সবুজের বুকে লাল, সেতো উড়বেই চিরকাল
আমাদের জাতিয় জীবনে অর্জন খুব বেশি কিছু না। গার্মেন্টস, জনশক্তি রফতানি এবং জাতিসংঘ শান্তি মিশনে দ্বিতীয় বৃহত্তম সেনাদল। ১৬ কোটি আবাদির এই ভুমে মাত্র এই তিনটি উল্লেখযোগ্য অর্জন। আর হ্যা! ক্রিকেটে হঠাৎ হঠাৎ জ্বলে উঠে বাংলাদেশ চিৎকার করে তার আগমনি জানান দিচ্ছে।
সেই ক্রিকেটের বিশ্বকাপের আসর বসছে ।
ভারত শ্রীলংকার সাথে সহ আয়োজক বাংলাদেশ। উদ্বোধনি অনুষ্ঠানটা করার সৌভাগ্য বাংলাদেশের। এ নিয়ে উচ্ছাস আর আবেগের কমতি নেই। কিন্ত সেই আনন্দ আর উল্লাসে জল ঢেলে দেবার মত করেই, সেখানে বলিউড তারকাদের দিয়ে আমাদের সংস্কৃতি উপস্থাপনের পরিকল্পনাই নাকি চুড়ান্ত করা হয়েছে। অনেকে অবশ্য বলছে, ৫০ মিনিটের এই অনুষ্ঠানে তিন আয়োজক দেশেরই নাকি সংস্কৃতিকে তুলে ধরা হবে।
মাত্র ৫০ মিনিটেরর অনুষ্ঠানে এত কিছু কি সম্ভব হবে? তাছাড়া ক্রীড়াঙ্গনে এই ধরনের অনুষ্ঠানে মুলত আয়োজক দেশেরই সংস্কৃতি একচ্ছত্র প্রাধান্য থাকে। (দ্রস্টব্য দিনমজুর ভাইয়ের মন্তব্য, নীচের লিংকে)
Click This Link
সেখানে শ্রেফ বলিউড থেকেই কেন এতজন তারকাকে আনা হচ্ছে, সেই প্রশ্ন সবাই করছেন।
যারা আয়োজন করছেন, সেই এ টি এন বাংলার কিন্ত মান সম্মত অনুষ্ঠান প্রচারের কোন রেকর্ড নেই। যিনি এই সংস্থাটির কেউকেটা, তার রুচিবোধ নিয়েও বিশাল প্রশ্নবোধক চিহ্ন রয়েছে। তিনিই আবার ঘটা করে ইন্ডিয়াতে গিয়ে বচ্চন পরিবার সহ বেশ কিছু বলিউড তারকাকে নিমন্ত্রন করে এসেছেন।
তাই ইন্ডিয়ার দিকে আঙ্গুল তোলার অবকাশ নেই।
লেখালেখি কিংবা বক্তৃতা বিবৃতি অথবা শ্রেফ কথাবার্তাতে হলেও ভারতীয়রা নিজেদের দেশকে ভারতবর্ষ হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। অথচ ভারতবর্ষ ভেঙ্গে যে আরো দুটো স্বাধীন দেশের অস্তিত্ব আছে, সেটা তারা স্বীকার করতে চান না। এটি এক ধরণের সাইকলজিকার ম্যানুপুলেশনের মধ্যে পড়ে। অর্থাৎ অখন্ড ভারতের একটা আগাম বার্তা দিয়ে রেখে বিশ্ববাসিকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে রাখা।
বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনি অনুষ্ঠানে স্বাধীন বাংলাদেশে বলিউডের নর্তন কুদনকে সেই চর্চার অংশ বলেই মনে হচ্ছে। আমাদের বুকে বসে আমাদেরই দাড়ি ছেড়ার আয়োজন, অথচ আমাদেরই কোন বিকার নেই।
বিকার থাকবেই বা কি করে? আমাদের নারী সমাজ আর কিশোর কিশোরি তরূন তরুনী, হিন্দিতে এমনই আচ্ছন্ন যে, হিন্দিকেই ওরা অনেক চেনা আর আপন মনে করে রেখেছে। তাই বাংলাদেশের মঞ্চে বলিউডের তারকাদের দাপাদাপিকে ওরা বিজাতিয় বলে ভাবতেও পারবে না।
আর সেখান থেকেই আমাদের সংস্কৃতির শবযাত্রা শুরু হবে।
বহু বছর আগে আমাদের তরুণদের যে দুরদর্শিতা ছিল, উর্দুর প্রভাবশালি রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা কিংবা উর্দুর ছবির চাকচিক্য সেই দুরদর্শিতাকে ম্লান করতে পারেনি। বুকের রক্তে রাজপথ রক্তিম করে দিয়েও বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ঝান্ডা দিগন্তমুখি করে রেখেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় ৩০ লক্ষ অমাউষের আত্মদান আর কয়েক লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের দামে বাংলা নামের দেশ, ভাষা আর সংস্কৃতি বিশ্বমানচিত্রে স্থান পেয়েছিল।
বুকের রক্ত দিয়ে যে উর্দু আর উর্দুভাষিদের সীমানা ছাড়া করা হয়েছিল, সেই পুণ্যভুমিতে উর্দুরই সহোদর কি সুন্দর জেকে বসেছে। বাংলা, হিন্দি আর অশুদ্ধ ইংরেজির মিশেলের এমন জগাখিচুড়ি ভাষাভাষিরাই আগামিতে বাংলাদেশের চালক হবেন, ভেবে আতংকিত হতেই হয়।
