আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিবর্তিত একজনঃ প্রথম পর্বঃ কওমী মাদ্রাসার গল্প

থিংক সিম্পল।

এই টাইটেলের সব গুলা পোস্ট আমার ঢোল। আমি ইচ্ছা মতন বাজাবো, তবে এর ছন্দ আমার জীবন থেকে নেয়া। অতএব, সামনে আগানোর আগেই সতর্ক হয়ে যান। ভাল না লাগলে চোখে তুলা দিয়ে বসে থাকুন।

প্রথমে ভাবসিলাম অল্প কিছু পর্বে আমি কোথেকে কই আসলাম, তা লিখে ফেলব, গতানুগতিক আস্তিক থেকে নাস্তিক বা নাস্তিক থেকে আস্তিক অথবা বিশ্বাসের বিবর্তন নিয়ে প্রতিটা রচনার মত। পরে ভাবলাম এতে করে নিজের ঢোল ভাল মতন পেটানো যাবে না, আর তাছাড়া মাটির ময়নার মাদ্রাসার ছেলেটের মত আরেকজন মাদ্রাসায় পড়ুয়া ছেলের এই পর্যন্ত আসার গল্পটা সবাইকে বলতে আমার খুবই ইচ্ছে করে। তাই লম্বা ডেইলী সোপের জন্যেও প্রস্তুত হয়ে যান। (এক দিন সমান চব্বিশ ঘন্টা নাও হতে পারে) আর সবার মতন বুক ফুলিয়ে বলতে পারিনা যে এই মাটিতে আমার জন্ম, তার থেকেও বেশী বুক ফুলায় এক সময় বলতাম নবীর দেশের মাটিতে আমার জন্ম। তখন আব্বা সৌদিতে এক ট্রাভেল এজন্সিতে চাকুরি করতেন।

জন্মের আড়াই বা তিন বছরের মাথায় আমি হাজীও হয়ে যাই। তখনকার একটা ঘটনা আমার মনে পড়ে, সায়ী করার সময় যখন আস্তে দৌড়ানো লাগে, তখন আমি জোড়ে দৌড় দিসিলাম, ভিরের মধ্যে আম্মাকে হাড়ায় ফেলি তারপর ভ্যা করে কান্না, জানিনা এটা আমার স্মৃতি নাকি আম্মার বলার কারণে আমার মনে আসে। হারায় যাবার কিচ্ছুক্ষন পর আম্মা দৌড়ে এসে আমাকে ধরেন, তারপর বাকী সময় আম্মার কোলে থেকে আর নামিই নাই! জাবালে রহমতে আমার একটা ছবি ছিল, আমি কেঁদে আম্মুকে ডাকছি। আম্মুর কাছ থেকেই আমি অ, আ, ক, খ, শিখেছিলাম। আম্মার ইচ্ছা ছিল আমাকে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন, কিন্তু আমার পরিবারের বলতে গেলে এটা একটা প্রথা যে প্রত্যেক পুত্রের একটা ছেলেকে আল্লাহর রাস্তায় দান করতে হবে।

আল্লায় জানে বাপ চাচাদের মধ্যে প্রতিযোগীতা ছিল কিনা, সবাই যার যার ছোট ছেলেকে পাঠালেও আব্বা পাঠালেন প্রথম সন্তানকে। আমি ছিলাম আম্মার ফ্যান, আর আমার আব্বা ছিলেন তার আব্বার ফ্যান, আব্বা যখন জানলেন প্রায় ডজনের কাছাকাছি সন্তানের বাপ আমার দাদা তার পুত্র বিয়োগ আর সহ্য করতে পারছেন না, তখন প্রবাসের সুখের জীবন বিসর্জন দিয়ে পরিবার সহ দেশে ফেরত আসলেন। দেশে আসার কিছুদিন পর আমাকে মাদ্রাসায় পাঠানো হল, ফজরের নামাজের পর পাজামা পাঞ্জাবি পড়ে তিন টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে মাদ্রাসায় যেতাম, এখন এই দুরত্বের ভাড়া পনেরো টাকা। ন’টায় ছুটি দিত, বাসায় এসে গসুল করে ঘুম, তারপর আবার বারোটায় ক্লাসের জন্যে যেতাম। বিকালে বাসায় এসে কার্টুন দেখতাম।

