আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফেলানির জন্য প্রতিরোধ আন্দোলন



ভারত সীমান্তে কাটা তারের বেড়া দেয়া যেদিন শুরু করল, সেদিন থেকেই একটা বিষয় স্পষ্ট যে, ভারতের সাথে বাংলাদেশের সর্ম্পকের মাপকাঠি কোন সাংস্কৃতিক, নৃতাত্তিক কিংবা কোন চিরায়ত কুটুম্বিতার ভিত্তিতে হবে না। ভারত আগ্রাসি হয়ে উঠছে। ভারতের পররাষ্ট্রনীতি এ অঞ্চলের উদীয়মান রাষ্ট্রগুলোর জন্য হুমকি। অনেকে বলে ভারত একটি বিরাট রাষ্ট্র। ভারতের সাথে তোয়াজনীতির মনস্তাত্তিক ভিত্তি ওখানটায়।

রাষ্ট ভৌগোলক ভাবে কতটা হাতির মত, সেটা দিয়ে রাষ্ট্রের ক্ষমতা মাপা যায় না। পুরিমাপক হলো রাষ্ট্রশক্তি। রাষ্ট্রের প্রাণশক্তি। রাষ্ট্র তার নিজের নাগরিকের জীবনের মর্যাদা কতটুকু দেয় , তা দিয়ে অন্যান্য রাষ্ট্রো ওই দেশের নাগরিকের সাথে সম্পর্ক বিচার করে। ফেলানী’র মৃত্যু আবারো আমাদের মনে করিয়ে দিলো যে, ভারতের সাথে দোস্তালির মিথ যারা নিজেদের রাজনীতির জন্য প্রচার করেন, তারা বাংলাদেশের মানুষের জীবনের প্রতি দু’পয়সার কোন মায়া মমতা নাই।

তথ্য যা পাওয়া যায়, তাতে বলাই যায়, গড়ে বছরে সত্তর জনের মত বাংলাদেশের নারী, পুরুষ, শিশু, দিনমজুর,ক্ষেতে কাম করতে যাওয়া চাষী, ছাগল খুঁজতে যাওয়া কিশোরী, ছিটমহলের বাসিন্দা এদের হাত থেকে কারো রেহাই নাই। সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় বিএসএফ একতরফা যুদ্ধ জারি রেখেছে। শেষ পর্যন্ত ফেলানীকে গুলি করে হত্যা করেছে কাটাতারের বেড়ার উপর। চার ঘন্টা বেড়ার উপর পরে ছিলো এই কিশোরী। তার এলাকার খুব নিকটে।

এই দৃশ্য মনে করিয়ে দেয় ভারতের সাথে বাংলাদেশের স্বরূপ। যে কারণে আমি বাংলাদেশের মানচিত্র এখন পূব থেকে পশ্চিমে পাঠ করি। আমরা ভারতের হৃদয় ফেড়ে একেবারে বঙ্গোপসাগরের দিকে চলে যাই। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের কাছে আমরা সবাই ফেলানী। মানে বাতিল, আমাদের কোন দাম নাই।

ফেলানি মানে রাষ্ট্র নাগরিকের নিরাপত্তার প্রশ্নে সকল নাগরিককে ফেলনা মনে করে। ফেলানির জন্য দুঃখ প্রকাশ করলো বদমায়েশগুলো। আর ঠিক তাদের লোক দেখানো “ ক্ষমা” চাওয়ার চব্বিশ ঘন্টা পার হতে না হতেই রাজশাহীর মতিহার সীমান্তের থানপুর সীমান্তে আবার হত্যাযজ্ঞ চালালো এরা। দু’জনকে খুন করলো। অতএব ভারতীয় সীমান্ত রক্ষি বাহিনীর একজন সদস্যের কথাও বিশ্বাস করা যায় না।

কূটনৈতিক কুম্ভিরাশ্রু আর চাপে পড়ে শুকনা দু;খ প্রকাশ আমাদের অনবরত রক্তক্ষরণ কী করে বন্ধ করবে। কোন কোন মিডিয়া বলছে, এরা ক্ষমা চেয়েছে। কে, কোন পর্যায় থেকে কার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। কমান্ড স্ট্রাকচারের মধ্যে তাদেরকে কে এইসব হত্যাকান্ডের জন্য নির্দেশ দেয়! তাদের কী বিচার হয়! কী মেসেজ দিচ্ছে তারা। বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (সীমান্ত রক্ষী) রক্ষী বাহিনীর মত তামাশা দেখবে।

