আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ব্লাশফেমি এবং সন্ত্রাসবাদের বীজতলা

তোমাকে ছাড়া বাচতে পারবো না.....

মার্কিন সামরিক বাহিনীর জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের চেয়ারম্যান মাইক ম্যুলেন কোন রাখ-ঢাক ছাড়াই স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন, বিশ্ব সন্ত্রাসবাদের বীজতলা হচ্ছে পাকিস্তান। ওয়াশিংটনের ফরেন প্রেস সেন্টারে সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের বার্ষিক মূল্যায়ন পরিস্থিতি তুলে ধরতে গিয়ে সম্প্রতি ম্যুলেন সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে এই মন্তব্য করেন। ম্যুলেন বলেন, পাকিস্তান হচ্ছে বিশ্ব সন্ত্রাসবাদ বিস্তারের মূল কেন্দ্র। পাকিস্তানের প্রশাসন এবং সেনাবাহিনীও তা ভালই জানে। কিন্তু সন্ত্রাসের বীজতলা নির্মূলে পাকিস্তান কোনভাবেই সফল নয়।

ম্যুলেনের মন্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট, পাকিস্তান থেকে সন্ত্রাসবাদের আখড়া ভেঙে দেয়া সহজ হবে না। যতদিন সম্ভব ধর্মান্ধতার আগুনে ঝলসে দেশটির কিছু স্বার্থান্ধ গোষ্ঠী নিজেদের রাজনৈতিক এবং জাগতিক স্বার্থ ষোলআনা উশুল করে নেবেই। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় যুদ্ধবাজরা জেনে গেছে, যতক্ষণ দেশটির সীমান্তে সন্ত্রাসবাদের বীজতলা থাকবে ততদিনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডলার বৃষ্টি দেশটির উপর বর্ষিত হতেই থাকবে। সীমান্তের জঙ্গিবাদের মধুচক্রটি গুঁড়িয়ে গেলে দেশটি মার্কিন আগ্রহের কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে ছিটকে পড়বে। এ’ধরনের পরিস্থিতির কোনদিন উদ্ভব হলে ধর্মান্ধ এবং রাজনীতিক ওয়ার লর্ডদের ক্ষমতার মসনদ থেকে চিরতরে ছিটকে পড়তে হবে।

এর তাৎক্ষণিক নজির, পাঞ্জাবের গভর্নর সালমান তাসির হত্যাকাণ্ড। পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন পিপলস পার্টির নেতা এবং প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির ব্যক্তিগত বন্ধু সালমান তাসিরকে হত্যা করেছে গভর্নরের দেহরক্ষী এলিট পুলিশ ফোর্সের সদস্য মালিক মুমতাজ কাদরি। সালমান তাসিরের অপরাধ তিনি ব্লাশফেমি আইনে সাজাপ্রাপ্ত আছিয়া বিবি নামের একজন দরিদ্র খ্রিস্টান নারীকে ক্ষমা করে দেয়ার পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন। আছিয়া বিবির অপরাধ, সভ্য জগতের আইনে খুবই টুনকো। কয়েকজন মুসলিম মহিলার সাথে আছিয়া বিবির পানি নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়।

কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে আছিয়া বিবি তার নিজের ধর্ম অর্থাৎ খ্রিস্টান ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে বড়াই করেন। আর যায় কোথা, সঙ্গে সঙ্গে মৌচাকে ঢিল! তার বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্ম অবমাননা অর্থাৎ ব্লাশফেমি আইনে ঠুকে দেয়া হয় মামলা। আর পাকিস্তানে ব্লাশফেমি আইনে দোষী সাব্যস্ত হলেই সর্বোচ্চ শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড। আছিয়া বিবিকেও মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়া হয়েছে। এ’নিয়ে দেশে-বিদেশে তীব্র সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়।

আছিয়া বিবির পক্ষে যুক্তি দেয়া হয়, যেকোন ধর্মাবলম্বীই তার নিজের ধর্মকে শ্রেষ্ঠ মনে করে। আর এই বিশ্বাস থেকেই সে ধর্ম পালন করে থাকে। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াউল হক প্রবর্তিত ব্লাশফেমি নামের কালো আইনটি কোন মানবিক যুক্তির ধার ধারেনা। যদিও ব্লাশফেমি শব্দটা ইসলামি শব্দ নয়, এমনকি আইনটাও নয় ইসলামি ঘরানার। তবুও ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্ধীদের ছেটে ফেলতে পাকিস্তানের মত ধর্মান্ধ ও স্বৈরশাসক নিয়ন্ত্রিত দেশে ব্লাশফেমির মত কালো আইন ইচ্ছেমত অপব্যবহার করা হচ্ছে।