তখন বিটিভির কার্টুনই ছিল ভরসা, সন্ধ্যার পর আম্মুর কাছে টুক টাক বাংলা ইংরেজী পড়তাম আর রাতে তিন ভাই (আমার বড় দুই চাচাতো ভাই) এক সাথে ম্যাগগাইভার, দ্যা ফল গাই সিরিয়াল গুলো দেখতাম। তখন অনেক রাতে হত, সম্ভবত দশটার ইংরেজী সংবাদের পর। তো আমরা জেগে থাকার জন্যে বালতি পানি নিয়ে রাখতাম, ঘুম আসলে যাতে চোখে দেয়া যায়। এভাবে রাত জেগে টিভি দেখার ফলাফল সকালে ক্লাসে যেয়ে ঘুম, ঘুমটা খুব আনন্দের লাগত, বসে বসে ঘুমায় কত সপ্ন দেখতাম যে ম্যাগ গাইভারের মত শক্রুদের বুদ্ধি দিয়ে ঘায়েল করছি! কিন্তু চোখ খুলে যেই হুজুরের ভিলেন মার্কা হাসি দেখতাম, তখন সুখ নাই হয়ে যেত, রেহেলের উপর রাখা কিতাব খানা হজুরের সামনে চলে গেছে, সেইটা আনতে হলে একটা বেতের বারি খাইতেই হবে, বাচার জন্যে কোন বুদ্ধিও মাথায় আসত না। এইভাবে কাটলো ছয় মাস, আমি আল্লাবান্দা, কায়দা সেপারা পড়ি আর কার্টুন দেখে বেড়াই।

মোটামুটি লেজ বিশিষ্ট ছিলাম, লেজের আগে বান্দরের বৈশিষ্ট না লাগিয়ে শান্ত শিষ্ট যুক্ত করবেন। তো আমার প্রতি আল্লাহর পেয়ার বৃদ্ধি পাইল। বাসায় থাকলে শয়তানের আসর বেশী পড়তে পারে এমন কথা বলে আমারে বাসা থেকে বের করে দেয়া হল। স্থান হল বোর্ডিং এ। এইখানে বড়ই যন্ত্রনায় পরলাম, এক হাত যায়গায় নিজের বিছানা পাততে হবে, এক চুল পরিমান বেশী হলেই বি এস এফ এর মত হামলা চালাতো পার্শবর্তী তালেবে এলেম(ছাত্রদেরকে বলা হয় আরকি)।

ফজরের আজানের এক ঘন্টা আগে রিং বেজে উঠত, এই রিং এর সাথে সাথে না উঠলে পরবর্তীতে সরাসরি বেতের বারির মাধ্যমে উঠানো হত, তাও অনেকে উঠত না। অনেকের আবার তালব্য শ বের হয়ে থাকত। বড় হুজুর ঠিক ঐ যায়গায় গুতা দিয়ে তাদের জাগাতেন। ক্লাস শুরু হত ফযরের আযানের দশ মিনিট আগে, নামাজের পর সবক দিতাম। সাতটার দিকে দিতাম সাত সবক, মানে সাতদিনের পুরোন সবক আর দুপুর বারোটার পর থেকে বিকাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে দিতাম আমক্তা।

আমক্তা বলা হয় যে পারাগুলো মুখস্ত হয়ে গেছে, সেগুলো শুনানো। মাগরিবের ঠিক পর থেকে পৌণে নয়টা পর্যন্ত নতুন সবক মুখস্ত করার সময় পেতাম। মাদ্রাসায় বিনোদনের বড়ই অভাব ছিল। থাকবেই না বা কেন, বিনোদন তো সব শয়তানের কাজ কারবার। টিভি দেখা হারাম, গান শুনা হারাম, রেডিও শুনা হারাম, বই পড়া হারাম, পত্রিকা পড়া হারাম, মোট কথা বাংলা ইংলিশে সব পড়া হারাম।

