেন, এবার তাহলে সারার ব্যাগও গুছিয়ে দে।
রূপা মুখ টিপে হাসল।
কথাটা সারার কানে যায়নি। ফেসবুকে নতুন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এসেছে। কে? বুক কাঁপছে। সাদিয়া।
মেয়ের নাম। সামান্য হতাশা গ্রাস করে ওকে। নতুন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এলেই মনে হয় কোনও ছেলের-যে ছেলেটি ওর স্বপ্ন পূরণ করবে। সেরকম এখনও অবশ্য হয় নি। সালমানের সঙ্গে সম্পর্কটা এখনও সেটল হয়নি।
রূপা বলল, ইস! বাবা দেশে থাকলে কত ভালো হত। তাই না মা?
জাহানারা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। রূপার বাবা ডাক্তার। মালয়েশিয়ায় গিয়েছেন চিকিৎসকদের একটা সম্মেলনে যোগ দিতে। ফিরতে ফিরতে রোববার।
এদিকে জাহানারার শ্বশুরের মৃত্যুবার্ষিকী শুক্রবার। আজ বৃহস্পতিবার। আজই সন্ধ্যায় রওনা হয়ে শুক্রবার থেকে শনিবার ঢাকায় ফেরা কথা। মেয়েদের কলেজ খোলা। শ্বশুরবাড়ি ঢাকার কাছেই।
ধামরাই। ওখানে বছরে দু-একবার যাওয়া হলেও শ্বশুরের মৃত্যুবার্ষিকী কোন বারই মিস হয় না।
এবারই প্রথম রূপার বাবা দেশে নেই।
গাড়িতে সারাক্ষণ কানে হেডফোন গুঁজে বসে রইল সারা । কোলে ল্যাপটপ।
ভঙ্গিটা কেমন বিষন্ন আর যান্ত্রিক। যেন ও দূর কোনও গ্রহের জীব-ওকে বন্দি করে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ... রূপা বসেছিল পিছনে ওর মায়ের পাশে। মায়ের সঙ্গে টুকটাক কথা হল। সারাক্ষণই বাইরে তাকিয়ে রইল।
দুপাশে দৃশ্যগুলি সরে যাচ্ছিল দ্রুত। হেড লাইটের আলোয় অন্ধকার রাস্তার দৃশ্য দেখতে দেখতে ঝিম ধরল। রূপা জানে ... সারা না-থাকলে ড্রাইভার ...মমতাজের কোনও হিট গান ছাড়ত। ড্রাইভারের নাম মহরম-মমতাজের ভক্ত। সারার জন্য সাহস পাচ্ছে না।
সারা কেন যেন মমতাজকে সহ্য করতে পারে না। ওর প্রিয় ব্যান্ড evanescence ...
জাহানারার ফোন এল। সেটটা অন করে বললেন, হ্যালো। ...হ্যাঁ ... হ্যাঁ ... আমরা রওনা হয়েছি। রাস্তায়।
আসছি। আটটা সাড়ে আটটার মধ্যেই পৌঁছে যাব।
আরও কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন অফ করে দিলেন জাহানারা।
কে মা?
তোর সাজু ফুপু। ওরা আজ দুপুরেই এসেছে।
অবশ্য তোর ফুপা আর রন্টি আসেনি।
কেন?
রন্টির নাকি পরীক্ষা।
ওহ্। রূপা বিষন্ন বোধ করে। কতদিন রন্টি দেখে না, টেলিফোনে অবশ্য কথা হয় ...রন্টি এবার ক্লাস টেনে উঠল।
চমৎকার রবীন্দ্রসংগীত গায় ...
আমি কান পেতে রই
ও আমার আপন হৃদয়গহন-দ্বারে বারে বারে ...
রন্টিরা থাকে বগুড়া। মাঝে-মাঝে ঢাকায় আসে। তখন রূপাদের বাড়িতেই ওঠে। তা ছাড়া বছর একবার ধামরাই এলে দেখা হয়।
রন্টি এবার এল না!
