মনের কথা ব্লগে বলে ফেলুন,নয়তো মনে কথার বদহজম হবে
পল অ্যাসাঞ্জ একজন অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক, প্রকাশক এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে সমাজ ও রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে চেষ্টা করে যাওয়া একজন কর্মী (অ্যাকটিভিস্ট)। তার সবচেয়ে বড় পরিচয় সাড়াজাগানো ওয়েবসাইট উইকিলিক্স-এর প্রতিষ্ঠাতা তিনি। এই ওয়েবসাইটটিতে কাজ করার আগে তিনি ছিলেন একজন কম্পিউটার প্রোগ্রামার এবং হ্যাকার। তিনি অনেক দেশে বাস করেছেন এবং বিভিন্ন উপলক্ষে গণমাধ্যমে এসেছেন, কথা বলেছেন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সেন্সরশিপ এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বিষয়ে।
জন্ম ও বাল্যকাল
জুলিয়ান পল অ্যাসাঞ্জের জন্ম ১৯৭১ সালের ৩ জুলাই পূর্ব-উত্তর অস্ট্রেলিয়ার টাউন্সভিলির কুইন্সল্যান্ডে।
বাল্যকালে বেশিরভাগ সময় কেটেছে ম্যাগনেটিক আইল্যান্ডে। যখন অ্যাসাঞ্জের বয়স মাত্র এক বছর তখন তার মা ক্রিস্টাইন বিয়ে করেন ব্রেট অ্যাসাঞ্জ নামের এক থিয়েটার পরিচালককে। যার নামে জুলিয়ান পলের নামের শেষে অ্যাসাঞ্জ পদবি যোগ হয়। ক্রিস্টাইন এবং ব্রেট অ্যাসাঞ্জ একটি ভ্রাম্যমাণ থিয়েটার কোম্পানি চালাতেন।
জুলিয়ানের আসল বাবা জুলিয়ান সম্পর্কে পরবর্তীকালে মন্তব্য করেন, ‘একজন খুবই তীক্ষè বুদ্ধিসম্পন্ন বালক।
ঠিক-বেঠিক সম্পর্কে যার স্পষ্ট ধারণা রয়েছে। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি কোনো সংঘবদ্ধ দলকে কোনো দুর্বলের ওপর অত্যাচার করতে দেখলেই সে রেগে যেত। সব সময়ই সে দুর্বলের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। ’
১৯৭৯ সালে জুলিয়ানের মা আরেকটি বিয়ে করেন। তার নতুন স্বামী ছিলেন একজন মিউজিশিয়ান।
এই স্বামীর ঔরসেও তার গর্ভে একটি সন্তান জন্ম নেয়ার পর ১৯৮২ সালে বিচ্ছেদ হয়। অ্যাসাঞ্জের মায়ের একাধিক বিয়ের কারণে ছোটবেলায় অ্যাসাঞ্জের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ হয়েছে, পড়াশোনা করতে হয়েছে একাধিক বিদ্যালয়ে এবং কখনো কখনো পরিবারই হয়েছে তার পাঠশালা।
হ্যাকিং
হ্যাকিংয়ের সংজ্ঞা হিসাবে যা পাওয়া যায় তা হলো, ‘জানার জন্য অন্যের কম্পিউটার সিস্টেমে ঢুকতে পারা। সিস্টেমটি কীভাবে কাজ করে এবং কী রয়েছে তাতে, তা জানতে চেষ্টা করা। ’ তবে বর্তমানে হ্যাকিং বলতে বুঝায় অন্যের কম্পিউটারে অনুমতি ছাড়া সেটির নিরাপত্তা কোড ভেঙে প্রবেশ করা ও তথ্য হাতিয়ে নেয়া।
তবে বলাই বাহুল্য, এজন্য অবশ্যই একজন হ্যাকারকে নিজের চিন্তাশক্তি, বুদ্ধিমত্তা, মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার পূর্ণ ব্যবহার করতে হয়। বর্তমানে হ্যাকিং একটি অপরাধমূলক কাজ বা সাইবার ক্রাইম। অ্যাসাঞ্জ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থার কোড ভেঙে সেখান থেকে গোপনীয় তথ্য বের করে নিয়ে আসেন এবং তা ইন্টারনেটে প্রকাশ করেন। এ কাজটি করে তিনি বিশ্বব্যাপী আলোচিত ও আমেরিকার মাথাব্যথার কারণ হয়েছেন। তার নাম ইন্টারপোলের ওয়ান্টেড লিস্টে উঠে এসেছে।
তবে হ্যাকিংয়ের অভিযোগ করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অদ্যাবধি সাইবার ক্রাইমের অভিযোগ আনেনি অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে।
১৩ বছর বয়সে অ্যাসাঞ্জকে তার মা একটি কম্পিউটার কিনে দেন। সেটি ব্যবহার করতে করতে মাত্র ৩ বছরে অ্যাসাঞ্জ প্রোগ্রামিং শিখে ফেলে। এমনকি অন্যের কম্পিউটার সিস্টেমে ঢোকাও তার জন্য ডালভাত হয়ে যায়। ১৯৮৭ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই অ্যাসাঞ্জ ‘মেনড্যাক্স’ নামে হ্যাকিং শুরু করেন।
অ্যাসাঞ্জ ‘মেনড্যাক্স’ শব্দটি নিয়েছিলেন হোরেস-এর বাগধারা ‘স্পেনডিড মেনড্যাক্স’ বা ‘চমৎকার অসত্য’ থেকে। তিনি এবং আরো দুই হ্যাকার মিলে একটি দল গঠন করেন ‘ইন্টারন্যাশনাল সাবভারসিভস’ নামে। পরিবর্তনের নাম নিয়েই শুরু করেনÑ ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক বিবর্তনের আন্দোলনÑ আন্তর্জাতিকভাবে বাস্তবায়নের স্বপ্ন নিয়ে। তারা হ্যাকিং করে অন্যের কম্পিউটারে ঘুরে আসতেন কেবল তথ্য নিতে। তারা কোনো তথ্য কখনো পরিবর্তন বা বিকৃত করেননি।
