আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ওরিয়ানা ফ্যালাসির বর্ণনায় শেখ মুজিবুর রহমানের নির্বিচারে মানুষ হত্যা


বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইতালির বিখ্যাত মহিলা সাংবাদিক ওরিয়ানা ফ্যালাসি তত্কালীন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাত্কার নিতে ঢাকায় আসেন। ১৯৭২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের একটি সাক্ষাত্কার নেন। সেই সাক্ষাত্কার গ্রহণ এবং এর আগে-পরে তিনি দেশের যে অবস্থা দেখেছেন সেই বর্ণনা দিয়েছেন তারই ‘ইন্টারভিউ উইথ হিস্ট্রি’ গ্রন্থে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাত্কার নিতে এসে তিনি তত্কালীন বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের যে বিবরণ দিয়েছেন তার কিছু অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো। ‘রোববার সন্ধ্যা : আমি কলকাতা হয়ে ঢাকার পথে যাত্রা করেছি।

সত্যি বলতে কি, ১৮ ডিসেম্বর (১৯৭১) মুক্তিবাহিনী তাদের বেয়োনেট দিয়ে যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তা প্রত্যক্ষ করার পর পৃথিবীতে আমার অন্তিম ইচ্ছা এটাই ছিল যে, এই পাপিষ্ঠ নগরীতে আমি আর পা ফেলব না। এরকম সিদ্ধান্ত আমি নিয়েই ফেলেছিলাম। কিন্তু আমার সম্পাদকের ইচ্ছা যে আমি মুজিবের সাক্ষাত্কার নেই। ভুট্টো তাকে মুক্তি দেয়ার পর আমার সম্পাদকের এই ইচ্ছা যথার্থ ছিল। তিনি কি ধরনের মানুষ? আমার সহকর্মীরা স্বীকৃতি দিলো—তিনি মহান ব্যক্তি, সুপারম্যান।

তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি দেশকে সমস্যামুক্ত করে গণতন্ত্রের পথে পরিচালিত করতে পারেন। ’ ‘আমার স্মরণ হলো, ১৮ই ডিসেম্বর আমি যখন ঢাকায় ছিলাম, তখন লোকজন বলেছিল, মুজিব থাকলে সেই নির্মম, ভয়ঙ্কর ঘটনা কখনই ঘটতো না। মুজিব প্রত্যাবর্তন করলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। কিন্তু গতকাল (সম্ভবত ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২) মুক্তিবাহিনী কেন আরও ৫০ জন নিরীহ বিহারিকে হত্যা করেছে? টাইম ম্যাগাজিন কেন তাকে নিয়ে বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে হেডলাইন করেছে? আমি বিস্মিত হয়েছি যে, এই ব্যক্তিটি ১৯৬৯ সালের নভেম্বরে সাংবাদিক অ্যালডো শানতিনিকে এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, আমার দেশে আমি সবচেয়ে সাহসী এবং নির্ভীক মানুষ, আমি বাংলার বাঘ, দিকপাল... এখানে যুক্তির কোন স্থান নেই...। আমি বুঝে উঠতে পারিনি আমার কি করা উচিত।

’ ‘সোমবার বিকেল : হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের বাসায় যান ফ্যালাচি। ... আমরা একটা গেট দিয়ে প্রবেশ করলাম। গেটে মেশিনগানধারী মুক্তিবাহিনীর কড়া প্রহরা। ... আমি তার (মুজিবের) কাছে গিয়ে পরিচয় পেশ করলাম এবং আমার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলাম। তিনি একটু উষ্মার সাথে আমার দিকে তাকালেন।

একটু অবজ্ঞার হাসি হেসে বললেন, আমার সেক্রেটারীর সাথে কথা বল। বিকেল চারটার সময় আমি সরকারী বাসভবনে হাজির থাকতে পারলে আমাকে দশ মিনিট সময় দেয়া হবে। ’ বিকেল সাড়ে তিনটায় নগরী ক্লান্ত, নিস্তব্ধ, ঘুমন্ত মধ্যাহ্নের বিশ্রাম নিচ্ছে। রাস্তায় কাঁধে রাইফেল ঝুলানো মুক্তিবাহিনী শহর জুড়ে টহল দিচ্ছে। যুদ্ধ শেষ হয়েছে এক মাসেরও বেশি সময় আগে।

কিন্তু এখনও তাদের হাতে অস্ত্র আছে। তারা রাতদিন টহল দেয়। এলোপাতাড়ি বাতাসে গুলি ছুড়ে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে। হত্যা না করলে দোকান লুট করে। কেউ তাদের থামাতে পারে না—এমন কি মুজিবও না।