এবারই প্রথম বাবা দেশে নেই।
কি যেন ঘটতে চলেছে।
চাপা উত্তেজনা বোধ করছে রূপা।
ধামরাই পৌঁছতে পৌঁছতে ন’টা বাজল।
রূপার দাদুর বাড়িটি বেশ পুরনো । দোতলা।
সামনে বড় উঠান। পিছনে আমবাগান। পুকুর। বাঁশঝাড়। পারিবারিক কবরস্থান।
ওখানেই শুয়ে আছেন রূপার দাদু ইব্রাহীম খান মজলিশ। বছরে এই সময়টায় তাঁর মৃত্যুবাষির্কীতে তাঁর ছেলেমেয়েরা এসে পুরনো বাড়িটি মূখর করে তোলে; অন্য সময়ে এত বড় বাড়িটা খাঁ খাঁ করে। সাত্তার নামে এক বৃদ্ধ খানমজলিসদের ভিটেবাড়ি দেখাশোনা করে। অনেক পুরনো লোক সাত্তার। পুরনো আর বিশ্বাসী।
জমিজমা বিক্রি হয়ে গেলেও ভিটেবাড়ি বিক্রির কথা কেউই তোলে না। শরিকেরা বসতভিটে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছে। রূপাদের ভাগে পড়েছে দোতলায় পাশাপাশি দুটো ঘর।
উঠানে আলো জ্বলে ছিল। উঠানে পা দিয়েই সাজু ফুপুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল রূপা।
রূপা প্রায় দৌড়ে ওর সাজু ফুপু কে জড়িয়ে ধরল। ফুপুর দুই গালে চুমু খেয়ে বলল, রন্টি এল না ফুপু?
না রে, ওর স্কুল খোলা।
ওহ্ । আমার জন্য কই মাছ রেঁধেছ ফুপু?
ওমাঃ রাঁধব না? তুই আসবি।
সারা আর দাঁড়াল না।
ও সবাইকে পাশ কাটিয়ে দোতলায় উঠে এল। তারপর সোজা ঘরে ঢুকল। একটা কম পাওয়ারের বাল্ব জ্বলে ছিল। আলোটা কেমন ম্লান। ঘরটা বেশ বড়, বিছানাটাও অনেক বড়।
সারা টের পেল-ওর মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এ ঘরের ইলেকট্রিক সকেটগুলি নড়বরে; মোবাইল কিংবা ল্যাপটপের চার্জ শেষ হলে সমস্যা ...জানালায় এলোমেলো বাতাস। সে বাতাসে পিছনের পানা পুকুর আর গোবরের গন্ধ মিশে আছে। ... কি দরকার ছিল এই গোবরের গন্ধের মধ্যে আসার? মা এসব বার্ষিকী-ফার্সিকী নিয়ে বাড়াবাড়ি করে ... কোনও মানে হয় ...
ড্রাইভার মহরম এসে ব্যাগ রেখে চলে গেল।
এ বাড়ির খাওয়ার টেবিলটা একতলার টানা বারান্দার ওপর ।
হাতমুখ ধুয়ে এসে ওখানেই বসল সবাই। জাহানারা মেয়েকে বললেন, যা সারাকে ডেকে নিয়ে আয়।
দোতলায় চলে যায় রূপা। একটু পর ফিরে এসে বলল, সারা আসবে না মা। ওর খিদে নেই বলল।
জাহানারা অস্বস্তি বোধ করেন। মেয়েটা দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করে না। আজ সাজুর সঙ্গে একটা কথাও বলল না। সাজু কি মাইন্ড করল? প্রসঙ্গ পালটিয়ে জাহানারা বললেন, শুনলাম, কামাল ভাইরা নাকি আসবে না।
সাজু মাথা নাড়লেন। বললেন, আমিও তো তাই শুনলাম। যত দিন যাচ্ছে, মা-বাবার প্রতি ছেলেমেয়েদের টান কমে যাচ্ছে। বছরে একবার এলে কি হয়-না, ছেলেমেয়ের স্কুল-কলেজ খোলা।
জাহানারা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
বড় ভাসুর কামাল। ব্যবসা করেন। খুলনা থাকেন। প্রতি বছর বাবার মৃত্যুবার্ষিকীতে ধামরাই আসে। এ বছর কি হল? সাজু যা বলল তাই কি সত্যি?
সাজু আক্ষেপের সুরে বললেন, ভাইজানের দোষ দিয়ে কী লাভ।
রন্টি আর রন্টির বাবাও তো আসতে পারল না, অথচ কত ইচ্ছে ছিল আসার। রন্টির বাবা বলল, মন্টি আর রেজাউর কে নিয়ে যাও।
রেজাউর? কার কথা বলছ? জাহানারা অবাক হলেন।
কেন আমার ননদের কথা তোমার মনে নেই ভাবী?
কার কথা বলছ?
