বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই করছে। চারদিক থেকে ঝুপঝুপ করে নামছে অন্ধকার। সাথে কুন্ডলী করা কুয়াশা। ঠান্ডার তীব্রতাও অনেক। মনে হচ্ছে শরীরে চাপান ভারী জ্যাকেট কেটে কেটে ভেতরে ঢুকছে শীতের ফলা।
এরই মধ্যে হলের বাইরের মাঠে দাঁড়িয়ে কুয়াশার মতো কুন্ডলী করছে অনেকে। খন্ড খন্ড কুন্ডলীতে এসে যোগ দিলেন বইটির লেখক শেখ মহিতুর রহমান বাবলু। সজ্জন উপস্থাপক নাসিরুদ্দিন কিশোর। চ্যানেল আই-এর সাংবাদিক এমদাদুল হক। কবি মনির।
মাইনুল ইসলামসহ আরো অনেকে। তাদের আড্ডা দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ জমেছে। কমিউনিটির সব সুশীল মানুষগুলোর আড্ডা এক স্থানে। যার কাছে হার মেনে যাচ্ছে তীব্র ঠান্ডা।
আমিসহ অন্যান্যরা আর টিকতে পারছিলাম না ঠান্ডায়।
সুতরাং ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচতেই ঢুকে পড়লাম হলের মধ্যে। তখনো একটি ইতালিয়ান নারী সংগঠনের অনুষ্ঠান চলছে সেখানে। ওরা একটু বেশি সময় নিয়ে ফেলল। এরই মধ্যে শ্রমিক ফেডারেশন ‘সিজল’ এর ডেলিগেট বাবু ভাই দুইবার ওদেরকে তাড়া দিয়ে গেলেন। মনে হলো তাতে একটু কাজ হলো।
ওরা ওদের অনুষ্ঠান শেষ করলো অল্প সময়ের মধ্যে। কে যেন হেকে বলল, ‘সবাই আসেন’। অমনি হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল সবাই। কানায় কানায় ভরে উঠল ম্যাস্ত্রে কমুনের হল। মুহূর্তের মধ্যে লটকে দেয়া হলো অনুষ্ঠানের ব্যানার।
উপস্থাপক নাসিরুদ্দিন কিশোর উঠে এলেন মঞ্চে। জীবনের গতি, সময়ের গতি, কলমের গতি, ভাষার গতি নিয়ে লম্বা-চওড়া বক্তৃতা করলেন তিনি। কথার ফাঁকে ফাঁকে মঞ্চে ডেকে নিলেন অনুষ্ঠানের সভাপতি আবদুল আজিজ সেলিম ও অনুষ্ঠানের মধ্যমনি শেখ মহিতুর রহমান বাবলুসহ অতিথিদের। করতালিতে উত্তাল হয়ে উঠল হল। আর এভাবেই শুরু হল ইতালি থেকে প্রকাশিত একমাত্র বাংলা ভাষার ড্রাইভিং বই ‘ইতালীয়ান ড্রাইভিং লাইসেন্স এবি’ এর দ্বিতীয় সংস্করণ এর প্রকাশনী উৎসব।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন কামরুজ্জামান বাবু, রাজা ওয়াসীম খাঁন সজন, এম এ হাকিম, সাইফুল ইসলাম খোকন প্রমূখ।
অনুষ্ঠানের মধ্যমনি লেখক সাংবাদিক শেখ মহিতুর রহমান বাবলু ইতালীয়ান ‘ড্রাইভিং লাইসেন্স এবি’ বইটির লেখা থেকে শুরু করে প্রকাশ সময় পর্যন্ত তার বিভিন্ন অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণ করে বলেন, এখন থেকে প্রায় ১০ বছর আগের কথা। তখন ইতালিতে বাংলাদেশের ড্রাইভিং লাইসেন্স অনুমোদন করা হতো। সে সময় ইতালির প্রভাবশালী দৈনিক পত্রিকা ‘কর্রিয়েরে দেল্লা সেরা’ ইতালির সড়ক দুর্ঘটনার উপর একটি সমীক্ষামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে তুলে ধরা হয় ইতালিতে কোন দেশের অভিবাসীরা কত শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়।
সেই তালিকার শীর্ষে ছিল বাংলাদেশের নাম। যা লেখককে দারুনভাবে নাড়া দেয়। তার মধ্যে একটি আলোড়ন সৃষ্টি হয়। আর সেই আলোড়ন থেকেই তিনি ইতালিয়ান ড্রাইভিং লাইসেন্স ও সড়ক আইনের উপর বাংলা ভাষায় বই লিখার উদ্যোগ নেন। এছাড়া আরো অনেক কারণ আছে, তা হলো শুধু মাত্র ভাষাগত সীমাবদ্ধতার কারণে ইতালিতে অধিকাংশ বাংলাদেশি অভিবাসী ড্রাইভিং পরীক্ষায় পাশ করতে পারে না।