গভর্নর সালমান তাসির অমানবিক এই কালো আইন বাতিলের দাবি তোলায় নিজের দেহরক্ষী মালিক মুমতাজ কাদেরি ২৭টি সাব মেসিনগানের গুলিতে ঝাঁজরা করে দিয়ে তাঁর নাম চিরতরে বাতিলের খাতায় তুলে দেন। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, তাসির হত্যাকাণ্ডের সময় গভর্নরের এলিট দেহরক্ষিদের অন্য সঙ্গীরা মুমতাজ কাদরিকে নিরস্ত্র করার বদলে চেয়ে চেয়ে মজা উপভোগ করেছেন। এ’ধরনের নৃশংসতার কী কোন জবাব আছে! গভর্নরের বুকে পুরো ম্যাগাজিন গুলি উগলে দিয়ে কাদরি নিজেই পুলিশের কাছে খুশিমনে আত্মসমর্পন করেন। পরে যখন তাকে আদালতে হাজির করা হয়, তখন শত শত ধর্মান্ধ সমর্থক তাঁকে বীর এবং গাজীর মর্যাদায় ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে সম্বর্ধিত করে। কয়েক ডজন আইনজীবী তার পক্ষে মামলা লড়তে দাঁড়িয়ে যান কোর্টে।

গভর্নর তাসির হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি পাকিস্তানের জন্য কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। জুলফি ভুট্টোকে হটিয়ে পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণের পর সত্তর দশকের শেষদিকে জেনারেল জিয়া দেশটিতে ব্লাশফেমি আইন চালু করেন। বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের স্তব্দ করে দিতে তিনি ব্যাপকভাবে আইনটির অপপ্রয়োগ করেন। পরবর্তীতে পাকিস্তানে নির্বাচিত সরকার এবং গণতন্ত্র ফিরে আসলেও বেনজির ভুট্টো বা নেওয়াজ শরিফ কেউই ব্লাশফেমি আইন প্রত্যাহার করে ধর্মান্ধদের রোষানলে পড়ার সাহস দেখাননি। পাকিস্তানের মার্কিন অনুগত জেনারেল পারভেজ মুশারফও ব্ল্যশফেমি লালন করেছেন।

শুধু ব্লাশফেমির মত কালো আইন নয়, পাকিস্তানে ব্যক্তি, দলীয় ও গোষ্ঠী স্বার্থে পবিত্র ধর্ম ইসলামের অমর্যাদা এখন প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পেয়ে গেছে। ধর্মান্ধতার আবরণে দেশটির সাধারণ মানুষকে উগ্র জঙ্গিবাদ এবং সন্ত্রাসবাদের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে প্রায় জোর করে। আফগান সীমান্তজুড়ে জঙ্গিবাদের বিশাল অভয়ারণ্য গড়ে তুলে পাকিস্তান একদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন মার্কিন ডলার সাহায্য লুফে নিচ্ছে। অন্যদিকে দেশটির প্রতিরক্ষা বাহিনীসহ আইন শৃংখলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটেও জঙ্গিবাদ স্থায়ী ঘাটি গেঁড়ে বসছে। গভর্নর সালমান তাসির হত্যাকাণ্ডের ঘটনা পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও আইন শৃংখলা বাহিনীর অভ্যন্তরে জঙ্গিবাদের লুকিয়ে রাখা বীভৎস ক্ষতটি আবারো নতুন করে বিশ্ববাসীর সামনে উলঙ্গ হয়ে পড়েছে।

গভর্নর তাসিরের ঘাতক মুমতাজ কাদেরি পাঞ্জাব পুলিশের অভিজাত বাহিনীর সদস্য। ১৯৯৮ সালে পাঞ্জাবের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ (নেওয়াজ শরিফের ছোটভাই) পুলিশের এই অভিজাত ইউনিট প্রতিষ্ঠা করেন। এলিট পুলিশের মূল দায়িত্ব হচ্ছে সন্ত্রাসবাদ ঠেকানো এবং রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ। এই বাহিনীর জন্য আছে আলাদা একজন মহা পরিদর্শক। লাহোরে স্থাপন করা হয়েছে আলাদা প্রশিক্ষণ একাডেমি।