বিনোদন বলতে এশার নামাজের পর হুজুরদের সম্মিলিত বয়ানই ছিল একমাত্র উৎস। এইখানে বিনোদন প্লাস সোয়াব মিলত, কারণ হুজুররা বলতেন এই ধরনের আলোচনায় ফেরেশতারা দোয়া বর্ষণ করতে থাকেন। সেখানে আদম হাওয়ার কেচ্ছা কাহিনী থেকে শুরু করে নুহ, ইব্রাহীম ইসমাইল, ঈসা, ইউসুফ নবী এদের সব কাহিনী শুনানো হত। মাঝে মাঝে পুন প্রচারের ন্যায় পুনঃ বয়ানো দিত হুজুরেরা। সেইসব কাহিনী বলার পাশাপাশি মহাজগৎ সম্পর্কেও থাকত অদ্ভুত সব গল্প।

যেমন প্রথম আসমান কতদুরে, সেখানে যেতে ফেরেশতাদের কতক্ষন লাগে, জ্বীনেরা কেন যেতে পারে না। কবে থেকে তাদের এ যাওয়া বন্ধ হল, সিদরাতুল মুন্তাহার পরে কি আছে ইত্যাদি। উল্লেক্ষ্য তাদের সব গল্প আজকের মত মোডিফাইড না। একেবারে ট্রাডিশনাল গল্প, যা তারা যুগ যুগ ধরে শুনে আসছে। যাহোক তাদের কথা শুনে মনে হত কুরানে এত কিছু লেখা আছে! দুনিয়ার সব প্রশ্নের উত্তর এই এক বইতেই পাওয়া যায়! মানুষ তাহলে স্কুলে পড়ে কেন! ওগুলা নিশ্চই শয়তানের শিক্ষা।

এছাড়াও চলত জান্নাত জাহান্নামের গল্প। জাহান্নাম হচ্ছে শাস্তি দেয়ার স্থান, যারা আল্লার বিরুদ্ধে তাদের সহ যারা আল্লার আদেশ মত চলে না, তাদের শাস্তি হবে এখানে। খাবার হিসেবে দেয়া হবে রক্ত পুজ। তাদেরকে দংশন করবে বড় বড় সাপ। জাহান্নামে যাবার আগে রয়েছে কবরের আযাব, নানা কারণে কবরে আযাব হবে, মুনকার নকীরের ইন্টারভ্যু এর পর হবে শান্তি অথবা শাস্তি।

একফোটা পেশাব ভয়াবহ কবরের আযাবের কারণ হবে। এতসব আযাবের কথা শুনে সারাক্ষন ভয়ে থাকতাম। আবার জান্নাতের ব্যাপারে বলা হত যে কেয়ামতের দিন নাকি আল্লাহ তায়ালা হাফেজদের বলবেন যে পাঠ কর, তারা এক আয়াত পাঠ করবে আর এক তলা করে বাড়ি দেয়া হবে, এভাবে ছয় হাজার ছয়শত ছিশট্টি আয়াত পাঠে সমপরিমান দালান জান্নাতে পাওয়া যাবে, একজন আমল ওয়ালা হাফেজ দশজন জাহান্নামীর জন্যে সুপারিশ করতে পারবে, তার মা বাবাকে নুরের মুকুট পড়ানো হবে ইত্যাদি, এছাড়া বলা হত জান্নাতের দরজা সমুহ স্বর্ণ নির্মিত হবে, পিলার হবে সবুজ স্বচ্ছ পাথর নির্মিত। সেখানে থাকবে দুধের নহর, মদের নদী, হুর; এরা রক্ত মাংশের মানুষ থেকে হাজারগুণ সুন্দর হবে, এদের কারো থুতু যদি পৃথিবীতে পরত, তাহলে সমস্ত পৃথিবী সুগন্ধময় হয়ে যেত, এরা যদি একবার হাসত, তাহলে নুরের ঝলকানিতে পৃথিবী রাতের বেলা আলোকিত হয়ে যেত, এদের শরীরে কাপর এত পাতলা থাকবে যে তা ভেদ করে দেহ দেখা যাবে, এদের কারো সাথে একবার সোহবত করলে সত্তুর হাজার বছর কেটে যাবে। কিছু বেয়াড়া আবার প্রশ্ন করে বসত, হুজুর সোহবত কি জিনিস? হুজুর বলতেন, সোহবত মোহব্বতের প্রতিশব্দ।

