আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প, দিনান্তে

শাদা পরচুল অন্ধকার

এখন আমার হাতে তেমন কোন কাজ নেই। বলা যায় একমুঠো নিশ্চিন্ত অবসর। এমন অখন্ড অবসর অমিত বাবুর জীবনে জুটেছিল কীনা নিশ্চিন্ত নয়। তাহলে এত ব্যাকুল হয়ে তিনি হয়ত বলতেন না- “ দোহাই তোদের,একটু সবুর কর! ভালোবাসিবারে- দে অবসর। ।

” এই মুহূর্তে আমার এমনতরো সময় সংকট নেই। আমার মনে নেই কোন অতৃপ্তির বেদনা, কর্মের ব্যস্ত ঘনঘটা। তাই আজ মন খুলে চিৎকার করে গাইতে ইচ্ছা করছে- ”আজ বিরাম নেব সব কিছুর পর- আজ যে মোর চির অবসর! কোরব রচন- কোরব সপ্নে চয়ন- ভালবাসার অনন্ত বাসর!” বাইরে বৃষ্টি ঝড়ছে। একটানা অবিশ্রান্ত বর্ষণ দৃষ্টি সীমায় আঘাত করছে। সবকিছূ ঝাপসা হয়ে আসছে।

কিছুটা ক্লান্ত লাগছে। শুয়ে পড়লাম বিছানায়। একটু তন্দ্রামত আসল। আমি হারিয়ে গেলাম স্বপ্নে -ওই সময়ের কোন এক অজানা সাগরে। সে আমায় নিকট অতীতে নিয়ে গেল।

আমি আরো দূরে যেতে চাইছিলাম, কিন্ত সে সায় দিল না। কী আশ্চর্য- এখানেও বৃষ্টি ঝরছে। এখানে আমি - কারও একজনের আগমন অপেক্ষায় কাতর। কার আসবার কথা? স্মৃতি মিলিয়ে দেখবার আগেই সে এসে গেল। সে আর কেউ নয়, আমার অতি পরিচিত এক সুহৃদ।

তার নামটি না হয় অজানাই থাক। আমার সাথে সে গল্পে মত্ত হল। বিষয় অতি সাধারণ-বৃষ্টিতে ভিজবার গল্প। কিন্ত কী মুগ্ধ হয়ে সেদিন তা শুনেছিলাম-সে আজ বুঝতে পারছি। বৃষ্টির গল্প শেষ হলে পরে আরো দু ঘন্টা গল্প হল।

দু একটা কাজের কথা হলেও বেশিরভাগই গুরুত্বহীন। তবু সে বাদল মুখরিত দিনের আড্ডা আমার জীবনে স্মরণীয় হয়ে হইল। ******* পূর্বাগমন হঠাৎ করেই কী এক সপ্তসুর কানে মধুর বাঁশরী সুর ঢেলে দিল। ঘুমটা চলে গেল-কিন্তু রয়ে গেল তার মধুর আবেশ। হাতে দিনলিপিটা তুলে নিলাম।

হায়! নিয়তি আজ আমার সাথে এ কী খেলা খেলছে- বুঝতে পারছি না। কতগুলো পাতা নাড়াচাড়া করতেই বেরিয়ে এল সেদিনের অংশটুকু। দেখি তার পাতায় লেখা আছে আমার নিজস্ব কিছু গবেষণা-যাকে পূর্বানুমান বলা যায়-অথবা বলা যায়,মনোবিশ্লেষণ। পাত্র আর কেউ নয়- সেই বর্ষারোহিত ব্যক্তি। ডায়েরীর পাতায় লেখা আছে- “মানসিকতা ঝরঝরে বাহুল্যবীহিন।

কথাবার্তা মাপা নয় তবে তাতে কৃত্রিমতার পরিমান খুব কম। চালচলন, ভাবভঙ্গি-আশাব্যাঞ্জক। ওর একটি অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে-হাসি। এটিই তার সবচেয়ে বড় গুন আবার সবচেয়ে বড় দোষ। হাসবার সময় মনে হয় সে জগতের সবচেয়ে সুখী।

মাঝেমাঝে অবশ্য তা অনর্থক মনে হয়। তখন এ হাসি সন্দেহের উদ্রেক করে। হতে পারে-এ হাসি পরিবেশকে অতি লঘু করে ফেলে সবাইকে আপন করে নেবার জন্যে, অথবা সবার আপন হবার এ এক নিগূঢ় পন্থা। যাই হোক, আমার অবশ্য ভালোই লাগল ব্যপারটা। হোক না এ তার দোষ- অনর্থক হাসি।

সেতো হাসি,কান্নাতো নয়। তাই সে শুদ্ধ। এমন দোষ থাকলেও ক্ষতি নেই। আরেকটা কথাও মনে হচ্ছে। ঘুরিয়ে পেচিয়ে না বলে স্পস্ট করে সোজা বাংলায় বলি- যাকে বলে, জাতে মাতাল তালে ঠিক।

