সার্জারিওক্যাল অনুসন্ধানে ‘শাশ্বতিকী’র অনুবাদসংখ্যা
তৌহিদ ইমাম
বাংলা কবিতায় আধুনিকতার শিক্ষক বুদ্ধদেব বসু একবার নাকি বলেছিলেন, ‘অনুবাদসাহিত্য অনেকটা কাশ্মিরী শালের উল্টোপিঠ’ - আবছা, অস্পষ্ট, বিভ্রান্তিকর। মূলের প্রতি অনুবাদকের কমিটমেন্ট, তার স্বচ্ছতা ও সততা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে অহরহই। আক্ষরিক অনুবাদ ও ভাবগত অনুবাদ এই দুইয়ের মাঝে পড়ে বেশিরভাগ অনুবাদকেরই অবস্থা দাঁড়ায় ত্রিশঙ্কুর মতো। সর্বোপরি আছে চৌর্য্যবৃত্তির প্রবণতা; এই সবকিছু মিলিয়েই অনুবাদসাহিত্য হয়ে উঠতে পারত বাতিলযোগ্য কিছু- যদি না অনুবাদসাহিত্যের ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তার মৌলিক প্রশ্নটি অনিবার্য হত।
ক’জন দহনপ্রিয় তরুণ (মোজাফফর হোসেন, রাতুল পাল ও মুহাম্মদ মেহেদী হাসান)-এর প্রচেষ্টা ‘শাশ্বতিকী’ নামের সাহিত্যের কাগজটি।
গত আগস্টে বেরিয়েছে এর ষষ্ঠ সংখ্যা, অনুবাদসংখ্যা হিসেবে। পঞ্চম সংখ্যা থেকেই বিশেষসংখ্যার প্রতি ওঁদের আগ্রহ ও মনোযোগ। কেননা পঞ্চম সংখ্যাটি ছিল ‘নাটক সংখ্যা’, এবার ‘অনুবাদ সংখ্যা’, এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে লোকসংস্কৃতি বিষয়ক সংখ্যা। বিশেষ সংখ্যার প্রতি শাশ্বতিকী’র এই দুর্বলতা বোধ করি ব্যবহারিক সচেতনতা থেকেই। এখানে অনুবাদ সংখ্যাটি নিয়ে আলোচনা করতে চাই।
প্রথমেই আছে অনুবাদবিষয়ক মুক্তগদ্য, লিখেছেন আব্দুল্লাহ আল মামুন, খোন্দকার আশরাফ হোসেন এবং কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর। তিন প্রবন্ধকারের ভেতরে আব্দুল্লাহ আল মামুনের ‘বাংলাদেশের অনুবাদসাহিত্য : মৌলিকত্ব ও সৃজনশীলতা’ প্রবন্ধটি সবচেয়ে তথ্যবহুল ও বিশ্লেষনমুখী। প্রবন্ধটিতে বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের একটা ধারাবাহিক ইতিহাস পাওয়া যায়, সেই সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, গিরীশ ঘোষ, মুনীর চৌধুরী, কবীর চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, সৈয়দ আলী আহসান, শামসুর রাহমান বাংলাসাহিত্যের যাঁরা স্বনামধন্য অনুবাদক, তাঁদের প্রত্যেকেরই অস্বচ্ছতা আর স্বেচ্ছাচারিতা অনাবৃত হয়ে পড়ে। অনুবাদক তীক্ষ্ণ তীর্যক বিশ্লেষণে এ সকল অনুবাদকের অবিশ্বস্ততা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে অনুবাদক হিসেবে মোতাহের হোসেন চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, খালিকুজ্জামান ইলিয়াস, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, সরদার ফজলুল করিম এবং সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ-এর অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন।
অনুবাদকের সততা ও বিশ্বস্ততাই বোধকরি অনুবাদকর্ম সফল হওয়ার সবচেয়ে বড় শর্ত। আবার খোন্দকার আশরাফ হোসেন-এর ‘তরজমার জমাখরচ’ ও কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের ‘অনুবাদ : সৃজনের নবনির্মাণ’ নামের একরত্তি প্রবন্ধ দুটি খুবই গতানুগতিক। তবে খোন্দকার আশরাফ হোসেন তাঁর প্রবন্ধের শেষাংশে কেবল উৎসভাষা জানাটাই যথেষ্ট নয়, সেই সঙ্গে সে ভাষার আন্তরপ্রবণতা জানাটাও জরুরী বলে যে অভিমত প্রকাশ করেছেন, তার সঙ্গে ঐক্যমত পোষণ করি। এরপরে আছে অনুবাদ প্রবন্ধ; অনুবাদক