এই হ্যাকিং কার্যক্রমের প্রতিফল হিসাবে ১৯৯১ সালে মেলবোর্নে অ্যাসাঞ্জের বাড়িতে অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল পুলিশ রেইড দেয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি অস্ট্রেলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডিয়ান টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি নরটেল এবং আরো অনেক সংস্থার কম্পিউটারে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করেছেন। ১৯৯২ সালে তার ঘাড়ে হ্যাকিংয়ের ২৪টি অভিযোগ এসে পড়ে। সে দায় মুক্ত হন তিনি ভালো আচরণ দেখিয়ে এবং ২১শ অস্ট্রেলিয়ান ডলার জরিমানা গুনে। সে সময় প্রসিকিউটর বলেছিলেন, ‘কেবল অনুসন্ধিৎসু বুদ্ধিমত্তা আর অনেক কম্পিউটারের মধ্য দিয়ে ঘুরতে পারার সামর্থ্যরে আনন্দ ছাড়া আর কোনো প্রমাণ নেই।
’
পরে অ্যাসাঞ্জ এ বিষয়ে বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে এটা একটু বিরক্তিকর। কারণ হ্যাকার হয়ে আমি যৌথভাবে বই লিখেছি, সে ব্যাপারে তথ্যচিত্রও রয়েছে। মানুষের মাঝে অনেক আলোচিতও হয়েছি। তারা আমার কাজগুলোর কপিও করতে পারে সহজে। কিন্তু সেটা ২০ বছর আগের কথা।
আমি খুবই বিরক্ত হই যখন দেখি বর্তমানের আধুনিক সময়েও আমাকে হ্যাকার বলে সম্বোধন করা হয়। তবে এ রকম বলার পেছনে খুবই সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। ’
কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ
১৯৯৩ সালে অস্ট্রেলিয়াতে প্রথম সাধারণ মানুষের জন্য ইন্টারনেট সার্ভিস চালু করার কাজে যারা সম্পৃক্ত ছিলেন অ্যাসাঞ্জ তাদের অন্যতম। যার নাম সাবআর্বিয়া পাবলিক অ্যাকসেস নেটওয়ার্ক। ১৯৯৯ সালে মেলবোর্নে বসবাসকালে অ্যাসাঞ্জ একজন প্রোগ্রামার এবং ফ্রি সফটওয়্যার ডেভেলপার হিসাবে কাজ শুরু করেন।
সবার জন্য ফ্রি সফটওয়্যার নিশ্চিত করা ছিল এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য। ১৯৯৫ সালে তিনি রচনা করেন ‘স্ট্রোব’ যা প্রথম ফ্রি ওপেন সোর্স। ১৯৯৬ সালে প্রোজেক্ট পোস্টগ্রেএসকিউএল-এর বিভিন্ন অংশে কাজ করেন। তিনি ১৯৯৭ সালে আন্ডারগ্রাউন্ড : টেলস অব হ্যাকিং, ম্যাডনেক্স অ্যান্ড অবসেশন অন দি ইলেক্ট্রনিক ফ্রন্টিয়ার’ বইটি লেখায় সহযোগিতা করেন, যা তাকে একজন গবেষক ও প্রতিবেদক হিসাবে সম্মান এনে দেয়। ১৯৯৭ সালে লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেমের হয়ে ‘রাবার-হোজ ক্রিপ্টঅ্যানালাইসিস’-এর বিপরীতে রাবারহোজ ডিনাইয়্যাবল এনক্রিপশন সিস্টেমের সহউদ্ভাবক হিসাবে কাজ করেন তিনি।
এই সিস্টেমটি উদ্ভাবনের সময় তার ইচ্ছা ছিল এটি হবে মানবতাকর্মীদের একটি ‘টুল’, যেখানে তারা সংবেদনশীল তথ্য সংরক্ষণ করে রাখতে পারবে। এছাড়াও তিনি সারফ্র, এনএনটিপিকেস, ইউজনেটের মতো ফ্রি সফটওয়্যারের রচয়িতা, যা কিনা ওয়েবনির্ভর সার্চ ইঞ্জিনের প্রধান মেন্যুর চেহারায় কাজ করে। ১৯৯৯ সালে অ্যাসাঞ্জ ষবধশ.ড়মৎ নামক ডোমেইনটি রেজিস্ট্রি করেন। কিন্তু তিনি বলেন, ‘তখন আমি এটা নিয়ে কিছু করার কথা ভাবিনি। ’
অ্যাসাঞ্জ ২০০৩ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে মোট ৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন।
তিনি মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন পদার্থবিদ্যা ও গণিত বিষয়ে। ২০০৫ সালে তিনি অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় পদার্থবিদ্যা প্রতিযোগিতায় মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তবে তিনি কোনো বিষয়েই গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেননি বা পাসের জন্য ন্যূনতম গ্রেডও অর্জন করেননি বলে নিজস্ব ওয়েবপেজে বর্ণনা করেছেন। তিনি দর্শন এবং স্নায়ুবিজ্ঞান বিষয়েও পড়ালেখা করেছেন।
উইকিলিকস
২০০৬ সালে উইকিলিকস প্রতিষ্ঠিত হয়।