অবশ্য তার একটা ব্যাপার আমার কাছে স্পস্ট নয়। সে হল তার প্রকৃতি। সেকি পর্বতের মত অটল,বজ্রের মত নিষ্ঠুর; না কী নদীর মত শান্ত,সাগরের মত বিশাল তার হৃদয়। এ বিষয়ে আমি দ্বিধান্বিত। ” -মন্দ নয়।

আমার মন হেসে উঠল কল্পনার সফলতার মধুর জয়গানে। নিজের সঙ্গে নিজেই রসিকতা করলাম- বোধহয় জ্যোতিষী নেমে পড়লেও খারাপ হয় না। ****** চরিত্রাবলী ডায়েরীর পাতা বন্ধ করলাম। আজকের বাদল দিনে একটা গান না হলেই নয়। স্টেরিওতে ছেড়েদিলাম গান।

বিশুদ্ধ বর্ষার গান- “ আজি বাদলের দিনে- দাড়াও যদি নিভৃত বাতায়নে; খুঁজে পাবে মোরে, তব প্রতি স্পন্দনে, ঐ বাহুডোরে। ঝড়ে যাওয়া জলের ধারায়!” গানের সুরে আমি হারিয়ে গেলাম দূরে বহুদূরে। সেখানে কোন এক মেঘরাণী আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল। সে আমার সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে দেবার কথা বলছে। কিন্তু তার আগেই চলে এল তেজোদীপ্ত সূর্য।

ভীষণ বেরসিক সে। অমিত তেজ তার। তবু বিন্দুমাত্র সময় অপরের আধিপত্য মেনে নিতে রাজি নয়। আমার ভাবনায় ছেদ পড়ল। ইত্যবসরে সে চলে এল।

এসেই আমার হাতে একগোছা কদম ধরিয়ে দিয়ে বলল, শুধু কী জলে ভিজলেই হবে, বর্ষার প্রতীক এ কদম দানা লাগবে না? আমি হেসে উঠতেই সেও হেসে দিল। এরপর বদলে দিল গান - “ তোমার দুয়ারে এসেছি প্রিয়তম, হাতে ধরা সিঁদুর মম - রাঙাবে ঔ সিথির কেশরী , আমি বাজাব বর্ষার বাঁশরী। মোর দেয়া কদম দুখানি দুলিতেছে আনমনে, ভুলিতেছে সুরবাণী। আমি অবাক হয়ে গান শুনছিলাম। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে অনুভব করলাম - কী ভীষণ মায়া তাতে! আমার ভাবনার জগতে তখন প্রচণ্ড তোলপাড়।

সে কে? কী বলতে চায় সে? কী তার মনের কথা। তার সব কথাই আমার জানা। তবু যেন সব নতুন নতুন মনে হয়। আমার মনের কথা বঝতে পেরে হেসে বলল -আমি কে? তা জানা কী এতই সহজ! দেখ- আজতক আমি নিজেকে চিনিনি। আমি সহাস্যে বলে উঠলাম- কোন মানুষই মানুষকে চিনতে পারে।

হয় তুমি আমাদের মানুষ বলে গণ্য করো না, না হয় তুমি মানবের উর্ধ্বে। সে সল্লজ কণ্ঠে বলে উঠল - “না না, তা নয়। আমি অতি,অতি সাধারণ। তোমাদের তুলনায় আমার স্তর অনেক নীচু। আমায় মানবের উর্ধ্বে বলে অপরাধী কোর না।

” আমি ওর ইতস্তত ভাবটা দূর করবার জন্য বললাম-ওসব থাক। তার চেয়ে আমি তোমায় কেমন দেখেছি তাই বলি। সে হেসে বলে উঠল -বল দেখি। তোমার দেখায় আমি নিজেকে দেখি, তেমার চেনায় আজ নিজেকে আবার নতুন করে চিনি। আমি আবৃত্তি করতে লাগলাম- অনেক ভাল তুমি, সুরের মাঝে যেন সুর সপ্তমী।

কিন্তু আবার কেমন খাপছাড়া- মানতে চাওনা নিয়ম বাঁধাধরা। উড়তে চাও নীলাকাশে- দেখ যেই পাখি-উড়ে আর ভাসে। কিন্তু ভুলে যাও হায়, উড়ার ক্ষমতা দেয়া হয়নি তোমায়। এ নয় দোষ তব- মানুষ তুমি কিছু আছে তোমার,কিছু সর্বগামী- রেখেছে গোপন করে। আজ তারে- আনো বের করে।

অগমের পাড়ে- যাবার মত শক্তি,সাহস-আর ভালবাসা-ঐ বুকে বারবার দোল খায়; বান ডেকে যায়- অনিবার। তুমি বড় নিঠুর, যেন মরু পথ বন্ধুর। এ তোমার খেলা- যত হয় বেলা,ভাসাও পাষাণ ভেলা। তাতে কর যাত্রী-প্রিয় যত মানব তব! ভাবনাই কোনদিন- ধরণীর গহীন ঐ ভবপাড়ে, কি তোমায় ডাকতেছে হাক ছেড়ে! আমি বলে যাই- গেয়ে যাই গলা ছেড়ে- ভূলে যাও তব কল্পিত বেদনারে। জীবনের স্বপ্ন সুখপাখিরে- একদিন পাবেই খুঁজে।

