আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লাল সালাম শহীদ লখাই হাওলাদার



লখাই হাওলাদার। জন্ম আনুমানিক ১৯৩০ কিংবা ১৯৩২ সালে, ফরিদপুর (বর্তমান মাদারীপুর জেলায়) জেলার নড়িয়া উপজেলার চাকদর গ্রামে। বাবা মোফাজ্জল হাওলাদার ছিলেন প্রান্তিক চাষী। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে লখাই হাওলাদার ছিলেন কর্মপাগল। চাষবাসের উপর নির্ভর করে পরিবার পরিজন নিয়ে জীবন চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল তার।

ওই অবস্থায় লখাই হাওলাদার শীত মৌসুমে খেজুর গাছ কেটে রস বিক্রির জমানো টাকা দিয়ে কোনমতে সংসার চালাতেন। অভাবের সংসারে চাহিদা যখন বাড়তে থাকলো, তখন অধিক রোজগারের উদ্দেশে ১৯৬৯ সালে গাজীপুরে আসেন লখাই হাওলাদার। গাজীপুরে এসেই নিজের পেশায় ব্রতী হন লখাই হাওলাদার। গাজীপুর সদর উপজেলার কাউলতিয়া ইউনিয়নের হাতিয়াব এলাকায় ছিল ব্যাপক খেজুর গাছ। এসব খেজুর গাছ বিক্রির কাজে লেগে পড়েন তিনি।

সহজ সরল লখাই হাওলাদার অল্প দিনের মধ্যেই এলাকাবাসীর সান্নিধ্যে চলে আসেন। হাতিয়াব এলাকায় ছিল প্রচুর খাস জমি। হাতিয়াব বল খেলার মাঠের পুকুর পাড়ে প্রথমে পলিথিন কাগজের ছাউনি ও বেড়া দিয়ে ঘর তৈরী বসবাস শুরু করেন তিনি। ফরিদপুরের তুলনায় গাজীপুরে কাজের ক্ষেত্র বেশি থাকায় পুরো পরিবার পরিজন নিয়ে গাজীপুরেই জীবন যাপন শুরু করেন তিনি। ভুমিহীন ক্ষেতমজুর আরো অনেকেই লখাই হাওলাদারের দেখাদেখিতে ওইস্থানে বসতি গড়তে থাকেন।

ওই এলাকার খাস জমি দখলে রাখতো মূলত স্থানীয় জোতদাররা। এরই মধ্যে গত শতাব্দীর আশির দশকে গড়ে ওঠে বাংলাদেশ ক্ষেতমজুর সমিতির খাস জমির আন্দোলন। অল্প সময়ে গড়ে ওঠে বিশাল সংগঠন, আড়াই হাতি লাঠি নিয়ে জঙ্গি মিছিল আর লাল পতাকা গেড়ে খাস জমির দখল নেওয়া। গ্রামে গ্রামে গড়ে ওঠা আন্দোলনের ছায়া হাতিয়াবতেও পরে। আর লখাই হাওলাদার অনিঃশেষ অবিচল আশায় আড়াই হাতি লাঠির মিছিলে শরিক হয়ে পড়েন।

ওই এলাকার ক্ষেতমজুরদের নেতৃত্বে ছিলেন জয়নাল খান, জামাল সরকার প্রমুখ ক্ষেতমজুর নেতা। কেবল হাতিয়াবতে দুইশ’ ক্ষেতমজুর দখল করেছিল একশ’ একর খাস জমি। দখলের দন্ড হিসাবে লাঠির মাথায় লালা পতাকা বসিয়ে সীমানা চিহিত করা হয়। বিভিন্ন্ সরকার বিভিন্ন সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ভূমিহীন ক্ষেতমজুরদের জমি বরাদ্দের। কিন্তু আজ পর্যন্ত ওইসব ক্ষেতমজুররা কোন কাগজপত্র পাননি জমির মালিকানা স্বরূপ।

অবশ্য কয়েকবার সরকারী অফিসে আবেদন করেছিল কাগজপত্রের জন্য। ক্ষেতমজুরদের দখল করা অল্প কিছু জমিতে চাষবাস চলছিল। একরকম সমবায়ী পদ্ধতিতে চাষবাস শুরু হয়েছিল। হাতিয়াব মৌজার এক নম্বর খতিয়ানের ৪৫ নম্বর দাগের জমিতে ধান রোপন করেছিলেন লখাই হাওলাদার ও কালিচরণ বর্মণ। ১৯৮৮ সালের ১৭ নভেম্বর লখাই হাওলাদার অন্যান্য স্থানীয় ক্ষেতমজুরদের নিয়ে নিজেদের রোপন করা পাকা ধান কাটতেছিলেন।