বাছাই করা সদস্যদের বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত করা হয়। মুমতাজ কাদেরি ২০০২ সালে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়ে ২০০৭ সালে অভিজাত ইউনিটে পদোন্নতি পেয়ে যান। প্রায় ৮ মাস তিনি হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত তাসিরের দেহরক্ষির দায়িত্ব পালন করেন। রাওয়ালপিন্ডির সবজি বিক্রেতার পুত্র মুমতাজ দাওয়াত-ই-ইসলাম নামে একটি গ্রুপের সাথে জড়িত ছিলেন। গ্রুপটির নেতা ইলিয়াছ আক্তার কাদরির নামের সাথে মিল রেখে নিজের নামের শেষে কাদরি শব্দ যোগ করে নেন।

সংগঠনটি ব্রেলভি মতাবলম্বী। গভর্নর হত্যাকান্ডের পর ব্রেলভি সম্প্রদায়ের নেতারা প্রথম ঘাতক কাদরিকে অভিনন্দন জানান। এই গ্রুপের ৫০০ শীর্ষ ব্যক্তি তাসিরের জানাযায় অংশ না নিতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি প্রচার করেন। সম্ভবত এরই প্রতিক্রিয়ায় সালমান তাসিরের ঘনিষ্ট বন্ধু এবং দলীয় নেতা, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি তার জানাযায় অংশ নেননি। ঘাতক কাদরি নিয়মিতই ধর্মীয় গোষ্ঠীটির সাথে যোগাযোগ রাখতেন।

ধর্মীয় উগ্রবাদ পোষণের দায়ে কয়েক দফা তার উপর গোয়েন্দা নজরদারির পাশাপাশি জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। কিন্তু বাহিনীর শীর্ষে জঙ্গিবাদ ও ধর্মান্ধ ব্যক্তিদের অবস্থান মজবুত থাকায় কাদরিকে ভিভিআইপি পাহারার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া যায়নি। ২০০৯ সালে লাহোরে সফররত শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারদের নিরাপত্তার দায়িত্বেও ছিল ‘এলিট পুলিশ ফোর্স’। এ সময় শ্রীলঙ্কান টীমের উপর সন্ত্রাসী হামলায় ৬ পুলিশ নিহত এবং ৬ শ্রীলঙ্কান টিম সদস্য আহত হন। তবুও বাহিনীটি ভেঙ্গে দেয়া যায়নি।

তাসির হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে একের পর এক পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর অভ্যন্তরে গেঁড়ে বসা জঙ্গিবাদের বীভৎস ক্ষত বেরিয়ে আসছে। হত্যাকাণ্ডের পর এলিট ফোর্সের পাঁচ শীর্ষ কর্মকর্তাকে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে বরখাস্ত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, নিউইয়র্কের টাইম স্কোয়ারে গাড়িবোমা বিস্ফোরণ ঘটানোর চেষ্টার অভিযোগে আটক ফয়সাল শেহজাদের সাথে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর জনৈক মেজরের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে। পাশাপাশি দেশটির বেশিরভাগ আত্মঘাতি হামলার সাথে নিরাপত্তা বাহিনীর কোন না কোন সদস্যের সংশ্লিষ্টতার সন্দেহ দিনে দিনে ঘনীভূত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি সমীক্ষা রিপোর্টে বলা হয়েছে সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটসহ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার ভাইরাস প্রবলভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।

নতুন রিক্রুটদের মধ্যে এই প্রবণতা ভয়াবহভাবে বেশি। পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমীক্ষক আসলাম কিয়ানি বলেছেন, পাকিস্তানে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ভণ্ডামির শিকড় যেভাবে বিস্তৃত হচ্ছে, তাতে পুলিশ বা অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীকে এই সংক্রমণ থেকে কোনভাবেই মুক্ত রাখা সম্ভব নয়। কারণ তারা দেশটির ধর্মান্ধ ধারার প্রতিনিধি। ধর্মান্ধতা এবং জঙ্গিবাদ ছাড়া এরা অন্য কিছু বুঝে না। এ’অবস্থায় দেশটির বাহিনীগুলোতে শুদ্ধি অভিযান চালানো হলে ‘ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে’।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।