সে বছরই অ্যাসাঞ্জ উইকিলিকসের উদ্দেশ্য বিষয়ে দুটি প্রবন্ধ লেখেন। তিনি বলেন, ‘শাসকদের আচরণে মৌলিক পরিবর্তন আনতে আমাদের অবশ্যই পরিষ্কারভাবে এবং সাহসিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। ভেবে দেখতে হবে, আমরা সেসব বিষয় সম্পর্কে কিছু শিখেছি কিনা যা পরিবর্তন হোক বলে শাসকরা চায় না। আমাদের অবশ্যই অতীতের সেসব মানুষের কথা ভাবতে হবে যারা আমাদের পথ দেখিয়েছেন এবং প্রযুক্তিগত পরিবর্তন উপহার দিয়েছেন। যেগুলো আমাদের সাহসী করেছে এমন পথে কাজ করতে যে পথে পূর্বপুরুষরা কাজ করতে পারেননি।
’
অ্যাসাঞ্জ উইকিলিকসের ৯ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। যখন সংবাদমাধ্যমগুলো তাকে উইকিলিকসের পরিচালক বা প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে বর্ণনা করছে তখন অ্যাসাঞ্জের বক্তব্য হলো, ‘আমি নিজেকে একজন প্রতিষ্ঠাতা বলি না। ’ তিনি নিজেকে বর্ণনা করেন উইকিলিকসের প্রধান সম্পাদক হিসাবে। তিনি বলেন, এই সাইটে কী কী প্রকাশ হবে তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা হবে তার। এই সাইটটিতে কাজ করা অন্য কর্মীদের মতো অ্যাসাঞ্জও একজন স্বেচ্ছাসেবী যারা এ কাজের বিনিময়ে কোনো টাকা-পয়সা বা বেতন নেন না।
অ্যাসাঞ্জ বলেন, সারা বিশ্বের সংবাদপত্রের সম্মিলিত তথ্যের চেয়েও অনেক বিশুদ্ধ তথ্য তারা প্রকাশ করছেন। তিনি বলেন, ‘আমি বলব না যে, এটা তেমন একটা কিছু। আমরা কতটা সফল সেটা বলার চাইতে এটা দেখানো বড় যে, সম্মিলিত সংবাদমাধ্যম ও মিডিয়ারও এমন সুযোগ বা কাজ করার ক্ষেত্র রয়েছে। এটা কেমন কথা যে, সংবাদমাধ্যমগুলো জনগণের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা তাদের ভালো-মন্দের তথ্যকে প্রকাশ করতে পারল না, যা মাত্র পাঁচ সদস্যের একটি দল পারল? এটা খুবই লজ্জাজনক। ’ অ্যাসাঞ্জ সমর্থন করেন একটি স্বচ্ছ ও বিজ্ঞানভিত্তিক সাংবাদিকতাকে।
তিনি বলেন, ‘আপনি একটি সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার তথ্য ও ফল ছাড়া পদার্থবিজ্ঞানের ওপর কোনো সংবাদ প্রকাশ করতে পারেন না। সাংবাদিকতায় এটিই হওয়া উচিত মানদ-। ’
২০০৬ সালে ‘কাউন্টারপাঞ্চ’ অ্যাসাঞ্জকে অস্ট্রেলিয়ার এক অখ্যাত হ্যাকার হিসাবে আখ্যায়িত করে। ‘দি এজ’ তাকে আখ্যা দেয় ‘বিশ্বের সবচেয়ে চতুর লোকদের অন্যতম এবং ইন্টারনেটের ফ্রিডম ফাইটার’ হিসাবে। অ্যাসাঞ্জ নিজের সম্পর্কে মন্তব্য করেন ‘নিদারুণ সংসারবিবাগী, বৈরাগী’।
দি পারসোনাল ডেমোক্রেসি ফোরাম অ্যাসাঞ্জের ব্যাপারে মন্তব্য করেছিল ‘অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে নীতিবান কম্পিউটার হ্যাকার’ হিসাবে। তার সম্পর্কে বহুবার বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি একজন বড় মাপের স্বশিক্ষিত এবং বিজ্ঞান ও গণিতে বিস্তর পড়াশোনা করা মানুষ, যে কিনা বুদ্ধিমত্তার যুদ্ধে উন্নতি করেই চলেছে। ’
উইকিলিকস কেনিয়াতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের তথ্য ও সংবাদ, আফ্রিকায় সমুদ্র উপকূলে বিষাক্ত বর্জ্য ফেলার প্রতিবেদন প্রচার করে যাচ্ছিল। এগুলো ছিল শুরুর দিককার কাজ। ২০০৭ সালের ১২ জুলাই বাগদাদে বিমান হামলার ভিডিও প্রকাশ করে উইকিলিকস।
তাছাড়া অন্যান্য তথ্যের সঙ্গে প্রচার করে কাউপথিং এবং জুলিয়াস বায়েরের মতো বড় ব্যাংকারের সংবাদও।
জনসমুক্ষে
২০০৯ সালে অ্যাসাঞ্জ কোপেনহেগেনে উইকিলিকসের সম্পাদক এবং কর্তৃপক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে জনসমুক্ষে আসতে থাকেন বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্যে। বেশ কয়েকটি মিডিয়া কনফারেন্সে তিনি অংশ নেন। যেমন কোপেনহেগেনের নিউ মিডিয়া ডেজ ’০৯, ইউসি বার্কলি গ্রাজুয়েট স্কুল অব জার্নালিজমে ২০১০ সালে লোগান সিম্পোজিয়াম ইন ইনভেস্টিগেটিং রিপোর্টিং এবং ২৫ ও ২৬তম কাওস কমিউনিকেশন কংগ্রেস নামক হ্যাকার কনফারেন্স। ২০১০ সালের প্রথমার্ধে তিনি আলজাজিরা ইংলিশ, এমএসএনবিসি, ডেমোক্রেসি নাও, আরটি এবং দ্য কোলবার্ট রিপোর্টে উপস্থিত হন উইকিলিকসে বাগদাদে বিমান হামলার ভিডিওচিত্র প্রকাশের পর তা নিয়ে আলোচনার অনুষ্ঠানে।