তারা বাড়ির দারোয়ানে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ এখনো পুরনো বিডিআর, হালের বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড-এর উপর ভরসা রাখে। সারা বাংলাদেশের মানুষ পদুয়ার ঘটনায়, সিলেটের জৈন্তিয়া এলাকার ঘটনায় এর রাজনৈতিক মানে ও মর্ম যে বুঝেছে সেটা ফেলানির “শহীদ” হবার পর এই ঘটনায় যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে,তাতে রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদশ যে আগামী দিনে এইসব দাদাগিরি, খুন, সাধারণ জনগণের উপর হামলা, ধরে নিয়ে যাওয়ার জবাব দেবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। রক্ষী একটি সামন্তবাদী ধারণা। গার্ড বলতে আমরা আগে বনরক্ষীদের বুঝতাম।

রক্ষী বাহিনী শেখ মুজিবকে রক্ষা করতে পারে নাই। নিজেদের জান বাচাচ্ছিল। সে-ই রক্ষী বাহিনীর অনেকেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে আত্মীকৃত হয়েছিলো। একজন তো জেনারেল পর্যন্ত হয়েছিলেন। আমরা কোন রক্ষী চাই না, আমরা স্মার্ট সৈনিক চাই।

আমাদের সীমান্তে ফেলানীর উপর হামলার কড়া জবাব দেবে সৈনিক। সীমান্ত চোকিতে বসে বসে ঝিমুবে না। কান খাড়া করে রাখবে। রাইফেল তাক করা থাকবে। কোন ভারতীয় নাগরিকের উপর হামলা করবে না।

কেবল ফেলানির উপর হামলা হলে এক ঝাঁক বুলেট ছুটে যাবে। ফেলানিকে চার ঘণ্টা কাটাতারের উপর উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেবে না। হয়ত আজই ফেলানির হাত মেহেদি রঙ্গিন হয়ে উঠত। তার বিয়ের সাজানী কার কাছে ছিল। তার বাবার কাছে কী? সীমান্তের জনগণ অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণেই ভারত-বিরোধী।

কারণ, ভারতের ভয়াবহ আচরণ তারাই প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে দেখে। তালপট্টি থেকে শুরু করে বঙ্গোপসাগেরের ম্যারিটাইম বাঊন্ডারি সব ব্যাপারে ভারতের ছাড় না দেয়া, গ্রাস, গিলে ফেলার খাই খাই নীতি আর সহ্য করা যায় না। বাংলাদশ শহিদানের দেশ। ভারত ফেলানির জন্য কী করবে জানি না। তবে মনমোহনের সফরের সময় আমরা বাংলার মানুষ কাফনের কাপড় পরে ঢাকায় ও হত্যাকান্ড ঘটেছে যে সকল এলাকায় সাদা কাপড় পরে কালো ব্যাজ পরে দাড়িয়ে থাকবো।

এটাই কর্মসূচি। পদুয়া সহ যে সব এলাকায় মানুষ হত্যা করা হয়েছে, সেখানে স্মৃতির মিনার তৈরি করুন। ঢাকা শহরে প্রতিটি বিয়ের অনুষ্ঠান ফেলানির প্রতি নিবেদন করুন। প্রতিটি সীমান্তে গণ আদালত তৈরি করুন। কীসের সীমান্ত হাট! কাটা তারের বেড়া দিয়ে জাতি হিসেবে আমাদেরকে অপমান করা হয়েছে।

এটাও বলুন, দিল্লির হিন্দী বলয়ের সরকার ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিম বাঙলা শাসনের মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক অধিকার হারিয়েছে। বিএসএফের আচরণ দেখে তো মনে হয় তারা পাকিস্তান সীমান্ত পাহারা দিচ্ছে। তাদের হত্যাকান্ডের মধ্যে বর্বোরচিত সাম্প্রদায়িকতার বিশ্রী গন্ধ পাচ্ছি। ভারত-বাংলাদেশের ১৯৭১, মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে যে কৃতজ্ঞতার রাজনীতির, হাত পা কচলান, তোয়াজের রাজনীতি সেটার বিপরীতে না দাঁড়ালে বাঙলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রাণশক্তি তৈরি করা যাবে না। রাষ্ট্র ধারণার অন্তর্গত যে “শত্রু” ধারণা তার অর্থ এই নয় যে উঠতে বসতে দুনিয়ার সকল দেশকে আমরা শত্রু জ্ঞান করতে হবে।