সড়ক আইন বুঝতে পারে না। শুধুমাত্র ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকার কারণে জীবন থেকে পিছিয়ে পড়ছে। সময়ের সাথে তাল মেলাতে পারছে না। হারাচ্ছে ভালো কাজের অফারসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা। সর্বপরি অনেকের জীবন প্রদীপ নিভে যাচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায়।
বই লিখতে গিয়ে তিনি বারবার বিভিন্ন জটিলতার মুখে পড়েন। তা থেকে উদ্ধার পেতে ছুটে যান ড্রাইভিং স্কুলে। ফিরে আসেন লেখার টেবিলে। আবার ছুটে যান সংশ্লিষ্ট দফতরে। এভাবে কেটে যায় প্রায় ২ বছরেরও বেশি সময়।
বই লিখার কাজ শেষ করার পরে প্রকাশ করতে গিয়ে শুরু হয় নতুন জটিলতা। ইতালির কোনো প্রকাশক বইটি প্রকাশ করতে আগ্রহ দেখায় না। সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে প্রকাশের জন্য আইনগত অনুমোদন পেতেও পোড়াতে হয় অনেক অসুবিধা। এভাবে কেটে যায় আরো এক বছর। কিন্তু লেখক বাবলু হাল ছাড়েননি।
লেগে থেকেছেন নিজেদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। এক সময় তাদের বরফ গলতে শুরু করে। সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে অনুমোদন মেলে। ইতালির অন্যতম প্রধান প্রকাশক প্রতিষ্ঠান ‘আতেছিয়া’ এগিয়ে আসে বইটি প্রকাশের জন্যে। এরপর শুরু হয় অন্যরকম এক যুদ্ধ।
ইতালি থেকে বাংলা ভাষায় বই প্রকাশ করতে বাংলার কাজ জানা দক্ষ মানুষের অভাব দেখা দেয়। পান্ডুলিপি ঢাকায় পাঠানো হয় ছাপার যোগ্য পিডিএফ করার জন্য। প্রথমে ঢাকার একটি নামকরা প্রতিষ্ঠানকে কাজটি দেয়া হয়। তারা কোনো ভাবেই ‘আতেছিয়া’র চাহিদা মতো কাজ করে দিতে পারছিলনা। পান্ডুলিপি ফেরত নিয়ে তারপর দেয়া হয় আর একটি প্রতিষ্ঠানকে।
সেখানেও প্রায় অভীন্ন সমস্যা দেখা দেয়। তারা মুখে বলে এক রকম কথা, আর কাজ করে অন্য রকম। এভাবে গড়িয়ে যায় আরো এক বছর। এক পর্যায়ে ‘আতেছিয়া’ বইটি প্রকাশের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তখন বাধ্য হয়ে লেখক নিজে ঢাকায় গিয়ে বসে থেকে কাজ করিয়ে এনে পিডিএফ তুলে দেন প্রকাশকের হাতে।
এভাবেই ২০০৫ সালে ইতালি থেকে প্রথম বাংলা ভাষার বই প্রকাশিত হয়। প্রকাশকের প্রত্যাশা থেকে কয়েক গুণ বেশি বই বিক্রি হয় অল্প সময়ের মধ্যে। উদ্যোগ নেয় দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের।
লেখক বাবলু কমিউনিটির সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার বক্তব্য শেষ করেন।
সভাপতি আবদুল আজিজ সেলিম বলেন, ‘ইতালীয়ান ড্রাইভিং লাইসেন্স এবি’ শুধু মাত্র একটি বই নয়।
এটি একটি দলিল। এমন একটি বই বাংলাদেশের সড়ক আইন এবং ড্রাইভিং এর ক্ষেত্রে অনুসরণ করলে সেখানের যানজট ও সড়ক দুর্ঘটনা ৮০ ভাগ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। রাজা ওয়াসীম খান সজন বলেন, শেখ মহিতুর রহমান বাবলু ইতালির বাংলাদেশি কমিউনিটির গর্ব। তিনি ইতালিতে বাংলা ভাষাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষাকে নতুন করে পরিচিত করিয়েছেন।
কমিউনিটির সম্মান উজ্জল করেছেন। তিনি আমাদের জন্য অনুকরণীয় ইতিহাস হয়ে থাকবেন।
কামরুজ্জামান বাবু বলেন, বাংলাদেশে প্রতিদিন যে পরিমাণে সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে তাতে বাংলাদেশের স্কুল কলেজের পাঠ্য সূচিতে ‘ইতালীয়ান ড্রাইভিং লাইসেন্স এবি’ এর মতো একটি বই থাকা উচিৎ।
আসমা পারভীন ঝুমুর
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।