আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ব্লগে আস্তিকদের যে সকল আচরণে বিরক্ত বোধ করি (গতকালের পর)



গতকালের পোস্টে বলেছিলাম আস্তিক-নাস্তিক পোস্টে আস্তিকদের আচরণ নিয়ে একটি পোস্ট দিব। আজ সেটাই লেখার চেষ্টা করছি। ব্লগের আস্তিক জন-গোষ্ঠিকে আমার দৃষ্টিতে মোটা দাগে আট ভাগে ভাগ করা যায় (ঈশ্বর ও ধর্ম বিষয়ক পোস্ট সাপেক্ষে): ১. ঈশ্বর অথবা ধর্ম বিষয়ক পোস্টের ব্যাপারে উদাসীন ব্লগার (এরাই হয়তো মেজরিটি হবে) ২. ধর্ম-প্রচারক ব্লগার: এরা বিভিন্ন ধর্মীয় বিষয়ে সরল মনে পোস্ট দিয়ে থাকে। ধর্মের ভালো দিকগুলোই এরা প্রচার করে থাকে। কোরআনের সুরার অনুবাদ, হাদিসের ব্যাখ্যা এদের প্রিয় বিষয়গুলোর অন্যতম।

এদের সংখ্যা খুবই কম। এদের ব্লগে সাধারণত নাস্তিকেরা আক্রমন কম করে বা এড়িয়ে যায়। কিছু সন্ত্রাসী টাইপের নাস্তিক এদের আক্রমণ করেও থাকে। ব্লগে এদের পরিচিতি কম। ৩. আরেকপক্ষ আছেন অতি ধার্মিক।

এরা সবকিছুতেই ধর্মের মহিমা খুঁজে পায়। পৃথিবীতে যা কিছু ভালো সবকিছুর ক্রেডিট নিজের ধর্মকে না দিতে পারলে এরা স্বস্তি পান না। বিজ্ঞানের কোন আবিস্কারের ক্রেডিট তারা বিজ্ঞানীকে না দিয়ে ধর্মগ্রন্থকে দিয়ে আনন্দ লাভ করেন। প্রয়োজনে ধর্মগ্রন্থের বানীর মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে হলেও নিজের ধারণা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। সবকিছুতে অলৌকিকতা খুঁজে বেড়ান।

নিজের ধর্মবিশ্বাসকে সবার চেয়ে সেরা প্রমাণে এরা উদ্ভট সব যুক্তি উপস্থাপন করেন। যুক্তি-তর্কে এদের পার্ফর্মেন্স নৈরাশ্য-জনক। এদের সাথে যারা যুক্তি-তর্ক করতে আসেন তারা বোরড হয়ে যান; কারণ একই যুক্তি বারবার বলে এরা জিততে চান, নতুন কিছু দেয়ার সামর্থ কম। ব্লগে এদের নাম হচ্ছে তালগাছবাদী। এদের মধ্যে কয়েকজন আবার সেলিব্রেটি ব্লগারে পরিণত হয়েছেন, তাদের ফ্যানও রয়েছে।

তবে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে নাস্তিকেরা এদের সাথে যুক্তিতর্কে লিপ্ত হলেও সেটা অশ্লীল গালাগালিতে পৌছায় না। বড়জোর তাদেরকে তালগাছবাদী বলে গালি দেয়া হয়, কটাক্ষ করা হয়। মোটের ওপর এদের উদ্দেশ্য ক্ষতিকর কিছু নয়, এজন্যই সম্ভবত এরা গালাগালির স্বীকার হন না। ৪. চতুর্থ প্রকার রয়েছে সাম্প্রদায়িক আস্তিক। এরা নিজের ধর্মবিশ্বাসকে শুধু সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠই মনে করে না, অন্যদের ধর্মবিশ্বাস এবং নাস্তিকতাকে পৃথিবীর জন্য ক্ষতিকর বলে বিশ্বাস করে।

