Never argue with idiots. They bring you down to their level and then beat you with experience
সিন্ডিকেটের ফাঁদে বাজার; দমনের উদ্যোগ নেই
বাজার সিন্ডিকেটের ফাঁদে পড়েছে সরকার। তেল, চিনি, আটা, ময়দা থেকে শুরু করে বেশিরভাগ নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে গুটিকয়েক ব্যবসায়ী গ্রুপ। সিন্ডিকেটের কারণে সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবিও কার্যকর কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছে না। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাজার নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেটের কারসাজির কথা তুলে ধরে বলেছিলেন , ‘গুটিকয়েক ব্যবসায়ী গ্রুপের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে নিত্যপণ্যের বাজার। ’ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির তরফ থেকেও বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে এ অভিযোগ তোলা হয়েছিল।
আইন করে সিন্ডিকেটে জড়িত ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ারও পরামর্শ দিয়েছিলেন কমিটির সদস্যরা।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) জানিয়েছে, নিত্যপণ্যের বাজারে এখন শক্তিশালী সিন্ডিকেট সক্রিয়। এ সিন্ডিকেট কখনও চিনি, কখনও তেল, আবার কখনও গমের দাম বাড়ায়। একই ব্যবসায়ী গ্রুপের মাধ্যমে অধিকাংশ নিত্যপণ্য আমদানি হওয়ার সুবাদে বাজার বরাবরই অস্থিতিশীল থাকছে বলে মনে করেন ক্যাবের মহাসচিব কাজী ফারুক।
অর্থনীতিবিদরা জানিয়েছেন, আগে শুধু আমদানি পর্যায়ে সিন্ডিকেট হতো।
এখন খুচরা ব্যবসায়ীরাও সিন্ডিকেট করছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা আগে কয়েকজন আমদানিকারক ও বড় ব্যবসায়ীর মধ্যে সিন্ডিকেটের কথা শুনে এসেছি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। এখন আর সিন্ডিকেট একটি নয়, একাধিক। এখন আমদানিকারক-ব্যবসায়ীর পাশাপাশি খুচরা বিক্রেতারাও সিন্ডিকেট করছে।
যে যেভাবে পারছে মুনাফা করছে। তাদের মধ্যে একটা অলিখিত চুক্তি রয়েছে বলেও মনে হয়। পণ্য সঙ্কট নেই, সরবরাহ স্বাভাবিক, তারপরও দাম বাড়ছে। ’
সরকারের ভেতরই বাজার সিন্ডিকেট
ভোজ্যতেল, চিনি, ডালের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সরকারের কোনো উদ্যোগ এখনো ফলপ্রসূ হয়নি। চার মাস আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (টিসিবি) নির্দেশ দিলেও এখন পর্যন্ত কোনো কাজ করেনি প্রতিষ্ঠানটি।
এ ব্যাপারে বাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, সরকারের মধ্যে বাজার নিয়ন্ত্রণকারী শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। ওই সিন্ডিকেট টিসিবিকে নিষ্ক্রিয় করে রাখছে। তাদের কারণে টিসিবি কার্যকর হতে পারছে না। এসব কারণে গত রমজানেও টিসিবিকে কার্যকর করার নির্দেশনা কোনো কাজে আসেনি।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কর্মকর্তা এমদাদ হোসেন বলেন, শুধু সিন্ডিকেট আছে বলে দায়িত্ব শেষ করা যাবে না।
সিন্ডিকেটের হোতাদের তালিকা সরকারকে প্রকাশ করতে হবে। তিনি বলেন, মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রাইস কমিশন করা হয়নি। বড় কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। শুধু দোষারোপ করে সরকার দায়িত্ব শেষ করেছে।
বাজার বিশ্লেষকরা যা বলেন
বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, বাজার নিয়ন্ত্রণে নতুন কোনো উদ্যোগের প্রয়োজন নেই।
নির্বাচনী ইশতেহারে সরকার যেসব উদ্যোগের কথা বলেছে, তা করলেই সিন্ডিকেট দমন করা যাবে। নির্বাচনী ইশতেহার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ইশতেহারে মূলত চারটি উদ্যোগের কথা বলেছে আওয়ামী লীগ। এগুলো হলো সময়মতো আমদানির সুবন্দোবস্ত, বাজার পর্যবেক্ষণসহ বহুমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করা, চাঁদাবাজি বন্ধ করা ও ‘ভোক্তাদের স্বার্থে ভোগ্যপণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ’ গড়ে তোলা।
