আপনাকে স্বাগতম!
“আজিকে হয়েছে শান্তি, জীবনের ভুলভ্রান্তি, সব গেছে চুকে।
রাত্রিদিন ধুক ধুক, তরঙ্গিত দুঃখসুখ, থামিয়াছে বুকে।
যত কিছু ভালোমন্দ, যত কিছু দ্বিধা দ্বন্দ্ব, কিছু আর নাই।
বলো শান্তি, বলো শান্তি, দেহ সাথে সব ক্লান্তি, হয়ে যাক ছাই। ”
(মৃত্যু পরে/ রবীন্দ্রনাথ)
বস্তুগত দুনিয়ায় মানুষের দু’টি শ্রেণী আছে: যাদের নেই এবং যাদের আছে।
কথার বলে, নেংটার নেই ছিনতাইয়ের ভয়। পৃথিবীতের যার সম্পদ নেই, ক্ষমতা নেই, নাম-যশ কিছুই নেই, তার পক্ষে মৃত্যুবরণ করাটা একটু স্বস্তিরই। প্রতিবেশীরা বলে, বেটা মরে বেঁচে গেলো। বিষয়টি কত নিষ্ঠুর অথচ কত সত্য! অন্যদিকে যাদের উপরোক্ত সবকিছুই আছে তাদের মৃত্যুই যেন ‘সবকিছুর মৃত্যু’ ঘটায়। এ দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষগুলোর পক্ষেই মৃত্যুকে মেনে নেওয়া কঠিন।
তাদের বিষয় নিয়েই আজকের লেখা। খ্যাতিমানদের মৃত্যু-মুহূর্তের শেষ কথাগুলো যেন একটি জানালা খুলে দেয় আমাদের জন্য। এ জানালা দিয়ে তাকালে তাদের কর্ম ও মনস্তত্বকে অবলোকন করার সুযোগ হয়।
মৃত্যুর পূর্বে মানুষ কী বলে, তা জানার আমার আজন্ম আগ্রহ। মনে হয়, অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই।
মৃত্যুপথযাত্রী যাবার বেলা কী বলে গেলো, কার সাথে তার সর্বশেষ কথা হয়েছিলো – এগুলো কে না জানতে চায়! অখ্যাত অনেকেরই কথা আমার স্মৃতিতে আছে। এবার সুযোগ নিলাম প্রখ্যাতদের সম্পর্কে জানার। বিষয়গুলো অনেকেরই চিন্তার দরজাকে খুলে দিয়ে ভাবনার সাগরে ফেলে দেবে। কবিরা কবিতা লেখবেন, গল্পকাররা পাবেন নতুন চরিত্র। নিচে কয়েকজন খ্যাতিমান ব্যক্তির জীবন সায়াহ্নের শেষ মুহূর্তের কথাগুলো নিয়ে আলোচনা করলাম।
লেখার ‘বিষয়বস্তুর’ মতো পাঠকের মন্তব্যও আমার কাছে অনেক আকাঙ্ক্ষিত!
১) প্রথম এলিজাবেথ – মৃত্যু ১৬০৩, ইংল্যান্ডের রানী।
“আমার সকল সম্পদ একটি মুহূর্তের জন্য। ”
ইউরোপিয়ান সাহিত্যে এলিজাবেথান যুগের প্রবর্তনকারী কুমারি রানী এলিজাবেথ বিভিন্ন কারণেই ইতিহাসে বিখ্যাত। ব্রিটিশ রাজা অষ্টম হেনরি’র কন্যা। ব্রিটিশ রাজনীতিতে তিনিই প্রথম কাউন্সিল বা উপদেষ্টা প্রথার শুরু করেন।
শাসন কার্যে একনায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ না হয়ে একদল উপদেষ্টা বা মন্ত্রীর পরামর্শে তিনি দেশ পরিচালনা করতেন। কুমারি ছিলেন, আমৃত্যু কুমারিই থেকে গেলেন রানী এলিজাবেথ। অনেকের ধারণা ছিলো টিউডর রাজবংশের শেষ উত্তরাধিকারী হিসেবে তিনি হয়তো বিয়ে করে উত্তরাধিকার রেখে যাবেন। তা তিনি করেন নি। সম্পদ বা ক্ষমতায় তা লোভ যে ছিলো না, তা তার শেষবাক্যে বুঝা যায়।
২) নবম লুই, মৃত্যু ১৭১৫, ফ্রান্সের রাজা।
“কেন কান্না করছো? তোমরা কি ভেবেছিলে আমি অমর?”
