ছেলেবেলা থেকেই শুরু করি। ভাবি মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা মায়ের আচলের নিচে থেকে নিষ্ঠুর পৃথিবী থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখা ছেলেটির ভাবনা কী থাকে ? সেই ভাবনা কৈশরে কী রূপ ধারন করে ? আর যৌবনেই বা এর প্রভাব কী? ছোটবেলার সেই চিন্তা বড় হয়ে কী করব কী হব র সাথে পরিপূর্ণ একজন যুবকের চিন্তার পার্থক্য কোথায়?
আসলে ঘুরে ফিরে নিজের চাহিদা নিজের স্বপ্ন গুলিই হয়ত উঠে আসবে নানা ভাবে। অবশ্যই আপামর পুরুষ সমাজের মানসিক বিশ্লেষণ করবার সাহস অথবা শিক্ষা কোনওটাই আমার নেই। তাই নিজের চিন্তাগুলোকেই লিখে দিব বলে ভাবছি।
ছোট বেলায় মা বলত "বাবা বড় হয়ে ডাক্তার হবি।
" আমি ভাবতাম ডাক্তার ? পাড়ার পেট মোটা ডাক্তার আংকেলের ছবি মনে ভাসত। ভাবতাম ধুর মা আসলেই কিছু বোঝে না, আমি হব রোবকপ। যথারীতি মায়ের স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপ হিসেবে স্কুলে ভর্তি হলাম একদিন। ক্লাশ সম্পর্কে ধারণা কখনই ছিল না মা শুধু বলে দিয়েছিল "বাবা দুষ্টামি করবা না টীচার কিন্তু মারবে। " ভেবেছিলাম ব্যাপারটা ঘুরে বেড়ানোর মত হবে কিন্তু মারের ভয় নিয়ে ঘুরে বেরানো যায় না এই সত্য বুঝতে পারলাম স্কুলের প্রথম ঘন্টায়।
কাউকেই প্রথম দিন বন্ধু বলে ভাবতে পারি নি মেয়েদের তো নয়ই।
তারপর ধীরে ধীরে একদিন দেখলাম চারপাশের মানুষের মাঝে মতের কিছু অমিল আছে। পিছনে বসে সামনে বসা ছেলেটাকে কলম দিয়ে খোচা দিতে আমার যত খানি ভালো লাগে অনেকের তা লাগে না। আবার কারও কারও লাগে। বুঝে গেলাম বন্ধু কারা।
এভাবেই একদিন আবিষ্কার করলাম পড়াশোনা মানেই সব না পরীক্ষা বলেও একটা ব্যাপার আছে, বুঝলাম রোল ১,রোল ২ রোল ১৬ বলেও ব্যাপার আছে যা কিনা স্কুলের সমাজের জন্য সম্ন্নানের মাপ কাঠি। এও জানলাম ক্লাশের সবচেয়ে ভালো ছেলেটির চেয়ে সবচেয়ে দুষ্ট ছেলেটি বন্ধু হিসেবে অনেক ভালো হতে পারে। বুঝে গেলাম আমরা সবাই এক না। সবার পছন্দও এক না। সবার চাওয়াও এক না।
আরও একটা ব্যাপার বুঝে গেলাম যে মায়েরা আসলে অবুঝ। তাই ডাক্তার হবার চিন্তা পুরোপুরি ঝেড়ে মাথা থেকে ফেলে দিলাম। বানালাম নিজের দুনিয়া। কিন্তু পড়াশোনাটা করতেই হবে মায়ের অত্যাচার থেকে বেচে থাকার জন্য এই কথাটা বুঝতে বেশী বেগ পেতে হল না।
এভাবেই করে বছর পেরিয়ে গেল।
খুব ভালো না কিন্তু দুষ্টূ মেধাবী ছাত্রের উপাধী নিয়ে জীবন চলতে থাকল। এরই মাঝে বুঝতে পারলাম মেয়েরা আসলে শত্রু না। ও রাও বন্ধু হতে পারে মাঝে মাঝে ছেলেদের থেকে অনেক ভালো বন্ধুও।
যাই দেখতাম তাই ভালো লাগত। এর মধ্যেই কৈশর চলে এল।
আহ সে কী জীবন ! মনে হত জীবনটা বুঝি এরকম সহজ এভাবেই কেটে যাবে। শুধু সন্ধ্যা বেলাটা ভালো লাগত না। রোবকপ হবার ইচ্ছাটা মন থেকে ভোতা হয়ে যাচ্ছিল ক্রমেই। কী কী যেন সব ভাবতাম। বন্ধু বান্ধব কে মনে হত জীবনের সব কিছু।
আকাঙ্ক্ষা বলতে যা ছিল তা হল রোল নাম্বার টা যদি ১৬ না হয়ে ১০ হত মন্দ হত না এরই মাঝে সীমাবদ্ধ। বড় হয়ে যাওয়ার আনন্দ রক্তে কিল বিল করত। অনেক নতুন বিষয় জানতে থাকলাম। কিছু নিষিদ্ধ ব্যাপার চোখের সামনে এসে উপস্থিত হল। দুনিয়া হয়ে গেল নতুন।
ছোট্ট জগত আমার আর ছোট্ট রইল না।
ছোট বেলা থেকেই এস,এস,সি পরীক্ষার সময়টা ছিল আনন্দের। স্কুল ছুটি দুপূরে খেলে বেড়ানো , খাবার সময় শুধু খাবার ,ঘুমের সময় ঘুম আর বাকী সময় খেলা মৌজ মাস্তি। কিন্তু একটা বছর খুব এলোমেলো হয়ে এল। সময়টা দশম শ্রেনী কিছু বুঝতে পারার আগেই পরীক্ষা চলে এল, সব বন্ধু গুলোও যেন কেমন মন মরা করে ঘুরে বেরায় খেলতে আসে না পড়া এবং কোচিং হঠাৎ করে খুব দরকারি বলে মনে হয়।