বিশ্লেষকদের মতে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বাজার নিয়ন্ত্রণে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ‘ভোক্তাদের স্বার্থে ভোগ্যপণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ’ গঠনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দুই বছরেও এটি আলোর মুখ দেখেনি।
স্বাধীনতার পর থেকে সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রণের মূল হাতিয়ার ছিল টিসিবি। অঙ্গীকার করেও টিসিবিকে এখনো কার্যকর করেনি সরকার। সর্বশেষ গত ৯ ফেব্রুয়ারি টিসিবির নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার একটি প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় টিসিবিকে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা বন্ধ করে দিয়েছে। এক হাজার ৬৬১ কোটি টাকা বরাদ্দের ওই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় টিসিবিকে নতুন কর্মপরিকল্পনা জমা দেওয়ার কথা বলেছে। ফলে টিসিবির সফলতা কবে আসবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, সিন্ডিকেট দমনের জন্য নিয়মিত বাজার পর্যবেক্ষণ করতে হবে। টিসিবিকে পুরোপুরি ঢেলে সাজিয়ে এর মাধ্যমে প্রচুর পণ্য আমদানি করতে হবে। ছোট আমদানিকারকদের পণ্য আমদানিতে উৎসাহ ও সহায়তা দিতে হবে, যাতে গুটিকয়েক ব্যবসায়ীর হাতে আমদানি নিয়ন্ত্রিত না হয়। পাশাপাশি চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে।
শেষ কথা
বস্তুত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারদরের ওঠানামা প্রধানত নির্ভর করে চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্যের ওপর।
সুতরাং চাহিদা-পরিমাণ ও জোগান-পরিস্থিতি সম্পর্কে সঠিকভাবে না জানলে বাজারদরের অস্থিরতা প্রশমন করা সম্ভব নয়। সরকার তথা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে এই চাহিদার বিষয়ে যেমন কোনো উপাত্ত নেই, তেমনি নেই জোগান-পরিস্থিতির হালনাগাদ পরিসংখ্যান। একইভাবে অদূর-ভবিষ্যতে বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা ও জোগান সম্পর্কে প্রক্ষেপণ করার কোনো নিবিড় পদ্ধতিও গড়ে ওঠেনি। আবার সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যেও এ বিষয়ে নেই কোনো সুসমন্বয়। এর ফলে চাহিদা-জোগান সম্পর্কে জানতে নির্ভর করতে হয় আমদানিকারকসহ ব্যবসায়ী মহলের ওপর।
এখানেও দেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠনসহ বাণিজ্য সংগঠনগুলোর গোছানো কোনো কাজ নেই। ফলে চাহিদা-জোগানের বিষয়টি বহুলাংশে অনুমাননির্ভর হয়ে গেছে। আর এই অনুমাননির্ভর উপাত্তের ভিত্তিতে বাজারে সরকারি হস্তক্ষেপের চেষ্টা বাজারদরের অস্থিরতাকে আরও উসকে দিচ্ছে।
প্রশ্ন হলো, বাজারে হস্তক্ষেপ করার সামর্থ্য কেন সরকার গড়ে তোলেনি? ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মতো নাজুক সংস্থাকে দিয়ে নিত্যপণ্যের বাজারে সরবরাহ বাড়ানোর সীমিত চেষ্টাও যে বারবার ব্যর্থ হয়েছে, তা তো সবারই জানা। তার পরও একই চেষ্টা করার মানে কী? আবার বিভিন্ন পণ্যের বাজারদর বেঁধে দিলেও তা কাজে আসছে না।
কাজে তো আসবেই না। সরকার যখন প্রচলিত বাজারদরের চেয়ে বেশি দামে ভোজ্যতেলের দাম বেঁধে দেয়, তখন তা আমদানিকারক ও বিক্রেতাকে আসলে আরেক দফা দাম বাড়ানোরই সংকেত দেয়। ব্যবসায়ী নেতারাই বা কেন বারবার লোক-দেখানো বৈঠক করে দাম স্থিতিশীল রাখার আশ্বাস দিচ্ছেন? তাঁরা যদি সত্যিই বাজারদর স্থিতিশীল রাখতে সরকারকে সহায়তা করতে চান, তাহলে পণ্যের সরবরাহ বাড়ানোর দিকে বেশি মনোযোগ দিলেই পারেন। একদিকে সরকার ও ব্যবসায়ী নেতারা বাক্যব্যয় করবেন, অন্যদিকে বাজারদরে অস্থিরতা চলবে, এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। অর্থবহভাবে বাজারে হস্তক্ষেপ ও তদারকির সামর্থ্য সরকারের থাকতে হবে, অন্যথায় বাজারদরে স্থিতিশীলতা আনা কঠিন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।