আমাদের মাদ্রাসাটা বড় মাদ্রাসাই ছিল তাই প্রতি বছর পাগরি প্রদান ও বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতি ছাত্রদের পুরস্কার অনুষ্ঠান একসাথে হত। মক্তবে থাকতেই এইসব অনুষ্ঠানে ক্বেরাত, আযান ও ধর্মীয় নাটিকা প্রদর্শনে অংশ নিতাম। ধর্মীয় নাটিকা বলতে দশ পনেরো জনের একটা টিম থাকত। আমি একটা টিমের ইমাম ছিলাম, আমার নাটকের বিষয় ছিল জানাজার নামাজ। সংলাপ গুলো ছিলো এমন ইমামঃ এই মাইয়েতের নাম কি? আত্মীয় নাম বলল।

ইমামঃ মাইয়েত বালেগ? না নাবালেগ? পুরুষ না মহীলা? জবাবের পর আবার ইমামঃ নামাজ রোজা কাজ্বা আছে? আত্মীয়ঃ জ্বি হুজুর আছে, কাফফারা আদায় হইয়াছে? তখন স্বজনের পক্ষে অভিনেতাঃ কাফফারা আবার কি হুজুর? তারপর কাফফারা কি এর বর্ণনা, তারপর জানাজা নামাজ পড়ায় শেষে কিভাবে কবর দেয়া হবে তার প্রদর্শন। কিছুটা বড় হবার পর বাইরে যাবার অনুমতি মিলল। মাদ্রাসার কাছে বড় মাঠ ছিল। মৌসুম অনুসারে সব খেলাই খেলত ছাত্ররা। ফুটবলের ব্যপারে হুজুরদের নির্দেশ ছিল হাফ প্যান্ট পড়ে খেলা যাবে না।

যেদিন বৃষ্টি হত, সেদিন কেউ মাঠে যেত না। আমি যেতাম ছাতা নিয়ে, আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে আছে, চারদিকে বৃষ্টি হচ্ছে, মাঠে পানি জমে যাচ্ছে, সবুজ ঘাসগুলো পানির মধ্যে মাথা উচু করে থাকার চেষ্টায় ব্যস্ত, চারদিকে টুপটাপ শব্দ আর হালকা বাতাস, ভীষণ ভাল লাগা এক মুহুর্ত! বৃষ্টিতে না ভিজে এই দৃশ্য দেখতেই ভাল লাগত। এরকম বৃষ্টির দিনে মাঠে যেয়ে দেখি ছাউনির নিচে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আমার চেয়ে বয়সে বড় হবে, কাছে যেতেই বলল “তোমার ছাতাটা একটু দিতে পারো? আমি বাসায় যেয়ে আমার ছাতাটা নিয়ে এসে তোমারটা দিয়ে দেব, আমার ছাতাটা ভেঙ্গে গেছে” আমি বললাম ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি আইসেন। একটু পর নিজের ছাতা মাথায় দিয়ে আসল, ছাতা ফেরত দিয়ে পকেট থেকে দুটো পেয়ারা বের করে আমাকে একটা দিল। প্রথমে নিতে চাই নাই, পরে জোরাজুরি করলে বেগানা নারীর হাত লেগে যেতে পারে এই ভয়ে নিয়ে নিলাম।

