বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
‘লঙ্গরখানা’- এই শব্দটির অর্থ আমরা জানি। আর্তদের বিনামূল্যে খাদ্য বিতরন করার জন্য আপৎকালীন সময়ে লঙ্গরখানা খোলা হয় । এই পদ্ধতির অন্য নাম থাকতে পারে, এবং আছেও, তবে- লঙ্গরখানা শিখধর্মের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত।
অবশ্য শিখরা লঙ্গরখানা শব্দ ব্যবহার করে না, তারা কেবল লঙ্গর (ইংরেজি Langar) শব্দটি ব্যবহার করে। শিখদের উপাসনালয়কে বলা হয় গুরুদুয়ারা, লঙ্গর তারই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, লঙ্গর ব্যতীত গুরুদুয়ারা সম্ভব নয়। লঙ্গর-এর কিছু অপার মানবিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে-যা আমাদের কৌতূহলকে উশকে দেয় ...
লঙ্গর
লঙ্গর শব্দটি ফারসি। এর অর্থ: সমাজের দুঃস্থ ও নিঃস্বদের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। সুফি-দরবেশদের খানকা বা আস্তানাকেও বলা হয় লঙ্গর-ওই ফারসি ঐতিহ্যের সুবাদেই।
গুরু নানক। (১৪৬৯-১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দ ) শিখ ধর্মটি গুরু নানক এর শিক্ষার ওপরই প্রতিষ্ঠিত । যিনি বলেছিলেন: Death would not be called bad, O people, if one knew how to truly die. (হে মানুষ, মৃত্যু কি এমন, যদি তুমি জান কী ভাবে সত্যি সত্যি মরতে হয়!) গুরু নানক ১৫০২ সালে ঢাকায় এসেছিলেন। অবস্থান করেছিলেন-এখন যেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুদুয়ারা নানকশাহী-সেখানে।
লঙ্গর-এর উদ্ভব গুরু নানক-এর তরুণ বয়েসে।
শিখদেও বিশ্বাস এই রকম: নানক-এর তখন কুড়ি বছর বয়েস; তাঁর বাবা নানককে কিছু টাকা দিয়ে বললেন ব্যবসাবানিজ্য করতে। নানক দরিদ্র মানুষ দেখে বিচলিত হয়েছিলেন, তবে তিনি তাদের সাহায্য করতে পারেননি। এবার তিনি টাকা দিয়ে গরীব-দুঃস্থদের আহারের ব্যবস্থা করলেন। বাবা জিজ্ঞেস করলেন-টাকা দিয়ে কি ব্যবসা করলে শুনি? নানক বললেন, টাকা দিয়ে দরিদ্র মানুষকে খাইয়েছি। এইই হল ‘প্রকৃত ব্যবসা’ (ট্রু বিজনেস)।
এই হল লঙ্গর- এর আদি ইতিহাস।
গুরু নানক। শিখ ধর্মের মূলে ঈশ্বর-এর আরাধনা হলেও শিখরা বিশ্বাস করে ক্ষুধার্ত থেকে ঈশ্বর-এর সাধনা সম্ভব না। যে কারণে লঙ্গর ব্যতীত গুরুদুয়ারা সম্ভব নয়। কেবলি প্রার্থনাসভা শিখদের কাছে মূল্যহীন।
আমার মনে হয় এটি ভারতের ধর্মচিন্তায় পারস্যের সুফিবাদের প্রভাবের ফল। সুফিবাদী চিশতিয়া তরিকায় লঙ্গরখানা একটি অনিবার্য দিক। সুফিবাদের পূর্বে ভারতীয় ধর্মে দান-ধ্যান অবশ্যই ছিল, তবে সুফি কিংবা শিখদের প্রতিষ্ঠিত লঙ্গরখানা যে রকম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে, সেভাবে সম্ভবত ছিল না।
লঙ্গর- এ খেতে দেওয়া হয় রুটি, ডাল এবং নিরামিষ । নানক-এর সময়ে অবশ্য মাংস দেওয়া হত।