বাহাত্তর বছর রাজক্ষমতায় থাকলে তো মানুষের এরকম ধারণা হবেই! তার ওপর তিনি বিশ্বাস করতেন যে, রাজারা ঈশ্বর কর্তৃক নিযুক্ত হন। ফরাসি রাজ চতুর্দশ লুই রাজক্ষমতায় ঐশ্বরিক বা স্বর্গীয় প্রভাবে বিশ্বাসী ছিলেন। প্রতিবেশী ডাচ, স্প্যানিশ ইত্যাদি শক্তিধর প্রতিপক্ষের সাথে কঠিন অসম্ভব শক্তি দেখিয়ে বিজয় অর্জন করেন এবং ফরাসি বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত প্রবল পরাক্রমে দেশ শাসন করেন। তখনকার বিশ্বেও চতুর্দশ লুইয়ের নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র ছিলো সুপরিচিত।
৩) জর্জ ওয়াশিংটন – মৃত্যু ১৭৯৯, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেজিডেন্ট।
“আমার মৃত্যু কঠিন, কিন্তু আমি যেতে ভয় পাই না। ”
উত্তর আমেরিকানদের জাতির পিতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেজিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন তার দীর্ঘদিনের বন্ধুকে কথাগুলো বলেছিলেন। স্ত্রীকে বললেন, “ড্রয়ার থেকে দু’টি কাগজ বের করে নিয়ে এবং একটি রেখে অন্যটি পুড়িয়ে দাও। ওগুলো আমার উইল।
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পূর্বে আমার মৃতদেহ নিয়মমতো তিন রাখো। ” মৃত্যুকে একটি দৈনন্দিন বিদায়ের মুহূর্ত হিসেবে মেনে নিয়ে, পৃথিবীর সফলতম ব্যক্তিটি এভাবেই তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দু’টি মেয়াদে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় ছিলেন। পরবর্তিতে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু রাষ্ট্রিয় দায়িত্বে থাকলেও প্রশাসনের গভীরে আর প্রবেশ করতে চান নি জর্জ ওয়াশিংটন।
৪) প্রাশিয়ার রাণী লুইজ, মৃত্যু ১৮২০।
“আমি একজন রানী। কিন্তু নিজের হাতগুলোও নাড়াবার ক্ষমতা আমার নেই। ”
প্রাশিয়ার রাজা ফার্দিনান্দ (১৭৩০-১৮১৩)এর স্ত্রী। প্রাশিয়া বর্তমানে জার্মানির সাথে যুক্ত।
৫) এন্ড্রু জ্যাকসন, মৃত্যু ১৮৪৫, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেজিডেন্ট।
“আহা, কান্না করো না। ভালো মানুষ হও, দেখা হবে স্বর্গে। ”
যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকার ৭ম রাষ্ট্রপতি এন্ড্রু জ্যাকসন ব্যক্তি স্বাধীনতার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ইতিহাসে সমাদৃত। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ডেকোক্র্যাটিক পার্টির প্রতিষ্ঠাতা। “সাহসী মানুষ সংখ্যাগরিষ্টের সমর্থন পায়” উক্তির জন্য বিখ্যাত।
প্রেজিডেন্ট এন্ড্রু জ্যাকসন যেমন প্রভাবশালী ছিলেন, তেমনি ছিলেন প্রবল আগ্রাসী ও বিতর্কিত। তিনজন দত্তক সন্তান ছিলো। অন্তিমকালে ভালো হবার চেতনা প্রবল হয়ে এসেছিলো এবং তা-ই বিতরণ করে গিয়েছেন জীবনের শেষ মুহূর্তে।
৬) গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড, মৃত্যু ১৯০৮, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেজিডেন্ট।
“সঠিক কাজটি করতে আমি কঠিন চেষ্টা করেছি।
”
যুক্তরাষ্ট্রের ২২ ও ২৪তম প্রেজিডেন্ট। ক্লিভল্যান্ড মরলেন ঠিক সেভাবে, যেভাবে তিনি বেঁচেছিলেন – আত্মনিয়ন্ত্রিত। থিওডর রুজভেল্ট তার শ্রদ্ধাঞ্জলিতে তাকে ‘সুখী যোদ্ধা’ বা হ্যাপি ওয়ারিয়র হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। তিনি সম্মানজনভাবে দু’টি আলাদা মেয়াদে প্রেজিডেন্ট হবার বিরল মর্যাদা তিনি পেয়েছিলেন, কারণ তিনি জানতেন প্রেজিডেন্ট হওয়া মানে হলো ‘জনগণের আস্থা’।
মতাদর্শে ভিন্ন হলেও ভেনিজুয়েলা তাদের জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রেখেছিলো।
অন্যের মতামত দিয়ে যদি কাউকে বিচার করতে হয়, তবে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড সঠিক কাজটি করার চেষ্টা করেছেন।
৭) উডরো উইলসন – মৃত্যু ১৯২৪, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেজিডেন্ট।
“আমি প্রস্তুত। ”
যুক্তরাষ্ট্রের ২৮তম প্রেজিডেন্ট হিসেবে টমাস উডরো উইলসন দু’টি মেয়াদ কাঠিয়েছেন, ১৯১৩ থেকে ১৯২১। “কোন কিছুতে সংস্কার এনে দেখুন কীভাবে শত্রু তৈরি হয়!” – তার বিখ্যাত উক্তি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় উত্তর আমেরিকাকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং লীগ অভ নেশনস গড়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যার বর্তমান রূপ জাতিসংঘ। সংবিধানে সংশোধনী এনে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নারীদেরকে ভোটাধিকার প্রদান করেন। বিশ্ব শান্তি এবং নারী অধিকারের জন্য ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন যিনি, তিনি তো বলতেই পারেন, “আমি প্রস্তুত!”