দেখি ও বসে আছে, নাম জিজ্ঞেস করলাম, বলল (আসল নামটি এখন মনে নেই, ছদ্মনাম দিলাম তাই)লাবন্য। কিসে পড়েন জিজ্ঞেস করলাম, আঙ্গুল দিয়ে দেখালো ঐ স্কুলটায়। মাদ্রাসার থেকে কিছু দূরে একটা স্কুল ছিল। তখন মনে করতাম যে স্কুলে কিভাবে সংসার চালাতে হয় তা শেখানো হয়, অতএব আল্লা কি বলেছেন এটা ওদের না জানলেও চলবে। আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি কোথায় পড়ি, বললাম মাদ্রাসায়, -“মাদ্রাসায় কি পড়ানো হয়”? --কুরান শরিফ, -“কুরান শরিফে কি আছে? প্রশ্ন শুনে অবাক হলাম, উনি জানেননা কুরান শরিফে কি আছে! আমি বললাম, কুরান শরিফে সব আছে।

-“কুরান শরিফে অভিকর্ষ শক্তি সম্পর্কে কি লেখা আছে”? --জিজ্ঞেস করলাম এটা কি জিনিস? -“যে কারণে আমরা পৃথিবী পৃষ্ঠে থাকতে পারি, মহাকাশে ছিটকে যাই না। আমি বললাম ওহ! এই কথা, আমরা আকাশে ছিটকে যাই না কারণ আমরা ভারি, আর আকাশ উপরে, মাটি যদি উপরে হত তাহলে আমরা পড়ে যেতাম। উত্তর শুনে হাসতে হাসতে শেষ, আমারো কেমন লজ্জা লাগল, নিজেরে গাধা মনে হল। ও আমাকে বল, তোমার পায়ের নিচে পৃথিবীর আরেক প্রান্তে মানুষ আছে, তোমার কথা অনুযায়ীতো তাদের পড়ে যাবার কথা ছিল! আমার তখন ধারনা ছিল না যে পৃথিবী গোল, ও আমাকে তখন বুঝিয়ে বলল অভিকর্ষ শক্তি কি। সন্ধ্যার পর পড়তে বসে মনোযোগ বসল না।

রাতে বয়ানের সময় হুজুরকে জিজ্ঞেস করলাম অভিকর্ষ শক্তি কি? হুজুরও বলতে পারলেন না, তাকে বুঝিয়ে বললাম, যে কারণে আমরা পড়ে যাই না, হুজুর বললেন, আল্লাহ মাটিকে আদেশ করেছেন সব কিছু ধরে রাখতে, তাই কেউ কোথাও পড়ে না, মনে মনে ভাবলাম ইস! এই চিন্তাটা তখন মাথায় আসল না কেন! কয়েকদিন টানা বৃষ্টিতে লাবণ্যের সাথে ভালই বন্ধুত্ব হয়ে গেল, ওকে আপু ডাকতে বলেছিল। বিজ্ঞান সম্পর্কে আমার ধারনাগুলো শুনে প্রায়ই হাসতো, আমার রাগ লাগলেও যখন নতুন কিছু জানতে পারতাম, তখন ভাল লাগত। তার সাথে থাকার কারণে মহাবিশ্ব সম্মন্ধে অনেক ভুল ধারনাই আমার ভেঙ্গে গিয়েছিল। আলোচনার পাশাপাশি সে আমাকে তার ক্লাস এবং তার বড় ভাইদের ক্লাসের বই ও বিভিন্ন বিজ্ঞান লেখকের বই পড়তে দিতো। সেই সময়ে আমি আব্দুল্লাহ আল মুতির অনেকগুলো বই পড়েছিলাম।

এই বই গুলিই হুজুরদের কাছে ছিল শয়তানের জ্ঞান। নব্বই এর পর একবার সূর্য গ্রহন হয়। সেদিন সকল ছাত্রের সূর্য গ্রহনের নামাজ পড়া বাধ্যতামুলক ছিল। হুজুররা জামাত করে নামাজ শুরু করেন অনেক আগে থেকেই। আমাদের মাঝে নানা রকম ভয় ছিল সূর্য গ্রহনের ব্যপারে।