একই বছর ৩ জুন তিনি ড্যানিয়েল এলসবার্গের সঙ্গে একটি ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নেন পারসোনাল ডেমোক্রেসি ফোরামে। এলসবার্গ সে সময় এমএসএনবিসিকে বলেন, অ্যাসাঞ্জ বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ এখন তার জন্য নিরাপদ নয় বলে তিনি মনে করছেন।
১১ জুনে লাসভেগাসে অনুষ্ঠিত হয় ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টার্স অ্যান্ড এডিটরস কনফারেন্স। সেখানে অ্যাসাঞ্জের উপস্থিত থাকার কথা ছিল। কিন্তু কয়েক দিন আগে তিনি অপারগতার কথা জানিয়ে দেন।
২০১০ সালের ১০ জুন জানা যায়, পেন্টাগন চেষ্টা করছে অ্যাসাঞ্জের ঠিকানা বের করতে। এর ওপর ভিত্তি করে বলা হয়, পেন্টাগন অ্যাসাঞ্জকে ভয়ভীতিও দেখাতে চাচ্ছে। এলসবার্গ বলেন, ব্র্যাডলি ম্যানিংয়ের গ্রেফতার এবং তার পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকা- ও চিন্তাভাবনা এই যে, ‘এরপর অ্যাসাঞ্জ আর কী প্রকাশ করতে পারে’ এগুলো স্পষ্টভাবে অ্যাসাঞ্জের জীবনকে বর্তমানে বিপদের মুখে ফেলেছে। এলসবার্গের এই কথাকে হাস্যকর বলে উল্লেখ করেন দি আটলান্টিক, মার্ক অ্যামবিন্ডার।
২০১০ সালের ২১ জুন এক মাসের মধ্যে অ্যাসাঞ্জ প্রথমবারের মতো জনসমুক্ষে আসেন বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে।
সেখানে তিনি একটি প্যানেলের সদস্য হিসাবে ইন্টারনেট সেন্সরশিপের ওপর আলোচনা করেন। সাম্প্রতিককালে তথ্যের ওপর সেন্সর দেওয়া এবং পরিশোধন করে প্রকাশ করার বিষয়ে তার দুশ্চিন্তার কথা তুলে ধরেন। দি গার্ডিয়ান পত্রিকার একটি উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, কীভাবে অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলো এমনকি তাদের নিবন্ধ কিছু সময়ের মধ্যে সম্পূর্ণ পাল্টে নতুনভাবে উপস্থাপন করছে। তিনি সেখানে গার্ডিয়ানকে বলেন, নিজের নিরাপত্তা নিয়ে তিনি ভয় পান না। তিনি স্থায়ীভাবে সতর্ক হয়ে গেছেন এবং আমেরিকা সফর করাটা তিনি এড়িয়ে চলবেন।
তিনি বলেন, ‘প্রকাশ্যে বক্তব্য যুক্তিসঙ্গত কিন্তু যে বক্তব্য ব্যক্তিগতভাবে তৈরি হয় তা কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ। রাজনৈতিকভাবে এটা তাদের জন্য কাজের ক্ষেত্রে একটা বড় ভুল। আমি সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ অনুভব করি কিন্তু আমার আইনজ্ঞ আমাকে উপদেশ দিয়েছেন এই মুহূর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ না করার জন্য। ’
২০১০ সালের ১৭ জুলাই হ্যাকার্স অন প্ল্যানেট আর্থের (হোপ) কনফারেন্সে নিউইয়র্কে বসে উইকিলিকসের পক্ষে জ্যাকব অ্যাপেলবাম বক্তব্য রাখেন অ্যাসাঞ্জের জায়গায়। কারণ কনফারেন্সে ফেডারেল এজেন্সির লোকেরা উপস্থিত ছিল।
তিনি সেখানে ঘোষণা করেন, উইকিলিকসের সাবমিশন পদ্ধতি পুনরায় চালু হয়েছে এবং তা চালু রয়েছে। ক্ষণস্থায়ীভাবে বন্ধ থাকার পর ২০১০ সালের ১৯ জুলাই অ্যাসাঞ্জ অক্সফোর্ডে বক্তব্য রাখেন, যা ছিল উপস্থিতদের জন্য অপ্রত্যাশিত। তিনি সেখানে উইকিলিকস পুনরায় চালু থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এরপর ২৬ জুলাই উইকিলিকস ‘আফগান ওয়্যার ডায়েরি’ প্রকাশ করার পর অ্যাসাঞ্জ উপস্থিত হন ফ্রন্টলাইন ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের জন্য।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক নথি প্রকাশ
২০১০ সালের ২৮ নভেম্বর উইকিলিকস প্রকাশ করতে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২ লাখ ৫১ হাজার গোপন দলিল, যার ৫৩ শতাংশ অপরিশোধিত বলে তালিকাভুক্ত ছিল।
৪০ শতাংশ ছিল গোপনীয় এবং কেবল ৬ শতাংশ ছিল পরিশোধিত ও গুপ্ত। পরদিন অস্ট্রেলিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল বরার্ট ম্যাকক্লেল্যান্ড সাংবাদিকদের বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়া অ্যাসাঞ্জ এবং উইকিলিকস সম্পর্কে খোঁজখবর করবে। ’ তিনি বলেন, অস্ট্রেলিয়ার দিক থেকে আমরা মনে করি এই তথ্য প্রকাশের দ্বারা অনেক অপরাধ আইন লঙ্ঘিত হতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল পুলিশ সে ব্যাপারে খোঁজ করছে। ম্যাকক্লেল্যান্ড অবশ্য এমন আইন জারি করতে পারেনি যে, অস্ট্রেলিয়ান কর্র্তৃপক্ষ অ্যাসাঞ্জের পাসপোর্ট বাতিল করবে এবং অস্ট্রেলিয়ায় ফেরামাত্র অ্যাসাঞ্জকে অভিযোগের মুখোমুখি হতে হবে।