৮) বেনিটো মুসলিনি – মৃত্যু ১৯৪৫, ইটালির একনায়ক শাসক।
“আমার বুকে গুলি করো। ” মৃত্যুদণ্ড কার্যকারীদের প্রতি।
ভূমিকা নিষ্প্রয়োজন। ইটালির ২৭তম প্রধানমন্ত্রী এবং ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টির প্রধান বেনিটো মুসলিনি। কুদেতা বা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন ফ্রাসিস্ট ও উগ্র জাতিয়তাবাদী মুসলিনি। গুপ্তঘাতক দ্বারা অনেকবারই আক্রান্ত হয়েছেন – তারা নাক পর্যন্ত সফল হয়েছিলো! ব্যর্থতার শাস্তি হিসেবে কাউকে তাদের কাউকে কাউকে একই স্থানে মরতে হয়েছে। তাই মৃত্যুদণ্ডের সময় বুকে গুলি করার পরামর্শ দেওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
৯) এডলফ হিটলার, মৃত্যু ১৯৪৫, জার্মানির রাষ্ট্রনায়ক ও সামরিক প্রধান।
“আত্মসমর্পনের অপমান এড়ানোর জন্য আমি এবং আমার স্ত্রী আত্মহত্যাকে বেছে নিলাম। শেষকৃত্য সম্পর্কে আমাদের ইচ্ছা হলো, তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের মৃতদেহকে পুড়িয়ে ফেলা হোক সে স্থানে যেখানে আমি আমার বিগত বিশ বছরের জনসেবার গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলো কাটিয়েছি। ” আত্মহত্যাপূর্ব চিরকুট (সুইসাইড নোট)।
এপ্রিলের ২৯ তারিখে ইভা ব্রাউনের সাথে বিয়ে এবং ৩০ তারিখে আত্মহত্যা! হিটলার নিজ গুলিতে, ইভা সায়ানাইড ক্যাপসুলে।
পরম মিত্র ইটালির একনায়ক মুসলিনির নিহত হবার একদিন পর হিটলার আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। হিটলারের জনপ্রিয়তা তার মৃত্যুর সাথে সাথে উদাও। শত্রু-আক্রান্ত জার্মানিতে সহযোদ্ধারা নিজ প্রাণ রক্ষাতেই ব্যস্ত - শোকাহত হবার সময় পায় নি। তবে জার্মানিরা তাকে যেভাবেই দেখুক, হিটলারের মৃত্যুর সাথে সাথে ইউরোপে জার্মান আধিপত্যের অবসান হয়।
১০) সাদ্দাম হুসেন, মৃত্যু ২০০৬, ইরাকের প্রেজিডেন্ট।
মৃত্যুদণ্ডের পূর্বে।
“আল্লাহ ছাড়া মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ সা. আল্লাহ’র প্রেরিত রাসুল। ”
পূর্ব পশ্চিমের সকল গণমাধ্যমে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিলো সাদ্দাম হুসেনকে দেওয়া পাশবিক মৃত্যুদণ্ডের এমেচার ভিডিওটি যখন ছড়িয়ে পড়েছিলো। বিবিসি, টাইমস এবং দ্য হিন্দু এটিকে মধ্যযুগীয় মৃত্যুদণ্ড বলে আখ্যায়িত করেছিলো। তৈল-কেন্দ্রিক বিশ্ব রাজনীতির কথা না হয় বাদই দিলাম! পৃথিবীর ক্ষমতাবানদের হাতেই ধর্ম বলে অনেকে মেইভারিক মন্তব্য করে থাকেন।
কিন্তু সাদ্দাম হুসেন যেভাবে একেশ্বরবাদকে ফাঁসির মঞ্চ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাতে শুধু ধর্ম নিয়ে নয়, ঈশ্বরের পরাক্রম নিয়েও নতুন করে ভাবা উচিত। নিজেকে বিলীন করে দিয়েও নিজের বিশ্বাসকে অটুট রেখে সাদ্দাম শেষ মুহূর্তে সমালোচকদেরকে নিজের পক্ষে রেখে গেলেন!
*তৃতীয় অর্থাৎ শেষ পর্বে ‘বিখ্যাতদের’ জীবনের শেষ কথা নিয়ে আলোচনা করা হবে
** ছবি যোগ করা গেলো না কোন মতেই
_________________________________________________
মৃত্যুকথার পর্ব ১: জীবন ও মৃত্যুর অজনা বন্ধন
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।