এর মানে হলো, অস্তিত্বের নিয়ামক শক্তি হল, শত্রু থাকা। শত্রুর অধিবাস সেনাবাহিনীর প্রস্তুতির মধ্যে, জনগণের অন্যদের সাথে মিলে মিশে দুনিয়াকে এক রাষ্ট্র করে তোলার অস্বীকৃতির মধ্যে। আমরা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র গড়ে তুলেছি। কারণ ভারত নামক রাষ্ট্র ঐতিহাসিকভাবে আমাদের রাষ্ট্র হয়ে উঠবার কোন শর্ত ছিলো না। আমরা কারো দয়ায় দেশ শাসন করিনি।

ভারতের ভূমিকা কোন ভালোবাসার প্রকাশ নয়। এটা তাদের দিক থেকে ঐতিহাসিক অনিবার্যতা। আমাদের মৌলানা ভাসানির মত দৃঢ়চেতা হতে হবে। হুজুরের তর্জনির মত আমরা খাড়া হই। আসুন, ঢাকা শহরের বুদ্ধিজীবিরা ফারাক্কা মিছিলের মত সীমান্ত মিছিলে যাই।

সীমান্তের কাছাকাছি প্রতিটি এলাকা থেকে “ সীমান্ত” মিছিল বের করুন। কসবা দিয়ে ট্রেন যাওয়ার সময় জোরে হুইসাল বাজান। ঢাকা-চিটাগাঙ হাইওয়ের যে সব জায়গায় ভারতীয় সীমান্ত হাতের নাগালের মধ্যে সেখানে দশ সহস্র বাস-ট্রাক একসাথে হর্ন দিন। আমরা প্রতিবাদ জানাতে চাই। যতটুকু সম্ভব ভারতীয় পণ্য বর্জন করুন।

ভারতের সাথে বাংলাদেশের ব্যবসা না করলেই চলবে। যা ব্যবসা করে আনি, তার চেয়ে বেশী মারোয়াড়ীরা নিয়া যায়। পুরান ঢাকায় যান, মৌলভি বাজারে যান, দেখবেন ভারত থেকে আমদানীকারক রপ্তানীকারক একই পরিবারের সদস্য। আগরোয়াল, ঠনঠনি, ঝুনঝুনিওয়ালারা চামে চামে যা রপ্তানি করে আয় করি, শতগুণে নিয়া যায়। এই হিসাব সরকার রাখেন না।

শুধু রোষ নয়, জোশ নয়, একটা গণপ্রতিরক্ষা নীতিও চাই। ভারতের বিরুদ্ধে বললেই ইসলামপন্থি, জঙ্গি- এই সব প্রপাগান্ডা দিয়ে আমাদের মুখ বাধা যাবে না। যে গণতন্ত্র মূখে “কামার” লাগিয়ে ঘাস খাওয়ায়, মাকুন্দা মার্কা রাষ্ট্র তৈরি করে, সেটা আমরা চাই না। আর ইসলামপন্থি হলে দোষ কী? হিন্দু-মুসলমানকে নিয়ে যারা রাজনীতি করেন, তারাই ভারত –বাংলাদেশে রাষ্ট্র ক্ষমতায়। আমরা অন্য রাজনীতি-মানুষের- তবে কোন বিমূর্ত মানুষের নয়, ধর্ম, জাতীয়তা, খাদ্য-ক্ষুধা,সংস্কৃতি, গান-বাজনা ও দর্শন সহ যে সজীব মানুষ- তার রাজনীতি করি।

বিমূর্ত পশ্চিমা মানবতাবাদী রাজনীতি নয়, মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের, রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্কের, প্রাণ ও প্রকৃতির রাজনীতি করি। আসুন, সীমান্ত হত্যা প্রতিরোধ মঞ্চ গড়ে তুলি। ফেলানি তো লাল টুকটুকে বউ হতে পারলো না। তার বুক থেকে লাল টুকটুকে রক্তধারা গড়িয়ে গড়িয়ে তিস্তা, দুধকুমার, রুপকুমারের সব পানি আজ লাল।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.