২০১০ সালের ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত উইকিলিকস মোট ১২৯৫টি নথি প্রকাশ করে, যা মোট নথির ১ শতাংশেরও অর্ধেক।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ এ তথ্য ফাঁসের বিরুদ্ধে অপরাধ তদন্তের নির্দেশ দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের আইনজ্ঞরা বিশ্বের বিভিন্ন আইন বেছে দেখেন কোনো আইনের অধীনে অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা যায় কিনা। কিন্তু ব্যাপারটি তাদের কাছে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তথ্য ফাঁসের পর টাইমের প্রতিবেদক রিচার্ড স্টেঙ্গেল একটি সাক্ষাৎকার নেন অ্যাসাঞ্জের।
স্টেঙ্গেল প্রশ্ন করেছিলেন হিলারির পদত্যাগ করা উচিত কিনা? অ্যাসাঞ্জ তার উত্তরে বলেছিলেন, ‘তার পদত্যাগ করা উচিত। যদি এটা দেখানো যায় যে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের জাতিসংঘের ভেতরে গুপ্তচরগিরির জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং আন্তর্জাতিক চুক্তি ভেঙেছিলেন যেখানে যুক্তরাষ্ট্রও স্বাক্ষর করেছিল। ’
পেন্টাগন পেপার্সের বিপদবাঁশি বাজানোর অন্যতম ব্যক্তি ড্যানিয়েল এলসবার্গ বলেন, ‘অ্যাসাঞ্জ আমাদের (আমেরিকানদের) গণতন্ত্র ও আইনের শাসনকে যথাযথভাবে উপকার করছেন গুপ্ত নিয়মনীতিকে চ্যালেঞ্জ করে। এসব গুপ্ত নিয়মের বেশিরভাগই আসলে এদেশের আইন নয়। ’ উইকিলিকসের আমেরিকান কূটনীতিক গোপন নথি ফাঁসের দ্বারা আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তার ব্যাপারটি বিবেচনা করে এলসবার্গ বলেন, ‘অনেক দিক দিয়ে অ্যাসাঞ্জ অবশ্যই একজন যোগ্য ব্যক্তি।
আমি মনে করি তার অনুপ্ররণা হচ্ছে এসব ডকুমেন্টের বেশিরভাগ বিষয়ই প্রকাশ হওয়ার দাবি রাখে। আমরা বাদানুবাদ করছি এমন বিষয় নিয়ে যা বাদানুবাদের দাবি রাখে না। কারণ অ্যাসাঞ্জ এখন পর্যন্ত এমন কিছু প্রকাশ করেনি, যা কারো জাতীয় নিরাপত্তায় আঘাত করে। ’
যৌন হয়রানির অভিযোগ
২০১০ সালের ২০ আগস্ট একটি তদন্ত ও একটি গ্রেফতারি পরোয়ানা অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে বের হয় সুইডেন থেকে। তার বিরুদ্ধে ২৬ ও ৩১ বছর বয়সী দুজন সুইডিশ নারী যৌন হয়রানির অভিযোগ আনে।
একজন এককোপিং থেকে, আরেকজন স্টকহোম থেকে। স্টকহোমের মহিলা এক সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ উপস্থাপন করে অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে। একটি তদন্ত শেষ হওয়ার পর প্রধান প্রসিকিউটর ইভা কিন্নে অভিযোগটি বাতিল করে গ্রেফতারি পরোয়ানা তুলে নেন এবং বলেন, ‘আমি মনে করি না যে, তাকে (অ্যাসাঞ্জ) দোষী সাব্যস্ত করার কোনো কারণ আছে এই মর্মে যে সে ধর্ষণ করেছে। ’ তবুও হয়রানির সম্ভাব্য অভিযোগ আনার চেষ্টায় তদন্ত অব্যাহত থাকে।
অ্যাসাঞ্জ তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেন।
তাকে ৩১ আগস্ট পুলিশ প্রায় ১ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে। এরপর ১ সেপ্টেম্বর একজন সুইডিশ সিনিয়র প্রসিকিউটর মেরিঅ্যান নাই ‘নতুন তথ্য পাওয়া গেছে বলে অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে মামলাটি পুনরায় চালু করেন। ’ এ সময় অভিযোগকারিণীদ্বয়ের উকিল ক্লায়েস বর্গস্ট্রোম এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করেন এবং মামলাটি আর এগিয়ে না নিতে অনুরোধ করেন। অ্যাসাঞ্জ বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে আনীত এই অভিযোগ সম্পূর্ণ সাজানো এবং সেটা করেছে উইকিলিকসের শত্রুরা। ’
অক্টোবরের শেষ দিকে সুইডেন অ্যাসাঞ্জের কাজের অনুমতি এবং বসবাসের জন্য অনুমতি চেয়ে করা আবেদন প্রত্যাখ্যান করে।