তাদের সাম্প্রদায়িক উস্কানীমূলক পোস্ট থেকে অনেক বিতর্কের জন্ম হয়। আস্তিক-নাস্তিক বিতর্কে এরা 'নাস্তিকেরা মালাউন', 'নাস্তিকেরা সব হিন্দু', 'ভাদা' এই ধরণের উস্কানিমূলক কথা বলা শুরু করে। আর এদের সাথে নাস্তিকদের তর্ক-বিতর্ক প্রায় সর্বদাই গালাগালিতে রূপ নেয়। ৫. আরেক ধরণের আস্তিক ব্লগাররা তাদের পুরুষ তান্ত্রিক মানষিকতা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, সমাজে নারীদের অগ্রগতিতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে নারী-স্বাধীনতা বিরোধী পোস্ট ধর্মের মোড়কে পরিবেশন করে। পর্দা, ইভটিজিং, কর্মজীবী নারী, মেয়েদের খেলাধুলা এগুলো হচ্ছে তাদের প্রিয় বিষয়।

তাদের পোস্টের প্রতিবাদ আস্তিক-নাস্তিক যেই করুক না কেন তাকে ধর্মবিরোধী ট্যাগ দিয়ে প্রতিবাদকারীর মা-বোনকে জড়িয়ে উদ্ভট সব প্রশ্ন করে এরা। কিছু কিছু প্রশ্ন এমন অবান্তর হয় যে (যেমন: আপনার বোনকে দিবেন মাঠে যেয়ে ফুটবল খেলতে?, আপনার মা যদি অন্য লোকের সাথে হ্যান্ডশেক করতো তাহলে আপনার কেমন লাগতো?, আপনার স্ত্রী অফিসে বসের সাথে হেসে কথা বললে আপনার কেমন লাগবে? আপনার বোন পর্দা না করলে ভালো লাগবে?) হাসি আটকে রাখা প্রায় অসম্ভব। এদের সাথেও নাস্তিকদের তর্ক-বিতর্ক এবং গালাগালি নিয়মিত ঘটনা। ৬. সামু ব্লগে আস্তিক নাস্তিক বিতর্ক থেকে আরেক শ্রেণীর অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। এদের বলা যায় নাস্তিকতা-বিরোধী ব্লগার।

এরা অন্য ধর্মের প্রতি যতটা সহনশীল, নাস্তিকতার ব্যাপারে ঠিক ততটাই অসহনশীল। এদের অনেকের ধারণা ধর্ম ছাড়া কোন নৈতিকতা থাকতে পারে না। তাদের ধারণা নাস্তিকেরা পৃথিবীর সব খারাপ কাজ করে বেড়ায়। খুন, ব্যাভিচার, অজাচার, মদ্যপান সব খারাপ কাজ সকল নাস্তকেরা সকাল বিকার করে বেড়ান। যেহেতু নাস্তিকেরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, পরকালে বিশ্বাস করে না, সেহেতু তাদের দ্বারা সবকিছুই সম্ভব।

এদের আরেক অংশের ধারণা নাস্তিকেরা বেওকুফ ছাড়া আর কিছুই না, কারণ ঈশ্বরের অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে তারা ব্যর্থ। ৭. অনুভুতিপ্রবণ আস্তিকরাও সংখ্যায় কম না। ধর্মের ব্যাপারে সামান্য সমালোচনাতেই তাদের অনুভুতিতে আঘাত লাগে। মুহাম্মদ (সা: ) এর নামের শেষে (সা: ) না লাগালেও তারা আহত হন, এবং নাস্তিকদের ব্যাপারে অভিযোগ করে বেড়ান। মুহাম্মদ (সা: ) এর জীবনের কিছু বিতর্কিত বিষয়, যা বর্তমান যুগের নৈতিকতা অনুসারে হয়তো অগ্রহনযোগ্য, সেই বিষয়গুলোকে নাস্তিকেরা হাইলাইট করলে এরা তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে।