যেমন, এই সময় সুর্যের দিকে তাকালে চোখ নষ্ট হবে, ভবিষ্যতের বাচ্চার উপর প্রভাব ফেলবে, সুর্যের এমন তাপ হবে যে ব্রেন গলে যেতে পারে, যারা সূর্য গ্রহন দেখবে, তারা দাজ্জালের দোসর হবে ইত্যাদি। কিন্তু আমার সূর্যগ্রহন দেখার ইচ্ছা ছিল প্রবল, আগে থেকে সিনেমা দেখার ভিডিও ক্যাসেটের ফিতা যোগাড় করে রেখেছিলাম। , আপু বলেছিল বলের মধ্যে পানি অথবা এক্সরে এর প্লেট দিয়ে দেখতে, কিন্তু ঐ ফিতা দিয়েই ভাল দেখা যাবে এটা আমি জানতাম। সেদিন রাতে মাদ্রাসায় বিচার আসর বসে, বিভিন্ন কারণে যারা নামাজ ফাকি দিয়েছিল, তাদের শাস্তি হচ্ছে, আমি দাঁড়িয়ে আছি আর ভয়ে ভয়ে ভাবছি আমার কি হবে! কারণ আমি হুজুরদের সাথে বেয়াদবী করেছি, হুজুররা আব্বাকে খবর দিতে দুজন ছেলেকে পাঠিয়ছে। আব্বা আসলেই আমার বিচার শুরু হবে।

আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ যে একেতো আমি নামাজ পড়িনি, তার উপর বলেছি যে সূর্য গ্রহন একটি সাধারণ ব্যাপার। পৃথিবীর অনেক যায়গা থেকে সূর্য গ্রহন দেখা যায় না, যেখান থেকে দেখা যায় না সেখানে যদি নামাজ না পরা লাগে, তাহলে এখানে কেন নামাজ পড়তে হবে? মহানবী যদি জানতেন এইটা একটা সামান্য ঘটনা, তাহলে তিনি ভয়ও পেতেন না, আর সুর্য গ্রহন শেষ না হওয়া পর্যন্ত নামাজো পড়তেন না, একটি মহাজাগতিক ঘটনায় ভয় পাবার কি আছে, এর থেকেও ভয়ঙ্কর ঘটনা মহাবিশ্বে ঘটতে পারে! আমার বাবা আসলেন, তার সামনে আমার বিচার শুরু হল, আমার ট্রাঙ্ক ঘেটে পাওয়া গেল ক্লাস ফাইভের ইংলিশ গ্রামার বই আর অন্যান্য কিছু বই। এইগুলা বর্তমানে জিহাদী বই এর মতই পরিত্যাজ্য ছিল তাদের কাছে। বড় হুজুর আমাকে বললেন, তোমাকে বড় শয়তানের ধরেছে, পৃথিবীতে দুই প্রকার জ্ঞান আছে। আল্লাহর জ্ঞান, আর শয়তানের জ্ঞান, আল্লাহর জ্ঞান হচ্ছে কুরান হাদিস, আর সেই জ্ঞানের ভাষা আরবী।

আর শয়তানের জ্ঞান হচ্ছে বিজ্ঞান এবং ভাষা বাংলা ইংরেজী! শয়তান চায় তার দল ভারী করতে, শয়তানের জ্ঞান অর্জন করে আজকে মানুষ দুনিয়ার পিছে ছুটছে, তাই এত সমস্যা চারিদিকে। আর আল্লার জ্ঞান অর্জন করলে সব জায়গায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হত, মুসলমান ছাড়া বাকী সবাই শান্তি বিনষ্টকারী, তাই তারা সত্যের পথিকদের পথচ্যুত করতে চায়। ছোট মানুষ, গুরুজন যা বলে তাই ঠিক মনে হয়। আমাকে তওবা পড়ানো হল, এবং এক সপ্তাহ মাদ্রাসার বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হল। আর আব্বা চলে যাবার পর আপুর কথা হুজুওরদের কানে যায়, এই জন্যে ভয়াবহ পিটানি খাই।