৪ নভেম্বর অ্যাসাঞ্জ বলেন, তিনি সুইজারল্যান্ডের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইবেন। এদিকে স্টকহোম ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট অ্যাসাঞ্জকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটকে রাখার একটি অনুরোধ অনুমোদন করে। ২০ নভেম্বরে সুইডেনের পুলিশ বাহিনী অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে একটি আন্তর্জাতিক গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে ইন্টারপোলের মাধ্যমে। সেই সঙ্গে ‘সেঙ্গেন ইনফরমেশন সিস্টেম’-এর মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়নে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করা হয়।
২০১০ সালের ৩০ নভেম্বর ইন্টারপোল অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে লাল পরোয়ানা জারি করে সুইডেনের পক্ষ থেকে যৌন হয়রানির অপরাধের কারণে।
৭ ডিসেম্বর অ্যাসাঞ্জকে গ্রেফতার করে লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ সার্ভিস। অ্যাসাঞ্জ তখন পুলিশের সঙ্গে একটি মিটিং শেষ করে বের হচ্ছিলেন। এরপর অ্যাসাঞ্জের জামিন নামঞ্জুর হয় এবং রিমান্ডের জন্য কাস্টডিতে রাখা হয়। ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত তাকে ওয়ার্ডসওয়ার্থ জেলে রাখা হয়। ১৪ তারিখে অ্যাসাঞ্জ জামিন লাভ করেন শর্তসাপেক্ষে এবং জরিমানা দিয়ে।
প্রশংসা-প্রার্থনা-সমর্থন
ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইস ইনাসিও লুলা ডি সিলভা অ্যাসাঞ্জের গ্রেফতারের পর পরই তার প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেন। তিনি অ্যাসাঞ্জের গ্রেফতারের নিন্দা জানিয়ে বলেন, ‘এটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর একটি নগ্ন হামলা। ’ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ এক বিবৃতিতে নোবেল কমিটিকে আহ্বান জানান, জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে নোবেল প্রাইজ দেওয়ার জন্য। ন্যাটোর রাশিয়ান অ্যাম্বাসেডর দিমিত্রি রোগোজিন অ্যাসাঞ্জের গ্রেফতার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বলেন, ‘এ ঘটনা প্রমাণ করে, পশ্চিমে সংবাদমাধ্যমের কোনো স্বাধীনতা নেই। ’
অ্যাসাঞ্জের সমর্থনে সিডনি টাউন হলের সামনে প্রায় ৫শ মানুষের সমাবেশ হয় ২০১০ সালের ১০ ডিসেম্বর।
১১ ডিসেম্বরে মাদ্রিদে ১শর বেশি মানুষ ব্রিটিশ অ্যাম্বেসির সামনে সমবেত হয় অ্যাসাঞ্জের গ্রেফতারের প্রতিবাদ জানিয়ে। চীনের বেইজিং সিটি গভর্নমেন্টের দ্বারা প্রকাশিত পত্রিকা বেইজিং ডেইলির সম্পাদকীয়তে পরামর্শ দেওয়া হয় নোবেল শান্তি পুরস্কারটি লিউ জিয়াওবোকে না দিয়ে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে দেওয়া হোক।
পুরস্কার-সম্মাননা
অ্যাসাঞ্জ ২০০৯ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী। কেনিয়াতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- নিয়ে তার প্রতিবেদন ‘দ্য ক্রাইম অব ব্লাড এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং অ্যান্ড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’এর কারণে তাকে এই পুরস্কারটি দেওয়া হয়। এই পুরস্কারটি নেয়ার সময় অ্যাসাঞ্জ বলেছিলেন, ‘পুরস্কারটি কেনিয়ার সাধারণ মানুষের শক্তি ও সাহসের প্রতিফলন।
’ ২০০৮ সালে অ্যাসাঞ্জ ইকোনমিস্টের ‘ইনডেক্স অন সেন্সরশিপ অ্যাওয়ার্ড’ জেতেন।
২০১০ সালে অ্যাসাঞ্জকে স্যাম অ্যাডাম্স অ্যাসোসিয়েশনের ‘স্যাম অ্যাডম্স অ্যাওয়ার্ড’ দেয় বুদ্ধিমত্তায় সততার কারণে। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ৫০ ব্যক্তি ২০১০-এর নির্বাচনে ২৩তম স্থান অধিকার করেন ব্রিটিশ ম্যাগাজিন নিউ স্টেটসম্যানের দ্বারা।
উটনি রিডার ম্যাগাজিন তাদের নভেম্বর-ডিসেম্বর ইস্যুতে অ্যাসাঞ্জকে আখ্যায়িত করেন ২৫ বাস্তববাদীর একজন হিসাবে, যারা ‘আমাদের বর্তমান পৃথিবীকে বদলে দিচ্ছেন। ’
সমালোচনা
ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা ড্যানিয়েল ইয়েটস লিখেছেন, ‘অ্যাসাঞ্জ আফগানিস্তানের মানুষের জীবনকে বিপজ্জনক করে তুলেছেন…।