আহা। টুকুকে তোমার মনে নেই- সেই যে তোমার বিয়ের সময় জ্বরে পড়ল, আসতে পারল না ...পরে কত আফসোস করল ...
ওহ্ ।
হ্যাঁ। এবার মনে পড়েছে।
ওরই ছেলে। রেজাউর এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। ইকোনমিক্স ডিপার্টমেন্টে।
ঘুরে বেড়াতে ভীষণ ভালোবাসে। মন্টিকে নিয়ে সেই যে দুপুরে বেড়িয়েছে এখনও ফিরছে না।
রূপার বুকটা কাঁপছিল। খেতে খেতে বলল, ফুপু। রান্না দারুণ হয়েছে ।
সত্যি!
সত্যি না তো কি! আমি কি মিথ্যা বলব?
সাজু হাসলেন।
ঠিক তখনই উঠানে ছেলেটাকে দেখল রূপা। বেশ লম্বা। এদিকেই আসছে। পাশে মন্টি।
সাজু ফুপুর ছোট ছেলে-ক্লাস এইটে পড়ে। মন্টির পাশে লম্বা পাঞ্জাবি পরা ছেলেটাকে আলোর ভিতরে ভালো করে দেখে রূপার শরীরে হিম¯্রােত বয়ে যায়।
সাজু বলল, আয় রে রেজাউর। খুব ঘুরলি না?
ছেলেটা হাসে। রূপাদের দেখে অবাক হয়েছে বলে মনে হল।
রূপা বলল, কি রে কে মন্টি? কেমন আছিস?
ভালো রূপা’পা।
দিন দিন লম্বা হচ্ছিস যে? রূপা হালকা স্বরে কথাটা বলল বটে-তবে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে।
মন্টি হাসল।
বারবার চোখ চলে যাচ্ছে ছেলেটার দিকে। চশমা পরা।
কালো প্যান্ট আর সাদাকালো টি-শার্ট পরেছে।
শ্যামলা হলেও ভীষণ মিষ্টি মুখটা।
গতরাত্রির স্বপ্নের কথা মনে পড়ে যায় রূপার।
সাজু বলল, জানু বু। এ হল রেজাউর।
টুকু বুর ছেলে।
জাহানারা রেজাউরের দিকে চেয়ে হাসলেন। বললেন, ওহ্ । টুকুবুর ছেলে? কত বড় হয়ে গেছে। কত ছোট দেখেছিলাম।
রেজাউর লাজুক হাসল।
রেজাউর ? ইনি হচ্ছেন আমার জানু ভাবী। জানু ভাবীর কথা তো তোর মায়ের কাছে শোনার কথা।
রেজাউর সালাম দিল।
বেঁচে থাক বাবা, বেঁচে থাক ।
জাহানারা বললেন। বলেই আড়চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন। রূপা চট করে মাথা নামিয়ে খাওয়ার ভান করে।
সাজু বললেন, যা। তোরা হাতমুখ ধুয়ে নে-আমি ভাত বাড়ছি।
জলদি করিস। তরকারি ঠান্ডা হয়ে গেল।
মন্টি আর রেজাউর বাথরুমের দিকে চলে যায়।
যাওয়ার আগে এক পলক রূপার দিকে তাকালো
অন্তত সে রকমই মনে হল রূপার ।
রাত আরও গড়ালে, দোতলায় উঠে এসে ঘরে ঢুকল রূপা।
তারপর বিছানায় উঠে গুটিশুটি মেরে সারার পাশে শুয়ে পড়ল রূপা ।
মা কই? ল্যাপটপ-এর ডিসপ্লে থেকে মুখ না সরিয়ে সারা জিজ্ঞেস করে। দু-হাত কিবোর্ডের ওপর।
সাজু ফুপুর ঘরে। ওখানেই ঘুমাবে।
রূপা বলল।
কথাটা ভালো করে শুনল না। ফেসবুকের জন্য নতুন একটা এ্যাড অন পেয়েছে ব্লগে। ফেসবুক ফটো জুম-ফেসবুকের কোনও ছবির ওপর কার্সার রাখলে ছবিটা নাকি বড় দেখাবে। সেই অ্যাড-অনটা ইন্সটল করছে।
যে কোনও অ্যাড-অন ইন্সটল করার সময় বুকের ভিতরে এক তিরতিরে আনন্দ টের পায় সারা। এই মুহূর্তে সেরকম আনন্দ হচ্ছে ওর। ঘর অন্ধকার। কেবল ডিসপ্লের আলো ছড়িয়ে আছে ...