সবার সাথে আমিও কেমন যেন হয়ে গেলাম। বই এর পাতা গুলো দেখলেই গা কেমন যেন করত। এরই মাঝে হঠাৎ আবিষ্কার করি আমার ইচ্ছের পরিবর্তন হয়েছে।
সেই ছোট বেলার মায়ের বলা কথা হঠাৎ মনে বেজে ওঠে। ঘর বাড়ি হয়ে যায় জীবনের গন্ডি।
ঘোরের মত কেটে যায় কয়েকটি দিন। তারপর আবার সব স্বাভাবিক আবার বন্ধু আবার আড্ডা। কোথায় হারিয়ে যায় কী করব কী হবে চিন্তা। মাঝে মাঝে ফলাফল নিয়ে মায়ের চিন্তা নিজেকে ভাবিয়ে তোলে কিন্তু তা সাময়িক। কিন্তু হঠাৎ চলে আসে নতুন মুহুর্ত ফলাফল ঘোষণা দুষ্ট মেধাবী এবার তার মেধার পরিচয় দেয়।
মায়ের স্বপ্ন হয় আরও দৃঢ় সঙ্গে নিজের টাও।
কলেজ জীবন ছোট্ট জীবন সিগারেট এর ধোয়া বুকে নেয়া শিখতে শিখতেই শেষ হয়ে যায়। বন্ধু বান্ধব গুলো তেমন জমানো হয় না। কলেজ জীবন ভালোও লাগে না। স্কুলে ফেলে আসা বন্ধুত্ব মনে পরে।
দেখা হয় মাঝে মাঝেই খুব ভালও লাগে। কিন্তু মনে হয় অনেক কিছু যেন আর এক সাথে করা হয় না। কলেজ জীবনের শেষ মায়ের সেই স্বপ্ন এখন জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। খুব ভয়ানক ভাবে কিছু দিন পার হয়। অনেকটা ঘোরের মাঝে।
আবার সেই কোচিং আবার সেই নষ্ট প্রতিযোগিতা। বন্ধু গুলোর সপ্নের সাথে স্বপ্ন মেলে না একেকের একেক স্বপ্ন, যাদের সাথে মেলে তারা তো বন্ধু না আমার প্রতিযোগী। সব স্বপ্ন পূর্ণ হয় না তাই বুঝতে পারা হয় যখন ডাক্তারী লিস্টে নিজের নাম খুজে পাওয়া যায় না। তবুও মনে হয় জীবন তো থেমে থাকবে না।
নিজের নামের সাথে প্রকৌশলী যোগ করবার সুযোগ চলে আসে।
বাবা মা তো বাবা মাই সব কিছুতেই খুশি। এত ভালো কেন এরা?
৪ বছরের পড়াশোনা নতুন জীবন নতুন স্বপ্ন। যে সব স্বপ্ন নিয়ে কখনই ভাবা হয় নি সেই স্বপ্ন বড় হব, টাকা হবে, বাড়ি হবে গাড়ি হবে। সাথে সাথে চলে অন্য জগত; বন্ধু ,আড্ডা, গান। মউজ মাস্তি নতুন নাম পায়।
স্কুলের বন্ধুদের সাথে কদাচিৎ দেখা হয়। সবাই নিজের জীবন নিয়ে ব্যাস্ত । অনেকে আবার ঝরে পরে আগেই। তাদের আর কোনও খোজ নেয়া হয়ে ওঠে না।
বন্ধুত্বে স্বার্থপরতা ঢুকে পরে।
অনেক বন্ধুত্ব ভালোবাসাতেও পরিণত হয়। রাজনীতি শেখা হয় শেখানো হয়। এই করেই শেষ হয় বিশ্ববিদ্যালয়। চাকরি ক্ষেত্র মজার। অনেকের হয় অনেকের হয় না।
জ্যাক না থেকেও ভালোই চাকরী পেয়ে যাই। মনে হয় আহ ১০ হাজার টাকা তো অনেক। কিন্তু এই অনেক টাকা এক সময় তুচ্ছ মনে হয়। আশে পাশে যাকেই দেখি ঈর্শা হয়। আরও বড় হতে ইচ্ছা হয়।
মনে হয় নাহ নিজের একটা ল্যাপটপ নিজের ডেস্ক এ একটা ফোন না থাকলে কি ভাবে হবে। সুযোগ এসে পরে লুফেও নেই। পেয়ে যাই সব কিছু। উল্লাসে ফেটে পরি। কাজে ঝাপইয়ে পরি।
বড় হই আরও বড় স্বপ্ন দেখি গাড়ি হবে নিজের সেই স্বপ্নও পূরণ হয়। অবাক হয়ে দেখি স্বপ্ন যখন বাস্তবে রূপ নেয় তখনই আবার স্বপ্ন বদলায়। আরও ভালো , আরও বেশী চাই ভাব কখনওই পুর্ণ হয় না। আরও চাই আরও চাই। মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানীতে বড় কর্তা, নতুন ব্যাবসা , শেয়ার , জমি, সুন্দরি বৌ এর কাউকেই আমার চাহিদা মেটানোর মত যোগ্য বলে মনে হয় না আমি আরও চাই।
মনে হয় এই চাহিদাই আমাকে চালিত করে আজ যদি আলাদিনের চেরাগের দৈত্য এসে বলত "মালিক আপনার সব চাহিদা ইচ্ছা পূরণ হয়েছে" বেচে থাকার আর কোনোও অর্থ আমার কাছে থাকত না বলে আমার বিশ্বাস।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।