দুলাল আল মনসুর ল্যারি শুভার্জের একটি প্রবন্ধ, আলম খোরশেদ হেনরি মিলারের ‘ভাবনাগুচ্ছ,’ সৈকত চৌধুরী ড্যান বার্কারের ‘ঈশ্বরবাদ খন্ডন’, রাতুল পাল অসীম দত্তরায়-এর ‘আধ্যাত্মিকতা ও মানব মস্তিস্ক’ এবং অনুবাদক এ এম রেজাউর রহমান রিয়েল জিদ্দু কৃষ্ণমূর্তির ‘ব্যক্তি ও সমাজ’ এর অনুবাদ করেছেন। এছাড়াও অনূদিত হয়েছে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘আক্লীন ওয়েল লাইটেড প্লেইস’ অ্যামোনে ওজের ‘বেদুঈন ও ভাইপার’, আমোস তুতুওলার ‘লেডি গোবরেপোকার বায়োডাটা’, আন্তভ চেখভের ‘বাজি’ এবং আর কে নারায়ণের ‘সান্ধ্য উপহার’; অনুবাদক যথাক্রমে মীর ওয়ালীউজ্জামান, জাকির তালুকদার, মোয়াজ্জেম আজিম, মাসউদ আখতার এবং তাওহীদ পাভেল।
অনুবাদক শরীফ আতিক উজ জামান অনুবাদ করেছেন নোবেল লরিয়েট মিগুয়েল অ্যানজেল অস্তোরিয়াসের নোবেল ভাষণ ও ডি এইচ হাবীব অনুবাদ করেছেন আন্তন পাভলোভিচ চেখভের নাটক ‘তিন বোন’।
সমকালীন ভারতীয় কবিতার অনুবাদক রায়হান রাইন, শার্ল বোদলেয়ার-এর কবিতার হাসানআল আব্দুল্লাহ, আধুনিক জার্মান কবিতার হিন্দোল ভট্টাচার্য, স্যাফো’র কবিতার অর্জুন চৌধুরী, ওসিপ ম্যানডেলস্টোম-এর কবিতার মলয় রায় চৌধুরী, মুস্তাফা মাহমুদ ও রবিনসন জেফার্স-এর কবিতার হোসেনউদ্দীন হোসেন, অ্যাডোনিস-এর কবিতার আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ্, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ করেছেন প্রাচীন চর্যাপদের আধুনিক বাংলায় পদ্যরূপান্তর, সৌমিত্রদেব অনুবাদ করেছেন ভ্লাদিমির মায়োকোভস্কির দুটি কবিতা, পৃথ্বীরাজ চৌধুরী ভিসেওয়াভা সিমবর্স্কার কবিতা, কয়েকটি ভারতীয় কবিতার অনুবাদ করেছেন অরুন চক্রবর্তী, মাহমুদ দারবিশের কবিতার অনুবাদ করেছেন শেখ নজরুল, অ্যালবার্ট অশোক-এর হাতে অনূদিত হয়েছে ভিসেওয়াভা সিমবর্স্কার একটি কবিতা, ম. হাসান অনুবাদ করেছেন ম্যানুয়েল অ্যালেগ্রের একটি লিরিক, পুরা ইনফোর একটি লিরিক অনুবাদ করেছেন মোঃ ফয়সাল জামান এবং গৌতম বসু অনুবাদ করেছেন আলেক্সজান্ডার পোপের কবিতা। একসঙ্গে এতগুলো বিদেশী কবিতা পাঠের এ আয়োজন নিঃসন্দেহে অভিনব। বিশ্বকাব্যসাহিত্য তোলপাড় করে ছেঁকে তোলা হয়েছে প্রাচীন কবি স্যাফো থেকে অধূনাতম মাহমুদ দারবিশ পর্যন্ত। এসেছে ভারতীয় কবিতা, ফরাসী কবিতা, জার্মান কবিতা, ইংরেজী কবিতা, জাপানি কবিতা, ফিলিস্তিনি কবিতা এবং বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদের কবিতাও।
এ আয়োজন বিপুল ও দুঃসাহসিক। এছাড়াও প্রতিটি কবিতার সঙ্গে কবির পরিচয় সংযোজন একটি উল্লেখযোগ্য দিক। শাশ্বতিকী’র নিয়মিত বিভাগে আছে ‘বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ’, চলচ্চিত্র, সাহিত্যকাগজ পাঠ এবং গ্রন্থালোচনা। এগুলো নিয়ে আলাদা আলোচনা অনাবশ্যক।
ভার্জিনিয়া উলফ বলেছিলেন, ‘লেখা, শৈল্পিক সৃষ্টি সম্ভবত বুনোহাঁসের পশ্চাদ্ধাবন ছাড়া বেশি কিছু নয়’।
তবুও কেউ কেউ এ বুনোহাঁসের পেছনে ছুটে ছুটে ঘর্মাক্ত হতে চায়, আর সে ক্ষরিত ঘামেই জন্ম নেয় একটি নতুন পত্রিকা, নতুন একটি গ্রন্থ। অ্যালবার্ট অশোকের চমৎকার নান্দনিক প্রচ্ছদশোভিত শাশ্বতিকী’র অনুবাদসংখ্যা শৈল্পিক দুঃসাহসেরই ফসল।
তৌহিদ ইমাম
আলোচক ও কবি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।