আমি চাই শক্তিশালী স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ
বাংলাদেশের টেলিকম বাজার দখল করার ভারতীয় নীলনকশার অংশ হিসেবে গতকাল এয়ারটেলের যাত্রা শুরু হয়েছে। তবে এ উপলক্ষে কোনো অনুষ্ঠান তারা করেনি।
কর ফাঁকির মাধ্যমে এবং ভারতীয় উচ্চাভিলাষের অংশ হিসেবে গত ৪ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ওয়ারিদের ৭০ শতাংশ শেয়ার মাত্র এক লাখ ডলারে কিনে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ভারতী এয়ারটেল। তবে এয়ারটেলের এক কর্মকর্তা দাবি করেছেন, ‘এখানে কর ফাঁকির কিছুই নেই। আমরা লোকসানি একটি প্রতিষ্ঠানকে টোকেনমূল্যে কিনেছিলাম, কোনো অনিয়ম করে নয়।
’
সূত্রমতে, বাংলাদেশের টেলিবাজারে ভারতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে রয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহম্মেদ রাজু। তবে বিটিআরসি, ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব সুনিল কান্তি বোসসহ কয়েকজন কর্মকর্তা ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তারা সরকারের বাইরের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এয়ারটেলের পক্ষে কাজ করছেন বলে জানা গেছে।
বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র এরই মধ্যে নিশ্চিত করেছে, সরকার ভারতকে ট্রানজিটের পাশাপাশি টেলিকরিডোর দিচ্ছে। ভারতী এয়ারটেল ও রিলায়েন্স কমিউনিকেশন্স যৌথভাবে বিটিআরসির কাছে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কের টেলিকরিডোর স্থাপন করার অনুমতিও চেয়েছিল।
সরকার বিতর্ক এড়াতে শেষ পর্যন্ত বিটিসিএল ও ভারতীয় সরকারি কোম্পানি বিএসএফএলের মাধ্যমে এ টেলিকরিডোর প্রদানের বিষয় চূড়ান্ত করার পদক্ষেপ নিয়েছে। এয়ারটেল গত বছরের শেষদিকে টেলিকরিডোর দেয়ার আবেদন করে।
জানা গেছে, এ করিডোরের মাধ্যমে এয়ারটেলসহ ভারতীয় টেলিকম অপারেটররা ফাইবার অপটিক কেবল স্থাপন করে উত্তর-পূর্ব ভারতের ৭ রাজ্যের সঙ্গে টেলিযোগাযোগ সহজ ও সস্তা করতে চাইছে। তারা আসামে টেলিকরিডোরের জন্য দুটি রুটের প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো কলকাতা-মেহেরপুর-ঢাকা-জাফলং এবং অন্যটি কলকাতা-মেহেরপুর-ঢাকা-কুমিল্লা-আগরতলা রুট।
বর্তমানে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলো ভিস্যাটের মাধ্যমে ভারতের কেন্দ্র ও বহির্বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত, যা খুবই ব্যয়বহুল।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ট্রানজিটের মতোই ভারত কৌশলে এই টেলিকরিডোর আদায় করে নিচ্ছে। এর মাধ্যমে উত্তর-পূর্ব ভারতে টেলিযোগাযোগ, ইন্টারনেট ইত্যাদি সস্তা হবে আর বিনিময়ে বাংলাদেশ কিছু চার্জ বা ভাড়া পাবে মাত্র। পাশাপাশি বিটিসিএল বাড়তি ব্যান্ডউইথ বিক্রি করতে চাইছে। কিন্তু বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, টেলিকরিডোরের মাধ্যমে উত্তর-পূর্ব ভারতের স্বাধীনতাকামী মানুষের কথোপকথন মনিটরিং থেকে শুরু করে ফাইবার অপটিক কেবলের নিরাপত্তার নামে বাংলাদেশের ওপর ভারতের সামরিক ও প্রযুক্তিগত নজরদারি আরোপিত হবে।