৮. সর্বশেষ প্রকরণ হচ্ছে জামাত সমর্থক ব্লগার। যে কেউ সামু ব্লগে কয়েকদিন নিয়মিত হলেই এদের কর্মকান্ড বুঝতে পারবে। আমি এপ্রিল মাস থেকে নিয়মিত সামহো্য়্যার এর পাঠক। এদের উদ্দেশ্য বুঝতে আমার মাত্র ২ মাসের মত লেগেছে। এরা আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে সকল ব্লগারের গালাগালির মোক্ষম এবং উপযুক্ত টার্গেট।

১ ও ২ সম্পর্কে আমার বলার কিছুই নাই। তৃতীয় প্রকরণের ব্লগারদের ব্যাপারে আমি প্রচন্ড বিরক্ত। তবে এদের সৃজনশীলতার প্রশংসা না করে পারা যায় না। হয়তো এরা একদিন পবিত্র কোরআনে কিভাবে বিবর্তনবাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল সেই সম্পর্কিত আয়াতও আবিস্কার করবে। এদের উদ্দেশ্যে বলবো, আপনারা আপনাদের কর্মকান্ড দ্বারা আপনাদের প্রিয় ধর্মকেই জনসমক্ষে হেয় প্রতিপন্ন করছেন।

ধর্ম আস্তিকের কাছে অতি পবিত্র। ধর্মের মহিমা প্রচারের জন্য যদি মিথ্যা বা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিতে হয় তবে সেটা প্রকৃত বোধ-বুদ্ধিসম্পন্ন আস্তিকের মনো-কষ্টের কারণ হয়। নাস্তিকের গালি অপেক্ষা আপনাদের কোরআন-হাদিসের বিকৃত ব্যাক্ষা আমার কাছে কম অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয় না। চতুর্থ প্রকরণের ব্লগারদের মধ্যে অনেকেই হয়তো সত্যিই বিশ্বাস করেন যে নাস্তিকতা হচ্ছে অমুসলিমদের ইসলামকে গালি দেয়ার জন্য একটি লেবাস। যারা মনে করেন নাস্তিকেরা হিন্দু তাদের উদ্দেশ্যে বলবো, হিন্দুদের নাস্তিক সেজে ইসলামকে গালি দিয়ে কি লাভ? আর হিন্দু ধর্ম তো নাস্তিকতাকে সমর্থন করে না।

আপনার ঈমান যেমন আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, হিন্দু আস্তিকের কাছেও তার ঈমান গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামকে গালি দিতে হলে তো সে হিন্দু পরিচয়েই গালি দিতে পারে। এমন তো নয় যে, নাস্তিক পরিচয়ে গালি দিলে সেটা সহজেই পার পেয়ে যাবে, আর হিন্দু পরিচয়ে গালি দিলে সেটা পাবে না। আর যারা ইচ্ছে করেই হিন্দু-বিদ্বেষ ছড়ায় তারা তো আস্তিক-নাস্তিক কোনটা হওয়ারই যোগ্যতা রাখে না। পঞ্চম প্রকরণের ব্লগারদের বলবো, নারীরা যেমন পুরুষেরা কি করছে, না করছে তা নিয়ে ব্লগে কান্নাকাটি করে বেড়ায় না, আমাদেরও উচিৎ না তাদের ব্যাক্তিগত বিষয় নিয়ে ব্লগে উপদেশ বিলিয়ে বেড়ানো।

আর মানবসমাজে সময়ের প্রয়োজনেই লিঙ্গগত ভুমিকার পরিবর্তন হয়। এটা সবযুগেই হয়ে এসেছে। কখনো নারী সমাজের নেতৃত্ব দিয়েছে, কখনো পর্দার পেছনে থেকে কাজ করেছে। কোনটা নারীর আদর্শ ভুমিকা সেটা নারীকেই বেছে নিতে দিন না। এদের সম্পর্কে আর বিশেষ কিছু বলার নেই।