এমন সময় বাধ সাধলো স্থানীয় জোতদারের ভাড়াটিয়া গুন্ডাবাহিনী। বেধে যায় সংঘর্ষ। সংঘর্ষের একপর্যায়ে গুন্ডাবাহিনীর কোপের আঘাতে শহীদ হন লখাই হাওলাদার। নিজের দখল করা ও সৃজিত ফসল ঘরে তোলার সংগ্রামে ওই খাস জমিতে অবিচল আশাবাদী লখাই হাওলাদার শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তারপর অনেক ঘটনা ঘটে গেছে।

রাজনীতির সালিশ হয়েছে। কিন্তু ক্ষেতমজুররা পিছু হটেনি। আজো আছে তবে অনেক শংকার মাঝে। লখাই হাওলাদার মিশে গিয়েছিলেন ক্ষেতমজুরদের মাঝে প্রাণের টানে। খুব দৃঢ়তার সাথে বুঝেছিলেন গরীব মানুষের মুক্তির দিশা।

যাকে তিনি বলতেন শ্রেণী সংগ্রাম। তার মতে এটাই প্রকৃত শ্রেণী সংগ্রাম। সংগঠনে যুক্ত হওয়ার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ছিলেন দুর্দান্ত সাহসী। একনিষ্ঠ কর্মী হিসাবে প্রতিটি মিটিং মিছিলে তিনি থাকতেন একাগ্র চিত্তে। কেবল তার জানার বিষয় ছিল আবার কবে কোথায় কখন মিছিল হবে ক্ষেতমজুরদের।

ক্ষেতমজুর নেতা জয়নাল খানের কাছে বারবার ঘেষে বলতে চেয়েছেন নিজের অনুভুতির কথা। তিনি দুইটি নাম মুখস্ত করেছিলেন খুব ভাল করে। প্রায়ই বলতেন কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ ও কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের সাথে দেখা করে কি জানি একটা প্রস্তাব দিবেন ক্ষেকমজুরদের জন্য। কিন্তু নানা কারণেই সেটা সম্ভব হয়নি তার । তৎকালীন জাতীয় সংসদেও অধিবেশনে জাতীয় শহীদের তালিকায় লখাই হাওলাদারের নাম প্রস্তাব ও পাশ হয়েছিল তার আতœত্যাগের জন্য।

১৭ নভেম্বর শহীদ লখাই দিবস। হাতিয়াব গ্রামবাসী কবরে ফুল দিয়ে, নীরবতা পালন করে শ্রদ্ধা জানায় বিপ্লবী লখাই হাওলাদারের প্রতি। কেমন আছে রখাই হওেলাদারের পরিবার পরিজন এমন খোজ নেয়নি একবারও ঘুনে ধরা সমাজের প্রতিনিধিরা। অথচ লখাই হাওলাদারের মৃত্যু পরে অনেক রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরাই দৌড়ঝাপ পেরেছিলেন ফায়দা হাসিলের জন্য। মামলা পরিচালনার জন্য আধা বিঘা জমি বন্ধক ছিল ।

সেই জমি আজো বন্ধক মুক্ত হয়নি টাকার অভাবে। সিদ্ধান্ত নিয়েছিল স্থানীয় সংগঠন ওই আধা বিঘা জমির ফসল ব্যবহার হবে শহীদ লখাই হাওলাদারের স্মৃতি রক্ষার কাজে। শেষ পর্যন্ত আশাবাদী ওই এলাকার শহীদ লখাই হাওলাদারের সহকর্মী অনুসারী ক্ষেতমজুররা। এমন বাংলাদেশ তারা গড়তে চান তারা যেখানে প্রতিদিন শোষন মুক্তির সংগ্রামে শুভ প্রভাতে শহীদদের প্রদি সশ্রদ্ধ সালাম জানিয়ে কর্মদিবস শুরু হবে। তারই ধারাবাহিকতায় এবছরও ১৭ নভেম্বর ঈদেরদিন থাকায় ২২ নভেম্বর পালিত হয়েছে আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ লখাই দিবষ।

লাল সালাম শহীদ লখাই হাওলাদার।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।