আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চলনবিলের দেশে রবি ঠাকুর

বসন্তে মাতাল আমি এক অপূর্ণতা ...
‘এখানে যেমন আমার মনে লেখবার ভাব এবং লেখবার ইচ্ছা আসে আর কোথাও না ৷' নওগাঁয় পতিসরে বসে একথাই লিখেছিলেন ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরান। কবির নিজস্ব জমিদারই শুধু জমিদারিই ছিল না বরঞ্চ এখানকার সৌন্দর্যের মুগ্ধতায় প্রাণ এর নোঙর করেছিলেন এখানে। বর্ষাকালের পতিসর কবির মনে দাগ ফেলে কেননা চলনবিল,আত্রাই আর নাগর বর্ষাকালে কবির সাহিত্য খাতায় পুর্ণতা এনেছিল। বর্ষাকালে এটা চলনবিলের দেশই ছিল বটে! নাগর নদীর পাড়ে পতিসর কালিগ্রাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজস্ব জমিদারি হলেও পিতামহ প্রিন্স দারকানাথ ঠাকুরের কেনা শাহজাহাদপুরের জমিদারি তাঁকে দেখতে হয়েছে পাঁচ বছর ৷ প্রথম তিনি সেখানে আসেন ১৮৯০ সালের জানুয়ারি মাসে ৷ শাহাজাহাদপুর পতিসরের কাছারি বাড়িতে এখন রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত জিনিসপত্রের অবশিষ্ট যা আছে তার কিছু প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংরক্ষণ করলেও নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক কিছুই উদ্ধার হয়নি এখনও ৷ রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এই জমিদারি কেনেন ১৮৩০ সালে। কালীগ্রাম পরগণার সদরদপ্তর ছিল পতিসর।

'পতিসর' নওগাঁর আত্রাই উপজেলার একটি গ্রামের নাম। আত্রাই উপজেলা সদর থেকে পূর্বদিকে ১৪ কিলোমিটার দূরে দুর্গম এলাকায় অবস্থিত। নাগর নদের তীরের এই পতিসরেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কাচারি বাড়ি। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরপরিবারের তত্কালীন পূর্ববঙ্গে তিনটি জমিদারি ছিল। নদীয়া (বর্তমান কুষ্টিয়া) জেলার বিরাহিমপুর (সদর শিলাইদহ) পরগণা, পাবনা জেলার সাজাদপুর পরগণা (সদর সাজাদপুর) এবং রাজশাহী জেলার কালীগ্রাম পরগণা (সদর পতিসর)।

কবি-জমিদার রবীন্দ্রনাথ কখনো শিলাইদহ থেকে, কখনো সাজাদপুর থেকে, কখনো আত্রাইঘাট রেল স্টেশন থেকে নিজস্ব বোটে পদ্মা, করতোয়া, বড়াল, আত্রাই, নাগর এবং চলনবিল পেরিয়ে জমিদারি তদারকের জন্য পতিসর আসতেন। পতিসর এলাকার মানুষের সাথে রবীন্দ্রনাথের প্রাণের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পতিসরই হয়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের উন্নয়ন ও পরিকল্পনার প্রাণকেন্দ্র। এখানে প্রজাদের কল্যাণে অনেক জনহিতকর কাজ করেন তিনি। পতিসরে কৃষিব্যাঙ্ক স্থাপন, রাস্তা-ঘাট, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, দাতব্য চিকিত্সালয় স্থাপন, রেশম চাষ, সমবায় পদ্ধতি, বিচারব্যবস্থা, পুকুর-দিঘি খনন, চাষাবাদের জন্য কলের লাঙলের প্রচলন, তাঁতে কাপড় বোনা, গ্রাম্য শিল্প প্রচলন, মাছের ব্যবসা, দুর্ভিক্ষের জন্য ধর্মগোলা স্থাপন ইত্যাদি।

পতিসর এলাকায় এ ধরনের সমস্যা ছিল না। সে জন্য তিনি পতিসরকেই বেছে নিয়েছিলেন বিভিন্ন উন্নয়নমূলক সংস্কার কাজের ক্ষেত্র হিসেবে । কালীগ্রাম পরগণায় বিভিন্ন উন্নয়নমূলক ও সংস্কারকাজের জন্য প্রজাদের নিয়ে 'কালীগ্রাম হিতৈষী সভা' গঠন করা হয়। পাঁচজনকে নিয়ে কেন্দ্রীয় হিতৈষী সভা গঠন করা হয়। এই পাঁচজন ছাড়াও কেন্দ্রীয় হিতৈষী সভায় জমিদারের একজন প্রতিনিধি থাকে।