হঠাৎই টের পেল সারা-রূপা কাঁদছে।
কিরে কাঁদছিস কেন?
রূপা চুপ করে থাকে।
তবে ওর শরীর কাঁপছে। সারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হাত বাড়িয়ে বোনের গালে গালে হাত দেয়। তুলতুলে নরম আর উষ্ণ গাল। চোখের উষ্ণ পানির ছোঁওয়াও পেল।
মেয়ে বলেই সারা জানে-এ কান্না দুঃখের নয়, এ কান্না সুখের। তাহলে কি স্বপ্নপূরণের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে রূপা ।
কী ভাবে যেন টের পেল সারা।
আধো-অন্ধকারে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল।
পরের দিন।
সকাল থেকেই বাড়ি জুড়ে ভিড় আর হইচই। বেশির ভাগই গ্রামের আত্মীয় স্বজন। এ অঞ্চলে খানমজলিসদের বেশ নামডাক আর লতায়-পাতায় অনেক আত্মীয়স্বজন। ইব্রাহিম খান মজলিশ অত্যন্ত জনপ্রিয় মানুষ ছিলেন। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী-লোকজন তো হবেই।
সারা আর নিচে নামল না। এসব গ্রামীণ ভিড়টির ওর ভালো লাগে না। পিঠে বালিশ গুঁজে বিছানায় হেলান দিয়ে ল্যাপটপ কোলে নিয়ে বসে রইল ও। রূপা একবারও ওপরে এল না। সম্ভবত প্রজাপ্রতির মতো সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কী যে মজা পায় লোকজনের সঙ্গে এত হা -হা হি - হি করে? রূপার মধ্যে একটুও নিজস্বতা নেই, রূপা কখনোই ‘প্রাইভেট স্পেস’-এর প্রয়োজন বোধ করে না।
সারা আপনমনে হাসে। তবে ও উদ্বেগও বোধ করছিল। আজ সকাল থেকে নেটে সালমান-এর পাত্তা নেই। বুক ধড়ফড় করছে ওর।
কি হল ওর? সালমানের ফেসবুক ইনফোতে কেবল ইমেল অ্যাড্রেস আছে। ফোন নম্বর নেই। ফোন নম্বর থাকলে ফোন করত সারা। সালমান ফেসবুকে ফোন নম্বর দেয়নি কেন? এটা কি ওর সত্যিকারের প্রোফাইল না? তাহলে? সালমান ওর অবস্থান লুকোতে চাইছে কেন? ফেসবুক ইনফোতে যা যা লিখেছে তা কি সত্যি? নাকি ফেইক? মনের ভিতরে ভীষণ খচখচ করছে। মাস তিনেক আগে বিচ্ছিরি এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল ওর।
একটা ছেলের সঙ্গে খুব ডিপে চলে গিয়েছিল সারা। নিজের খোলামেলা ছবি পাঠিয়েছিল। পরে দেখা গেল ওটা ছিল একটা মেয়ের নিক। মেয়ে বলেই ব্ল্যাকমেইল করেনি।
একটা ই-মেইল পাঠালো সালমানকে ...তুমি বোঝ না কেন-যে-আমি অপেক্ষায় আছি।
আমি কি মরে যাব? প্লিজ উত্তর দাও।
দরজার কাছে শব্দ হল। সাজু ফুপু ঘরে ঢুকল। হাতে একটা প্লেট।
নে,খা।
কাল রাতে কিছু খাসনি।
প্লেটে খিচুরি আর ডিম ভাজি।
থ্যাঙ্কস আন্টি। বলে সারা হাসল। ওর খিদে পেয়েছিল।
প্লেটটা নিল সারা।
সাজু আন্টি বলল, আমার একটা ছবি তোল সারা। আর যখন ভালো বাসিস না, তখন আমার একটা ছবি থাক তোর মোবাইলে।
কথাটা শুনে সারা হাসল। বড় ম্লান সে হাসি।
অনিচ্ছ সত্ত্বেও নকিয়ায় ছবি তুলল । এই মডেলটা পুরনো হয়ে গেছে। বাবা এবার ‘এন-এইট’ আনবে মালয়েশিয়া থেকে। বাবা ভীষণ ভীষণ প্রিয় সারার। তবে বাবার এই ছোট বোন অতটা না ...