সম্ভবত তিনি তাদের থামাতে সক্ষম নন। তিনি সন্তুষ্ট এজন্য যে, নগরীর প্রাচীরগুলো তার পোস্টার সাইজের ছবিতে একাকার। মুজিবকে আমি আগে যেভাবে জেনেছিলাম, তার সঙ্গে আমার দেখা মুজিবকে মিলাতে পারছি না। ‘সোমবার সন্ধ্যা : আমি যে তার (মুজিবের) সাক্ষাত্কার নিয়েছে তা ছিল একটা দুর্বিপাক। .....আমি বলতে চাচ্ছি, কারাগার এবং মৃত্যুর ভয় ইত্যাদি সম্পর্কে কাহিনীগুলো... আমার কাছে খুব স্পষ্ট নয়।

এটা কী করে হতে পারে যে, তাকে যে রাতে গ্রেফতার করা হলো, সে রাতেই সকল প্রকার লোককে হত্যা করা হলো? কি করে এটা হতে পারে যে, কারাগারের একটি প্রকোষ্ঠ থেকে পলায়ন করতে দেয়া হলো, যেটা তার সামাধিসৌধ হতো, তিনি কি গোপনে ভুট্টোর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেছিলেন?.... ‘ঠিক চারটায় আমি সেখানে ছিলাম। ......চার ঘণ্টা অপেক্ষার পর মুজিবের সাক্ষাত্ পেলাম। তিনি বললেন, হ্যারিআপ, কুইক, আন্ডারস্ট্যান্ড? নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই, ইজ দ্যা ক্লিয়ার?। ’ শেখ মুজিবের গ্রেফতারের সময়কার অবস্থা, জেল থেকে পালানো, ভুট্টোর সঙ্গে তার সম্পর্ক—এসব বিষয়ে প্রশ্নের পর ১৮ ডিসেম্বর হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চান ফ্যালাচি। উত্তেজিত কণ্ঠে (মুজিব) ‘ম্যাচাকার? হোয়াট ম্যাসাকার,—ঢাকা স্টেডিয়ামে মুক্তিবাহিনীর দ্বারা সংঘটিত ঘটনাটি।

ঢাকা স্টেডিয়ামে কোনো ম্যাসাকার হয়নি, তুমি মিথ্যা বলছো। ’ মি. প্রাইম মিনিস্টার আমি মিথ্যাবাদী নই। সেখানে আরও সাংবাদিক ও পনেরো হাজার লোকের সঙ্গে আমিও হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছি। আপনি চাইলে আপনাকে তার ছবি দেখাবো। আমার পত্রিকায় সেই ছবি প্রকাশিত হয়েছে।

’ —মিথ্যেবাদী, ওরা মুক্তিবাহিনী নয়’। মি. প্রাইম মিনিস্টার মিথ্যাবাদী শব্দটা উচ্চারণ করবেন না। তারা মুক্তিবাহিনী। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল আব্দুল কাদের সিদ্দিকী এবং তারা ইউনিফর্ম পরা ছিল। —(মুজিব) তাহলে ওরা রাজাকার ছিল, যারা প্রতিরোধের বিরোধিতা করেছিল এবং কাদের সিদ্দিকী তাদের নির্মূল (হত্যা) করতে বাধ্য হয়েছিল।

—(ফ্যালাচি) মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার, কেউ প্রমাণ করেনি যে লোকগুলো রাজাকার ছিল এবং কেউই প্রতিরোধের বিরোধিতা করেনি। তারা ভীতসন্ত্রস্ত ছিল। হাত-পা বাঁধা থাকায় তারা নড়াচড়াও করতে পারছিল না। —মিথ্যেবাদী। —শেষবারের মতো বলছি, আপনাকে মিথ্যেবাদী বলার অনুমতি আপনাকে দেবো না।

—(মুজিবের প্রশ্ন) আচ্ছা, সে অবস্থায় তুমি কী করতে? আমি বিচারের মাধ্যমে নিশ্চিত হতাম যে, ওরা রাজাকার ওরা অপরাধী। ফায়ারিং স্কোয়াডে (বিচার শেষে) দিতাম এবং এভাবে এসব হত্যাকাণ্ড (বিচারবহির্ভূত) এড়াতাম। ওরা ওভাবে করেনি। —হয়তো আমার লোকদের কাছে বুলেট ছিল না। —(ফ্যালাচি) হ্যাঁ, তাদের কাছে বুলেট ছিল।