এটা অপরিহার্য যে, তালেবানরা এখন তাদের ওপর ভয়ানক প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করবে, যারা ন্যাটোকে সহায়তা করেছে। তাদের পরিবার এবং গোত্রগুলোও বিপদে পড়বে। ’ এই সমালোচনার জবাবে অ্যাসাঞ্জ ২০১০ সালের আগস্টে বলেন, ‘১৫ হাজার ডকুমেন্ট এখনো দেখা হচ্ছে কোথাও যদি নিরপরাধ ব্যক্তির নাম থাকে তবে তা বাদ দেওয়া হবে। ’
মাইক মুলেন, চেয়ারম্যান অব দ্য জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ বলেন, ‘মি. অ্যাসাঞ্জ নিজে ও তার সূত্র যা ভালো মনে করেন তা সম্পর্কে যা খুশি তাই বলতে পারেন। কিন্তু সত্য কথাটি হলোÑ তারা ইতিমধ্যেই কিছু তরুণ যোদ্ধার রক্তে হাত রাঙিয়েছে।
’ অ্যাসাঞ্জ তার জবাবে বলেন, ‘এটা খুবই উদ্ভট যে, গেট এবং মুলেন… যারা প্রতিদিন গুপ্তহত্যার নির্দেশ দিয়েছেন তারা জনগণকে বোঝাতে চাইছেন যে আমাদের হাতে রক্ত লেগে আছে। এ দুজন তো ওইসব যুদ্ধের মাধ্যমে ঝরানো রক্তের ভেতর হাবুডুবু খেয়ে পথ চলছেন। ’
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক হাউস স্পিকার নিউট গিনগ্রিচ বলেন, ‘তথ্যসন্ত্রাস যা জনগণকে মৃত্যুমুখে টেনে আনছে, তা সন্ত্রাস এবং জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ সন্ত্রাসী কর্মে জড়িত। একজন শত্রুযোদ্ধা হিসাবে তাকে শিক্ষা দেওয়া উচিত। ’
প্রসঙ্গ বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান
ওয়েবভিত্তিক সংবাদমাধ্যম উইকিলিকস যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিসহ গোটা বিশ্বের যে আড়াই লাখ নথি প্রকাশ করছিল তার মধ্যে ২ হাজার ১শ ৮২টি বাংলাদেশ বিষয়ক।
৪ ডিসেম্বর শনিবার পর্যন্ত বাংলাদেশ সময় বিকেল ৫টা পর্যন্ত উইকিলিকস তার ওয়েবসাইটে বাংলাদেশ সম্পর্কে ৬শ ৮৩টি নথি প্রকাশ করেছে।
উইকিলিকসের মাধ্যমে প্রকাশ হয়ে গেছে বাংলাদেশের গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কার অনেক অজানা কথা। ওই সময়কার ভারতীয় কর্মকর্তা মোহন কুমার ও ব্রিটিশ হাইকমিশন রাজনৈতিক কাউন্সেলর অ্যালেক্স হল-হলের কথোপকথনে উঠে এসেছে নানা বিষয়। সেগুলো হলো শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ করে দেওয়ায় বাংলাদেশের রাজনীতির মোড় ঘুরবেÑ এমন কথা আলোচনা করেছিলেন মোহন কুমার ও ব্রিটিশ হাইকমিশনের রাজনৈতিক কাউন্সেলর অ্যালেক্স হল-হল। এতে বলা হয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদের হাতে ক্ষমতা ছিল না।
তিনি ছিলেন সেনা রাজনীতির আজ্ঞাবহ মাত্র। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তর (ডিজিএফআই) জঙ্গিবাদী সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামীর (হুজি) সদস্যদের নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে সমর্থন দিয়েছিল। তারা জঙ্গিবাদীদের মূলধারায় আনতে চেয়েছিল। কিন্তু ঢাকার মার্কিন দূতাবাস তাতে আপত্তি তোলে। মোহন কুমার বাংলাদেশে ভারতের অর্থনীতি ও বাণিজ্যের প্রসারের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সহায়তার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
এছাড়া বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে দীর্ঘ সময় দেখতে চায়নি যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। এ নিয়ে রাজনৈতিক কাউন্সেলরদের সঙ্গে আলোচনা করেন ওই সময়ের ভারতের পররাষ্ট্র বিষয়ক যুগ্মসচিব মোহন কুমার। তারা এই অঞ্চলের বিভিন্ন ঘটনায় ভারতের অংশগ্রহণ নিয়ে আলোচনা করেন। এতে প্রথম দিকে উপস্থিত ছিলেন অ্যালেক্স হল-হল। ওই সময়ে তিনিও মোহন কুমারের সঙ্গে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন।
অ্যালেক্স হল-হল ও মোহন কুমারের মধ্যে আলোচনার পর তারা সম্মত হন যে, শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ দিয়ে দেশকে রাজনৈতিক মোড় ঘোরার পথে নিয়ে গেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সরকার দুই নেত্রীকে বাদ দেওয়ার কৌশল থেকে ফিরে এসেছে। এখন প্রশ্ন হলোÑ সরকার কী নির্বাচনী শিডিউল সামনে নিয়ে এগোবে নাকি মাটি কামড়ে হলেও ক্ষমতায় দীর্ঘ সময় থাকার স্বপ্ন দেখবে। মোহন কুমার স্বীকার করেন, সামরিক অভ্যুত্থান ঘটবে বলে তার মনে হয় না। তিনি প্রস্তাব দেনÑ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারতকে মূল বার্তাটি পৌঁছে দিতে হবে।