এতে দেশের যোগাযোগ খাতের ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ খর্ব হবে এবং তা বিপজ্জনকভাবে ভারতের হাতে চলে যাবে।
ভারতী এয়ারটেল ভারতের সর্ববৃহত্ টেলিকম কোম্পানি। এর গ্রাহকসংখ্যা ১১ কোটি ৬০ লাখেরও বেশি। কোম্পানিটি সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে। ফলে মুনাফা বাড়াতে দেশের বাইরে বিনিয়োগ করার উদ্যোগ নেয়।
দক্ষিণ আফ্রিকার এমটিএন মোবাইল কোম্পানির সঙ্গে ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের মার্জার বা একীভূত হওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর তারা ওয়ারিদের ৭০ শতাংশ শেয়ার কিনে কার্যত বাংলাদেশে একটি মোবাইল কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। আর এর মাধ্যমে ভারতের টেলিকরিডোর পাওয়ার স্বপ্নও বাস্তবায়নের পথ খুলে যায়। এ কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, ১৫ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশে এরই মধ্যে গ্রামীণফোনের গ্রাহকসংখ্যা ৩ কোটি ২০ লাখ, বাংলালিংকের গ্রাহকসংখ্যা ১ কোটি ৫৫ লাখ, রবির গ্রাহকসংখ্যা ১ কোটি ৪০ লাখ ছাড়িয়ে যাওয়ার পরও কেন কোম্পানিটি বাংলাদেশের বাজারে বিনিয়োগ করতে এলো?
সূত্র জানায়, এর পেছনে মূলত দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশের মোবাইল কোম্পানিগুলোর গ্রাহকসংখ্যা অনেক হলেও এর ঘনত্ব বা টেলিডেনসিটি ভারতের তুলনায় এখনও অনেক কম। ভারতের টেলিডেনসিটি যেখানে শতকরা ৪৬ ভাগ, বাংলাদেশে সেখানে মাত্র ৩২ ভাগ।
ফলে এয়ারটেলের পক্ষে সুযোগ রয়েছে গ্রাহকসংখ্যা আরও বাড়ানোর। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ফাইবার অপটিক কেবল ভারতের কেন্দ্র থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতে নিয়ে যাওয়া এবং সেখানকার বিশাল বাজার ধরা।
সূত্র জানায়, ভারতী এয়ারটেল এরই মধ্যে বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী পাঠিয়েছে। তারা কাজে যোগও দিয়েছেন। ওয়ারিদের শেয়ার কেনার ক্ষেত্রেও এয়ারটেল কৌশলের আশ্রয় নেয়।
ওয়ারিদের মোট মূল্য ১ কোটি টাকা দেখিয়ে মাত্র ৭০ লাখ টাকা বা ১ লাখ ডলারের বিনিময়ে ওয়ারিদ টেলিকমের ৭০ ভাগ শেয়ার কিনে নেয়। যুক্তি হিসেবে বলা হয়, ওয়ারিদ একটি লোকসানি কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে, ফলে টোকেনমূল্য দিয়ে ওয়ারিদকে এয়ারটেল কিনে নিয়েছে। বিশ্বে টোকেনমূল্যে একটি কোম্পানি কেনার প্রথম ঘটনা এটাই।