হুজুরদের কথাই যে ঠিক তা কিছুদিন পরেই আমার কাছে সত্য বলে মনে হল। শাস্তির মেয়াদের পর ঘটনা চক্রে জানতে পেলাম যে আপুটা হিন্দু। তখন আমার মনে হল সত্যিইতো! এরা মুসলমানদের শয়তানের পথে নিয়ে যেতে চায়! ও যে মুসলিম নয় তাতো আমাকে বলেনি! কি প্রমাণ আছে যে ও যা বলেছে তা সত্য! এরপর থেকে ওকে এড়ায় চলা শুরু করলাম। খেলাধুলা আমি প্রায় ছাড়তে বসেছিলাম। প্রতিদিন বিকালে ওদের বাসার নিচে বসে বিভিন্ন বই পড়তাম।

বই পড়াটা নেশার মত হয়েগিয়েছিল। এ ঘটনার পর মাঠে যাওয়াই কমায় দিলাম। ধর্ম পালনে আমি ভীষণ মনযোগী হয়ে পড়লাম। আল্লাহর ক্ষমা এবং তার আনুকুল্য লাভের জন্যে নানা রকম আমল করা শুরু করলাম। যে আমল-ই জানতাম, সেটাই করতাম।

যেমন জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি পাবার জন্যে সাতবার পড়তাম আল্লাহুম্মা আজিরনি মিনান নার, মগরিব এবং ফজরের পর। সত্তুর হাজার ফেরেশতা আমার জন্যে দোয়া করবে সেই আমল করতাম। পাচ ওয়াক্ত নামাজের পর পাচটি ভিন্ন সুরা বিভিন্ন ফজিলত প্রাপ্তির জন্যে পড়তাম। সুরা ওয়াকেয়া পড়তাম দারিদ্রতা থেকে বাচার জন্যে। সর্বোপরি আল্লাহর ওলী হবার জন্যে চল্লিশদিন তাকবিরে উলার সাথে নামাজ পড়া শুরু করলাম।

কিন্তু নানা কারণে দুই তিনবারের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল। একবার উনচল্লিশ দিন চার ওয়াক্ত পর্যন্ত যেয়েও মিস করি। একটা ব্যাপার কাজ করত যে, আমি যেই আমল করছি, তা যেন কেউ না জানে। কারণ যা করছি শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যে করছি। বার কয়েক ব্যর্থ চেষ্টার পর ঠিক করলাম যে তাবলীগে যেয়ে এক চিল্লায় এ কাজ সম্পন্ন করব।

সেই উদ্দেশ্যে হাফেজ হবার পর এক চিল্লা দিয়ে দিলাম। এবং সেখানেই আল্লাহর ওলীর খাতায় নাম লেখানোর এ আমল শেষ করলাম। সেদিন অনেক শান্তি পেয়ছিলাম। আল্লাহর কাছে দোয়া করলাম তিনি যেন আমার এ প্রচেষ্টা গ্রহন করেন। আমার জেহেন একটু কমই ছিল, এক পৃষ্ঠার বেশী পড়া দিতে পারতাম না।

হুজুররা বলেছিলেন শেষ করতে সময় লাগবে, আব্বা যেহেতু আল্লার রাস্তায় দান করে দিয়েছেন, তাই তিনি সময়কে গুরুত্ব দেননি। হাফেজ হতে তাই লেগে গেল দু বছর। এর পরে এক বছর শুনালাম। সে বছরি পাগরি প্রদান অনুষ্ঠানে অংশ নেই হাফেজ হিসেবে। আমার প্রিয় সকল মাওলানাই সেদিন উপস্থিত ছিলেন।

মাওলানা ওবায়দুল হক্ব সাহেব, আজিজুল হক্ব সাহেব, আমিনুল ইসলাম সাহেব, সহ আরো অনেক বড় বড় আলেম ছিলেন অনুষ্ঠানে। শুরুতেই আমি একটা উর্দু হামদা পড়েছিলাম। তখন ভালই উর্দু হামদ পারতাম। সভাপতি বাদে সকলের বক্তব্যের পর পাগরী প্রদান শুরু হল, সবাই এক প্যাচ দিতে ছেড়ে দিচ্ছিলেন, ছোট মাথায় তখন এ পাগরী অনেক বড় লাগছিল, সবার শেষে বড় হুজুর পুরো পাগরী বেধে দিলেন। আমরা মোট পচানব্বই জন হাফেজ ছিলাম।