আমার ধারণা এদের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব ধর্মসৃষ্ট নয়, বরং ধর্ম এদের কাছে পুরুষতান্ত্রিকতা টিকিয়ে রাখার একটা উপকরণমাত্র। ষষ্ঠ টাইপের আস্তিকেরা একটা ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে বিতর্কে জড়ায়। মানুষের নৈতিকতাবোধ গঠন একটি জটিল প্রকৃয়া। একে শুধু ধর্ম-সৃষ্ট বলে মনে করাটা নির্বোধ সরলীকরণ। যেসকল সমাজে ধর্ম নেই সেসকল সমাজ কি টিকে নেই? বৌদ্ধ ধর্মে আস্তিকতা নেই (যদিও তা নিজেকে নাস্তিক বলেও ঘোষনা করে না)।

তাই বলে কি বৌদ্ধ ধর্মপ্রধান দেশগুলোর সমাজ টিকে নেই? মানুষের ঈশ্বরে বিশ্বাস বা ধর্মবিশ্বাসের সাথে নৈতিকতার কোন সম্পর্ক আছে কি না সেটা এখনো কেউ প্রমাণ করতে পারে নি। নাস্তিক প্রধান স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে দুর্নীতির হার কম। বলতে পারেন, তারা তো লিভ-টুগেদার করে বেরায়। এটা ওদের দেশে সামাজিকভাবে স্বীকৃত। আমাদের দেশে যেখানে বেশিরভাগ লোক আস্তিক, লিভ-টুগেদার এর সামাজিক স্বীকৃতি নেই সেখানে ঠিক কত শতাংশ ছেলে মেয়ে বিবাহ বহির্ভুত শারীরিক সম্পর্ক করে বেড়ায় একটু খোজ নিয়ে দেখুন।

নাস্তিকেরা পৃথিবীকেই অস্তিত্বের শেষ বলে মনে করে। তার মানে যদি এই হয় যে তারা পৃথিবীতে যা ইচ্ছা তাই করে বেড়াবে; তবুও বলবো, খারাপ কাজ করার ইচ্ছা খারাপ মানুষদের মনেই আসবে, সেটা আস্তিক নাস্তিক নির্বিশেষে। যে একজন পরিপূর্ণ ভালো মানুষ হয়ে উঠেছে তার মনে খারাপ কিছু করার ইচ্ছাই কখনো আসবে না। আর নাস্তিকদের আহাম্মক বা সেধরণের কিছু মনে করাটা আহাম্মকি ছাড়া আর কিছুই নয়। আপনার ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষে যতগুলো যুক্তি আছে, তাদের ঠিক ততগুলোই যুক্তি আছএ ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিপক্ষে।

এক্ষেত্রে কে কোন যুক্তি গ্রহণ করবে এটা তার বুদ্ধিমত্তার ওপর নির্ভর করে না। অনুভুতিপ্রবণদের বলবো, একজন নাস্তিক তো বাধ্য নয় আপনার ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী চলতে। আপনার কাছে মোহাম্মদ (সা: ) নবী হলেও তাদের কাছে সে একজন সাধারণ মানুষ মাত্র। অন্য আর দশজন লোককে আপনি যেভাবে দেখেন মোহাম্মদ (সা: ) কেও তারা সেভাবেই দেখে। তাই তার সমালোচনার ভাষাও সেরকমই হয়।

এক্ষেত্রে এত অল্পতে মনে কষ্ট পেলে তো চলবে না। অন্য ধর্মের স্রষ্টাকে আপনি যেভাবে দেখেন, আপনার ধর্মের স্রষ্টাকে তারা এরচেয়ে ভিন্ন কিছু মনে করেন না। যেহেতু তারা নাস্তিক, তাই ধর্মের অসংগতি তুলে ধরেই তারা নাস্তিকতা প্রচার করবে। এতে প্রতিক্রিয়াশীল না হয়ে বরং ধর্মের ভালো মানব কল্যানমূলক দিকগুলো তুলে ধরলেই বোঝা যাবে ধর্ম নাস্তিকতার চেয়ে কোন অংশে কম মানবিক নয়। ছাগুদের সম্পর্কে কি আর বলবো, তাদেরকে সবাই চিনে।

[কম সময়ে অনেক বড় পোস্ট লিখলাম। সবকিছু গুছিয়ে লিখতে পারিনি বলে দু:খিত]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.