২০০৫ সালে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ওয়ারিদের মালিক ধাবি গ্রুপের স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক অনুসারে ওয়ারিদের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে ধাবি গ্রুপের ৭৫ কোটি ডলার বিনিয়োগ করার কথা। প্রশ্ন উঠেছে, এই ৭৫ কোটি ডলার গেল কোথায়? ওয়ারিদ কি এতই দেনাগ্রস্ত ছিল যে এর দাম মাত্র ১ লাখ ডলার হয়ে গেল? অথচ নেটওয়ার্কের কাজে ওয়ারিদ এরিকসন বা মটোরোলার কাছ থেকে যেসব যন্ত্রপাতি কিনেছে সেগুলোর দাম হিসাব করলেও তা ৫০ থেকে ৬০ কোটি ডলারের কম হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, ওয়ারিদের ব্যবহার করা প্রায় তিন হাজার বিটিএসের একেকটির দামই ৫০ হাজার ডলার, সেই বিটিএসগুলোর কন্ট্রোলার হিসেবে ব্যবহৃত মোট ২৫টি বিএসসির একেকটির দাম কমপক্ষে আড়াই লাখ ডলার। এর সঙ্গে যুক্ত হবে এমএসসি, আইএন, ভাস, ট্রান্সমিশন ইকুইপমেন্ট ইত্যাদির মতো আরও মূল্যবান যন্ত্রপাতির দাম। সঙ্গে রয়েছে ব্র্যান্ড ভ্যালু, লাইসেন্স ফি ইত্যাদির হিসাবও। এ বিষয়ে ২০০৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর ভেঞ্চার ক্যাপিটালবিষয়ক ওয়েবসাইট ভিসি সার্কেল একটি হিসাব প্রকাশ করে যেখানে বলা হয়, ‘ওয়ারিদের সম্পদের মূল্যায়ন করে বলা যায়, এর পরিমাণ ৫০ থেকে ৫৫ কোটি ইউএস ডলার হবে, ফলে ভারতী এয়ারটেলকে ৩০ থেকে ৩৫ কোটি ডলারে ওয়ারিদের ৭০ ভাগ শেয়ার কিনতে হতে পারে। ’ কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন ২০০১-এর ধারা ৩৭(১) অনুসারে বিটিআরসি থেকে লাইসেন্স পাওয়া কোনো কোম্পানি অন্য কোনো কোম্পানিকে লাইসেন্স বিক্রি করতে পারবে না। কিন্তু ৩৭(৩)-এর ঝ উপধারা অনুসারে শেয়ার হস্তান্তর করতে পারবে। আর এই শেয়ার হস্তান্তরের সময় শেয়ারের মূল্যের ৫.৫ ভাগ বিটিআরসিকে দিতে হবে। ভারতী এয়ারটেল হিসাব করে দেখেছে, ওয়ারিদের ৭০ ভাগ শেয়ারের মূল্য ৩০ কোটি ডলার দেখালেও এর ৫.৫ ভাগ, অর্থাত্ ১ কোটি ৬৫ লাখ ডলার বা ১১৫.৫ কোটি টাকা বিটিআরসিকে দিতে হবে। কিন্তু শেয়ারের মূল্য নামমাত্র ৭০ লাখ টাকা দেখানোর কারণে তারা তখন বিটিআরসিকে দিয়েছিল ৭০ লাখ টাকার ৫.৫ ভাগ অর্থাত্ মাত্র ৩ লাখ ৮৫ হাজার টাকা।
সূত্রমতে, তথ্য গোপনের মাধ্যমে ভারতী এয়ারটেল ১৩৫ কোটি টাকা থেকে বাংলাদেশ সরকারকে বঞ্চিত করতে পেরেছে।
কারণ মোবাইল অপারেটর একটেলে এ কে খান গ্রুপের ৩০ শতাংশ শেয়ার ছিল। সেই শেয়ার ৩৫০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে কিনে নেয় জাপানের এনটিটি ডকুমো। ওই শেয়ার বিক্রি থেকে তখন সরকার প্রায় ১৩২ কোটি টাকা ফি পেয়েছিল। এর আগে সিটিসেলে প্যাসিফিক টেলিকমের শেয়ার সিং টেলের কাছে হস্তান্তর থেকে সরকার শত কোটি টাকা পেয়েছিল।
এসব কারণে বাংলাদেশের টেলিকম বাজারে ভারতী এয়ারটেলের অন্তর্ভুক্তি সুস্থ প্রতিযোগিতার জন্ম নাও দিতে পারে, এমনটাই আশঙ্কা করছেন টেলিকম বিশেষজ্ঞরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, অপটিক্যাল ফাইবার কানেক্টিভিটি নিশ্চিত করতে পারলে ভারতী এয়ারটেল ভালো ব্যবসা করতে পারবে এদেশে। কিন্তু তারা যদি ভারত থেকে কল সেন্টারগুলো অপারেট করে, তাহলে বাংলাদেশের টেলিকম বাজারে অস্থিরতা বাড়বে।
জিয়াউদ্দিন সাইমুম
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।