তার গানে গানে বাজবে আমার সুর তোমার কানে। ******* ক্ষণিক বিদায় সে চলে গেল। যাবার আগে তাকে কিছুটা বিব্রত দেখালো। তার মনে জেগে উঠেছিল কোন এক অজানা বেদনা। সে আমার দিকে চেয়ে ম্লান হাসি দিয়ে বলল- আজ আসি! আমি বললাম,“আবার কবে দেখা হবে?” সে বলল-কি জানি, হয়ত কাল,হয়ত এক হপ্তা বা এক মাস পর।

সে আমাকে একা রেখে বিদায় নিল। দীর্ঘ পনেরটি দিন তার সঙ্গে দেখা হয়নি। রাতে ফোনে কথা হয়নি। এদিকে আমার মন ততদিনে বুঝতে পারল সেই “সে” আমার অস্তিত্বের সাথে কেমন করে যেন জড়িয়ে যাচ্ছে। আমি আর নিজেকে আলাদা করে ভাবতে পারছি না।

আমার পৃথিবীতে কিসের যেন একটা ঝড় আসছে। সে ঝড় আমায় উড়িয়ে নিতে যেতে চাইলো। প্রথমে আমি বিক্ষিপ্ত ভাবে বাধা দিলেও পরে আর কোন বাধা দিলেম না। কারণ সে ঝড়ের তোড়ে উড়ে যেতে মন একান্তই চাইছিল। যে ঝড়ে সে দিন উড়ে গিয়েছিলাম- তার নাম ভালবাসার ঝড়।

জানি কেউ কেউ একে বাড়াবাড়ি, পাগলামি, খেয়ালি মনের খেলা বলে আঘাত করতে চাইবে। তাতে লেপে দিতে চাইবে অনন্ত রাত্রির কালি। কিন্তু আমি জানি এ ভালবাসা পবিত্র। এর নেই কোন কামনার উন্মাদনা, বাসনার সুরাপাত্র। ‘‘সে’ আমার অন্তরের প্রবেশ করেছে বিশুদ্ধ ভালবাসা নিয়ে-যাতে মোহ ছিল না।

তাই সে ঝড়ে ডুবে গিয়ে কাদঁলাম, আর গাইলাম- কাঁদালে তুমি মোরে- ভালবাসারি ঘায়ে, নিবিড় বেদনাতে; পুলক লাগে গায়ে। ******* প্রত্যাবর্তন আমার বিবেচনা বোধ যত শক্ত ভিতের উপরে দাড়িয়ে থাক না কেন, সেই বর্ষারোহিত ব্যক্তি -আমার ভালবাসার নিষ্ঠুরতার সম্বন্ধে আমি সজাগ ছিলাম না। আর তাই সে সুযোগ পেয়ে গেল। আমায় আঘাত করল। ভালবাসার আঘাত।

আশ্চর্য এই- সে আঘাতে আমি কোন বেদনা অনুভব করিনি। কারণ আমি জানি,ভালবাসা বেদনারই আরেক রূপ। যাকে ভালবাসব-তার প্রতি সদা উদ্বিগ্ন থাকাই ভালবাসা। যুগে যুগে পৃথিবীতে যত অমর প্রেমগাঁথা রচিত হয়েছে-সবই সীমাহীন বেদনার ইতিকথা। তাই আমার এই নিগূঢ় প্রেম- সেও নিবিড় বেদনাময়।

তাকে এই বেদনার নীলে অবগাহন করিয়ে আমি বেদনাকে কাছে টেনে নিলাম, তার সুখগুলো অনুভব করলাম। সে এবার বুঝতে পারল বেদনার ভাষা। আমায় আলিঙ্গণে নিয়ে বলল- আমার ভুলগুলো তুমি ক্ষমা কর। আর কখনো তোমায় ছেড়ে কোথাও যাব না। তোমায় না দেখে থাকা - এ আমার হবে না।

কথা দিলাম, আর কোন দিন হারিয়ে যাব না। তোমার পাশে থাকব শেষদিন পর্যন্ত। মৃত্যুর দিনেও আমি তোমার পাশে থাকব- ছায়া হয়ে, পাতা ঝরা বয়েসী কোন অচিন বৃক্ষ হয়ে, গান ভুলে যাওয়া ক্লান্ত কোকিল হয়ে, দলে যাওয়া দূর্বাদল হয়ে, মাড়িয়ে যাওয়া সজনে ডাটা হয়ে, তৃষ্ণার্ত চাতক হয়ে, তোমার এ বেদনার স্বপ্ন গুলো হয়ে। আমি তখন কিছুকাল আগেই জীবনে আসা সমস্ত বেদনাকে ভুলে গেলাম। আমার কন্ঠ আবার সুর ফিরে পেল।

প্রকৃতি যেন আমায় জাগিয়ে তুলবার জন্য তার বৃষ্টিতে রিমঝিম ছন্দের নাচন তুলল। আমি গাইতে শুরু করলাম। সেও আমার সাথে গলা মিলিয়ে গাইল- “আমারে তুমি অশেষ করেছ- এমনি লীলা তব। ”

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.