প্রচুর বুলেট ছিল। এখনও তাদের কাছে প্রচুর বুলেট আছে। তা দিয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত গুলি ছোড়ে। ওরা গাছে, মেঘে, আকাশে, মানুষকে গুলি করে শুধু আনন্দ করার জন্য। ’ ‘এর পরের ঘটনা : সাক্ষাত্কার নেয়ার সময় দুইজন মোটা মন্ত্রী ঘুমাচ্ছিলেন।

তাদের সঙ্গে কি যেন বললেন; কারণ আমি বুঝতে পারিনি। কথাগুলো ছিল বাংলায়। ’ সোমবার রাত : গোটা ঢাকা নগরী জেনে গেছে আমার আর মুজিবের মধ্যে কী ঘটেছে। শমশের ওয়াদুদ ছাড়া আমার পক্ষে আর কেউ নেই। লোকটি মুজিবের বড় বোনের ছেলে।

এই যুবক নিউইয়র্ক থেকে এসেছে তার মামার কাছে। তার মতে, মুজিব ক্ষমতালোভী এবং নিজের সম্পর্কে উচ্চ ধারণাসম্পন্ন অহংকারী ব্যক্তি। তার মামা খুব মেধাসম্পন্ন নয়....। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি (মুজিব) কেন বিজয়ী হয়েছিলেন? কারণ ভাসানী (মওলানা) আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। জনগণকে যদি পুনরায় ভোট দিতে বলা হয় তাহলে মুজিবের অবস্থা হবে ভিন্নতর।

যদি তিনি বন্দুকের সাহায্যে তার ইচ্ছাকে চাপিয়ে দিতে না চান। সেজন্যই মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দিচ্ছেন না এবং আমাদের স্মরণ রাখতে হবে রক্তপিপাসু কসাই, যে ঢাকা স্টেডিয়ামে হত্যাযজ্ঞ করেছিল সেই আব্দুল কাদের সিদ্দিকী তার ব্যক্তিগত উপদেষ্টা। ভারতীয় লোক তাকে গ্রেফতার করেছিল কিন্তু মুজিব তাকে মুক্ত করেছিলেন। ওই সময় ফ্যালাচি বলেন, ‘তার (মুজিবের) সবকিছু মেকি ও ভুয়া। তার শেষ পরিণতি হবে খুবই শোচনীয়।

যখন তিনি রোষান্বিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন আমি দৌড়ে বেরিয়ে এলাম এবং রাস্তায় প্রথম যে রিকশাটি পেলাম তাতেই চাপলাম। হোটেলে গিয়ে তড়িঘড়ি বিল পরিশোধ করলাম। স্যুটকেসটা হাতে নিয়ে যখন বেরুতে যাচ্ছি, ঠিক তখন দেখতে পেলাম মুক্তিবাহিনী আমার জন্য নিচে অপেক্ষা করছে। তারা একথা বলতে বলতে আমার কাছে এল যে, আমি দেশের পিতাকে অপমান করেছি এবং সেজন্য আমাকে চরম মূল্য দিতে হবে। তাদের গোলযোগের মধ্যে পাঁচজন অস্ট্রেলিয়ানের সাহায্যে শেষমেশ পালাতে সক্ষম হলাম।

তারা এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে প্রবেশ করছিল। এয়ারপোর্টে দু’জন ভারতীয় কর্মকর্তা আমাকে বিমানে উঠিয়ে দিলেন এবং আমি নিরাপদ হলাম। ’ ওরিয়ানা ফ্যালাচি ওই সময়ে রোম থেকে প্রকাশিত এল ইউরোপীয় পত্রিকায় কর্মরত ছিলেন। সত্তরের দশকের প্রায় পুরো সময় জুড়ে বিশ্বের বহু রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাক্ষাত্কার নিয়ে তিনি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। এসব সাক্ষাত্কার বিশ্বের প্রধান প্রধান সকল ভাষায় অনূদিত ও পুনঃপ্রকাশিত হয়।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফ্যালাচি স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষে জড়িত চার ব্যক্তিত্বের সাক্ষাত্কার নেন। তারা হচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান, ইন্দিরা গান্ধী, জুলফিকার আলী ভুট্টো ও হেনরি কিসিঞ্জার। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত গৃহীত ফ্যালাচির সাক্ষাত্কারগুলো ইন্টারভিউ উইথ হিস্ট্রি গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। সূত্র- আলাউদ্দিন আরিফ ওরিয়ানা ফ্যালাসি
 

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.