২০১০ সালকে যদি ব্যাবচ্ছেদ করা যায়, তবে দেখা যাবে ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের প্রাপ্তিটা নিরেট শুন্য। অবশ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ভারতের সুপ্রতিবেশিসুলভ আচরনের একটিও নজির নেই। আর ক্ষমতায় ভারত বান্ধব সরকার থাকায়, সোনায় সোহাগা। তাই দেশের সংস্কৃতিকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরার এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেলেও, সরকার নিরব। নিরব নিরপেক্ষতার বেশধারি সুশিল সমাজ কিংবা বুদ্ধিজীবি মহল।
অদ্ভুত নিস্পৃহতায় অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে রেখেছে প্রভাবশালি মিডিয়া আর সমাজের বিবেক বলে পরিচিতি অর্জনপ্রাপ্তরা।
সামওয়্যার ইন দা ব্লগ সেক্ষেতে ব্যাতিক্রম বটে। দেশে বর্তমানে বিদ্যমান ফ্যাসিজমের কালো থাবা এখনও একে গ্রাস করতে পারেনি বলে, মনে চেপে থাকা কথা বলার সুযোগ কিছুটা হলেও আছে।
আর তাই চোখের সামনে নিজের দেশ ও সংস্কৃতির সম্ভাব্য অপমানের প্রতিবাদে, লেখকদের লেখনি গর্জে উঠেছে এই ব্লগে। সুখবর হলো, বাংলা ভাষাভাষি অন্যান্য ব্লগেও একই ধরণের প্রতিবাদ শুরু হয়েছে।
লিংক দেখুন।
http://www.nagorikblog.com/node/3494
স্থান কাল পাত্র বিবেচনায় সামুতে প্রকাশিত প্রতিবাদি ওই লেখাটি অনেকেই স্টিকি করার আবেদন করেছেন।
Click This Link
লেখাটিতে আবেগ উদ্ভুত কিছু শব্দ লেখাটির আবেদনকে খাটো করছিল বিধায়, লেখক সেটা সম্পাদনাও করে দিয়েছিলেন। যাতে অন্তত স্টিকি হবার যোগ্যতার পথে সেটা অন্তরায় না হয়। কিন্তু বিধি বাম।
এত এত পাঠকের আবেদন সত্ত্বেও লেখাটিকে স্টিকি না করাতে সন্দেহ হয়। ফ্যাসিবাদিদের রক্তচক্ষুর দেখে কি কর্তৃপক্ষ ভয় পেয়েছেন? অবশ্য ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। কেননা সামু তাদের সন্তানের মত। আর সন্তানের অমঙ্গল হবে, এমন কাজ কোন অভিবাবকই কি কোনদিন করতে পারবেন? পারবেন না। সেক্ষেত্রে সামুর কর্তৃপক্ষকে দায় মুক্ত করাই যায়।
বাকি থাকে প্রতিবাদের অন্যান্য পন্থা অবলম্বন। অনেকেই বিসিবি এবং প্রধানমন্ত্রির দফতরে ইমেইল পাঠিয়েছেন। অনেকে বিসিবি এবং এ টি এন অফিসের সামনে বিক্ষোভের কথা বলেছেন। সরকার যেখানে বেসুর গাইবার জন্য টি আই বিকেও এক হাত দেখে নেয়া থেকে নিবৃত্ত হয়নি, সেখানে মুস্টিমেয় কিছু দেশপ্রেমিক তরুন তরুনিদের ইমেল কিংবা বিক্ষোভকে তারা পাত্তা দেবেন কি? আর বেগরবাই করলে পুলিশ তো আছেই, সাথে আছে নব্য রক্ষিবাহিনী ছাত্রলিগ আর যুবলিগ। এমনিতেই তো দেখা গিয়েছে যে, ক্রিকেটের টিকেটের জন্য প্রচন্ড শীতে নির্ঘুম রাত কাটিয়ে ঘণ্টার পর ঘন্টা লাইনে দাড়িয়ে থেকেও ব্যাংকের সামনে ছাত্রলিগের গুণধরেরা নিজেদের পছন্দের লিস্টি টাঙ্গিয়ে দিয়ে বাকিদের অর্ধচন্দ্র দিয়েছে।
এর পর যদি উদ্বোধনি অনুষ্ঠানের প্রতিবাদে রাস্তায় কেউ নামে, তাহলে তার কি হাল হতে পারে (হয় পিটুনি খেয়ে অর্ধমৃত হয়ে কিংবা জঙ্গি সন্দেহে রিমান্ডে গিয়ে হাসপাতালে) সেটা অনুমান খুব কস্টসাধ্য নয়।
তাহলে কি আমাদের সংস্কৃতির এই শবযাত্রার প্রক্কালে শুধু চোখের পানি ফেলাই যথেষ্ঠ? আমাদের পুর্বসুরিরা কি সেরকম কোন উদাহারণ রেখে গিয়েছেন? আমরা আজ যে নির্বিরোধি চরিত্রের অধিকারি, তারা যদি সেই রকম হতেন তাহলে পরধীনতার শৃংখল থেকে আমরা কোনদিনও বেড়িয়ে আসতে পারতাম না।
দেশমাতৃকাকে যদি সত্যিকার অর্থে ভালোবাসি, আর সেই ভালোবাসা যদি কঠিন প্রত্যইয়ের বাধনে বাধা হয়ে থাকে, তাহলে সাধ্য কি অসুরদের, আমাদের চোখের সামনে আমাদেরই মুখের ভাষা আর সংস্কৃতিকে শেষ শয়ানে তুলে দেয়?
** লেখাটি একই সাথে দুটি ব্লগে প্রকাশিত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।