এছাড়া ওই তিন দেশের কাজ হবেÑ নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে তাদের ওপর চাপ দেওয়া, নির্বাচন পর্যন্ত সরকারকে সমর্থন দেওয়া এবং রাজনীতি থেকে সেনাবাহিনীকে দূরে থাকতে স্পষ্ট করে বলা। অ্যালেক্স হল-হল উল্লেখ করেছিলেন, যে কোনো সহযোগিতার কথা গোপন রাখতে হবে, যাতে বাংলাদেশের মানুষ মনে না করে এটা এক রকম ষড়যন্ত্রের ফল। মোহন কুমার বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচনের সময়সীমার দিকে ভারতের সতর্ক নজর আছে। ভারত উদ্বিগ্ন যে, সরকার ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়েছে। তিনি বিশ্বাস করেন, ২০০৮ সালের প্রথম ভাগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন দিলে সুবিধা পেত।
তিনি বলেন, ৪ এপ্রিলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ও বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীনের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকের নোট নিয়েছিলেন তিনি। তাতে তার মনে হয়েছে, ড. ফখরুদ্দীন স্বাধীন নন। তিনি কোনো স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দিতে পারেননি। পরিষ্কার করে সরকারের নীতি ব্যাখ্যা করতে পারেননি। এতে মোহন কুমারের মনে হয়, ড. ফখরুদ্দীন আহমদ সেনাবাহিনীর আজ্ঞাবাহী মাত্র।
মোহন কুমার জানান, ভারতের সীমান্তরক্ষী বিএসএফ ও বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বিডিআরের মধ্যে আলোচনায় ভালো অগ্রগতি হচ্ছে। ফেব্রুয়ারি মাসে দুসংস্থার উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বৈঠককে চমৎকার বলে উল্লেখ করেন মোহন কুমার। তিনি বলেন, তাদের মধ্যে আলোচনা শুরুর পর দুপক্ষই অধিক সহযোগিতার কথা বলেছে। কুমার আরও বলেন, বাংলাদেশকে অর্থনীতি ও বাণিজ্য উন্মুক্ত করে দিতে চাপ দিয়ে ভারতকে সহায়তা করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য।
পাকিস্তানের ব্যাপারে মার্কিন উদ্বেগের মূলে আছে পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্রসম্ভারের সুরক্ষা।
উইকিলিকসের সর্বশেষ প্রকাশিত মার্কিন কূটনৈতিক দলিলে দেখা গেছে
পাকিস্তানের স্থিতিশীলতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র খুবই উদ্বিগ্ন। পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রভা-ারের নিরাপত্তা নিয়ে এসব দলিলে যুক্তরাষ্ট্রের যে উদ্বেগ প্রকাশিত হয়েছে তাতে ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে পাকিস্তান। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ অবশ্য এই উদ্বেগ নাকচ করে দিয়েছিল। এই দলিলে আরো দেখা যাচ্ছে, দেশটির প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারিকে ক্ষমতাচ্যুত করার কথা ভেবেছিলেন
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক কায়ানি। উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া সবশেষ এসব নথিপত্রে ওয়াশিংটনের সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্কের জটিলতা, সংবেদনশীলতা ও বিষয়টির গুরুত্বই আরো একবার প্রতিফলিত হয়েছে।
শুধু পরমাণু অস্ত্র নিয়ে আশঙ্কাই নয়, তারবার্তায় পাকিস্তানি সামরিক ও গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষের সম্পর্কে মার্কিনদের হতাশা ও পারস্পরিক সন্দেহের বিষয়টিও উঠে এসেছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত তো এই সন্দেহও প্রকাশ করেছেন যে পাকিস্তানে মার্কিন সহায়তা বাড়ানো হলেও তাতে ইসলামাবাদের জঙ্গি দমনের কার্যকারিতা আদৌ বৃদ্ধি পাবে বলে মনে হয় না। আর এর পেছনে কারণ শুধু আফগানিস্তানের পরিস্থিতি নয়, ওই অঞ্চলে ইসলামাবাদের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ, যার মধ্যে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতাও দায়ী।
তথ্যসূত্র:shaptahik-2000
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।