আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিক্ষাবিস্তারে বাধা: পার্বত্যাঞ্চলের কলঙ্কিত ইতিহাস

আকাশটা ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে

রাঙ্গামাটিতে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার পদক্ষেপ নিয়ে সরকার তা দশ বছরেও বাস্তবায়ন করতে পারছে না। এটা খুবই দুঃখজনক। আরো অবাক করার বিষয় হচ্ছে যে কিছু পাহাড়ি নেতার বিরোধীতার কারণে বারবার আটকে যাচ্ছে এ প্রকল্পের কাজ। শুধু রাঙ্গামাটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেই যে বাধা আসছে তাই নয়, পার্বত্যবাসীর দুঃখ হলো এ অঞ্চলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে পাহাড়ি নেতাদের বাধা দেয়াটা বৃটিশ আমল থেকেই রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। প্রথম দিকে বৃটিশরা তাদের শাসন কার্য পরিচালনার সুবিধার্থে কিছুসংখ্যক পাহাড়িকে শিক্ষিত করার উদ্যোগ নিয়ে বাধার মুখে পড়ে।

ফলে তারা এটা শুধু মাত্র অভিজাত পাহাড়িদের মধ্য সীমাবদ্ধ রাখতে বাধ্য হয়। আজকে অনেক পাহাড়ি নেতাকে মাতৃভাষায় শিক্ষা চালুর দাবী নিয়ে আন্দোলন করতে দেখা যায়। অথচ ইতিহাসের চরম সত্য হলো বৃটিশরা পাহাড়ে মাতৃভাষায় শিক্ষা দান চালু করেও এই পাহাড়ি নেতাদের আন্দোলনের কারণেই তা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল। ১৮৬৩ সালে চন্দ্রঘোনায় প্রতিষ্ঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানে বাংলা, ইংরেজী ছাড়াও চাকমাদের জন্য চাকমা ভাষা এবং মার্মাদের জন্য বার্মিজ ভাষায় শিক্ষা চালু ছিল।

মাঝখানে এ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ১৯৩৭-৩৮ সালে তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষা বিভাগের ডাইরেক্টর এবং রাঙ্গামাটি সরকারি হাই স্কুলের হেড মাস্টার হারবার্ট ফ্রেডারিক মিলার বাংলা, ইংরেজীর পাশাপাশি আবারো চাকমাদের জন্য চাকমা ভাষা এবং মার্মাদের জন্য বার্মিজ ভাষায় শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেন। কিন্তু তখনকার চাকমা নেতা কামিনী মোহন দেওয়ান এবং অন্যান্যরা এতে আপত্তি করেন। তারা চাননি চাকমা ছেলে-মেয়েরা চাকমা ভাষা শিখুক। ফলে পাহাড়িদের মাতৃভাষায় শিক্ষা ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগটি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। কামিনী মোহন দেওয়ান তার আত্মজীবনী ‘পার্বত্য চট্টলের এক দীন সেবকের কাহিনী’তে পাহাড়িদের মাতৃভাষায় শিক্ষার উদ্যোগের সমালোচনা করে লিখেছেন, ‘মিলার বদ উদ্দেশ্যে চাকমা ভাষা ও বার্মিজ ভাষা চালু করেছিল’।

রাঙ্গামাটি হাই স্কুল, সাধারণ পাহাড়িদের শিক্ষিত করার ব্রত নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়নি বরং বর্তমান চাকমা সার্কেল চীফের পূর্ব পুরুষ ভূবন মোহন রায়কে শিক্ষিত করার জন্য এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ১৮৯০ সালে গড়ে তোলা হয়েছিল। পাকিস্তান আমলে, ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় রাঙ্গামাটি কলেজ। কিন্তু এটি স্থাপনও সহজ কাজ ছিল না। কারণ তৎকালীন চাকমা সার্কেল চীফ ত্রিদিব রায় রাঙ্গামাটিতে কলেজ প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেছিলেন। তিনি শুধু বিরোধীতা করেই ক্ষান্ত হননি বরং এটি যাতে কোনভাবেই বাস্তবায়িত হতে না পারে সে চেষ্টাও করেছিলেন।

এর জন্য তিনি প্রথমে ঢাকার রাজস্ব বোর্ডের সদস্য এস এম হাসানের কাছে এবং পরবর্তীতে তৎকালীন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার করিম ইকবালের কাছে চিঠি লিখে রাঙ্গামাটিতে কলেজ স্থাপনের প্রয়োজন না থাকা সত্বেও তার জমি (যদিও জায়গাটি চীফের জন্য নির্ধারিত ৭৫ একর জমির মধ্যে ছিল না) জোর করে নিয়ে কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার সিদ্দিকুর রহমানের দৃঢ়তায় শেষ পর্যন্ত কলেজটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এসব তথ্য তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বন্দোবস্ত ও প্রশাসনের দায়িত্বে থাকা শরদিন্দু শেখর চাকমা তার ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ও আমার জীবন’ শীর্ষক বইয়ে লিখে রেখেছেন। একই বইয়ে তিনি নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতাসহ সাধারণ পাহাড়িদের শিক্ষার ব্যাপারে অভিজাত শ্রেণীর বাধা দেয়ার আরো বেশ কিছু উদাহরণ তোলে ধরেছেন। এর মধ্যে একটি হচ্ছে বর্তমান আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমার পূর্বপুরুষের ঘটনা।

শরদিন্দু শেখর চাকমার ভাষায় ঘটনাটি হলো, ‘সন্তু লারমার বাবার বড় ভাই কৃষ্ণ কিশোর চাকমা যখন বি, এ, পড়ছিলেন তখন তার বইগুলো চুরি করে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিলো, যাতে তিনি বি, এ, পাশ করতে না পারেন। এটা করা হয়েছিল কিছু উচ্চ বর্ণের দেওয়ান/তালুকদারের ষড়যন্ত্রের ফলে। তখন দেওয়ান তালুকদারগণ চাইত না সাধারণ চাকমারা লেখাপড়া শিখুক। কারণ সাধারণ চাকমারা লেখাপড়া শিখলে তাদের আর আগের মত মান্য করবে না। তাই সাধারণ পরিবারের সন্তান কৃষ্ণ কিশোর স্কুল সাব ইন্সপেক্টর হওয়ার পরে সাধারণ চাকমাদের মধ্যে ব্যাপকহারে শিক্ষা বিস্তারে আগ্রহান্বিত হন।

’ আজকের চরম বাস্তবতা হলো পার্বত্যাঞ্চলের সাধারণ মানুষের মাঝে শিক্ষা বিস্তারের অগ্রনায়ক কৃষ্ণ কিশোর চাকমার উত্তরসূরী সন্তু লারমাই রাঙ্গামাটিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন!! তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন নাই জানিয়ে কলেজে অনার্স কোর্স চালুর দাবী করছেন!!!!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.