পরে মাংস বাদ দেওয়া হয়। এর কারণ, লঙ্গর-এ বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের লোকজন যেন আসতে পারে। ( বৈষ্ণবরাই ভারতবর্ষে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ) লঙ্গর কেবল শিখদের জন্য না, লঙ্গরে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত ধর্মের অনুসারিরা খেতে পারে। লঙ্গর এ নিরামিষ পরিবেশিত হলেও বিশেষ বিশেষ উৎসবে মাংস দেওয়া হয়।
শিল্পীর চোখের নানক-এর সময়ের লঙ্গর
লঙ্গরকে ‘গুরু কা লঙ্গর’ বলা হয়।
গুরু মানে গুরু নানক। ঢাকায় যে গুরুদুয়ারা রয়েছে, সেখানেও প্রতি শুক্রবার লঙ্গর -এর ব্যবস্থা করা হয়। লঙ্গর-এর মূল উদ্দেশ্য মানবজাতির সেবা। লঙ্গর-এর রান্নাঘরকে বলা হয় ‘পবিত্র রান্নাঘর’ বা ‘হলি কিচেন’। রান্নাবান্নার কাজটি করে শিখরাই, ‘হলি কিচেনে’ পেশাদার রাঁধুনি-অর্থাৎ,বাবুর্চির প্রবেশ নিষেধ।
রান্না এবং খাবার পরিবেশনায় এমন কী ছোট ছোট শিখ শিশুরাও অংশ নেয়।
লঙ্গর-এ যারা খেতে আসে তাদের বলা হয় ‘সঙ্গত’। সমাজের যে কোনও শ্রেণির মানুষের জন্যই লঙ্গর-এর দরওয়াজা খোলা। গুরু নানক-এর এমনই নির্দেশ। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় ভারতবর্ষের মানুষকে একত্ববোধের শিক্ষা দিয়েছিলেন।
জীবদ্দশায় ভারতবর্ষ ঘুরে দেখেছেন, সপ্তদশ দশকের প্রারম্ভে যে তিনি আমাদের এই ঢাকা শহরে এসেছিলেন, যে কথা প্রারম্ভেই বলেছি; ঢাকা সফরকালে থাকতেন বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, ... এখন যেটি গুরুদুয়ারা নানকশাহী, প্রতিদিন উপদেশ দিতেন নানক, ঢাকাবাসী সেসব বাণী মন দিয়ে শুনত। তিনি বলতেন: হে মানুষ, মৃত্যু কি এমন, যদি তুমি জান কী ভাবে সত্যি সত্যি মরতে হয়!
দিল্লির গুরুদুয়ারা
লঙ্গর-এ বছরের প্রতিটি দিনই দু’বার করে খাবার পরিবেশন করা হয়। দিল্লির গুরুদুয়ারায় প্রতিদিন ৫০,০০০ থেকে ৭০,০০০ সঙ্গতের খাবার আয়োজন করে! প্রতি সপ্তাহে এক কিংবা একাধিক শিখ পরিবার লঙ্গরের দায়িত্ব নেয়। পরিবারের সদস্যরা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করে । তারা বাজার, রান্নাবান্না থেকে শুরু করে খাবার পরিবেশনা, এমন কী ধোয়া মোছার কাজ পর্যন্ত করে।
এদের বলে সেওয়াদ্বার (সেবাদার? মানে যারা সেবা করে?)।
স্পেনের একটি গুরুদুয়ারার লঙ্গর। গুরু নানক যখন তাঁর যৌবনে বাবার টাকা দিয়ে ‘ট্রু বিজনেস’ করেছিলেন, অর্থাৎ দরিদ্র দুঃস্থদের খাইয়েছিলেন তখন সেই হতদরিদ্রের সংখ্যা কতই-বা ছিল। বর্তমানে শিখদের সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ এবং তা কেবল ভারতবর্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, ভারতবর্ষের বাইরেও এই গভীর জীবপ্রেম এই নানক-প্রবর্তিত মানবতা ছড়িয়ে গেছে।
তথ্যসূত্র:
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।