কাজের সুবিধার জন্য সমগ্র পরগণাকে তিন ভাগে ভাগ করে তিনটি 'বিভাগীয় হিতৈষী সভা' গঠন করা হয়। প্রজাদের খাজনার প্রতি টাকার সঙ্গে তিন পয়সা অতিরিক্ত আদায় করে হিতৈষী সভার তহবিল গঠন করা হয়। প্রজারা স্বেচ্ছায় চাঁদা দিয়ে এই তহবিল গঠন করত। হিতৈষী সভা প্রথমে শিক্ষাব্যবস্থার কাজে হাত দেয়। হিতৈষী সভা কয়েকটি গ্রামে পাঠশালা, তিনটি মধ্য ইংরেজি স্কুল ও পতিসরে একটি হাই স্কুল স্থাপন করে।

রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'পিতৃ স্মৃতি' গ্রন্থে বলেন, 'সারা পরগণার মধ্যে শিক্ষার কোন ব্যবস্থাই পূর্বে ছিল না। অবস্থাপন্ন লোক তাদের ছেলেদের নাটোর, আত্রাই, বগুড়া প্রভৃতি শহরে পাঠাতো স্কুলে পড়াবার জন্য। ' পতিসরে কৃষির উন্নতি করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন। কারণ পতিসর অঞ্চলটা এক-ফসলে। অঞ্চলটা নিচু হওয়ায় বছরের বেশির ভাগ সময় ফসলের মাঠ পানির নিচে থাকে।

শুষ্ক মৌসুমেও মাটি কঠিন হয়ে থাকে, লাঙল চলে না। ১৩১৫ সালে তিনি কোন এক কর্মীকে লিখছেন: প্রজাদের বাস্তুবাড়ি ক্ষেতের আইল প্রভৃতি স্থানে আনারস, কলা, খেজুর প্রভৃতি ফলের গাছ লাগাইবার জন্য তাহাদিগকে উত্সাহ করিও। আনারসের পাতা হইতে খুব মজবুত সুতা বাহির হয়। ফলও বিক্রয়যোগ্য। শিমুল আঙ্গুর গাছ বেড়া প্রভৃতির কজে লাগাইয়া তাহার মূল হইতে কিরূপ খাদ্য বাহির করা যাইতে পারে তাহাও প্রজাদিগকে শিখানো আবশ্যক।

আলুর চাষ প্রচলিত করিতে পারিলে বিশেষ লাভের হইবে। ' রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পতিসরে কুটিরশিল্প বিস্তারে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। একজন মুসলমান জোলাকে শান্তিনিকেতনে পাঠানো হয়েছিল প্রশিক্ষণের জন্য। কুটিরশিল্পের ওপর প্রশিক্ষণ শেষে ওই জোলাকে পতিসর নিয়ে এসে তাকে শিক্ষক করে একটি বয়ন শিক্ষার স্কুল খোলা হয়। এখানে তিনি রচনা করেছেন অনেক কালজয়ী সাহিত্যকর্ম এখানে তিনি রচনা করেন দুর্লভ জন্ম, মেঘদূত, পল্লীগ্রাম, মধ্যাহ্ন, সামান্য লোক, খেয়া, বন, তপোবন, অনন্তপথে, ক্ষণমিলন, প্রেম প্রভৃতি কবিতা।

বিখ্যাত গান—বিধি ডাগর আঁখি, বধূ মিছে রাগ করো না, জলে-ডোবা চিকন শ্যামল, আমি কান পেতে রই, তুমি নবরূপে এসো প্রাণে প্রভৃতি। ছোট গল্প—প্রতিহিংসা, ঠাকুরদা, কাদম্বরী। উপন্যাস—'গোরা' ও 'ঘরে-বাইরে'র অংশ বিশেষ। এ ছাড়া বেশকিছু প্রবন্ধ, ছিন্ন পত্রাবলি এই পতিসরে রচিত। স্বাভাবিক ভাবেই রবীন্দ্রনাথ যে পদ্ধতিতে কৃষি তথা ভূমি-অর্থনীতির ব্যবহারিক দিক থেকে রায়ত-উত্পাদন-উপাদানব্যবস্থার ভেতরে কৃষিফসল ফলানোর উন্নতির পথ অবলম্বন করে দেখিয়েছেন, তা অবশ্যই 'রবীন্দ্র-কৃষি-উন্নয়ন মডেল' বলেই স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি রাখে।