তারমধ্যে দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। বাকীদের বেশীর ভাগ মার্কেটের দোকানে চাকুরি, অথবা ব্যবসা করছে, কিছু আছে বাবার মাদ্রাসার শিক্ষক হয়েছে, আর কয়েকজন আছে যারা বাসায় বাসায় কায়দা পড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। কিছুদিন আগে আমার এক বন্ধু এসেছিল, অনেক হাসির পর তার আসল কথা যখন শুনতে চাইলাম, কেঁদে ফেলল, ও দাওরা হাদিস পাস করে আমার প্রাক্তন হুজুরের সাথে নতুন মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করত, বেতন ছিল দেড় হাজার টাকা, এই চাকুরিটাও চলে যায় তার একটা সৎ পরামর্শের কারণে, অন্য কোথাও তার চাকুরি হয় না, কারণ তার কাজের কোন ফিল্ড নেই। আমি জানিনা এই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা আজকের যুগে টিকিয়ে রাখার কি প্রয়োজন। হুজুররা সমাজে নামাজ পড়ানো, জানাজা পড়ানো আর ক্ষেত্র বিশেষে বিয়ে পড়ানো ছাড়া আর কি কাজে আসেন? এই যে আমি, নিজের অসমর্থের কারণে পুরনো বন্ধুদের খোজ নিতে ভয় পাই, কারণ বেশীর ভাগেরই সাহায্য প্রয়োজন।

জীবনের মুল্যবান চারটি বছর এই কুরান মুখস্ত করতে আমার ব্যয় হয়েছে, ধর্মে অবিশ্বাসের কারণে তা আজ অপচয় হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে, আখেরাতেতো এর আর কোন মুল্য নেই, যদি তা থেকে থাকে, অনেক আস্তিকই এই কারণে বগল দাবা করে নাচবেন সেইদিন। আমার পরিবার, আত্মীয় স্বজন এবং পারা প্রতিবেশীর কাছে আমার সম্মান অনেক বেশী, কিন্তু তারা যদি জানে যে আমি এখন আর ধর্মীয় চিন্তাধারাকে সমর্থন করিনা, তাহলে তারা কি আমার এই শিক্ষার, শারিরীক কষ্টের কোন মুল্য দিবে? আমার কথা বাদ, এইসব মুসলিমরা তাদের সন্তানদের ধর্মীয় শিক্ষা দিতে যে শিক্ষক রাখেন, তাদেরকে মাসে পাঁচশ টাকাও দিতে চান না। একজন ডাক্তার, সে যে ধর্মেরই হোক, মানুষের কাজে আসেন, একজন ইঞ্জিনিয়ারো তাই, একজন উকিল দেশের আইন কানুন জেনে সকলের কাজেই আসতে পারেন, কিন্তু একজন আলেম কি কাজে আসেন? ধর্মীয় বিশ্বাস না থাকলে তার শিক্ষার কি কোন মুল্য আছে? আজকে ইন্টার্নেটের কল্যানে নেট আলেমের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে, কোন রকম প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা ছাড়াই ধর্মের এবং ধর্ম গ্রন্থের নানা ব্যখ্যা দিয়ে যাচ্ছে এসব স্বঘোষিত আলেমেরা, ধর্মের ব্যখ্যার জন্যে একেকজন একেক আলেমকে পছন্দ করছে, কেউ কারো কাছে আবার ভন্ডও! ফুৎকারে উড়িয়ে দিচ্ছে একে অপরের বক্তব্য, ফলে আগে যাও মিলাদ বা খতম পড়িয়ে হুজুরদের কিছু আয় হতো সেগুলোও বন্ধ হয়ে যচ্ছে। তাহলে এই ফকীর, পুরোহিত বানানোর শিক্ষা ব্যবস্থা এখনো চালু রাখার কোনই প্রয়োজন আছে? চলবে... দ্বিতীয় পর্ব


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.