ছবি তোলার পর সাজু আন্টি খুশি হয়ে চলে যায়।
সাজু আন্টি যতক্ষণ সাজু ঘরে ছিল-এক ধরণের মৃদু অস্বস্তি ঘিরে রেখেছিল সারাকে। কলকল করে অনেক কথা বলল সাজু আন্টি। এত কথা বলার কি দরকার। বোঝে না কেন-এত কথা বললে অন্যরা বিরক্ত বোধ করে।
দুপুরের পর সালমান নেটে নক করল।
সারা মনে মনে বলল, আই লাভ ইউ সালমান। টুকটাক কথা হল সালমানের সঙ্গে। সালমান এর এক্সজাম ছিল। তাই সকালে ল্যাপির সামনে বসা হয়নি। তবে সালমান কোথায় পড়ে সে কথা বলল না।
ধীরে ধীরে জানা যাবে।
এক পর্যায়ে সালমান লিখল, এই সারা। তোমার খোলামেলা কিছু ছবি পাঠাও না । আমি দেখতে চাই তুমি কত সুন্দর।
সারা হাসল।
শরীর শিরশির করছে। লিখল, তুমি জান যে সেটা এখুনি সম্ভব না।
দশ সেকেন্ড পর উত্তর এল।
বিচ!
সারার বুকের ভিতরে কে যেন পিন দিয়ে খোঁচা দিল। কে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে সারা।
ও জানে-এও এক ধরনের খেলা। ইন্টারনেটের এই পরিচয় ...তারপর হঠাৎই সেপারেশন ...সারা মেনে নেয়। ছেলেরা এভাবে মেয়েদের কষ্ট দেয়। মেয়েরা এই কষ্টের জন্য অপেক্ষা করে। কষ্ট পেলে ভালো লাগে, নিজেকে গুরুত্বপূর্ন মনে হয়।
ও জানে ওর বেশিক্ষণ খারাপ লাগবে না। আজকাল কোনও কিছু বেশিক্ষন ভালো কিংবা খারাপ লাগে না।
ল্যাপটপ রেখে উঠে দাঁড়ায় সারা ।
পুরনো দিনের বাড়ি বলেই জানালাটিও বড়। জালানা দিয়ে হু হু করে রোদ ঢুকছে।
সোনালি রঙের আলোয় ঘর ভরে আছে। ধীরে ধীরে জানালার কাছে চলে আসে ও। জানালা ঘেঁষে নাড়কেল গাছ। সবুজ পাতায়-পাতায় রোদের ঝিলিক। একটা টিয়ে পাখি।
দোল খাচ্ছে। বাতাসে খড় ও গোবরের গন্ধ । গরুর হাম্বা ডাক শোনা যায় ...
আর নীচে এক আশ্চর্য দৃশ্য স্থির হয়ে আছে।
সারা সেই আশ্চর্য সুন্দর দৃশ্য দিকে তাকায়। নীচে আমবন, কচুরিপানা, তার বেগুনি ফুল -সব উজ্জ্বল রোদে ভাসছে।
পুকুর ঘাটে পাশাপাশি
রূপা আর রেজাউর বসে। ছেলেটার সঙ্গে আজ সকালেই পরিচয় হয়েছে, সাজু আন্টির রিলেটিভ। কাল রাতে কাঁদছিল রূপা ... এখন রূপার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে বলে হেসে হেসে কথা বলছে। সাদা শাড়ি পরেছে রূপা। শাড়িটা মার ... খোঁপায় বেলি ফুলের মালা।
রেজাউরও হাসছে। নীল পাঞ্জাবি পরেছে । নির্জন পুকুর পাড়। আশেপাশে কেউ নেই, অথচ কেউ কারও হাত ধরছে না। কেবলি চোখে চোখ রেখে কথা বলে যাচ্ছে।
যেন এ জন্মেও সে কথা ফুরাবে না ...
নীচের ওই দৃশ্যটা স্বপ্নদৃশ্যের মতন মনে হয় সারার। ওর বুকের ভিতরটা হিম হয়ে যেতে থাকে। সারা জানে ওর ওই আলোর ভিতরে দাঁড়ানোর অধিকার নেই, এখন ও ওই রোদের ভিতর দাঁড়ালে ওকে ভীষণ ফ্যাকাশে দেখাবে ...ডাইনিবুড়ির মতন দেখাবে ...রোদের তাপে গলে গলে পড়বে ওর সাদা ত্বক, শনের মতো চুল আর নকল দাঁতগুলি ...
সারার ভীষণ কান্না পায়।
ও কাঁদতে পারে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।