রবীন্দ্রনাথ পতিসরে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তাঁর সাধের পল্লিসমাজ (স্বদেশি সমাজ), সচ্ছল শিক্ষিত স্বনির্ভর গ্রাম। আজ থেকে একশ বিশ বছর আগে পতিসর ঘিরে এই ছিল রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন। অথচ প্রথমে রবীন্দ্রনাথের ভালোই লাগেনি পতিসর। একসময় এতোটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তার সাহিত্য ভান্ডারে এর প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। নোবেল পুরষ্কারের ১ লক্ষ ৮ হাজার টাকা এখানকার কৃষি ব্যাঙ্কে যোগান দেন।

১৮৪০ সালে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, নাটোরের রানি ভবানীর জমিদারির অংশ ডিহি শাহজাহাদপুর ১৩ টাকা ১০ আনায় কিনলে ইন্দো-ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত দ্বিতল ভবনটি পান ঠাকুর পরিবার ৷ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ১৯৬৯ সালে এ বাড়িটি সংরক্ষিত ঘোষণা করে এখানে প্রতিষ্ঠা করে জাদুঘর ৷ কবির শখের জিনিসপত্রের পাশাপাশি তাঁর ব্যবহার করা নানা ধরনের সামগ্রী এ জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হলেও কবিগুরুর স্মৃতি সম্বলিত অনেক কিছুই এখনো রয়ে গেছে ব্যক্তিগত বা প্রতিষ্ঠানিক সংগ্রহে৷ যেমন শাহজাহাদপুর পাইলট হাই স্কুলে ভিজিটরদের মতামত খাতায় রবীন্দ্রনাথের লেখা মতামত এখনো রয়েছে ওই বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হেফাজতে ৷ ১৮৯০ সালের ২০ জানুয়ারি রবীন্দ্রনাথ শাহজাহাদপুর কাছারি বাড়ির কাছেই ওই বিদ্যালয় পরিদর্শনের সময় স্কুল সম্পর্কে ব্যক্তিগত মতামত লেখেন৷ বিদ্যানুরাগী ঠাকুর পরিবারের মুখ্য স্থপতি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর শাহজাহাদপুরে প্রতিষ্ঠা করেন কিরণবালা প্রাথমিক বিদ্যালয় আর তাঁর পৌত্র রবীন্দ্রনাথ পতিসরে ছেলে রথীন্দ্রনাথের নামে স্থাপন করেন আরেকটি বিদ্যালয় ৷ ওই বিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে এখনো রক্ষিত আছে রবীন্দ্রনাথ ও পুত্র রথীন্দ্রনাথের লেখা গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো চিঠি ৷ কিভাবে যাবেন: নওগাঁর আত্রাই স্টেশনে সবার আগে পোঁছতে হবে। এ জন্য সবচেয়ে ভালো মাধ্যম ট্রেন যোগাযোগ। রাজধানী থেকে দিনাজপুরগামী একতা এক্সপ্রস, দ্রুতযান এক্সপ্রেস, লালমনিরহাটগামী লালমনি এক্সপ্রেস, নীলফামারীগামী নীলসাগর এক্সপ্রেস, রংপুরগামী রংপুর এক্সপ্রেসে নাটোর কিংবা আত্রাইয়ে নামতে পারেন। আত্রাই স্টেশনের নিচের দিকে স্থানীয় কিছু যানবাহন আছে সেখান থেকে ১৪ কিঃমিঃ দুরত্বে পতিসরে সহজেই যেতে পারেন। এছাড়া বাসে নাটোর কিংবা নওগাঁ গিয়ে সেখান থেকেই চলে যেতে পারেন পতিসর।

থাকবেন কোথায়: নাটোর কিংবা নওগাঁতে যে কোন হোটেলে থাকতে পারেন অথবা পতিসরে জেলাপরিষদের বাংলোতেও থাকতে পারেন। এ জন্য প্রথমেই বুকিং দিতে হবে। বর্ষাকালে যেতে পারেন চলনবিলের আসল সৌন্দর্য দেখতে পাবেন। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে যেতে পারেন। কারন এই সময় বিভিন্ন আয়োজন থাকে সেখানে।

পত্রিকা লিঙ্ক- চলনবিলের দেশে রবীন্দ্রনাথ
 

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।